সুন্দরবনের মানুষখেকো – ৩

১৯৭২ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনে বাঘকে উপদ্রব বলে গণ্য করা হত। তখন অনুমোদনপ্রাপ্ত যে কোন শিকারী বাঘ মেরে চামড়া ও মাথার খুলি বন অফিসে জমা দিলে তাঁকে অর্থ পুরস্কার দেওয়া হত। ১৯৭৩ সালে জারীকৃত বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী বনে এখন সকল প্রকার প্রাণী শিকার নিষিদ্ধ, বন দফতর থেকে ‘মানুষখেকো’ বলে কাগজেপত্রে ঘোষণা করলে তবেই কেবল সেই বাঘ মারা যায়। পচাব্দী গাজীর শিকার জীবন ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত। এর মধ্যে তিনি ৫৭ টি বাঘ মেরেছে। ফ্রান্স, জার্মানী, মধ্যপ্রাচ্য ও জাপানের পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশনে শিকারী পচাব্দী গাজীর কৃতিত্বের কাহিনী প্রচারিত হয়।

বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় সেবা প্রকাশণী থেকে ১৯৮০ সালে।  বিখ্যাত শিকারি পচাব্দী গাজীর জবানিতে বইটি লিখেছেন হুমায়ুন খান। বইয়ে ৭টি অনুচ্ছেদ আছে। ১. আঠারোবেকির বাঘ, ২. দুবলার চরের মানুষখেকো, ৩. গোলখালীর বিভীষিকা, ৪. সুন্দরবনের ভয়ঙ্কর, ৫. শিকারী জীবনের বিচ্ছিন্ন স্মৃতি, ৬. সুপতির মানুষখেকো, ৭. তালপট্টির বিভীষিকা।

এটি বইটি ধারাবাহিক প্রকাশের তৃতীয় পর্ব। প্রথম পর্বদ্বিতীয় পর্ব এখানে পড়ুন।

গোলখালীর বিভীষিকা

খুলনার পাইকগাছা থানার গোলখালী গ্রাম সুন্দরবনের একেবারে প্রান্তে অবস্থিত। বড় নদী কপোতাক্ষীর পাড়ে বড় গ্রাম গোলখালী, পুরা নাম শিঙের গোলখালী । গ্রামবাসী অধিকাংশ মানুষই গৃহস্থ, হাল-বলদ আছে, চাষাবাদ করে, মাছের অভাব নেই, কাঠেরও অভাব নেই। কিছু কিছু লোক অতি দরিদ্র, তারা বাওয়ালী ও মৌয়াল, নদীর ওপারের গভীর বনে গিয়ে কাঠ-লাকড়ি-গোলপাতা কাটে, মৌচাক কেটে মধু আহরণ করে। এই গ্রামের কেউ কেউ বনে কাজ করতে গিয়ে বাঘের এমন কি মুখামুখি হয়েও রক্ষা পেয়ে এসেছে, কিন্তু বাংলা১৩৫২ সালে একটি বাঘ যখন গোলখালী গ্রামেই গিয়ে একের পর এক মানুষ মারতে থাকে, গৃহস্থের হালের বলদ খেয়ে ফেলতে থাকে তখন অসহায় গ্রামবাসীগণের মধ্যে মহা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়ে যায়।

বাঘ প্রথমে নিয়ে যায় একটি গরু। হালের বলদ, দুপুরের পরে জঙ্গলের ধারে খুঁটিয়ে রেখেছিল এক গৃহস্থ, সন্ধ্যার আগক্ষণে গোহালে আনতে গিয়ে দেখে গরু নেই, দড়ি ছিঁড়া। এক জায়গায় রক্ত দেখে তার মনে সন্দেহ হয়। গ্রামের লোকজনসহ হৈ-চৈ করতে করতে জঙ্গলে ঢুকে আন্দাজ শ দুই হাত ভিতরে আধা-খাওয়া বলদ খুঁজে পায়। তারা বলদের সেই অর্ধেকটাই টেনে খোলা জায়গায় এনে গর্ত করে পুঁতে রাখে গোলখালীর মানুষ সেই প্রথম গ্রামে বাঘের উপস্থিতি জানতে পারে। এই ঘটনার অনেক বছর আগেও একবার গ্রামের প্রান্ত থেকে বাঘে গরু নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তখন গরু পর্যন্তই, বাঘ কোন মানুষকে আক্রমণ করেনি। এ বছর তার ব্যতিক্রম ঘটল।

উক্ত ঘটনার পরের দিন একজন লোক নিজেরই প্রয়োজনে শুকনা ডাল কাটার জন্যে গ্রামের জঙ্গলে যায়। বাঘ যেখান থেকে গরু নিয়ে গিয়েছিল সেই এলাকায় নয়, গ্রামের সামনে নদীর ধারের কতকটা খোলা জঙ্গলে, কাছে মানুষের চলাচল ছিল । মাটিতে দাঁড়িয়েই উপরের ডাল কেটে কেটে জমা করছিল সে, হঠাৎ চীৎকার করে উঠে, দূরের লোকেরা সঙ্গে সঙ্গেই বাঘের গর্জন শুনতে পায়, তারপরেই সব নীরব। দিনের বেলা, সকাল দশটা সাড়ে দশটার ঘটনা। ভয়ার্ত গ্রামবাসী কিছুক্ষণের মধ্যেই একত্র হয়, গ্রামে বন্দুক ছিল, সেটা নিয়ে একজন শিকারী এবং অন্যান্য সবাই যার যা অস্ত্র ছিল তাই নিয়ে তাকে উদ্ধার করে আনতে যায়। জঙ্গলের অনেকখানি ভিতরে তার দেহ খুঁজে পায় কিন্তু দেখে যে তার মধ্যেই ক্ষুধার্ত বাঘ পেট আর ঊরু খেয়ে ফেলেছে ৷

এর তিনদিন পরে নদী থেকে গ্রামে ফিরার পথে দুইজনের মধ্য থেকে পিছনেরজনকে বাঘে নিয়ে যায় বিকাল বেলা। তারা মাত্র চার-পাঁচ হাত তফাতে হেঁটে আসছিল, হাঁটু সমান হুদো লতার জঙ্গল, সেই হুদো বন পার হয়ে একটু খালি জায়গা, তারপরেই আবার একটা মাঝারি আকারের হুদো ঝোপ; আগেরজন ঝোপ পার হয়ে মাত্র কয়েক হাত গিয়েছে, এম হঠাৎ ‘হুঙ্ক!’ করে ভয়ঙ্কর গর্জন। ভয়ে উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে যায়, সেই অবস্থায়ই পিছনে ফিরে দেখতে পায় সঙ্গেরজনকে মুখে করে ঝোপের ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে বিশাল বড় বাঘ। সে মরার মত কিছুক্ষণ মাটিতে পড়ে থাকে, তারপর ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গ্রামে এসে সকলকে এই দুঃসংবাদ জানায় মিনিট ত্রিশ-চল্লিশেকের মধ্যেই বন্দুক হাতে গ্রামের দুইজন শিকারীসহ অন্যান্যরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হৈ-চৈ করতে করতে ঘটনাস্থলে পৌঁছায়।

শিকারীগণ মানুষখেকো বাঘের পারা দেখে চিনতে পারলেন। নদীর পাড় থেকে দুইজনকে আসতে দেখে বাঘ আগেই ঝোপের ভিতরে শুয়েছিল, কাছে আসামাত্র হুঙ্কার দিয়ে পিছনেরজনকে ধরে। গ্রামবাসীগণ হৈ-চৈ, চীৎকার করতে করতে জঙ্গলের ভিতরে অগ্রসর হয়। খুবই সাবধানে আর ভয়ে ভয়ে এগুতে হচ্ছিল বলে মাত্র শ দুই হাত যেতেই অন্ধকার হয়ে যায় । তখন তারা বাধ্য হয়ে আবার গ্রামে ফিরে আসে ।

পৃষ্ঠা ৩৬

পরদিন সকালে গ্রামবাসীরা আবার দল বেঁধে শিকারীর পিছনে পিছনে লাশ উদ্ধার করতে যায় এবং জঙ্গলের অনেক ভিতরে গিয়ে মৃতদেহ খুঁজে পায় পেট, উরু, কোমর ও বুকের প্রায় সবকিছু খেয়ে ফেলেছে। তারা হাড়গোড় এবং দেহের বাকী অংশ কাপড়ে জড়িয়ে এনে, গোসল দিয়ে জানাজা পড়ে দাফন করে এবং বাঘের মুখে পর পর দুইজন মানুষের মৃত্যুসংবাদ কপোতাক্ষী ফরেস্ট অফিস ও বুড়ী গোলালিনী ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসে জানায়। কয়েকজন শিকারী সঙ্গে সঙ্গে গোলখালী আসেন। গ্রাম এলাকা বলে শিকারীদের এখানে কতগুলো সুবিধা ছিল, যেমন গাছতলায় গরু বা ছাগল বেঁধে রেখে মাচাতে বসে রাত্রে বাঘ মারার চেষ্টা করা বা গ্রামবাসীদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতা।

এই ব্যবস্থা গ্রহণের পরেও বুড়ী গোলালিনীর বন কর্মকর্তা নিশ্চিত হতে পারলেন না, বিশেষ লোক মারফত আমাদের গ্রামের বাড়ীতে আমার বাবা, সুন্দরবনের শ্রেষ্ঠ শিকারী মেহের গাজীকে খবর পাঠালেন। বাবা চাকরী করতেন না, কিন্তু বন দফতরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে শিকার করতেন । সুন্দরবনের কোনখানে মানুষখেকো বাঘের উপদ্রব হলেই বাবাকে খবর দেওয়া হত, তিনি গিয়ে সেই বাঘ মেরে বন দফতরের ঘোষিত নগদ পুরস্কার নিতেন। ইতিপূর্বে একটি মানুষখেকো বাঘের জন্যে পুরস্কার ছিল তৎকালীন দুইশ টাকা, কিন্তু গোলখালীর বাঘ বিভীষিকা সৃষ্টি করে ফেলায়, এবং বলতে গেলে গোটা গ্রামকেই একেবারে অচল করে দেওয়াতে বন দফতর থেকে সরাসরি তিনশ টাকা ঘোষণা করা হয়।

মানুষখেকো বাঘের কথা একবার শুনলে বাবা আর ঘরে থাকতে পারতেন না। আমাদের বাড়ী সোরা গ্রামে, শ্যামনগর থানায় আর শিঙের গোলখালী পাইকগাছা থানায়। কিন্তু উভয় গ্রামই থানার সীমান্তবর্তী হওয়াতে দুই গ্রামের মধ্যে দুরত্ব আড়াই মাইলের বেশী নয়; যেতে হয় কপোতাক্ষী নদী পার হয়ে। বাবা সেই মুহূর্তেই বন্দুক আর ছরা-বারুদ বের করলেন। দোনলা গাদা বন্দুকটি তিনি কিনেছিলেন এবং সেই অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য বন্দুকটি দিয়েই তিনি জীবনের অধিকাংশ প্রায় পঞ্চাশটা—রয়াল বেঙ্গল বাঘ মেরেছিলেন। আমি আর চাচা, বাবার ছোট ভাই, তিনিও নামকরা শিকারী ছিলেন, নাম নিজামদী গাজী, তৈরী হতে হতে বাবা বন্দুকের দুই নলই ভরে ফেললেন, তারপর মাকে কোন কিছু না বলে তক্ষুণি রওনা হলেন।

বিকাল তিনটা নাগাদ আমরা কপোতাক্ষীর তীরে গিয়ে পৌছলাম নদী পার হতে হতে মাঝির কাছে শোনলাম যে, গতরাতেই গোলখালীর এক গৃহস্থের গোহাল থেকে বাঘ একটা গরু নিয়ে গেছে, গোহালের দরজা বরাবর খোলা থাকে, গতরাত্রেও খোলাই ছিল, বাঘ নিঃশব্দে ঢুকে গাভীর ঘাড় ভেঙে দড়ি ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। গোহালের প্রায় সংলগ্নই বাড়ীর লোকেরা অন্য সব গরুর ছট্‌ফটানি শুনতে পেয়েছিল, বুঝতেও পেরেছিল যে বাঘ এসেছে, কিন্তু প্রাণভয়ে কেউ বের হয়নি। সকালে বাঘের পায়ের ছাপ ও তাজা রক্ত পায়। অন্য দুইটা বলদ দড়ি ছিঁড়ে দূরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।

গোলখালীর লোক সকলেই মেহের গাজীর নাম জানত। আমরা গ্রামের একটা বাড়ীতে গিয়ে পৌঁছতেই অল্পক্ষণের মধ্যে সেখানে প্রায় জনাত্রিশেক লোক জড়ো হল। তারা গতরাতে বাঘে গরু জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে যেখানে খেয়েছে তক্ষুণি সেই জায়গাটা দেখিয়ে দিতে চাইল, এবং বাবাও সেই মুহূর্তেই যেতে তৈরী ছিলেন; পাঁচ মিনিটও বিশ্রাম না করে হন্তদন্ত অবস্থায় ভয়ঙ্কর হিংস্র মানুষখেকো বাঘ মারতে রওনা হলেন। গ্রামের মানুষের অবস্থা তখন অতি বিপজ্জনক। সন্ধ্যা হবার আগেই সব ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়, এমন কি দিনের বেলাতেও কেউ স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে সাহস পায় না, হাট-বাজার বলতে গেলে প্রায় বন্ধই; গরু ছাগল পর্যন্ত ঘরের বাইরে নেয় না।

পৃষ্ঠা ৩৭

বেলা চারটার পরে আমরা গ্রামের প্রান্তে জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে আধা-খাওয়া গরুটা দেখলাম। গরুর উপরে তখন দুই গাছে দুইজন শিকারী বসে ছিলেন, একজন বন অফিসের, একজন গ্রামবাসী। গোহাল থেকে জঙ্গলের সেইখানটা অন্ততঃ পাচশ হাত দূরে। বাবা ও চাচা দুইজনেই বাঘের পারা দেখলেন এবং আন্দাজ করলেন যে, বাঘ মরি রেখে পুব-দক্ষিণ দিকের হুদোবনে ঢুকে গেছে, রাতের মধ্যে অবশ্যই আবার আসবে, কিন্তু ধূর্ত জন্তু যদি চক্কর দিয়ে থাকে তবে হয়ত কাছেই কোথাও শুয়ে মাচার উপরে বসা দুই শিকারীকেই লক্ষ্য করছে। শিকারীগণ বাবাকে জানালেন যে, তাঁরা একেবারে সারা রাতের জন্যে তৈরী হয়ে বসেছেন।

বাবা গ্রামের সকল লোককে যার যার বাড়ীতে চলে যেতে বললেন। তারা একটু খোলা এবং মোটামুটি নিরাপদ স্থানে না যাওয়া পর্যন্ত আমরা জঙ্গলের কিনারায়ই অপেক্ষা করলাম; তারপর মরি থেকে পশ্চিমমুখী অগ্রসর হলাম। শ দুই হাত যেতে বাঘের পারা পাওয়া গেল। তাজা পারা! হুদৌ জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দক্ষিণ-পূর্বমুখী গেছে। পারা ধরে অগ্রসর হলাম। বাবা আগে, তাঁর পিছনে চাচা, তারপরে আমি, বন্দুক শুধু বাবার হাতে। হুদো সুন্দরবনের একরকম লতানো গাছ, গুচ্ছ গুচ্ছ হয়। সাধারণতঃ হাঁটু সমান উঁচু হয়, কোমর সমান খাড়াও হয়। সরু হুদোলতার ডালপালা হয় না, গোড়া থেকেই লম্বা লম্বা পাতা মেলে।

এই হুদো বন একটানা বেশ কিছুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয় আর এত ঘন হয় যে তার ভিতরে বাঘ অনায়াসে লুকিয়ে থাকতে পারে, ভিতরে চার-পাঁচ হাতের বেশী কিছুই দেখা যায় নাবিপজ্জনক জঙ্গল ভেঙে দক্ষিণ-পুবমুখী আন্দাজ পঞ্চাশ হাত গিয়ে বাবা হঠাৎ থেমে গেলেন। সেখানে একেবারেই তাজা পারা, মাত্র কয়েক মিনিট আগে বাঘ হেঁটে গেছে। বাবা ও চাচা দুইজনেই থেমে খুব ভালভাবে জায়গাটা পরীক্ষা করলেন, তারপর ইশারায় স্থির করলেন যে অনুসরণ করবেন।

আধা-খাড়া আধা-বসা অবস্থায় আমরা এগুতে লাগলাম। নিশ্চিত যে বাঘ তখন আমাদের থেকে দূরে নেই, হয়ত আমরা যে রকম বাঘের দিকে এগুচ্ছিলাম বাঘও তেমনি আমাদের ঘ্রাণ ওঁকে বা হুদোগাছের নড়াচড়া দেখে আমাদের দিকে তাক করছিল; মৃত্যুভয় বহন করে আমরা এক পা এক পা করে সামনে এগুতে লাগলাম। বাবা একটু যান, থামেন, কখনও বা এক পা পিছনে হঠে আসেন, আবার বিবেচনা করে খাড়া হুদো লতার ফাঁক দিয়ে এক পা সামনে বাড়েন।

হঠাৎ হুদোঝোপ ভেঙে তিনি বামদিকে একবারে তিন-চার হাত পিছনে সরে এলেন। চাচা আর আমি তৎক্ষণাৎ তাঁর পিছনে ছুটে গেলাম। বাঘের গর্জন ও লাফ আর বাবার বন্দুকের আওয়াজ একই সঙ্গে হল; বিজলীর মত বাঘটা ডান দিক থেকে এসে আমাদের মাত্র পাঁচ হাত সামনে পড়ল এবং বাবা দ্বিতীয় ট্রিগার টানার আগেই পূবমুখে অদৃশ্য হয়ে গেল। মাত্র এক ঝলক আমি বাঘের কোমর থেকে লেজ দেখলাম, তারপর হুদোবন ভাঙা ছাড়া আর কিছুই দেখলাম না। একটা লতা সামনে থাকলেও বন্দুকের গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যায়, আর হুদোবনের ভিতর দিয়ে ছুটে যাওয়া অদৃশ্য বাঘকে গুলি করাটা একেবারেই অর্থহীন কাজ হত।

বাবা আর গুলি করলেন না, যতদূর দেখতে পেলেন বাঘের গতি লক্ষ্য করলেন, তারপর চাচার হাতে বন্দুকটা দিয়ে দুই হাত কোমরে রেখে চিন্তা করতে লাগলেন। মানুষখেকো বাঘ ঠিকই আমাদের লক্ষ্য করছিল এবং তার কাছাকাছি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়েছিল; বাবা যদি পিছনে হঠে গুলি না করতেন তবে দ্বিতীয় লাফে অবশ্যই বাবাকে ধরত। অভিজ্ঞ শিকারী, গুলি করেছিলেন বলেই বেঁচে গেলেন, কারণ বাঘ কখনও গুলি খাওয়ার পরে আর শিকারীকে আক্রমণ করে না। সামনে এগুতেই-বাঘের রক্ত দেখলাম, হুদো গাছের গোড়ায় ও মাটিতে। অর্থাৎ গুলি লেগেছে ঠিকই কিন্তু বাঘ ঘায়েল হয়নি।

পৃষ্ঠা ৩৮

বেলা তখন আর খুব বাকী ছিল না, বাঘ যতদূর গেছে হুদোবন ঠেলে সে পর্যন্ত পৌছাতে আমাদের অন্ধকার হয়ে যাবে, তখন অসহায় অবস্থায় গুলি খাওয়া বাঘের সামনে পড়ব। বাবা ও চাচা দুইজনেই ভেবেচিন্তে সেদিনের মত বাড়ী ফিরা স্থির করলেন, গোলখালীর সকলকে রাত্রে অত্যন্ত সতর্ক থাকার কথা বলে, কপোতাক্ষী পার হয়ে আমরা বাড়ী ফিরে এলাম। ভাত খেয়ে রাত্রেই বাবা আবার বন্দুক ভরতে বসলেন, তখন মা বাধা দিলেন। দারুণ জেদী শিকারী হলেও বাবা রাত্রির মত বন্দুকটা রেখে দিলেন।

কিন্তু মার বাধাকে পরোয়া না করে খুব ভোরে তিনি বন্দুক নিয়ে বসলেন, গাদা বন্দুকের দুই নলে বারুদ-ছা ভরলেন। চাচা নিজামদী গাজীও নিজের বন্দুক ভরলেন; সকাল সাতটার মধ্যেই আবার বাবা গোলখালী রওনা হলেন। এবারও আমরা তিনজন, তবে গতকাল বন্দুক ছিল এক বাবার হাতে, আর আজ বাবা-চাচা দুইজনের হাতে দুই বন্দুক; আমি চললাম শুধু একটা লাঠি হাতে ।

গোলখালী গিয়ে বাবা প্রথমেই গ্রামবাসী সকলকে অত্যন্ত সতর্ক অবস্থায় থাকতে বললেন, কেন না গুলি খাওয়া মারাত্মক হিংস্র বাঘ নিশ্চিত গ্রামের সীমানার মধ্যে রয়েছে। বেলা তখন সাড়ে নয়টা দশটার বেশী হয়নি। গতকাল বাবা গুলি করে বাঘ মারতে না পেরে ফিরে যাওয়ার পর থেকে সকাল পর্যন্ত কোন একটি প্রাণীও বাড়ী থেকে চল্লিশ হাত দূরে যায়নি, গোহাল থেকে কেউ গরু বের করেনি। বাবার কথামত গোলখালীর জনাদশেক সাহসী যুবক একটি বন্দুক সমেত গ্রামের বাড়ী বাড়ী সবাইকে সতর্ক করে দিতে রওনা হয়ে গেল, আর বাবা, চাচা ও আমি এগিয়ে গেলাম গ্রামের বাইরে গতকালকের ঘটনাস্থলে, দুনিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক অভিযানে ঠিক যেখানে বাঘকে গুলি করেছিলেন গতকাল, সেখানে আজও গেলেন এবং বাঘের পারা ও কাত হওয়া হুদোর চারা দেখে অত্যন্ত সাবধানে, অতি সতর্কতার সঙ্গে বাবা পূবমুখে অগ্রসর হলেন। আগে বাবা, বাবার হাত পাচেক পিছনে চাচা, আর চাচার হাত আষ্টেক পিছনে আমি লাঠি হাতে, যা বাঘের আক্রমণের মুখে হয়ত অতি সামান্যই কাজে আসবে।

ঘন হুদো বনের ভিতরে সামনে বা পাশে কোনদিকেই চার-পাচ হাতের বেশী দৃষ্টিতে আসছিল না, আমরা চোখের উপরে যতটা ঘ্রাণশক্তির উপরে তার চেযে বেশী নির্ভর করে অতি ধীরে, প্রায় নিঃশব্দে এগুতে লাগলাম, একটা কাঁচা পাতা নড়ার শব্দও তখন সঠিক শুনতে পাচ্ছিলাম। বাবার কালকের গুলি, খুব কার্যকরভাবে না হলেও, বাঘের গায়ে লেগেছিল এবং অবশ্যই বাঘ আহত হয়েছে। তিনি বুকে গুলি করেছিলেন, সে গুলি নিশ্চয়ই কাঁধ বা ঘাড়ের চামড়া ভেদ করে গিয়ে থাকবে। অনুসরণ করতে করতে স্থানে স্থানেই আমরা মাটিতে আর হুদো পাতায় জমাট রক্ত দেখতে পেলাম, কিন্তু কোনখানেই খুব বেশী পরিমাণে নয়, ফোঁটা ফোঁটা। নিশ্চিত হয়ে কিছু ধারণা করার মত চিহ্ন নেই। খুব জখম হলেও দ্রুতবেগে ধাবমান বাঘের দেহ থেকে যথেষ্ট রক্তক্ষরণ না হতে পারে, আবার গুলি কেবলমাত্র চামড়া ভেদ করে গিয়ে থাকলেও এ রকম হতে পারে। তবে সম্ভবতঃ বাঘ যেখানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল আজ সেখানেই শুয়ে রয়েছে।

পৃষ্ঠা ৩৯

দুই ঘন্টায় আমরা সামান্যই এগুতে পারলাম। সামনে, ডানদিকে, খুব ভাল করে লক্ষ্য করে, বার বার রুদ্ধপ্রায় নিঃশ্বাস টেনে তারপর একটি পা সামনে এগুতে হচ্ছিল। হাত বিশেক দক্ষিণে একটা মাঝারি আকারের কেওড়া গাছ পড়ল, তার ঠিক নীচে হুদোবন কিছুটা পাতলা ছিল, বাঘ গেছে সেদিকে। যদিও গ্রাম থেকে দূরত্বহেতু ঘয়েল বাঘের পক্ষে যে কোন আড়াল-আবডালে শুয়ে থাকা সম্ভব ছিল, তবু সেই হালকা হুদোবনে গাছের পিছনেই যে বাঘ থাকবে এটা সম্ভবতঃ বাবা বা চাচা কেউ ধারণা করতে পারেননি। কেওড়া গাছটা বরাবর আরও হাত আষ্টেক গিয়েই বাবা হঠাৎ থপ করে থামলেন। পাতার একটু নড়াচড়া হল এবং তারপর একেবারে আচম্বিতে ভয়ঙ্কর গর্জন করে বাঘ ছুটে এসে বাবাকে আক্রমণ করল। বন্দুক তাক করার আগেই হা-হা করে এসে বাবার উপরে পড়ল, তিনি বন্দুক হাতে কাত হয়ে একপাশে পড়ে গেলেন, বাঘ তার মাথায় একটা থাবা মেরেই আরেক লাফে গিয়ে চাচাকে ধরল। চাচা বন্দুক নিশানা করে থাকা সত্ত্বেও বাবা সামনে থাকায় ট্রিগার টানতে পারলেন না, বাঘ আরেকটা হুঙ্কার দিয়ে চাচার হাতে কামড় দিল এবং পরমুহূর্তে হুদোবনে ঢুকে গেল।

মাত্র হাত-দশেক দূরে থেকেও আমি বাঘ দেখতে পাইনি। হুদোগাছ ঠেলে এগিয়ে যেতেই দেখলাম বাবার বিকট চেহারা; মাথার বামদিকে তালু থেকে কপাল, কান ও চোয়ালের মাংসপেশী আলগা হয়ে কাঁধের উপরে ঝুলে পড়েছে, মাড়ির দাঁত বের হয়ে আছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সেই অবস্থায়ই বন্দুক আমার দিকে এগিয়ে অবিশ্বাস্য সাহসের অধিকারী বাবা চীৎকার করে হুকুম দিলেন, ‘ধর বন্দুক! গুলি কর!’ এক হাতে আদেশমত বন্দুক এবং আরেক হাতে বাবাকে বুকে ধরে সামনে তাকিয়ে অন্ততঃ দেড়শ হাত দূরে আমি কেবল হুদোগাছ নড়তে দেখলাম। চাচার দিকে চেয়ে দেখি তিনিও ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে এক হাতেই বন্দুক নিশানা করে বাঘের বরাবর চেয়ে আছেন, আরেকটা হাত কনুই-এর উপর থেকে নীচে ঝুলে আছে, রক্তের ধারা ছুটছে। বাবা ও চাচা দুইজনকে অতিকষ্টে ধরে হুদোবন ও জঙ্গল পার করে গোলখালী গ্রামে নিয়ে এলাম ।

গ্রামবাসীরা যে যতদূর পারল সাহায্য করল, সাধ্যেরও বেশী করল। এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে সুন্দরবনের দুই বিখ্যাত শিকারী ভাই-এর শিকার জীবনে যতি নেমে এল–একজনের চিরতরে। দীর্ঘ তিনমাস চিকিৎসাধীন থাকার পরে আমার বাবা মেহের গাজী সেরে উঠলেন, এবং তারপরেও আরো পাঁচটা বাঘ মেরে শেষ পর্যন্ত সুপতির মানুষখেকো বাঘের কামড়ে মারা যান; আর চাচা নিজাম্দী গাজী এর পরে যদিও আরো আঠারো বছর জীবিত ছিলেন তবু একহাতে আর বাঘ মারতে পারেননি।

চাচাকে সেই দিনই শ্যামনগর থানার সরকারী ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সুধীর ডাক্তার অপারেশন করে কনুইর উপর থেকে তাঁর হাত কেটে বাদ দেন। বাবাকে বাড়ীতেই চিকিৎসা করেন আমাদের মুন্সীগঞ্জের এক ভদ্রলোক, তিনি বাঘের কামড়ের বনজ চিকিৎসা জানতেন। পুরা তিন মাসে তিনি ভাল হন, কিন্তু ঘা শুকিয়ে চামড়া কুঁচকানোর ফলে বাবার সুন্দর চেহারা বিকৃত হয়ে যায়। তিনি পুরা মুখ হা করে ভাতের নওলা মুখে দিতে পারতেন না, অতিকষ্টে নরম ও তরল খাবার খেতেন।

সামনের দুই পায়ের থাবায় অবিশ্বাস্য শক্তি ধরে বাঘ, চকিতের মধ্যে বাবার মাথায় একটা থাবা মারতেই খুলির অংশ, কান, চোয়ালের মাংসপেশী সব আলগা হয়ে যায়। বারো দিন পরে বাবার জীবনের আশঙ্কা দূর হয় । আমাদের শিকারী পরিবার, তাই গোলুখালীর বাঘ মারার জন্যে আমাদের দায়িত্ব চলে যায়নি। তাছাড়া সুন্দরবনের মহাবীর মেহের গাজীকে তার ভাইসহ জখম করেছে গোলখালীর বাঘ, এখন তার চূড়ান্ত মোকাবিলা না করে আমরা পারি না, কেন না পরিবারের সকলেই আমরা বন্দুক ধরতে জানি ।

পৃষ্ঠা ৪০

বারো দিনের দিন আমার ছোট দাদা, অর্থাৎ বাবার চাচা, ইসমাইল গাজী এবং আমার দুই চাচা আতাব্দী গাজী ও মাদার গাজী গোলখালী রওনা হলেন, আমিও সঙ্গে চললাম। কপোতাক্ষী পার হয়ে সেই গ্রামে গিয়ে দাদা কিছুক্ষণ গ্রামবাসীগণের সঙ্গে কথা বলে বাঘের সন্ধান নিলেন। মানুষখেকো বাঘ সেই বারো দিনে আরো একজন মানুষ ও দুইটা গরু খেয়েছে। গ্রামের কেউ মৃতদেহ বা গরু উদ্ধার করে আনতে পারেনি যদিও বন্দুকসহ দল বেঁধে গিয়ে তারা কিন্তু চেষ্টা করেছিল। এর মধ্যে একজন একদিন দুপুর বেলা বাজার থেকে ফিরার পথে দূরে হুদোবনের ভিতরে বাঘের গোঙানি শুনতে পেয়েছিল, সে প্রাণভয়ে ছুটে কোনরকমে বাড়ী ফিরে আসে ।

যতদূর ধারণা করা গেল, বাঘ তখনো গোলাখালী গ্রামেই ছিল, জখম শুকায়নি— যদি গোঙানীর আওয়াজ শোনার কথা ঠিক হয়ে থাকে। বাবা ও চাচাকে কামড়ানোর পরে গ্রামবাসীরা তো বটেই শিকারীদের মধ্যেও এমন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল যে হুদোবনে বাঘের অবস্থান জানা সত্ত্বেও কেউ আর সেই বাঘ মারার জন্যে কাছে যেতে সাহস পায়নি মৃত্যুরূপ মানুষখেকোর উপস্থিতি সত্ত্বেও এর মধ্যে গ্রামবাসীদের মধ্যে কিছু কিছু দৈনন্দিন কাজ-কাম শুরু হয়েছিল। হাট-বাজার, কৃষিকাজ ও চলাফিরা না করে কোন মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। কিন্তু আছরের ওয়াক্ত হয়ে গেলে তখন সকলেই যার যার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিত এবং প্রাণে ভয় বহন করে তারা রাত্রে ঘুমানোর চেষ্টা করত যাই হোক, গ্রামবাসী সবাইকে সতর্ক থাকতে বলে বিকাল তিনটার সময়ে দাদা আমাদের নিয়ে হুদোবনে নামলেন।

সবার আগে দাদা ইসমাইল গাজী, তাঁর হাতচারেক পিছনে প্রায় পাশাপাশি আমার দুই চাচা, অতাব্দী গাজী ও মাদার গাজী, তাঁদের তিনজনের হাতেই বন্দুক, এবং তাঁদের ঠিক পিছনে খালি হাতে ছিলাম আমি। যেখানে বাঘ বাবা ও চাচাকে আক্রমণ করেছিল, দাদা সাবধানতার সঙ্গে অগ্রসর হয়ে আগে সেই কেওড়া গাছটার তলায় গেলেন, দুই চাচা দুই দিকে বন্দুক ধরে দাঁড়ালেন, দাদা গাছের গোড়ার চারদিকে ভাল করে পরীক্ষা করতে লাগলেন । তাঁর সঙ্গে আমিও বাঘের অসংখ্য পারা দেখতে লাগলাম।

মানুষখেকো হোক আর সাধারণ হোক, বাঘমাত্রই অতি চঞ্চল জন্তু, এক জায়গায় বেশীক্ষণ শোবে না বা ঘুমাবে না, কেবল হাঁটাহাঁটি করবে। কেওড়া গাছের চারপাশে হাত দশ-বারো জায়গার মধ্যেই সম্ভবতঃ গত দুই দিনে বাঘ বার বার শুয়েছে ও হেঁটেছে, চিহ্ন থেকে তা বুঝতে পারলাম। এখনো বাঘ নিশ্চয়ই এই গাছটার পোয়া মাইল এলাকার মধ্যেই রয়েছে ।

এক পা এক পা করে এগুতে লাগলাম। আমরা চারজন আগ বাড়তে যতটুকু শব্দ হচ্ছিল চারটা পিঁপড়া হেঁটে গেলেও সম্ভবতঃ তার চেয়ে বেশী আওয়াজ হত না। ঝানু শিকারী দাদা একটি একটি করে হুদো কাত করে উদ্যত বন্দুকটা হাতে পথ করে এগুচ্ছিলেন তাঁর পরিণতির দিকে, আর পিছনে আমরা। দক্ষিণমুখে পঞ্চাশ হাতের বেশী যাইনি, হঠাৎ দাদার ডানপাশে কয়েকটা হুদোগাছ খাড়া হয়ে উঠল, দাদা বন্দুক ঘুরানোর আগেই ভয়ঙ্কর গর্জন করে বাঘ তাঁর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল। মাত্র চার হাত পিছনে চাচারা দুইজন দাঁড়িয়ে থেকেও কিছু করতে পারলেন না, দাদাকে মেরে বাঘ বিজলীর মত অদৃশ্য হয়ে গেল এত কাছে থেকেও আমি গর্জন শোনলাম, বাঘ দেখলাম না। সামনে ছুটে গিয়ে দেখি হুদো ঝোপের উপরে দাদার লাশ পড়ে আছে, মাথার একদিক কামড়ের চাপে চ্যাপ্টা হয়ে বসে গেছে, রক্ত ছুটছে। ঘাড়-মাথা জোড়া একটিমাত্র কামড়ে অন্ততঃ বিশটি বাঘ শিকারের অভিজ্ঞতা অর্জনকারী খ্যাতনামা শিকারীর জীবনাবসান হল।

পৃষ্ঠা ৪১

দাদার লাশ বহন করে, গোলখালীর লোকদের আরও বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে ফেলে রেখে আমাদের গ্রামে ফিরতে হল, বেবাক বাড়ীতে হাহাকার পড়ে গেল। দুর্বল এবং তখনো শয্যাগত বাবা আহত যোদ্ধার মত মোচড় দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, পর মুহূর্তে ইসমাইল গাজীর চূর্ণ-বিচূর্ণ মাথা বুকে ধরে শিশুর মত কাঁদতে লাগলেন। চারপাশের কয়েক মাইল এলাকার মধ্যে এমন কথাও ছড়িয়ে পড়ল যে, শিঙের গোলখালীর মানুষখেকো বাঘ মারার ক্ষমতা কোন মানুষের নেই।

অনেকে, বিশেষ করে মেয়েলোকেরা, বিশ্বাস করেই বলতে লাগল যে, এটা বাঘ নয়, বাঘের রূপ ধরে এক নরখাদক প্রেতাত্মা এসেছে, বন্দুকের গুলি তার গায়ে লাগে না। কিন্তু দীর্ঘদিনের ভয়ার্ত লোকে যাই বলুক না কেন, আমরা তো জানতাম যে সেটা বাঘ, হুদোবনের গভীর আচ্ছন্নতা ও আত্মগোপনের অবাধ সুযোগ পেয়ে এতদিন ধরে ক্রমাগত মানুষ মেরে যাচ্ছে। কোন না কোন শিকারীর গুলিতে একদিন সে মারা পড়বেই, কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে আর কে আছে যে তাকে মারতে যাবে?

দাদার মৃত্যুর পরও ষোল দিন পার হয়ে গেল। এর মধ্যে গোলখালী গ্রামের আরও একজন মানুষ মারা পড়েছে। বনে আমরা সেই খবর পাই। গরু কয়টি গেল তা জানার মত মানসিক অবস্থা আর আমাদের ছিল না। ততদিনে বাবা অনেকটা হয়ে উঠেছেন, অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে একটু একটু হাঁটতে পারেন। কিন্তু হেঁটে আর কোনখানে নয়, কেবল তাঁর চাচা ইসমাইল গাজীর কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকেন।

হঠাৎ একদিন দুপুরবেলা বাবা ডাকলেন আমাকে। কাছে যেতেই মাকে ইশারা করলেন বন্দুক বের করতে। মা দোনলা গাদা বন্দুকটি বের করে দিতেই বাবা সেটি আমার হাতে তুলে দিলেন। বললেন, ‘ধর!’ দুই হাতে বন্দুকটি নিয়ে সামনে দাঁড়ালে তিনি বললেন, ‘যাও, তুমি ছাড়া আর কেউ এই বাঘ মারতে পারবে না।’ সুন্দরবনের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঘ শিকারী, আমার বাবা মেহের গাজী তাঁর জীবনের হাতিয়ার ও অন্তরের দোয়া আমাকে দিলেন।

হাতে আন্দাজ করে বারুদ দিয়ে বললেন, ‘ভর!’ আমি বারুদ ভরলাম। পাট নিজ হাতে দলা করে দিয়ে বললেন, ‘ভর!’ পাট ভরলাম। তারপর গণে গণে ছরা দিলেন, আমি ছর্রা ভরলাম, সবশেষে আবার পাটের দলা ভরলাম, ক্যাপ পকেটে নিলাম; ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে যখন বাড়ী থেকে গোলখালীর উদ্দেশে রওনা হলাম তখন বেলা আন্দাজ দুইটার কাছাকাছি। একবার পিছনে তাকিয়ে দেখলাম ঘরের বারান্দায় মার কাঁধে ভর দিয়ে বাবা আমাদের দিকে চেয়ে রয়েছেন। আমার বয়স তখন আঠারো-ঊণিশ বছর। বাবা ও চাচার সঙ্গে গিয়ে ইতিমধ্যে আমি চারটি বাঘ মেরেছি; কিন্তু তাদের কোনটিই মানুষখেকো ছিল না, ছিল সাধারণ বাঘ। শিঙের গোলখালীর মানুষখেকো শিকার করতে বাবা ও দাদার সঙ্গে যে দুইবার গিয়েছিলাম, প্রতিবারেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছি আর এবার জেদী বাপের হুকুমে বলতে গেলে অনভিজ্ঞ আমি যাচ্ছি গোলখালীর বিভীষিকার মোকাবিলা করতে।

পৃষ্ঠা ৪২

কিন্তু তবু আমার মনে কোন ভয় ছিল না, যত ভয়ঙ্করই হোক না কেন বাঘকে ভয় করলে আমাদের চলে না। বেলা চারটায় গোলখালী পৌঁছলাম। গিয়েই শোনলাম, গতরাত্রে বাঘ এক গৃহস্থের গোহাল থেকে একটি বাছুর নিয়ে গেছে। গোহালের দরজা খোলা ছিল, বাঘ নিঃশব্দে ঢুকে বাছুর মুখে তুলে প্রায় দুই আনা মাইল দূরে হুদোবনে গিয়ে খেয়েছে। রাত্রে বাড়ীর লোকেরা বাঘের কোন গর্জন শোনেনি, কোন আওয়াজও পায়নি, সকালে গোহালে গিয়ে বাঘের পারা ও রক্ত দেখতে পেয়েছে সেদিন পোলখালীতে বন বিভাগের একজন কর্মকর্তা এবং আরো দুইজন শিকারী ছিলেন; তাঁরা গোলখালী গ্রামের আরো একজন বন্দুকধারীসমেত গিয়ে হুদোঝোপের ভিতরে আধা-খাওয়া বাছুর খুঁজে পান। তারপর আর অগ্রসর না হয়ে রাত্রে বাছুরের উপরে বসবেন স্থির করে তারা গ্রামে ফিরে আসেন।

আমি যেতে এবার মোট শিকারীর সংখ্যা হল পাঁচ, যদিও তখন পর্যন্ত সত্যিকারের শিকারী আমি হইনি। আমরা স্থির করলাম যে, বাঘের সম্ভাব্য আসার পথে এবং আধা খাওয়া বাছুরের উপরে বিভিন্ন সুবিধাজনক স্থানে আমরা বসব।

বেলা পাঁচটার সময়ে প্রায় বিশ-পঁচিশজন সাহসী গ্রামবাসীসহ আমরা হুদোবনে ঢুকলাম। যেখানে নিয়ে বাছুর খেয়েছে সেখানে হুদোঝোপ ছিল অপেক্ষাকৃত পাতলা৷ বাছুরের প্রায় চার আনা খেয়েছে, কাজেই বাঘ রাত্রে যে আবার আসবে তা একেবারে নিশ্চিতই; কোনরকম বাধা না পেলে বাঘ তার শিকারের কিছুই ফেলে না।

হুদোবন একটানা নীচু হলেও কোথাও একটি-দুইটি, কোথাও একসঙ্গে কয়েকটি, এ রকম বড় গাছ ছিল। অন্যান্য শিকারীরা কেউ একা, কেউ একজন সঙ্গী নিয়ে যার যার সুবিধামত গাছে বসলেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন বন বিভাগের কপোতাক্ষী অফিসের ডেপুটি রেঞ্জার, কপোতাক্ষীই গোলখালী থেকে নিকটবর্তী বন অফিস ৷ আমি বসলাম বাছুরটা থেকে প্রায় পনের হাত দূরে এক কেওড়া গাছে। ছোট ভাই আমার নির্দেশমত আমার মাথার হাতচারি উপরে বসে গাছের ডালের সঙ্গে তার কোমর বেঁধে নিল আর মাটি থেকে নয় হাত আন্দাজ উপরে যেখানে আমি বসলাম সেখান থেকে কয়েকটি ডাল একসঙ্গে বের হয়েছিল, যার ফলে আমি বেশ ভাল আড়াল করেই বসতে পারলাম।

পৃষ্ঠা ৪৩

আমরা শিকারীরা সবাই গাছে উঠে বসলে ডেপুটি রেঞ্জার সাহেবের নির্দেশে গ্রামবাসী লোকজন সবাই হৈ-চৈ করতে করতে যার যার বাড়ীতে চলে গেল । চারজন শিকারী নিজ নিজ পছন্দ অনুযায়ী গাছে বসেছিলেন; বাঘ আসার সম্ভাব্য দিক অনুমান করে এবং বাঘ দেখার ও গুলি করার সুবিধা বিবেচনা করে একজন থেকে আরেকজন প্রায় পঞ্চাশ-একশ হাত দূরে দূরে ছিলেন। আমি যে বাছুরটার মাত্র পনের হাত দূরে কেওড়া গাছে বসেছিলাম তা ছিল একেবারেই ঘটনাক্রমে, আমার কোন বিশেষ পছন্দ অনুযায়ী নয়; আর কোন শিকারীই সেই গাছে বসেননি।

আধা-খাওয়া বাছুরটা তখন আমার গাছ থেকে দক্ষিণে; আমার পিছনে, অর্থাৎ উত্তর দিকে, গোলখালীর শেষ বসতবাড়ী-বাছুর যার সেই গৃহস্থের বাড়ী, আমার গাছ থেকে তার ঘরের চাল দেখা যাচ্ছিল। বাছুরটা থেকে হাত তিরিশ দক্ষিণে একটি ছোট্ট খাল ছিল আর, আগেই বলেছি, সমস্ত জায়গাটা ছিল একটানা হুদোবন, হাঁটু সমান, কোথাও কোমর সমান, স্থানে স্থানে কেবল বিচ্ছিন্ন বড়-মাঝারি গাছ। শিকারীরা কে কোন্ গাছে ছিলেন তা প্রত্যেকেরই জানা ছিল। বাঘ সম্পূর্ণ সম্ভাবনায় দক্ষিণ দিক থেকে আসবে, সে আন্দাজেই সবাই গাছ বাছাই করেছিলেন। আর এই রাত্রে যদি আসে তাহলে পাঁচজনের যে কোন একজনের হাতে মারা পড়বে, অন্ততঃ আরেকটা গুলি খাবেই। অল্পক্ষণের মধ্যেই সমস্ত শিঙের গোলখালী গ্রামে ও হুদোবনে অন্ধকার নেমে এল।

পিছনে তাকিয়ে দেখলাম, গ্রামে একটি বাতিও জ্বলে না অন্ধকার ও নীরবতার মধ্য দিয়ে প্রায় একঘন্টা সময় কাটলে তখন পুব আসমানে ভরা চাঁদ উঠল, আর আলোর সঙ্গে সঙ্গে বনের মধ্য দিয়ে যেন একটা শিহরণ খেলে গেল; প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত হুদোবন লণ্ডভণ্ড করে বাতাস ছুটল। এর ফলে একটা অসুবিধা দেখা দিল যে, বাঘ কাছাকাছি এলেও আমরা তার আওয়াজ শুনতে পাব না, এক চাঁদের আলোর উপরে নির্ভর করতে হবে, কিন্তু আলো তখনো তীর্যক ছিল বলে বাছুরটার কাছে যথেষ্ট ছিল না।

প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে ধীরে ধীরে বাতাস থেমে গেল, তখন আবার পাতা নড়ার শব্দও আমি পরিষ্কার শুনতে পেলাম। আন্দাজ নয়টার সময়ে অনেক দূরে টাই! টাই! করে হরিণের ডাক শুনে সচকিত হয়ে উঠলাম, কিন্তু তার পরেই আবার নীরবতা। দশটার দিকে বন ফাটিয়ে চাঁদ এল প্রায় মাথার উপরে। সে আলো এত প্রখর ছিল যে পনের হাত দূরে অর্ধভুক্ত বাছুরটার ছাটনার হাড় পর্যন্ত আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। উজ্জ্বল আলোতে পরের দুই ঘন্টা নিস্তব্ধতার মধ্যে কাটিয়ে ক্লান্ত হয়ে আমি যখন আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম যে বাঘ আর আসবে না, ঠিক তখন রাত প্রায় বারোটার সময়ে, দক্ষিণের ছোট্ট খালে ঝপ্! ঝপ্! করে দুইবার শব্দ হল। দীর্ঘ প্রতীক্ষারত আমার কাছে সেই শব্দ কত বড় আকাঙ্ক্ষিত যে ছিল তা গভীর বনে মানুষখেকো বাঘ শিকার করেননি এমন কাউকে বুঝানো যাবে না; এক মিনিট পরে ঝক্ঝকা আলোতে আমি বাঘের পুরা শরীর দেখতে পেলাম।

মরা বাছুরটা থেকে হাত দশেকের মধ্যে এগিয়ে এসে থামল, বসল, আবার উঠে ডানদিকে বামদিকে মুখ ঘুরিয়ে, বাছুরটার একেবারে কাছে এসে দাঁড়াল। চটাৎ! করে একটি অতি ছোট্ট শব্দ হতেই বাঘ সেদিকে ফিরে চাইল, তখন আর একটুও দেরী না করে আমি বুক বরাবর ট্রিগার টানলাম। বিকট একটা গর্জন করে বাঘ পিছনে ছিটকে পড়ল এবং চক্ষের পলকে হুদোঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। পরের আধা মিনিট পর্যন্ত আমি কেবল বাঘের গোঙানী আর চার পায়ের দাবড়া-দাবড়ি শুনতে পেলাম এবং তখন, কোন শিকারী যে কাজ হয়ত কখনো করতেন না, মুহূর্তের বিবেচনায় আমি তাই করে বসলাম; শব্দ লক্ষ্য করে দ্বিতীয় গুলি করলাম।

পৃষ্ঠা ৪৪

পরের ছয় ঘন্টা আমরা সবাই গাছেই বসে রইলাম। চাঁদ ডুবে গেল, পূবের আকাশ ধলা হয়ে উঠল এবং দূরে একসঙ্গে কয়েকটি পাখী ডেকে উঠল। আমি, আমার ভাই বা শিকারীদের মধ্যে কেউই তখনো পর্যন্ত নিশ্চিত জানতে পারিনি যে বাঘ মরেছে না কি আবার হুদোবনেই অদৃশ্য হয়ে গেছে সূর্য উঠলে তখন চারজন শিকারী গাছ থেকে নেমে অতি সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে এলেন। আমিও নামলাম। সঙ্গীদের পিছনে থাকতে বলে আমরা পাঁচজন শিকারী একসঙ্গে বাঘ সন্ধান করতে অগ্রসর হলাম যদিও আমার গাদা বন্দুকে তখন আর গুলি ছিল না। মাছির ভণ্ ভণ্ কানে আসতেই বুঝলাম যে গুলি রাত্রে ঠিকই লেগেছে, এবং একটু পরে বাঘ টেনে খোলা জায়গায় আনার পরে দেখলাম যে আমার দ্বিতীয় গুলিও বাঘের পাজরেই লেগেছে সেখানেই মাপা হলঃ সাড়ে দশ ফুট লম্বা বুড়া বাঘ । যে ‘চটাৎ!’ শব্দের জন্যে আমি বাঘের বুকে গুলি করার সুযোগ পেয়েছিলাম সেটা ছিল জোংড়ার মুখ খোলার আওয়াজ । রাত্রির নীরবতায় শামুকের অত ছোট্ট শব্দও আমি পরিষ্কার শুনতে পেয়েছিলাম।

আধ ঘন্টার মধ্যে শিঙের গোলখালী গ্রাম শূন্য করে মেয়ে-পুরুষ-ছেলে-বুড়া বেবাক লোক হুদোবনে ছুটে এল, চীৎকার, গালিগালাজ, ক্রোধ প্রকাশ ও উল্লাসধ্বনি করতে করতে তারা বাঘের চার পা বেঁধে বয়ে নিয়ে এল সেই গৃহস্থের বার বাড়ীতে। দীর্ঘদিনের ত্রাস সৃষ্টিকারী ভয়ঙ্কর হিংস্র শত্রুর নিধনের আনন্দ এবং পুত্রহারা পিতামাতার হাহাকারে শিঙের গোলখালী গ্রামের বাতাস ভারী হয়ে উঠল।

শিকারী ভাইদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, গোলখালী গ্রামবাসীদের আন্তরিক সহায়তায় কপোতাক্ষী নদী পার করে বাঘ আড়াই মাইল দূরবর্তী সোরা গ্রামে আমাদের বাড়ীতে নিয়ে এলাম।

বাড়ীতে আমরা সবাই মিলে আমাদের উঠানে গোলখালীর বাঘের চামড়া ছোলাই করলাম। আগেই বলেছি যে বাঘটা ছিল বুড়া, কয়েকটা দাঁত ছিল না, বাবার গুলি বাঘের কাঁধের নীচে চামড়া ও অনেকখানি গোশ্ত ভেদ করে গিয়েছিল এবং পচন ধরেছিল, সেখানেই মাছি ভণ্ ভণ্ করছিল ।

এই আমার জীবনের প্রথম মানুষখেকো বাঘ শিকারের কাহিনী। বন দফতরে গোলখালীর বিভীষিকা এই বাঘের চামড়া জমা দিয়ে পুরস্কারের তৎকালীন ৩০০ টাকা পুরাপুরি এনে আমি বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। বাবা তখনও শয্যাগত, ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছিলেন।

বইয়ের পরবর্তী অংশ ওয়েবসাইটে আপলোড করা হবে শীঘ্রই। চোখ রাখুন Green Belt The Travelers ফেসবুক গ্রুপে।

প্রথম পর্ব: আঠারোবেকীর বাঘ – পর্ব ১
দ্বিতীয় পর্ব: দুবলার চরের মানুষখেকো – পর্ব ২

আরো পড়ুন

সুন্দরবনের মানুষখেকো – ২

১৯৭২ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনে বাঘকে উপদ্রব বলে গণ্য করা হত। তখন অনুমোদনপ্রাপ্ত যে কোন শিকারী বাঘ মেরে চামড়া ও মাথার খুলি বন অফিসে জমা দিলে তাঁকে অর্থ পুরস্কার দেওয়া হত। ১৯৭৩ সালে জারীকৃত বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী বনে এখন সকল প্রকার প্রাণী শিকার নিষিদ্ধ, বন দফতর থেকে ‘মানুষখেকো’ বলে কাগজেপত্রে ঘোষণা করলে তবেই কেবল সেই বাঘ মারা যায়। পচাব্দী গাজীর শিকার জীবন ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত। এর মধ্যে তিনি ৫৭ টি বাঘ মেরেছে। ফ্রান্স, জার্মানী, মধ্যপ্রাচ্য ও জাপানের পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশনে শিকারী পচাব্দী গাজীর কৃতিত্বের কাহিনী প্রচারিত হয়।

বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় সেবা প্রকাশণী থেকে ১৯৮০ সালে।  বিখ্যাত শিকারি পচাব্দী গাজীর জবানিতে বইটি লিখেছেন হুমায়ুন খান। বইয়ে ৭টি অনুচ্ছেদ আছে। ১. আঠারোবেকির বাঘ, ২. দুবলার চরের মানুষখেকো, ৩. গোলখালীর বিভীষিকা, ৪. সুন্দরবনের ভয়ঙ্কর, ৫. শিকারী জীবনের বিচ্ছিন্ন স্মৃতি, ৬. সুপতির মানুষখেকো, ৭. তালপট্টির বিভীষিকা।

এটি বইটি ধারাবাহিক প্রকাশের দ্বিতীয় পর্ব। প্রথম পর্ব এখানে পড়ুন।

দুবলার চরের মানুষখেকো

বাগেরহাটের শরণখোলা রেঞ্জের অধীনে দুবলা বহু মাইলব্যাপী এক বিশাল চর। সমুদ্ররেখার বরাবর সুন্দরবনের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত এই দ্বীপ। এর একদিক দিয়ে পশুর আর আরেক দিকে মরজত নদী বয়ে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। প্রত্যেক বছর কার্তিক থেকে মাঘ এই চার মাস প্রধানতঃ চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য এলাকার অন্ততঃ কয়েক হাজার হিন্দু-মুসলমান ও মগ জেলে এসে দুবলার চরে অস্থায়ী বসত গড়ে। তারা নদীর মোহনা এলাকা ধরে ও সাগরে মাছ ধরে, চরেই শুঁটকি দেয় ৷ বহু তাজা মাছ সাম্পান আর যান্ত্রিক ট্রলার বোঝাই হয়ে সরাসরি চালান যায় চট্টগ্রামে, কক্সবাজারে, সেখানে সাগরতীরে বড় এলাকাজোড়া শুঁটকি দেওয়া হয়। লটিয়া, লাক্কা, ছুরি, রূপচান্দা, ইলিশ, বাইন, জাবা, ভেটকি, দাঁতনী, ভোলা, চিংড়ি, এবং আরো নানা জাতের মাছ, মগ জেলেরা হাঙর মাছও ধরে শুঁটকি দেয়।

ফাল্গুন মাস এলে হাওয়া ঘুরে যায়, সমুদ্র আবার উত্তাল হয়ে উঠে, জেলেরা তখন জাল গুটিয়ে বড় বড় সাম্পানে শুঁটকি বোঝাই করে নিয়ে চলে যায়। তারপর থেকে একেবারে আশ্বিনের শেষাশেষি পর্যন্ত দুবলা দ্বীপ একেবারেই জনশূন্য পড়ে থাকে। পরের কার্তিকে উত্তরের হাওয়া বইতে শুরু করলে সমুদ্র আবার শান্ত হয়ে যায় এবং কয়েক হাজার জেলেও আবার দুবলার চরে এসে গোলপাতার চালাঘর বেঁধে ব্যাপকভাবে মাছ ধরার প্রস্তুতি নেয়। সুন্দরবনের এই এক বিরাট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ছোট ছোট নৌকা করে মাছ ধরছে, বড় বড় ট্রলারে করে সব নিয়ে যাচ্ছে। দেখতে বড় আকর্ষণীয় ।

সবাই বড় বড় মটকি ভরে মিঠা পানি নিয়ে আসে। শুধু জেলেরাই নয়, মাঝি, জোংড়াখুটা, বাওয়ালী ও মৌয়াল যারা সারা বছর ধরে শত শত মাইল বিস্তৃত সুন্দরবনে কাজ করে তারা সবাই খাবার পানি সঙ্গে নিয়ে আসে। কারণ সুন্দরবনের সব নদীর পানিই লোনা–পানের অযোগ্য। নিতান্ত বিপদে আপদে চর খুঁড়লে কিছু মিঠা পানি পাওয়া যায়, কিন্তু সে পানির জন্যে কেউ সময় নষ্ট করে না বা তা যথেষ্টও নয় ।

দুবলার চরের জেলেদের কাজ তদারক করার জন্যে, এবং জেলেদের কাছ থেকে নির্ধারিত কর আদায়ের জন্যে বন দফতর সেখানে চার মাসের অস্থায়ী অফিস করে। একটি বড় ভাসমান বোটের মধ্যেই সেই অফিস, সেখানে একজন কর্মকর্তা আর অন্যান্য কর্মচারীগণ থাকেন। সুন্দরবনের এই দক্ষিণের চর অঞ্চলেই ফোঁটা হরিণ সবচেয়ে বেশী দেখা যায় খুব ভোরে আর ভরসন্ধ্যায় শত শত সুন্দর হরিণ যখন একসঙ্গে জড়ো হয় তখন সে দৃশ্যের তুলনা হয় না। আবার সুন্দরবনের যে ময়াল বা অজগর সাপের কথা সবাই জানেন সেই বিশাল আকারের ময়ালও এই চর এলাকায়ই বেশী বাস করে। এক একটা এক মণ, দেড় মণ পর্যন্ত ওজনের হয় এবং ইঁদুর, খরগোশ ও ছোট আকারের শূয়োর বা হরিণ আস্ত গিলে ফেলে। সুযোগ পেলে মানুষকেও আক্রমণ করে।

নদীতে ও সাগরে বড় ভয় দুইটির, কামোট ও কুমীরের। কেউ গোসল করতে কি কোন কাজে পানিতে নেমেছে, হঠাৎ পায়ে তীক্ষ্ণ খোঁচা লাগল, সেই পায়ে আর ভর করতে পারে না। হাতে খোঁচা লাগল, সেই হাতে আর বল পায় না, কামোট বা হাঙরে নিয়ে গেছে। প্রত্যেক বছর সমগ্র সুন্দরবন এলাকায় বহু লোক কামোটের দাঁতে হাত-পা হারায়। কুমীরের পেটেও যায় পাঁচ-দশজন। কুমীর কমোটের মত হাত-পা কেটে নেয় না, পানি থেকে গোটা মানুষই ধরে নিয়ে টুকরা টুকরা করে খেয়ে ফেলে। বাঘ একজন মানুষ খায় দুই দিনে কিন্তু কুমীর পরের দিনের জন্যে কিছু রাখে না। সুন্দরবনের সব কুমীরই মানুষ খায়।

পৃষ্ঠা ২৬

কিন্তু চর এলাকার শুধু চর এলাকার নয়, সমগ্র সুন্দরবন এলাকারই-জেলেদের সবচেয়ে বড় শত্রু হল বাঘ। কারণ সাবধান সচেতন থাকলে তারা কামোট-কুমীরের মুখ থেকে বাঁচতে পারে, কিন্তু বাঘের মুখ থেকে নয় বাঘ থাকে বনে-বনের সর্বত্র তার বিচরণ, তার মুখ থেকে বাঁচার উপায় নেই। দুবলার চর এবং সুন্দরবনের অন্যান্য চরগুলো আসলে এক একটি ছোট ব-দ্বীপ সবগুলোই বনজঙ্গলে ঢাকা। জঙ্গল কোথাও গভীর একেবারে দুর্ভেদ্য ও অগম্য, আবার জায়গায় জায়গায় কিছুটা ফাঁকা। বাংলা ১৩৫৮ সালের অগ্রহায়ণের শেষাশেষি এই চরে যখন একটি মানুষখেকো বাঘের উপদ্রব হয় তখন এখানে অন্ততঃ দুই হাজার হিন্দু-মুসলমান মগ জেলে মাছ ধরছিল । বাঘের বিরুদ্ধে সেই হতভাগ্যদের আত্মরক্ষার কোন ব্যবস্থাই ছিল না বলে মানুষখেকোটি একের পর এক জেলেকে নিয়ে যেতে থাকে।

বন কর্মকর্তা ও শিকারীগণ বোট নিয়ে, নৌকা নিয়ে জেলেদের বস্তির কাছাকাছি জঙ্গলে গিয়ে বাঘ মারার চেষ্টা করেন, কিন্তু ধূর্ত বাঘের ভয়ঙ্করতা তাঁদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়, মানুষখেকো হলে তখন বাঘের ধূর্তামিও অনেক বেড়ে যায়। কিছুদূর পরে পরে জেলে বসতি, চারদিকেই জঙ্গল; অসহায় জেলেদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শিকারীগণের প্রহরা ও অনুসন্ধান সত্ত্বেও এই মানুষখেকোটি দুবলার চরে মাত্র এক মাস সময়ের মধ্যে যে তেরজন জেলেকে ধরে খেয়েছিল আমি তাদের মধ্যে দুই-তিনটির সাধারণ উল্লেখ করব।

দশ-পনের হাত দূরে দূরে চারজন জেলে দাও দিয়ে গরানের চারা কাটছিল। খটি বা চালাঘর থেকে তারা তখন মাত্র শ-খানেক হাত দূরে এবং বেলা আন্দাজ আটটা । হঠাৎ একপাশ থেকে বাঘ গর্জন করে একজনের উপরে লাফ দিয়ে পড়ে, মাথায় কামড় দিয়ে ধরে মুখে তুলে নিয়ে যেতে থাকে। সঙ্গী জেলেরা প্রথমে মাটিতে শুয়ে পড়েছিল, কিন্তু চোখের সামনে তাকে নিয়ে যাচ্ছে দেখে কিছুক্ষণের মধ্যে সাহস ফিরে পায়। তারা চীৎকার করতে থাকে, অল্পক্ষণের মধ্যে লাঠিবাড়ি নিয়ে আরো কয়েকজন আসে। সকলে মিলে হৈ-চৈ করতে করতে জঙ্গলে এগুতে থাকে। প্রায় শ দুই হাত দূরে গিয়ে এক ঝোপের পিছন থেকে তারা হতভাগ্যের লাশ উদ্ধার করে আনে। এ ছিল হিন্দু, চরেই তার মৃতদেহের সৎকার করা হয় ।

জেলেরা গরান গাছ কাটে কষের জন্যে। সরু সরু গরানের ছাল টুকরা টুকরা করে জ্বাল দিয়ে যে কষ পাওয়া যায় তা তারা জালে লাগায়, শুকালে জাল মজবুত হয়। বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গার জেলেরা গাবের কষ দেয়, সুন্দরবনে গাব গাছ নেই। চরের জেলেরা যে বাঘের মুখে যায় তাদের অনেকেই এই গরান গাছ কাটার সময়ে সেই ঘটনার ঠিক পরের দিন। গরান গাছ কেটে বিকাল বেলা দুই জনে মুগুর দিয়ে পিটিয়ে ডাল থেকে ছাল আলগা করছিল। জায়গাটা তাদের চালাঘর থেকে খুব বেশী দূরে নয়। খালের পাড়ে জঙ্গল, তারই এক প্রান্তে দুইজন সামনা সামনি এবং অপেক্ষাকৃত খোলা জায়গাতে বসা ছিল। হঠাৎ পিছন থেকে এসে বাঘ একজনকে ধরে। জেলের ঘাড়ে-মাথায় কামড় দিয়ে ধরে দুইটা ঝট্কা মারে এবং ভয়ে আধমরা দ্বিতীয় জেলের সামনেই তাকে নিয়ে জঙ্গলে চলে যায়। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দ্বিতীয় জেলে দৌড় দেয়, ঘরের ভিতরে গেলে তবে তার মুখ থেকে চীৎকার বের হয় এবং সকলকে সে মর্মন্তুদ ঘটনার কথা জানাতে সক্ষম হয়।

পৃষ্ঠা ২৭

বিশ-পঁচিশজন লোক হৈ-চৈ করতে করতে জেলেকে উদ্ধার করতে রওনা হয়। কিন্তু তখন বেলা পড়ে গেছে, জঙ্গলের ভিতরে বেশীদূর এগুনো সম্ভব হয়নি। অগত্যা তারা সেদিনের মত ফিরে আসে। সকালে প্রায় পঞ্চাশ-ষাটজন রওনা হয়। কুড়াল, দা, লাঠি, কাঠ যার যা ছিল সঙ্গে নিয়ে চলল। বাঘের পারা, রক্তের চিহ্ন ধরে জঙ্গলের ভিতরে প্রায় সিকি মাইল যেতেই হঠাৎ বাঘের গর্! গর্! চাপা গর্জন শুনতে পায়, আর তাদের পক্ষে সামনে এগুনো সম্ভব হয়নি। এই জেলের লাশ বা হাড়-গোড় আর কেউ আনতে যায়নি; এ ছিল মুসলমান।

রাত্রে ভাত খেয়ে একজন জেলে পিছনের খটিতে তার এক আত্মীয়কে দেখতে যায় ৷ এটা কোনো অস্বাভাবিক কিছু নয় । জেলেদের খটি বা চালাঘরগুলো কোন কোন এলাকাতে বেশ ঘন ঘন থাকে এবং একটি থেকে হয়ত বা পাঁচ-ছয় বিঘা জায়গা পরেই আরেকটি চালাঘর। সারাদিন তারা নদীতে ও সাগরে মাছ ধরে, শুঁটকি করে, জাল শুকায়, তখন কর্মব্যস্ততার দরুন আত্মীয়-স্বজনের ভাল-মন্দের খবর নেওয়া সম্ভব হয় না; রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পরেই কেবল তাদের জীবনে সামাজিক সম্পর্ক রক্ষার সুযোগ এই জেলের খটি থেকে মাত্র কয়েক শ হাত হালকা জঙ্গল পার হলেই অপর খটি, সেখানে তার আত্মীয় থাকে। বের হয়ে যাওয়ার পর রাত্রে সে আর ঘরে ফিরেনি। তাদের ঘরের অন্য সবার মনে সন্দেহ হয়–স্বভাবতঃই যে, মাত্র ককেদিনের মধ্যে এই চরের আটজন মানুষকে বাঘে নিয়ে গেছে। অবশ্য তারা কেউ কোন বাঘের গর্জন শুনতে পায়নি ।

সন্দেহ আর ভয়ের মধ্যে দীর্ঘ রাত পার হয়। সকাল বেলা কয়েকজন মিলে পিছনের খটিতে খবর নিতে যায়, আধা রাস্তায় যেতেই তারা বাঘের পারা আর রক্ত দেখতে পায়। চীৎকার করে ডাকাডাকিতে দুই খটির জেলেরা সকলে সেখানে জড় হয় এবং ঘটনা বুঝতে পারে। তারা স্থির করে যে শুধু নিরস্ত্র অবস্থায় জঙ্গলে না ঢুকে বন অফিসের বোটের একজন শিকারীকে সঙ্গে নিয়ে যাবে, নতুবা মৃতদেহ উদ্ধার করে আনতে যারা যাবে তাদের মধ্য থেকে আরো একজন না একজন বাঘের মুখে পড়বে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বোট থেকে দুইজন শিকারীকে গিয়ে নিয়ে আসা হয়। তাঁদের পিছনে পিছনে বেশ অনেক লোক সিকি মাইলের মত জঙ্গল পার হয়ে গিয়ে এক আঁটো জায়গাতে লাশ পায় ! অর্ধেকই খেয়ে ফেলেছে। জেলেরা সেই আধা-খাওয়া দেহ এনে জানাজা পড়ে চালাঘরের সামনেই মাটি দেয়, শিকারী দুইজন সন্ধ্যা পর্যন্ত দুবলার জঙ্গলে বাঘের ব্যর্থ সন্ধান করেন।

মাত্র এক মাসের মধ্যে দুবলার চরের তেরজন জেলে অসহায়ভাবে বাঘের মুখে গেল। বন দফতরে নিযুক্ত শিকারীগণ, বোটের ফরেস্টার, বনপ্রহরী এবং ভাড়া করে আনা শিকারী সেই সময়ের মধ্যে বাঘের কোন মোকাবিলা করতে পারলেন না। কেউ একটি গুলি করার সুযোগও পাননি। কোন কোন দেহ জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে সৎকার বা কবর দেওয়া গিয়েছিল কোনটা তাও পারা যায়নি। দুবলার জেলেদের অনেকেই যেহেতু সুদূর চট্টগ্রাম এলাকা থেকে আগত তাই কারো মৃত্যু হলে তাকে আর বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না, চরেই পোড়াতে হয় বা কবর দিতে হয় দ্বীপের অবস্থা অতি শোচনীয় পর্যায়ে গিয়ে পৌছায়। জেলেরা যে কোথাও যাবে সে উপায় নেই, আবার মানুষখেকো বাঘের কিছু যে করবে সেই শক্তিও নেই। বোটের শিকারীগণ যথাসাধ্য চেষ্টা করেও প্রাণহানি রোধ করতে পারলেন না।

পৃষ্ঠা ২৮

দুবলার অস্থায়ী বোট অফিসের দায়িত্বে তখন ছিলেন রেঞ্জার কাজী করীম সাহেব দিন দিনই অবস্থা বেশী শোচনীয় হচ্ছে এবং সকলের আয়ত্বের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে তিনি আর স্থানীয় শিকারীগণের উপরে নির্ভর করে থাকতে পারলেন না। নিজেই লঞ্চ নিয়ে দীর্ঘ নদীপথ পার হয়ে আমার গ্রামের বাড়ী সোরাতে এসে উঠলেন। দুবলা হল। সুন্দরবনের সর্বদক্ষিণ প্রান্তে সমুদ্রের কিনারায়, আর আমার বাড়ী হল বনের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে ।

হাজার হাজার জেলের অসহায় অবস্থা, ধূর্ত নরখাদকের ভয়ঙ্করতা এবং প্রাণনাশের ঘটনাগুলো কাজী সাহেবের মুখ থেকে শোনার পরে আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। তখনো আমি বন দফতরে চাকরী নিইনি, পেশাদার বাঘ শিকারীরূপে বন বিভাগের স্বীকৃতিপত্র নিয়ে বনে গিয়ে শিকার করে থাকি। কিন্তু ঘটনাগুলো শোনার পরমুহূর্তের চেতনাবোধহেতু লঞ্চের ইঞ্জিন ঠাণ্ডা হবার আগেই আবার চালু করতে হল; নিজেদের কোন একজনকে সঙ্গী হিসাবে না নিয়েই আমি তৎক্ষণাৎ লঞ্চে উঠে বসলাম। আমার স্ত্রী আপত্তি করলেন এবং বলতে পারব না কেন, আমার মা ক্ষ্যান্ত বিবি, যিনি সুন্দরবনের দুর্জয় সাহসী, স্বনামধন্য বাঘ শিকারী মেহের গাজীর সংসার করেছেন, সেই মা-ও বললেন, ‘এখন যেয়ো না’। কিন্তু তাঁদের বাধা ঠেলেই আমি দুবলা রওনা হয়ে গেলাম; এবং তারপর সেখান থেকে যে আতঙ্কজনক অভিজ্ঞতা নিয়ে আবার বাড়ীতে ফিরে এলাম তা, ঘটনার এতদিন পরে, আজও মাঝে মাঝে আমার মনে জাগে এবং আমি যেন শুধু দুঃস্বপ্ন দেখতে থাকি৷

বাড়ী থেকে সন্ধ্যার পরে পরে রওনা হয়ে পরদিন সকাল সাতটায় আমরা দুবলা গিয়ে পৌঁছলাম । চরের অস্থায়ী অফিস আমাকে সকল রকম সুযোগ-সুবিধা দিল; একটি বড় বোট, সঙ্গে মজবুত ডিঙি, তিনজন বোটম্যান বা বনমাঝি এবং আরো একজন পাহারাদার, আর সকলের জন্যে যথেষ্ট খাবার। বিপদের মোকাবিলার জন্যে সুন্দরবনের সকল বন অফিসেই বন্দুক থাকে, দুবলার চরের ভাসমান অফিসেও ছিল। যে বন্দুক তাঁরা আমকে দিয়েছিলেন তা ছিল একটি দোনলা বেলজিয়াম। আগের দিনই বন অফিসে খবর পৌঁছেছিল যে মানিকখালীতে একজন জেলেকে বাঘে নিয়ে গেছে। কাজেই দুবলার অস্থায়ী বন অফিসের বোটে একবেলার বেশী দেরী করলাম না। জেলের দেহাবশেষ উদ্ধার করার এবং একটা সম্ভাব্য সুযোগের আশায় আমরা রওনা হলাম।

বিকাল তিনটায় দুবলা থেকে বোট ছেড়ে রাত বারোটায় মানিকখালী গিয়ে পৌছলাম। বাকী রাতটা বোটেই আধা-ঘুমা আধা-জাগা অবস্থায় কাটিয়ে দিলাম এবং সকাল সাতটার মধ্যেই নাশ্তা করে একটি ডিঙি নিয়ে বের হয়ে গেলাম, দুইজন বোটম্যান ডিঙি বাইতে লাগল আর মাঝখানে বন্দুক হাতে বসলাম আমি মানিকখালীর জেলেদের জিজ্ঞেস করে সঠিক জায়গা চিনে নিলাম যে কোনখান থেকে দুইদিন আগে গরান গাছ কাটার সময়ে জেলেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। জেলেদের কাছেই শোনলাম যে, ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যে তারা সবাই তাকে উদ্ধার করে আনতে গিয়েছিল, কিন্তু জঙ্গলের ভিতরে কিছুদূর যেতেই এক ঝোপের পিছন থেকে গভীর গর্! গর্! শব্দ শুনতে পায় এবং তখন সবাই প্রাণভয়ে ফিরে আসে। পঞ্চাশ-ষাটজন লোকের হৈ-চৈকেও বাঘ ভয় করে না এবং মুখের শিকার না খেয়ে সে ছাড়বে না জেলের দেহ আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি ।

সাধারণ বাঘ মানুষকে ভয় পায়, সামনে দেখলে বিদ্যুৎবেগে ছুটে পালায়। কিন্তু মানুষখেকো হলে তখন সেই বাঘের আর ভয় থাকে না, পাঁচ-দশজনের মধ্যে একজনকে আক্রমণ করে বসে, এমন কি সাঁতার কেটে নৌকায় উঠে ঘুমন্ত জেলে মাঝিদের পর্যন্ত মুখে তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু অর্ধভুক্ত দেহ উদ্ধার করতে আসা পঞ্চাশজনের উদ্ধারকারী দলকে গর্! গর্! ডাক দিয়ে ভয় দেখিয়ে পিছিয়ে দেওয়া এমন কি মানুষখেকো বাঘের জন্যেও অস্বাভাবিক ।

পৃষ্ঠা ২৯

গত একমাসে এই বাঘ গড়ে প্রতি তিন দিনে একজন করে মানুষ খেয়েছে; দুইদিন আগে ধরা শিকার নিশ্চয়ই এর মধ্যে সে খেয়ে ফেলেছে এবং আজ অবশ্যই খাবারের অন্বেষণে বের হবে; জেলেদের মধ্যে যারা জাল নিয়ে গাঙে ও সাগরে গেছে তারা নিরাপদ, যারা চালাঘরে কাজ করছে—শুঁটকি দিচ্ছে বা খোলা যায়গাতে বসে জালে কষ লাগাচ্ছে তারাও কিছুটা নিরাপদ; কিন্তু যারা গরান গাছ কাটতে বের হয়েছে তাদেরই বেশী ভয় ৷

আমি স্থির করলাম, দুইদিন আগে গরান গাছ কাটার সময়ে যেখান থেকে জেলেকে নিয়ে গেছে আগে সেখানে যাব, মরির যদি কিছুমাত্রও থাকে তবে—যদিও সে সম্ভাবনা কম—তাহলে মরির উপরেই আগে বসব। জেলেরা আমাদেরকে যে জায়গাটা দেখিয়ে দিল সেটা আমাদের বোট থেকে আধ মাইল.হবে না, খালের উল্টাপাড়ে। পাড় সেখানে সামান্য উঁচু এবং একবারে কিনারা থেকেই গভীর বন। মিনিট বিশেকের মধ্যে আমরা ডিঙি নিয়ে সেই স্থানে পৌছলাম।

গত দুইদিন বৃষ্টি হয়নি, সুন্দরবনে শীতকালেও মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়—কাজেই রক্তের চিহ্ন নিশ্চয়ই মুছে যায়নি, বাঘের পারাও থেকে থাকবে-যদিও পঞ্চাশজন লোক সেখান দিয়ে হেঁটে গেছে—তাই উদ্ধারকারী দল যেখান দিয়ে এগিয়েছিল সেই চিহ্ন ধরতে আমার অসুবিধা হবে না। পাছার মাঝি ডিঙি ঘুরিয়ে পাড়ে লাগাল আর বন্দুকের দুই নলে টোটা ভরে আমি লাফ দিয়ে টানে উঠলাম।

জঙ্গলের কিনারায় পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঘ আমাকে আক্রমণ করল। ‘হুঙ্ক!’ গর্জন শোনার আগেই কি শক্তিবলে যে আমি দুই হাত পিছনে সরে এসেছিলাম তা বলতে পারব না, বাঘ ঠিক আমার দুই হাত সামনে পড়েই গা-গা করে পিছনের দুই পায়ের উপরে খাড়া হয়ে উঠল, হাতের আন্দাজে নিশানা করে ট্রিগার টানলাম, কিন্তু গুলি ছুটল না। তখন বিকট হা মেলে গাঁ-গা করতে করতে বাঘ আমার মাথা লক্ষ্য করল। আমি বন্দুকের নল বাঘের ব্যাদান করা মুখের বরাবর ধরে ট্রিগার টানতে লাগলাম, কিন্তু গুলি ছুটল না! গুলি ছুটল না! গুলি ছুটল না! গলা ফাটিয়ে চীৎকার করতে লাগলাম। বাঘ হঃ! হঃ! ডাক ছেড়ে আমাকে কামড়ে ধরতে এল, বাঘের মুখের লালা আমার গায়ে আর মুখে ছিটকে পড়তে লাগল। চারটি ভয়ঙ্কর দাঁত আর গোঁফ যেন আমার হাতে লাগল। বন্দুকের নল তার দাঁত-মুখ বরাবর ধরে আমি বাঘের পাল্টা হাঁক ছাড়তে লাগলাম আর লাফিয়ে লাফিয়ে পিছে হঠতে লাগলাম! লালায় আমার শরীর ভরে গেল। একদলা ফেনা নাকে আর কপালে এসে ছিটকে পড়ল, সরাতে পারলাম না। আবার হঃ! হঃ! করে বাঘ তার বিশাল শরীরটা ঝাঁকাতে লাগল। আমার মনে হল গোটা দুনিয়া যেন থর্ থর্ করে কাঁপছে, আমি জমিনের নীচে চলে যাচ্ছি, মনে হল আমার শরীরটা নেই, আত্মা যেন হাড়ের সঙ্গে লেগে আছে। বাঘ আবার হঃ! হঃ! করে উঠতেই একসঙ্গে একদলা লালা ছিটকে এল, আমি আবার নিজের শরীরটা বোধ করলাম । হাঃ! হাঃ! যাঃ! যাঃ! ডাক ছেড়ে বন্দুকের নল একেবারে মুখের হা বরাবর ঠেলে দিলাম। বাঘ তার শরীর পিছনে সঙ্কুচিত করল, আমি একপাশে সরে যেতেই খালের পানিতে পা পড়ল, লাফ দিয়ে খালে পড়ে ডুব দিলাম ।

মাথা তুলতে দেখি খালের চারভাগের তিনভাগ পার হয়ে গেছি, আরেক ডুবে পাড়ে পৌছলাম । উঠে ছুটে কয়েক হাত দূরে একটা গাছের গোড়ায় গিয়ে পিছনে তাকালাম, দেখি বাঘ লাফ দিয়ে পানিতে যে পড়েছিল এখন গোঁ গোঁ করতে করতে আবার পাড়ে উঠছে। বন্দুকের টোটা খুলে পকেট থেকে অন্য দুইটি ভিজা টোটা ভরে বাঘের বুক বরাবর নিশানা করে আবার ট্রিগার টানলাম কিন্তু তবু গুলি ছুটল না। বেলজিয়াম বন্দুক, কিন্তু সেই বন্দুকটা ভাল ছিল না। ওপারে বাঘ পানি থেকে পাড়ে উঠে কয়েকবারই আমার দিকে তাকিয়ে মুখ খিঁচাল, তারপর জঙ্গলে ঢুকে গেল। জঙ্গলাকীর্ণ একেবারে জনশূন্য চর, পিছনে দেখতে দেখতে বেহুঁশের মত ছুটলাম আর এতক্ষণে দুই চোখ ফেটে পানি এল আমার।

পৃষ্ঠা ৩০

পাড়ে বাঘের গর্জন শোনামাত্র বোটম্যান দুইজন আমাকে ফেলে ডিঙি ভাসিয়ে দিয়ে নিজেদের প্রাণ দুইটি নিয়ে তাড়াতাড়ি বোটে চলে এসেছিল। আমি বাঘের মুখ থেকে রক্ষা পেয়ে চর পার হয়ে বেহুঁশের মত ছুটে গিয়ে যখন বোটে উঠব ঠিক সেই মুহূর্তেও তারা অন্যদের কাছে বর্ণনা করছিল যে কেমন করে হঠাৎ বাঘ আমার উপরে লাফ দিয়ে পড়ে আমার মাথাটা গিলে ফেলে এবং আরপর আমার শরীরটা এক ঝটকায় পিঠে তুলে নিয়ে জঙ্গলের ভিতরে চলে যায়; তারা কোন সাহায্য করারই সুযোগ পায়নি।

আমি বন্দুক হাতে বোটের গলুইয়ে পা দিতেই বোটটা দুলে উঠল আর ভিতরে ওরা ‘বাবা গো, খেয়ে ফেলল!’ বলে আর্তনাদ করে উঠল। ভাবল, যে-সঙ্গীকে বাঘের মুখে ফেলে পালিয়ে এসেছে সেই পচাব্দী গাজীকে খেয়ে বাঘ এবার অবশ্যই তাদেরকে খাবার জন্যে লাফ দিয়ে বোটে উঠেছে। আমি পর পর পাঁচ গেলাস পানি খেলাম, কথা বলতে পারলাম না, বন্দুকটা ফেলে পাটাতনের উপরেই শুয়ে পড়লাম। সারা শরীর থর্ থর্ করে কাঁপতে লাগল ।

সেইদিনই আমি দুবলার অস্থায়ী বন অফিসে ফিরে গিয়ে অকেজো বন্দুকটি জমা দিলাম এবং বাঘ শিকার করতে অস্বীকার করলাম। বোটের রেঞ্জার কাজী সাহেবসমেত সবাই আমার অভিজ্ঞতার কাহিনী শুনে ভয়ে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। কিন্তু অবস্থা বিবেচনা করে আবার বললেন যে বন্দুক আরো রয়েছে এবং আমি চলে যাওয়ার অর্থ হবে দুবলার চরের হতভাগ্য জেলেদেরকে মানুষখেকোর মুখের খোরাক করেই রেখে যাওয়া। তাঁরা অনেক আশা করেই আমাকে বাড়ী থেকে আনিয়েছিলেন; আর বাঘ শিকার করতে এসে বিখ্যাত মেহের গাজীর ছেলে পচাব্দী গাজী বাঘের মুখে পড়েছিল, অতঃপর প্রাণভয়ে বাড়ী চলে গেছে, এই কথাটি প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে দুবলার চরের হাজার হাজার জেলের মধ্যে একেবারেই অবশ কর্মহীনতা সৃষ্টি হয়ে যাবে। কিন্তু তাঁদের কথা বিবেচনা করার মত মানসিক অবস্থা তখন আর আমার ছিল না। বললাম, ‘বাড়ী যাই, যদি বাঘ শিকার করতে হয় তবে আমার নিজের লোক সঙ্গে নিয়ে এসে করব।’

দুবলার চর থেকে একটি মাছের নৌকা করে সেই রাত্রেই আমি খুলনা গেলাম এবং সেখান থেকে লঞ্চে করে পরদিন বিকালে আমার বাড়ী শ্যামনগর থানার সোরা গ্রামে পৌছলাম । পরের বারোদিন বাড়ীতে মা, স্ত্রী-ছেলেমেয়ে ও অনেক আপনজনের মাঝে বেশ হাসিখুশীতেই কাটালাম। ততদিনে মনের আতঙ্ক ও অস্বাভাবিকতা অতিক্রম করে আবার মজবুত হয়ে উঠলাম। কিন্তু তারপরেই আবার দুবলার চরের হাজার হাজার অসহায় মানুষদের কথা মনে করে আমি কেমন যেন অস্থির হয়ে পড়লাম দিনরাত কাদের যেন ডাক, কাদের যেন আর্তনাদ, হাহাকার আমাকে অস্থির করে তুলল ।

আমরা শিকারী বংশের মানুষ, যত ছোটই হই না কেন ভয়ঙ্কর মানুষখেকোকে সামনা সামনি মোকাবিলা করে বনের জেলে-বাওয়ালীদের রক্ষা করার গৌরব আমাদের রক্তে মিশে আছে। আমার দাদার ভাই দাদা, শিকারী ইসমাইল গাজী বাঘের মুখে প্রাণ দিয়েছিলেন, আমার বিখ্যাত বাবা, শিকারী মেহের গাজী পঞ্চাশটির বেশী বাঘ মেরে বাঘের কামড়ে মারা যান, আমার চাচা নিজাম্দী গাজীর একটা হাত বাঘে নিয়ে গেছে। যত ধূর্ত, যত ভয়ঙ্করই হোক না কেন, বাঘের কাছে আমি হার মানতে পারি না। সুন্দরবনের যেখানে মানুষখেকো বাঘ সেখানেই আমাদের ঠিকানা।

পৃষ্ঠা ৩১

এবারে মা ‘না’ বললেন না, স্ত্রীও কিছু বললেন না; ছোট ভাই হাশেম আলীকে আর শ্যালককে সঙ্গে নিয়ে আমার নিজের নৌকা করে আবার দুবলার ভাসমান বন অফিসের বোটে গিয়ে হাজির হলাম। কাজী করীম সাহেবের, বন বিভাগের অন্যান্য কর্মকর্তা ও লোকজনদের খুশীর আর শেষ রইল না। তাঁরা যেন জানতেন যে আমি আবার সেখানে যাব এবং মানুষখেকোকে শেষ পর্যন্ত আমিই মারব। কয়েকটা বন্দুকই এগিয়ে দিলেন, আমার যেটা পছন্দ । আমি আরেকটা দোনলা বেলজিয়াম বন্দুকই নিলাম, দুইটি কার্তুজ ভরে এবার আগেই শূন্যে গুলি করে দেখে নিলাম।

সেই বারোদিনে আরো দুইজন বাঘের মুখে গেছে। জেলেরা এমনি সাহস হারিয়ে ফেলেছে যে অনেকে মিলে গিয়ে যে উদ্ধার করে আনবে তাও করতে পারেনি। এর মধ্যে অন্যান্য শিকারীগণও চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কেউ বাঘকে গুলি করার সুযোগ পাননি পরবর্তী তিনদিন ধরে আমরা তিনজনে ডিঙি নিয়ে সন্ধান করতে থাকলাম। সারাদিন খালে খালে, বনের ধারে, বনের ভিতরে বাঘের সন্ধান করলাম, কিন্তু বাঘ যদিও একেবারে নিশ্চিত সেই এলাকাতেই ছিল।

এর মধ্যে দুবলার চরের সকল জেলেদের বলে দেওয়া হল যে, কোনখানে কেউ বাঘ দেখলে, কি বাঘে কোথাও কাউকে আক্রমণ করলে তা যেন তৎক্ষণাৎ বন অফিসের বোটে বা আমকে জানানো হয়। দুইদিন এক রাতের মধ্যে কোনখান থেকে খবর পাওয়া গেল না বা আমরাও কোনখানে বাঘ দেখতে পেলাম না। কিন্তু আমি নিশ্চিত জানতাম যে কোনখানে কোন একজন জেলের অসাবধানতার সুযোগ এই মানুষখেকো বাঘ অবশ্যই নিবে; তাই আমাকে একটু ক্ষান্ত হলে চলবে না।

দেখলাম না, তৃতীয় দিনে বন অফিসের বোট থেকে আমরা তখন প্রায় দুই মাইল দূরে। আমার ভাই হাশেম আর শ্যালক-রাত প্রায় বারোটা পর্যন্ত সজাগ থেকে তারপর ছৈ-এর নীচে ঘুমাতে গেল। আমি অর্ধেক শরীর ছৈ-এর ভিতরে এবং অর্ধেক বাইরে হয়ে বসে সকাল পর্যন্ত একাই জেগে থাকব স্থির করলাম। তখন মাঘ মাসের শুরু, কিন্তু সমুদ্রের কাছাকাছি চর এলাকায় শীত খুব বেশী ছিল না। পুর্ণিমার তিন দিন বাকী ছিল বলে প্রায় সারা রাতই চাঁদের আলো থাকবে, সেই আলোতে অন্ততঃ চল্লিশ হাতের মধ্যেও বাঘ এলে আমি দেখতে পাব এবং আমার গুলি সম্ভবতঃ লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে না।

ফজরের ওয়াক্ত পর্যন্ত বনে শুয়োরের শব্দ পেলাম দুই-তিনবার, হরিণের ডাকও শোনলাম, কিন্তু সেগুলোর কোনটাকেই ভয়ার্ত ডাক বলে মনে হল না এবং সারা রাতের মধ্যে বাঘের কোন চিহ্নও দেখলাম না। পূবের আকাশ ফর্সা হলে তখন হাশেম আলী ও আমার শ্যালককে জাগালাম, হাশেমের হাতে বন্দুক দিয়ে নামাজ পড়লাম এবং শুধু ক্লান্তি নিয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম । সকাল আটটার সময়ে গরম ভাত খেয়ে আমরা আবার নৌকা ছাড়ব, এমন সময়ে দেখি একটি ডিঙি নৌকা খুব জোরে বেয়ে আমাদের দিকে আসছে। আমরা নৌকা কিনারায় ভিড়িয়ে একটু দেরী করলাম। ডিঙিতে তিনজন জেলে, তাদের মধ্যে একজন তরুণ যুবক, আমার সামনে খালের পাড়ে শুয়ে পড়ে হাউমাউ করে বলতে লাগল, ‘আমার ভাই ভালয়ে গেছে! আমার ভাই ভালয়ে গেছে!’ তার আর কোন কথাই বুঝা গেল না, শোকে, আঘাতে সে এমন হয়ে গেছে যে, বারবারই কেবল বলছে, ‘আমার ভাই ভালয়ে গেছে!’ তার সঙ্গী দুইজনের কাছ থেকে আমরা অতি দুঃখজনক ঘটনার বর্ণনা শোনলাম।

পৃষ্ঠা ৩২

মাত্র এক ঘন্টারও কম সময় আগে বাঘ যেখান থেকে একজন জেলেকে নিয়ে গেছে সে জায়গাটা আমাদের নৌকা থেকে আরো আধা মাইল এবং দুবলা বোট অফিস থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে। খটি থেকে কিছু দূরে তারা চারজন গরান গাছ কাটতে গিয়েছিল। অল্প কয়েকটিমাত্র চারা গাছ কাটতেই হঠাৎ একপাশ থেকে বাঘ একজনের উপরে লাফ দিয়ে পড়ে এবং তাকে মুখে নিয়ে জঙ্গলের ভিতরে চলে যায়। যে হতভাগ্য বাঘের মুখে গেছে সে এই ক্রন্দনরত যুবকের আপন বড় ভাই।

আমি বললাম, ‘বন অফিসে পরে যাবে, আগে চল ওকে নিয়ে আসি।’ দুই নৌকা করে আমরা তক্ষুণি রওনা হলাম এবং আধ ঘন্টার মধ্যেই ঘটনাস্থলে গিয়ে পৌছলাম। বাঘের হিংস্রতার এক মর্মান্তিক চিহ্ন দেখলাম। জঙ্গলের কিনারায়ই তারা গরান চারা কাটছিল। চারজন একই জায়গায় প্রায় পাশাপাশি ছিল, অর্থাৎ কেউ কারো থেকে বিচ্ছিন্ন বা দূরে নয়। দশ-পনের মিনিটমাত্র গাছ কাটতেই বাঘ একটা গর্জন করে জেলেকে ধরে এবং তার ঘাড়ে কামড় দিয়ে ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু জেলে তখনো মরেনি, গোঙাতে গোঙাতে হাত-পা আছড়াতে থাকে, একটা ছোট চারাগাছ সে আঁকড়ে ধরে। শিকার নড়াচড়া করছে দেখে হাত দশেক নিয়ে গিয়ে বাঘ তাকে মাটিতে থোয়, আবার ঘাড়ে গলায় কামড়ে ধরে দুইটা হ্যাচকা ঝাঁকুনি দিয়ে মেরে ফেলে, তারপর মুখে তুলে নিয়ে যায়। যেখানে বাঘ জেলেকে প্রথমে ধরেছিল সে জায়গায় রক্ত পড়েছিল আর হাত দশেক দূরে যেখানে নিয়ে কামড় ছেড়ে দিয়ে আবার ধরেছিল, যখন হতভাগ্যের মুখ থেকে একটা ‘ক্যাক!’ শব্দ হয়ে গোঙানি থেমে যায়, সেখানে অনেক রক্ত।

আমরা ছয়জন বাঘের পারা আর রক্ত দেখে দেখে এগুতে লাগলাম। কিছুদূর যেতেই তার কাপড় পেলাম-একটা চারা গাছের সঙ্গে আটকে আছে— তারপর আর মাত্র হাত পঞ্চাশেক যেতেই জেলেকে পেলাম, গরান বনের ভিতরে কতকটা খোলা জায়গাতেই পড়ে রয়েছে। পা দুইটি গুটানো, মাথাটা একদিকে কাত অবস্থায়, চোখ খোলা, যেন চেয়ে আছে; বাঘ কাছে ধারে আছে বলে মনে হল না। জেলের শরীর থেকে এক খাবলা গোশত খায়নি। এমন হতে পারে যে তার ভাইয়ের চীৎকারে বিরক্ত হয়ে শিকার এ পর্যন্ত এনে কাছেই কোথাও অপেক্ষা করছিল, এখন আমাদের আওয়াজ পেয়ে সরে গেছে। গত তিন দিনে বাঘ কোন মানুষ খায়নি, আজ নিশ্চয়ই খুব বেশী ক্ষুধার্ত হবে, কেবল নিরাপত্তার অভাবেই শিকার খেতে শুরু করেনি।

জেলের ভাই তক্ষুণি মৃতদেহ নিয়ে যেতে চাইল, কিন্তু আমি এবং বাকী সবাই বুঝিয়ে বলাতে সে আধাবেলার জন্যে রাখতে রাজী হল। সেই আধাবেলার মাঝেই গুলি করার একটা নিশ্চিত সুযোগ পাবে বলে আশা করলাম। বাঘ অবশ্যই বেশী দূরে কোথাও যায়নি, অতি ক্ষুধার্ত থাকাতে, একটু নিরিবিলি পেলে এই এখনিও আসতে পারে।

মরি থেকে প্রায় বিশ হাত সোজা পশ্চিমে একটা বিশাল বাইন গাছের আট-নয় হাত উপরে একটি ডাল মোটামুটি বসার উপযোগী ছিল, সেটাতেই উঠে বসলাম। আমার শ্যালক খালি হাতেই উঠে বসল গিয়ে আমার উপরের ডালে। হাশেম আলী তিনজন জেলেকে নিয়ে হাত ধরাধরি করে, জোরে কথা বলতে বলতে নৌকায় চলে গেল আমার শ্যালক প্রায় সোজা আমার মাথার উপরে আড়াল করে বসল, আর মাটি থেকে আট-নয় হাত উপরে মোটা ডালে পাতার আড়াল করে কাণ্ডের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে বসলাম আমি। আমার বন্দুকের দুই নলই ভরা। জেলের মৃতদেহ আমার গাছের গুড়ি থেকে প্রায় বিশ হাত পূবে। এখন বাঘ যেদিক থেকেই আসুক না কেন, যদি মরির কাছে আসে তাহলে আমার গুলি করতে কোন অসুবিধা হবে না। আর বাঘ যদি ইতিমধ্যেই আমাদের দুইজনকে দেখে ফেলে থাকে এবং না আসে তাহলে আমার আজকের প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হবে।

কিন্তু আসার সময়ে অতি ক্ষুধার্ত ও ক্রুদ্ধ বাঘ সম্ভবতঃ তার ফেলে যাওয়া শিকার ছাড়া আর কোন কিছুই খুব সাবধানতার সঙ্গে খেয়াল করবে না। আমরা যখন বাইন গাছে উঠে বসি তখন বেলা ছিল এগারটা-সাড়ে এগারটা। তার পর থেকে বেলা একটা পর্যন্ত আধা-অন্ধকার বনে প্রায় স্তব্ধ নীরবতা বিরাজ করতে লাগল, বাতাসে পাতা নড়া ছাড়া আর কোন শব্দও শুনতে পেলাম না। সকল সতর্কতার সঙ্গে আমি লক্ষ্য রাখতে থাকলাম। মাঝে মাঝে উপরে তাকাই, প্রতিবারেই আমার শ্যালক হাত নেড়ে বা মুখ নেড়ে ইঙ্গিত করে জানায় যে কিছু চোখে পড়েনি। স্তব্ধতার মধ্যে সময় কাটতে লাগল ।

পৃষ্ঠা ৩৩

হঠাৎ পাতার চড়ু চড়ু শব্দ শোনলাম, প্রায় একশ হাত দূরে পূব-দক্ষিণ দিকে। সারা জীবন সুন্দরবনে কাটিয়ে ওই গুরুত্বপূর্ণ ছোট্ট শব্দের সঙ্গে আমি অতি পরিচিত ছিলাম, দূরের ক্ষীণ আওয়াজ হলেও আমার মনে সন্দেহমাত্র রইল না যে, বাঘ এসেছে ৷ এর পরের পাঁচ মিনিট সময় ধরে উত্তেজনায় আমার শরীরের সব লোম খাড়া হয়ে রইল, কিন্তু মরি থেকে প্রায় ত্রিশ হাত দূরে ঝোপের ভিতর থেকে বাঘ যখন বের হয়ে এল তখন আমার আর সাহসের অভাব হল না।

এদিক সেদিক কোথাও না তাকিয়ে বাঘ দাপটের সঙ্গে মরির দিকে এগিয়ে এল, জেলের ঘাড় কামড়ে ধরে তুলে নিয়ে যাবার জন্যে মুখটা উঁচু করল, আর সেই মুহূর্তে আমি বুক বরাবর গুলি করলাম ‘হৌক্ক!’ করে ডাক ছেড়ে বাঘ লাফ দিয়ে উঠল, মুখ থেকে জেলের দেহ শূন্যে ছুটে অন্ততঃ দশ হাত দূরে গিয়ে পড়ল আর গুলির আঘাতে বিশাল বাঘটা পিছন দিকে মাটিতে পড়ে চার পা দাবড়াতে দাবড়াতে শরীরটা একদিকে ঠেলতে লাগল। হাত পাঁচ-ছয় সে রকম ঠেলে ঠেলে বাঘের মাথাটা যখন একটা ঝোপের ভিতরে চলে গেছে কিন্তু বাকী শরীর বাইরে—তখন কোমরে দ্বিতীয় গুলি লাগতেই মুখের গোঙানি আর চার পায়ের মাটি দাবড়ানি সব থেমে গেল। বিশাল বাঘটা পিছনের একটা পা শূন্যে তোলা অবস্থায় আধা-চীৎ আধা কাত হয়ে পড়ে রইল। আমি গাছ থেকে ‘আল্লা! আল্লা!’ বলে ডাক দিলাম, সঙ্গে সঙ্গে নৌকা থেকে হাশেম আলী ডাক দিল, ‘আল্লা! আল্লা! আল্লা! আল্লা! আল্লাহ!’

এক নৌকায় বাঘ আরেক নৌকায় জেলের দেহ নিয়ে বেলা আনুমানিক তিনটার সময়ে আমরা দুবলার চরের অস্থায়ী বন অফিসে বোটের কাছে পৌছলাম এবং নৌকা কিনারায় ভিড়ানোর আগে শূন্যে একটা গুলি করলাম। শোকাহত দীর্ঘদিনের আতঙ্কগ্রস্ত হাজার হাজার জেলে এই শূন্যে একটা গুলির জন্যেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ছিল, এক ঘন্টা সময়ের মধ্যে প্রায় এক হাজার জেলে এসে বাঘের চারদিকে জড় হল ।

সেদিন তারা কিছুতেই চামড়া ছোলাই করতে দিল না, তাই সারারাত বাঘ রাখতে হল বোটের সামনে চরে। চাঁদনী রাত ছিল, রাতভরই লোক আসতে লাগল। মানুষখেকো বাঘ মারা পড়েছে, এখন আর কোন ভয় নেই, দল বেঁধে এবং একজন একজন করেও চাঁদের আলোয় দুবলার চরের চারদিক থেকে জেলেরা কেবল আসতে লাগল। মাঘ মাসের সারারাত ধরে এমন চলল ৷ পরদিন সকালে সব লোকের উপস্থিতিতে বাঘের চামড়া ছাড়ানো হয়। সাড়ে দশ ফুট লম্বা বাঘের সামনের চারটা দাঁত ছিল না, অর্থাৎ মানুষখেকো ছিল বুড়া বাঘ।

হারানো আত্মীয়-স্বজন ও সঙ্গীর শোকে অনেক জেলেই তখন কান্নাকাটি করছিল। দুবলার চরের মানুষখোকোর ষোল নম্বর এবং শেষ শিকার ছিল যে জেলে, তার ভাই বারবারই শুধু বলছিল, ‘আমার ভাইকে মারলি, তুইও মরলি!’

বইয়ের পরবর্তী অংশ ওয়েবসাইটে আপলোড করা হবে শীঘ্রই। চোখ রাখুন Green Belt The Travelers ফেসবুক গ্রুপে।

প্রথম পর্ব: আঠারোবেকীর বাঘ – পর্ব ১
তৃতীয় পর্ব: গোলখালীর বিভীষিকা – পর্ব ৩

আরো পড়ুন

ঘূর্ণিঝড় সংকেত সমূহ ও এর মানে

ঘূর্ণিঝড় এর আগেই আবহাওয়া অধিদপ্তর ঘূর্ণিঝড়ের বিভিন্ন সতর্কতা সংকেত জারী করেন। স্থানীয় প্রশাসন থেকে ঘূর্ণিঝড় সতর্কতা সংকেত মাইকেও প্রচার করা হয়। এলাকাবাসীকে সতর্ক করার জন্য এটি করা হয়ে থাকে। আজকে আমরা জানবো কোন ঘূর্ণিঝড় সংকেত এর মানে কী। সমুদ্র বন্দরের ১১ টি সংকেতকে বিপদের মাত্রায় ৭ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো-  দূরবর্তী সতর্কসংকেত, দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত, স্থানীয় সতর্কসংকেত, স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত, বিপৎসংকেত, মহাবিপৎসংকেত ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন সংকেত। নদী বন্দরের জন্যও আছে ৪ টি নির্ধারিত সংকেত।

সমুদ্রবন্দর এর ১১টি সংকেত

১ নম্বর দূরবর্তী সতর্কসংকেত: বন্দর থেকে জাহাজ ছেড়ে যাওয়ার পর দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সম্মুখীন হতে পারে। দূরবর্তী কোনো এলাকায় ঝোড়ো হাওয়ার অঞ্চল রয়েছে। এ সময় বাতাসের গতিবেগ থাকে ঘণ্টায় ৬১ কিলোমিটার। ফলে সামুদ্রিক ঝড়ের সৃষ্টি হতে পারে।

২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত: এর অর্থ গভীর সাগরে একটি ঝড় সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে বাতাসের গতিবেগ আছে ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কিলোমিটার। এর জন্য বন্দর এখনই ঝড়ে কবলে পড়বে না। তবে বন্দর ছেড়ে যাওয়া জাহাজ পথে বিপদে পড়তে পারে।

৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত: বন্দরে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। বন্দর এবং বন্দরে নোঙর করা জাহাজগুলো দুর্যোগ কবলিত হতে পারে। বন্দরে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৪০-৫০ কিলোমিটার হতে পারে।

৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত: বন্দর ঘূর্ণিঝড়ে কবলিত। বাতাসের গতিবেগ ঘন্টায় ৫১ থেকে ৬০ কিলোমিটার হতে পারে। তবে ঘূর্ণিঝড়ে চূড়ান্ত রকমের প্রস্তুতি নেওয়ার মতো তেমন বিপজ্জনক সময় এখনো হয়নি।

৫ নম্বর বিপদসংকেত: এর অর্থ হলো ছোট বা মাঝারি আকারের এক তীব্র ঝড়ের কবলে পরবে বন্দর।  এসময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কিলোমিটার হতে পারে। ঝড়টি বন্দরকে বামে রেখে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।

৬ নম্বর বিপদসংকেত: এই সংকেতটি ৫ নম্বর সংকেতের মতোই। বন্দর ছোট বা মাঝারি ঝড়ের কবলে পড়বে। বাতাসের গতিবেগ থাকবে একটানা ঘন্টায় ৬২-৮৮ কিলোমিটার। ঝড়টি বন্দরকে ডান দিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।

৭ নম্বর বিপদসংকেত: এই ঝড়ের তীব্রতা ৫ ও ৬ নম্বর সংকেত এর মতোই। বন্দর ছোট বা মাঝারি ঝড়ের কবলে পড়বে। বাতাসের গতিবেগ থাকবে একটানা ঘন্টায় ৬২-৮৮ কিলোমিটার। ঝড়টি বন্দরের উপর দিয়ে বা কাছ দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।

৮ নম্বর মহাবিপদসংকেত: এই সংকেতের মানে বন্দর প্রচণ্ড তীব্রতার ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়তে পারে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিলোমিটার বা এর বেশি হতে পারে। প্রচণ্ড ঝড়টি বন্দরকে বাম দিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করবে।

৯ নম্বর মহাবিপদসংকেত: এই ঘূর্ণিঝড় সংকেত ৮ নাম্বার সংকেতের এর মতোই। বন্দর প্রচন্ড তীব্র ঘূর্ণিঝড় এর কবলে পড়তে পারে। এসময় বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ৮৯ কিলোমিটার বা এর বেশি হতে পারে। ঝড়টি বন্দরকে ডান দিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করবে।

১০ নম্বর মহাবিপদসংকেত: উপকূলের জন্য এই সংকেত ৮ ও ৯ নম্বর সংকেত এর মতোই। বন্দর প্রচন্ড তীব্র ঘূর্ণিঝড় এর কবলে পড়তে পারে। বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ৮৯ কিলোমিটার বা এর বেশি হতে পারে। ঝড়টি বন্দরের উপর দিয়ে বা খুব কাছ দিয়ে উপকূল অতিক্রম করবে।

১১ নম্বর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন সংকেত: এর অর্থ ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সাথে সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। এবং স্থানীয় আবহাওয়া কর্মকর্তার বিবেচনায় চরম প্রতিকূল আবহাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

অন্যান্য আর্টিকেল

ঘূর্ণিঝড়ে পতাকা উত্তোলন পদ্ধতি

ঘূর্ণিঝড় এর সময় বন্দর এবং উপকূলে পতাকা উত্তলোন করতে হয়। পতাকার মাধ্যমেই সবাই সতর্ক হবে বলে ধরে নেওয়া হয়। ১,২,৩,৪ নম্বর সিগন্যাল এর জন্য একটি পতাকা, ৫,৬,৭ নম্বর সিগন্যাল এর জন্য দুইটি পতাকা এবং ৮,৯,১০ নম্বর সিগন্যাল এর জন্য তিনটি পতাকা একই খুঁটির মধ্যে উত্তোলন করে ঘূর্ণিঝড় সংকেত দিতে হয়। নিচের ছবিতে দ্রষ্টব্য।

নদীবন্দরের চারটি সংকেত

১ নম্বর নৌ সতর্কতা সংকেত: বন্দর এলাকা ক্ষণস্থায়ী ঝোড়ো আবহাওয়ার কবলে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঘণ্টায় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ৬০ কিলোমিটার। এই সংকেত আবহাওয়ার অবস্থার ওপর সতর্ক নজর রাখতে বলে।

২ নম্বর নৌ হুঁশিয়ারি সংকেত: বন্দর এলাকায় নিম্নচাপের সমান তীব্রতার একটি ঝড়, এর গতিবেগ ঘণ্টায় অনূর্ধ্ব ৬১ কিলোমিটার বা একটি কালবৈশাখী, যার বাতাসের গতিবেগ ৬১ কিলোমিটার বা তদূর্ধ্ব। এর কবলে নৌযান পড়লে নিপতিত হওয়ার আশঙ্কা আছে। ৬৫ ফুট বা তার কম দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট নৌযানকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হবে।

৩ নম্বর নৌ বিপদসংকেত: বন্দর এলাকা ঝড়ে কবলিত। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ একটানা ৬২-৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত গতিবেগের একটি সামুদ্রিক ঝড় শিগগিরই বন্দর এলাকায় আঘাত হানতে পারে। এই ঘূর্ণিঝড় সংকেত এ সব নৌযানকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে।

৪ নম্বর নৌ মহাবিপদসংকেত: বন্দর এলাকা একটি প্রচণ্ড বা সর্বোচ্চ তীব্রতার সামুদ্রিক ঝড়ে কবলিত। এটি শিগগিরই বন্দর এলাকায় আঘাত হানবে। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিলোমিটার বা তদূর্ধ্ব। সব ধরনের নৌযানকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে হবে।

আরো পড়ুন

ভ্রমণ সম্পর্কিত আপডেট পেতে জয়েন করতে পারেন আমাদের নিয়মিত ট্রাভেল আড্ডার গ্রুপ Green Belt The Travelers এ।

সুন্দরবনের মানুষখেকো – পর্ব ১

সুন্দরবনের কোন এলাকায় মানুষখেকো বাঘের উপদ্রব হলে প্রথমে বন অফিসের লোকেরাই সেই বাঘ মারতে চেষ্টা করেন। বন-কর্মকর্তাগণের মধ্যে, এমন কি বনপ্রহরী, বনমাঝিদের মধ্যেও অনেকে আছেন যারা ভাল শিকারী। কিন্তু মারাত্মক মানুষখেকোর ক্ষেত্রে তখন আর এঁদের উপরে নির্ভর করা যায় না, পেশাদার এবং শক্ত স্নায়ুর অধিকারী সুকৌশলী শিকারীর প্রয়োজন হয় । সুন্দরবনের প্রান্তবর্তী গ্রামসমূহে কিছুসংখ্যক শিকারী পরিবার আছে, তাঁদের মধ্যে বন দফতরের অনুমোদনপ্রাপ্ত শিকারীগণ রয়েছেন, বন দফতর মানুষখেকো বাঘের উপর পুরস্কার ঘোষণা করে সেই শিকারীগণকে খবর দেয়, তখন তাঁরা গিয়ে বাঘ মারেন। পচাব্দী গাজী তেমনি এক নামকরা শিকারী বংশের সন্তান এবং আজ পর্যন্ত সুন্দরবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে গৌরবময় কৃতিত্বের অধিকারী শিকারী । তিনি জীবনে সাতান্নটা রয়াল বেঙ্গল বাঘ মেরেছেন, সেগুলোর মধ্যে একুশটাই ছিল ভয়ঙ্কর মানুষখোকো।

১৯৭২ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনে বাঘকে উপদ্রব বলে গণ্য করা হত। তখন অনুমোদনপ্রাপ্ত যে কোন শিকারী বাঘ মেরে চামড়া ও মাথার খুলি বন অফিসে জমা দিলে তাঁকে অর্থ পুরস্কার দেওয়া হত। ১৯৭৩ সালে জারীকৃত বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী বনে এখন সকল প্রকার প্রাণী শিকার নিষিদ্ধ, বন দফতর থেকে ‘মানুষখেকো’ বলে কাগজেপত্রে ঘোষণা করলে তবেই কেবল সেই বাঘ মারা যায়। পচাব্দী গাজীর শিকার জীবন ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত, যদিও আশির দশকের শেষভাগে তিনি আরো একটি বিখ্যাত মানুষখেকো বাঘ মেরেছেন। তিনি প্রথমে চাকরী করতেন না, পিতার মত স্বাধীনভাবে শিকার করতেন, পরে বিখ্যাত বন কর্মকর্তা জনাব আবদুল আলীম তাঁকে বন বিভাগের চাকরীতে নিয়ে আসেন। ফ্রান্স, জার্মানী, মধ্যপ্রাচ্য ও জাপানের পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশনে শিকারী পচাব্দী গাজীর কৃতিত্বের কাহিনী প্রচারিত হয়।

বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় সেবা প্রকাশণী থেকে ১৯৮০ সালে।  বিখ্যাত শিকারি পচাব্দী গাজীর জবানিতে বইটি লিখেছেন হুমায়ুন খান। বইয়ে ৭টি অনুচ্ছেদ আছে। ১. আঠারোবেকির বাঘ, ২. দুবলার চরের মানুষখেকো, ৩. গোলখালীর বিভীষিকা, ৪. সুন্দরবনের ভয়ঙ্কর, ৫. শিকারী জীবনের বিচ্ছিন্ন স্মৃতি, ৬. সুপতির মানুষখেকো, ৭. তালপট্টির বিভীষিকা।

আঠারবেকীর বাঘ

তেইশজন মানুষ খাওয়ার পরে এই ভয়ঙ্কর বাঘটা আমার হাতে মারা পরে। এটার কথা আমি সবার আগে বলব সাতক্ষীরা জিলার শ্যামনগর থানার অধিকাংশ এলাকাই সুন্দরবনের অন্তর্ভুক্ত। রায়মঙ্গল ও যমুনা নদী দুইটি শ্যামনগরের ভিতর দিয়ে বয়ে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে; দুই নদীর মাঝখানের মৌজাটির নাম আঠারবেকী। প্রায় বিশ মাইল লম্বা মৌজা, পুরাটাই বন আর বন। সুন্দরবন। অত্যন্ত ঘন গজানো গরান আর গেওয়া বন, তার সঙ্গে সুন্দরী, কাঁকড়া, কেওড়া, বাইন ও অন্যান্য গাছ। মাঝে মাঝে হুদো লতার জঙ্গল, আবার অতি দুর্ভেদ্য হেতাল ঝোপ-বাঘের প্রধান আস্তানা।

নদী থেকে বের হওয়া অসংখ্য ছোটবড় খালে মৌজাটি প্রায় জালের মত ছাওয়া। চব্বিশ ঘন্টায় দুইবার জোয়ার, দুইবার ভাটা হয়। জোয়ারকে আমরা সুন্দরবনের লোকেরা বলি ‘গোণ লেগেছে’, অর্থাৎ গ্রহণ লেগেছে। সে সময়ে খালগুলো কানায় কানায় ভরে যায়, পাড় ডুবে বনের ভিতরেও হাঁটু পানি হয়। আবার ভাটার টানে সেই পানি সব নেমে যায়, তখন ঝিঝিরা পানিতে পড়ে থাকে অসংখ্য ছোট-বড় লোনাপানির মাছ। সুন্দরবনের সব নদী ও খালের পানিই লোনা।

এক আঠারবেকী মৌজার মধ্যেই এ রকম অসংখ্য খাল রয়েছে-নদীতে পড়েছে, নদী থেকে উঠেছে। এগুলোর ধারে ধারে, নদীর কিনারে সুন্দরবনের বিখ্যাত গোলপাতার গাছ হয়। পাতা গোল নয়, হুবহু নারিকেল পাতার মত, আবার নারিকেল গাছের মত কাণ্ড হয় না, একেবারে গোড়া থেকেই পাতা গজায়। গোলপাতা দিয়ে ঘরের ছাউনি হয়, বেড়া হয়, নৌকার ছৈ হয় সাবেক খুলনা, যশোর, বরিশাল, পটুয়াখালী ও নোয়াখালী জিলার নীচু অঞ্চলের অধিকাংশ নিম্নবিত্ত মানুষের ঘরই গোলপাতা দিয়ে ছাওয়া। অনেক অবস্থাপন্ন গৃহস্থের ঘরেও এই ছাউনি থাকে, একেক ছাউনিতে সাত-আট বছর চলে যায়। সুন্দরবনের নদী খালের কিনারা থেকে যারা এই গোলপাতা কেটে আনে, দুর্গম বন এলাকা থেকে যারা কাঠের গুড়ি আর লাকড়ি কেটে আনে তাদেরকেই বলা হয় ‘বাওয়ালী । এরা নেহায়েত দরিদ্র শ্রমিক, পেটের দায়ে বনে গিয়ে কাজ করে কোনরকমে সংসার চালায়।

ইংরাজী ১৯৬৬ সালের ঘটনা। সকাল সাতটা-আটটার সময়ে ছয়জন বাওয়ালী দুই ডিঙি নৌকা করে আঠারবেকীতে গোলপাতা কাটতে যায়। খালের কিনারা জুড়ে একটানা বিস্তৃত গোলগাছের কাছে ডিঙি বেঁধে কিনারায় আধা কাদা আধা-মাটিতে নেমে গোলপাতা কাটছিল, কেউ কারো থেকে বেশী দূরে নয়। একজন বাওয়ালী দুইখানা ডগা কেটে মাটিতে রেখে তৃতীয়টির গোড়ায় দায়ের কোপ দিয়েছে, সেই মুহূর্তে বাম পাশ থেকে হুঙ্কার দিয়ে বাঘ তার উপরে পড়ে। ঘাড় কামড়ে ধরে বিড়াল যে রকম সহজে ইঁদুর নিয়ে যায় ঠিক তেমনি বাওয়ালীকে নিয়ে পিছনের জঙ্গলে চলে যায় ।

বাঘের ‘হুঙ্ক!’ গর্জন শুনেই পাঁচজন বাওয়ালীর আত্মা কেঁপে উঠে, দুইজন গোলগাছের উপড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। পুরা হুঁশ হলে পাচজনই উঠে সঙ্গী যেখানে পাতা কাটছিল সেই গাছটার কাছে যায়। তাকে বাঘে নিয়ে গেছে চোখেই দেখেছে, তবু বিশ্বাস হতে চায় না। তার দা গোলগাছের গোড়ায় পড়ে রয়েছে, তীরের মত রক্ত ছুটে গাছের পাতায় আর কাদাতে লেগেছে, গোলপাতার ধার বেয়ে নীচে পড়ছে । সংখ্যায় পাঁচজন ছিল বলে আর সকালবেলা বলে বাওয়ালীরা সাহস সম্পূর্ণ হারায়নি। দা-কাঠ-লাঠি নিয়ে চীৎকার করতে করতে তারা সঙ্গীকে উদ্ধার করতে রওনা হয়। ভিজা মাটিতে বাঘের পারা ও তাজা রক্ত দেখে এগুতে থাকে। হাত বিশেক যেতেই তার নীল-রঙা লুঙ্গি পায়, এক কোনা গাছের ডালের সঙ্গে আটকা, একজনে ছিঁড়া লুঙ্গিটা হাতে তুলে নেয়।

পৃষ্ঠা ১৩

পাঁচজনে আবার এগুতে থাকে। আরও আন্দাজ দুইশ হাত জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে তারা লাশ পায়। বাওয়ালীর উলঙ্গ শরীরটা কুঁচকানো, মাথা একদিকে কাত হয়ে আছে। পিঠ আর বাম হাতে বাঘ যে থাবা মেরেছে গোশত আলগা হয়ে গেছে, ঘাড় গলা মারাত্মক দাঁতের কামড়ে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেছে, প্রচুর রক্ত পড়েছে এবং তখনো পড়ছে।

 বাওয়ালীরা হৈ-চৈ চীৎকার করতে করতে লাশ নৌকায় নিয়ে আসে। আঠারবেকীর মানুষখেকো বাঘ তার প্রথম শিকার খেতে পারেনি। দ্বিতীয়টি পেরেছিল। সেই দিনই রাত্রে এই ঘটনাস্থল থেকে মাত্র পোয়া মাইল দূরে ফুলখালীর খালের গোলপাতা বোঝাই নৌকায় ঘুমাচ্ছিল চারজন বাওয়ালী। এটা সুন্দরবনের খুব সাধারণ দৃশ্য এবং চিরাচরিত রীতি। খুব সকাল থেকে একেবারে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত বাওয়ালীরা বনে কাঠ, লাকড়ি বা গোলপাতা কাটে। রাত হলে কাঠ-কাটা বাওয়ালীরা নদীর কিনারায় মাটি থেকে সাত-আট হাত উঁচুতে তৈরী টোঙ বা অস্থায়ী ছোট্ট ঘরে গিয়ে ঢালা বিছানাতে ঘুমায়। কিন্তু পাতা-কাটা বাওয়ালীরা পাড় থেকে পনেরো-বিশ হাত বাইরে নৌকা গেড়ে সেখানে ঘুমায়। জোয়ারের সময়ে অনেকে খালেও রাত কাটায়। ভাটার সময়ে খালে পানি কম থাকলে তখন নৌকা নদীতে নিয়ে গিয়ে সে রকমই কিনারা থেকে পনের, বিশ কি তিরিশ হাত দূরে গেড়ে ঘুমায় নৌকা বড় হলে মজবুত ছৈ-এর তলে তারা নিরাপদেই থাকে, কিন্তু মাঝারি নৌকা হলে সাধারণ একটা ছৈ-মাত্র তাদের রাত কাটাবার আশ্রয় হয় ।

ফুলখালীর খাল বেশ বড়, চল্লিশ হাতের কম প্রশস্ত নয়। চারজন বাওয়ালী ছিল মাঝারি আকারের নৌকাতে। সামান্য ছৈ-এর তলায় সকলের জায়গা হয় না, বাকী নৌকাতে গোলপাতা বোঝাই, উপরভাগ সমান। সেই পাতার উপরেও বিছানা করা হয়েছিল। ভাত খেয়ে, হুঁকা খেয়ে, চারজন রাতের মত শুয়ে পড়ে। দুইজনের পুরা শরীরই ছৈ-এর ভিতরে থাকলেও পা ছিল বাইরে।

সকালবেলা মাত্র পোয়া মাইল দূরের একজন গোলপাতা কাটা বাওয়ালীকে যে বাঘে খেয়েছে সে কথা এই চারজন বাওয়ালী শুনেছিল, যদিও লাশ তারা দেখতে যায়নি। তা সত্ত্বেও মাত্র আধ মাইলখানেক দূরের নদীতে না গিয়ে তারা যে খালেই ঘুমানো স্থির করেছিল সেটা অবশ্য ছিল তাদের দুঃসাহস এবং বোকামী, কিন্তু সে ধরনের বোকামী সুন্দরবনে আদৌ কোন বিরল ঘটনা নয়। আগের দিন বিকালে যেখান থেকে হয়ত বাঘে মানুষ ধরে নিয়ে গেছে, পরদিন সকালেই তার আশেপাশে বাওয়ালীরা আবার কাজ করছে, এটা বনে অহরহ ঘটে থাকে ।

এদের নৌকা গোলপাতায় ভরেনি, আরো পাঁচ-সাত মন আন্দাজ খালি ছিল। ভেবেছিল যে, পরদিন সকালে আরো ঘন্টা দুই ঘন্টা পাতা কেটে বোঝাই পুরা করে তখন নৌকা ছাড়বে । তাছাড়া তাদের পানির হিসাবও মোটামুটি ঠিক ছিল। রাত্রে যখন তারা ঘুমায় তখন খালে ছিল জোয়ার ভাটার টানে পানি কমতে শুরু করলেও ভোর রাতের আগে ভাটা শেষ হবে না, তখন তারা ঘুম থেকে উঠে নামাজ-কালাম পড়বে। ফুলখালীর খালে ভাটার সময়েও কিছু পানি থাকে এবং মাঝখালে নৌকা রাখা চলে ।

পৃষ্ঠা ১৪

কিন্তু আঠারবেকীর মানুষখেকো ছিল সুন্দরবনের ইতিহাসে এক অতি ভয়ঙ্কর বাঘ । সম্পূর্ণ অচিন্তিত উপায়ে সে একজন হতভাগা মানুষকে ধরে নিয়ে যায়। রাত আন্দাজ বারোটার কাছাকাছি সময়ে বাঘ নিঃশব্দে সাঁতার কেটে কিনারা থেকে দূরে নৌকাতে গিয়ে উঠে। বাঘের ভরে নৌকা একদিকে কাত হয়ে ডুবে যাওয়ার মত হয়। তখন ডিঙিতে আধা শরীর তুলে ছৈ-এর বাইরে শোওয়া যে বাওয়ালীর ঘাড় কামড়ে ধরে, সে কেবল ‘ক্ক্যাক!’ করে একটা শব্দমাত্র উচ্চারণ করতে পেরেছিল। তিনজন বাওয়ালীর ভয়ার্ত ‘বাঘ! বাঘ! যাঃ! যাঃ!’ চীৎকারে কিছুমাত্র না দমে, লোকটিকে মুখে তুলে বিশাল বড় বাঘ খাল পার হয়ে বনের ভিতরে অদৃশ্য হয়ে যায়।

ভয়াবহ স্তব্ধতার মাঝে তিন বাওয়ালীর বাকী রাত কাটে। সকালে সূর্য উঠলে তখন নৌকা খুলে তারা গিয়ে আরো দশ-বারোজন বাওয়ালী ভাইকে ডেকে আনে। সকলে মিলে দা-কাঠ-কুড়াল নিয়ে হৈ-চৈ করতে করতে জঙ্গলে ঢোকে। বাঘের পারা দেখে দেখে প্রায় সিকি মাইল ভিতরে গিয়ে একটা আঁটো যায়গায় লাশ পায়। রাতের মধ্যে বাঘ বাওয়ালীর পেট, নাড়িভুরি, কোমর ও উরু সব খেয়ে ফেলেছে। সেই আধা-খাওয়া লাশ এনে তারা বন বিভাগের অস্থায়ী অফিসে এই মৃত্যুর খবর রেকর্ড করায় এবং তারপরে জানাজা পড়ে নদীর চরেই দাফন করে। এর পরে তিনদিন পর্যন্ত বাঘ যদিও আর কাউকে আক্রমণ করেনি তবু সমস্ত আঠারবেকী এলাকায় মারাত্মক ভীতি ছড়িয়ে পড়ে।

বন বিভাগের কর্মকর্তাগণ মানুষখেকো বাঘ সম্বন্ধে সতর্ক হয়ে উঠেন। অবিলম্বেই বন দফতরের কয়েকজন শিকা বন্দুক ও রাইফেল নিয়ে বের হয়ে যান। কর্মকর্তাদের মধ্যে শিকারী আছেন, অন্যান্য বন কর্মচারীগণের মধ্যেও কেউ কেউ আছেন যে শিকার করতে জানেন—যদিও তাঁরা ঠিক পেশাদার শিকারী নন। কোনখানে মানুষখেকো বাঘের উপদ্রব হলে সঙ্গে সঙ্গে এই শিকারীগণ সেখানে গিয়ে বাঘের মোকাবিলা করতে চেষ্টা করেন এবং বাওয়ালীরা যাতে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারে সে রকম নিরাপত্তার বিধান করেন। যখন এই ব্যবস্থা যথেষ্ট না হয় তখন বন বিভাগ থেকে মানুষখেকো বাঘের জন্যে পুরস্কার ঘোষণা করা হয় এবং পেশাদার শিকারীগণকে জরুরী সংবাদ পাঠানো হয় ।

ঠিক তিন দিন পরে বাঘ আরেকজন বাওয়ালীকে ধরে নিয়ে যায়। ফুলখালী থেকে কাঁচিকাটা খালের দূরত্ব আধ মাইলের বেশী নয়। দুইটি ডিঙি নৌকা করে ছয় বাওয়ালী গোলপাতা কাটছিল খালে। ফুলখালীর বাওয়ালীকে বাঘে খাওয়ার পর থেকে আঠারবেকীর আর সব বাওয়ালীই যতদূর সম্ভব সাবধানতার সঙ্গে পাতা কাটতে থাকে দল থেকে দূরে একাকী না থেকে পরস্পর কাছাকাছি থাকলে বাঘের আক্রমণের সম্ভাবনা কম থাকে। এই বাওয়ালীরাও খুব সতর্কতার সঙ্গেই কাজ করছিল

সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নির্বিঘ্নে পাতা কেটে, গোসল করে, বাওয়ালীরা নৌকায় বসে ভাত খায়। তারপর খানিক বিশ্রাম করে, হুঁকা টেনে, আবার গিয়ে পাতা কাটায় লাগে। কেউই একজন আরেকজন থেকে পাঁচ-সাত হাতের বেশী দূরে ছিল না। হঠাৎ ‘হুঙ্ক!’ করে এক ভয়ঙ্কর গর্জনের সঙ্গে বাঘ আড়াল থেকে একজন বাওয়ালীর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে। আক্রমণের ধাক্কায় আর বাঘের বিশাল দেহের ভারে বাওয়ালী তলে পড়ে যায়।

এই কাহিনী যিনি পড়বেন তিনি সঙ্গী বাওয়ালীদের সাবাসী না দিয়ে পারবেন না। হয়ত কতকটা মানসিক প্রস্তুতি তাদের ছিল, হয়ত বা একেবারে গায়ের কাছেই ঘটনাটি ঘটায় তারা মহা সাহসের সঙ্গে এক অবিশ্বাস্য কাজ করে ফেলে। পাঁচজন একসঙ্গে বনের কাটা ডাল দিয়ে বাঘকে পিটাতে থাকে আর চীৎকার করতে থাকে। তখন বাঘ শিকার ছেড়ে দিয়ে জঙ্গলের ভিতরে চলে যায়।

পৃষ্ঠা ১৫

হতভাগ্য বাওয়ালীর নিঃসাড় দেহ পড়ে থাকে সেখানে। মরা। ঘাড় থেকে মাথা থেকে তখন স্রোতের মত রক্ত ছুটছে। ঘাড়-মাথা জুড়ে একটা কামড় দিয়ে ধরেছিল, তাতে তার মাথা চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। বাওয়ালীরা কাশিমারী গ্রামের বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে তাকে দাফন করে।

কয়েকদিন পরেই এই বাওয়ালী দলটি আবার গোলপাতা কাটতে এলে তখন আমি গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করি এবং ঘটনার বিস্তারিত জানতে চাই। তখন একজন আমাকে বলে যে, ‘বিশাল বড় বাঘ, আমার মাথার উপর দিয়ে লাফ দিয়ে গিয়ে ওকে ধরল!’ আর আরেকজন বলে, ‘এই লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরে বাঘকে খেদিয়েছি!’

বর্ণনা দুইটি যত রোমাঞ্চকর তার চেয়ে অনেক বেশী দুঃসাহসিক। সঙ্গের সঙ্গীকে নিয়ে যাচ্ছে বাঘে, আর তাকে বাঁচানোর জন্যে মহা শক্তিমান ও হিংস্র জন্তুটিকে লাঠির বাড়ি দিয়ে তাড়ানোর চেষ্টা করাতে যে কি পরিমাণ সাহসের দরকার হতে পারে তা সার্কাসের বা চিড়িয়াখানার বাঘ দেখে ধারণা করা যাবে না। অন্তহীন, জনবসতিহীন গভীর বনে এমন কি দূরেও একটা সাধারণ বাঘ দেখলে প্রাণে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়ে যায়; আর বিশাল আকারের মানুষখেকোর মুখের সামনে অসহায় মানুষের পক্ষে নিজের জীবন বিপন্ন করে সঙ্গীকে বাঁচানোর চেষ্টা করাতে অবিশ্বাস্য বীরত্বেরই দরকার হয়। একটিমাত্র থাবায় তার মৃত্যু হতে পারে, আর থাবা মারতে বাঘের এক সেকেণ্ড সময়ও লাগে না। সুন্দরবনের দরিদ্র, অশিক্ষিত বাওয়ালীদের মধ্যে মনুষ্যত্বের এই যে পরিচয় এর কোন তুলনা নেই।

পচাব্দী গাজী

পর পর কয়েকজন বাওয়ালী বাঘের মুখে যাওয়ায় সমস্ত বন বিভাগে এক মহা শঙ্কা ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়ে যায়। বন কর্মকর্তা ও বনরক্ষীদের মধ্যে যারা শিকারী ছিলেন তাঁরা ইতিমধ্যেই বোট নিয়ে নৌকা নিয়ে আঠারবেকীতে বাঘের অনুসন্ধানে ছিলেন । কেউ যদিও এই বাঘকে একটি গুলি করার সুযোগ পাননি, তবু তাঁরা সকাল-সন্ধ্যা আপ্রাণ চেষ্টা করেই যাচ্ছিলেন। এই সময়ে বন বিভাগ থেকে সুন্দরবনের পেশাদার শিকারী পরিবারগুলোর কাছে এই বাঘ শিকারের জন্যে সংবাদ পাঠানো হয়। আমি অবিলম্বে রওনা হয়ে যাই এবং আঠারবেকীর অস্থায়ী বন অফিসে গিয়ে অন্যান্য শিকারীগণের সঙ্গে যোগ দিই।

বন বিভাগ থেকে শিকারীগণকে সকল রকম সুযোগ সুবিধা দেওয়া হল। আমাকে নেওয়া হয় এক বোটে, সঙ্গে একটি ডিঙি নৌকা এবং কয়েকজন বনপ্রহরী ও বনমাঝিকে সাহায্যের জন্য দেওয়া হয়। বড় বোট নদীতে রেখে ডিঙি করে সকাল সন্ধ্যা এক খাল থেকে আরেক খালে, পাড়ে উঠে কিনারে, এবং যেখানে যতদূর সম্ভব বনের ভিতরে গিয়ে আমি বাঘের খোঁজ করতে লাগলাম। সুন্দরবনে এভাবে ছাড়া খোজার বা চলাচলের আর কোন উপায় নেই। বিশাল বনের কোনখানে রাস্তাঘাট বলে কিছু নেই, কোন রাস্তার চিহ্নও নেই। একটানা বনের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার একমাত্র উপায় নৌকা। আমি সকলের সঙ্গে অব্যাহতভাবে মানুষখেকো বাঘের সন্ধান করতে লাগলাম।

এর মধ্যে আঠারবেকী এলাকায় কর্মরত সকল বাওয়ালী ও জেলেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, কোনখানে বাঘে কাউকে নিয়ে গেলে বা আক্রমণ করলে বা বাঘ দেখলেও যেন অস্থায়ী বন অফিসে বা কোন না কোন বোটে সঙ্গে সঙ্গে খবর দেওয়া হয়। তারপর কয়েকদিন ধরে চলল আমাদের সবার প্রাণান্তকর চেষ্টা আর সন্ধান। সেই সব চেষ্টাই ব্যর্থ হল, কোনখানে একবার বাঘ দেখতে পেলাম না। নৈরাশ্যের মধ্যে হঠাৎ একদিন অত্যন্ত দুঃখজনক আরেকটি মৃত্যুসংবাদ এল-আঠারবেকী মৌজা থেকেই। পাড় আঁটুনির খালে এক হিন্দু জেলে তার ছেলেকে নিয়ে মাছ ধরছিল। এই বৃদ্ধ সারা জীবন মাছ ধরেছে সুন্দরবনের খালে আর গাঙে। ছেলেকে যে সঙ্গে নিয়েছে তাও আজ অনেক বছর । বাঘ সে হয়ত দেখেছে বহুবার, চোখের সামনে দিয়ে গাঙ পার হয়ে যেতেও হয়ত দেখেছে বহুবার, কিন্তু মানুষখেকোর নজরে পড়তে হয়নি কোনদিন; একবার নজরে পড়ল, সেই সেবারেই মৃত্যু ঘটল।

পৃষ্ঠা ১৬

আগের দিন সন্ধ্যায় বাপ-ছেলে পাড়-আঁটুনির ভরা খালে জাল পেতে রেখে গিয়েছিল, সেদিন সকালে ভাটার টানে পানি নেমে গেলে তখন ঝিঝিরা পানিতে আটকে থাকা মাছ ধরতে আসে তারা। এই জেলেরা দুইদিন, তিনদিন, চার-পাঁচ-, এমন কি সাতদিন পর্যন্ত থাকে নৌকায়; ডিঙিতে খায়, ডিঙিতেই রাত কাটায়। মাছ ধরে ধরে নৌকায় দুইপাশে বাঁধা চাই-এর মধ্যে জিইয়ে রাখে, সেগুলো ভরে গেলে তখন নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে।

একটানা কয়েক ঘন্টা খালের কাদাতে অনেক দূরে পর্যন্ত হেঁটে হেঁটে বাপ আর ছেলে মাছ ধরল। বড় ছোট নানারকম লোনা পানির মাছ। বেলা দুপুর হলে তখন রান্নার ব্যবস্থা করতে হয়, বুড়া বাপ কিনারায় উঠল লাকড়ির জন্যে। বৃদ্ধ পাড়ে উঠল শুকনা ডাল কেটে আনতে, আর ছেলে মাছ ধরতে থাকল। হঠাৎ ছেলে একটা ‘হুঙ্ক!’ গর্জন শুনল, তারপর গোঙানি, কাঠ কাটার আওয়াজ থেমে গেল। বিভ্রান্ত ছেলে ‘বাবা! বাবা!’ বলে চীৎকার করতে করতে দ্রুত পাড়ে উঠল। কিন্তু বুড়া বাবার কাছ থেকে কোন জবাব এল না। সে কাণ্ডজ্ঞানহীনের মত বনের ভিতরে ঢুকে পড়ল। হঠাৎ মাত্র কয়েক হাত সামনেই ‘হাম!’ করে বাঘের গভীর ডাক শুনে তার জ্ঞান ফিরে এল । সে ডিঙিতে ফিরে দ্রুত গিয়ে কয়েকজন বাওয়ালীকে জোগাড় করে আনল।

সুন্দরবনের এ আরেক আশ্চর্য সহমর্মিতা। কারো বাবাকে, ভাইকে কি সঙ্গীকে বাঘে নিয়ে গেছে শুনলে কাছে-ধারের আর সবাই সেখানে আসে, বিপদ উপেক্ষা করে যতদূর সাধ্য সাহায্য করে। সকলে মিলে হৈ-চৈ করতে করতে বাঘের পায়ের চিহ্ন আর রক্তের দাগ দেখে বনের ভিতরে এগুতে থাকল। কিছুদূর যেতেই জেলের পরনের কাপড় পেল। বাপের দা আর রক্তমাখা কাপড় হাতে নিয়ে ছেলে ছুটতে লাগল পাগলের মত । সেই উদভ্রান্ত মুহূর্তে তার যেন বিশ্বাস ছিল যে, তাড়াতাড়ি যেতে পারলে বাবাকে সে জীবিতই উদ্ধার করে আনতে পারবে। কিন্তু বেলা ইতিমধ্যে পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটা হয়ে যাওয়াতে বাওয়ালীরা বাধ্য হয়ে অনুসন্ধান স্থগিত করে এবং ছেলেকে জোর করে নৌকায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে। বনে অন্ধকার দ্রুত ঘন হয়ে আসছিল, তাই আর অগ্রসর হওয়া তাদের পক্ষে মোটেই নিরাপদ ছিল না। এই জেলের দেহের অবশিষ্ট আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

আঠারবেকী মৌজা সীমানার মধ্যেই এই বাঘ একের পরে এক অসহায় জেলে ও বাওয়ালীকে খেতে থাকে। সমস্ত এলাকায় মারাত্মক ত্রাসের সৃষ্টি হয়ে যায়, বহু খালে বাওয়ালীরা প্রাণভয়ে লাকড়ি ও পাতা কাটা বন্ধ করে দেয়, জেলেরাও মাছ ধরা বন্ধ করে দেয়—যদিও এটাই তাদের রুজি রোজগারের উপায়। কয়েকজন বন কর্মকর্তা, অন্যান্য শিকারী ও আমি বহু চেষ্টা করেও তখন পর্যন্ত একবার মানুষখেকো বাঘ দেখতে পাইনি। আমি কেবল পায়ের পারার দাগ পেয়েছিলাম। কয়েকদিনের বাসি চিহ্ন হলেও বুঝতে পেরেছিলাম যে সেটা বিশাল এবং অস্বাভাবিক বড় এক বাঘের পারা; তত বড় আমি আগে আর কোনদিন দেখিনি।

পচাব্দী গাজী (ছবিতে ডানে)

এর মধ্যে একটি জার্মান টেলিভিশন দল সুন্দরবনে আসে ছবি তুলতে। সামগ্রিকভাবে পৃথিবীবিখ্যাত সুন্দরবনের এবং বিশেষ করে রয়াল বেঙ্গল টাইগারের চলচ্চিত্র তুলে নিয়ে যাবেন তাঁরা। রাজা, রাষ্ট্রপ্রধান, কোন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব বা বিদেশীগণ সুন্দরবনে এলে বন দফতর থেকে সাধারণতঃ আমাকেই তাঁদের গাইড নিযুক্ত করা হয়। জার্মান দলের গাইডও আমাকেই নিযুক্ত করা হল।

পৃষ্ঠা ১৭

যথাশীঘ্র সম্ভব খুলনা শহরে যাবার জন্যে আমার প্রতি জরুরী নির্দেশ এল যে বাঘের মাত্র কয়েকটি ভয়াবহতার আমি উল্লেখ করেছি, যে বাঘ কয়েক সপ্তাহ যাবত আমাদের সকল শিকারীর আপ্রাণ চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে এক বর্ণনাতীত ত্রাসের সৃষ্টি করে ফেলেছে তাকে জীবিত রেখে খুলনা শহরে যাবার কথা আমি চিন্তাও করতে পারিনি। কিন্তু বাধ্য হয়েই আমাকে আঠারবেকী ছেড়ে যেতে হল এই দলের কয়েকজনই ছিলেন নামকরা শিকারী। একজন মেম ছিলেন, তাঁরও শিকারে আগ্রহ কিছু কম ছিল না, কিন্তু দুনিয়ার অন্যান্য জায়গায় বনভূমিতে সাধারণ বাঘ শিকার করলেও সুন্দরবনে মানুষখেকো রয়াল বেঙ্গল শিকারের পূর্ব অভিজ্ঞতা তাঁদের কারো ছিল না।

আঠারবেকীতে এক মানুষখেকোর উপর্যুপরি আক্রমণে সেই এলাকায় জেলে বাওয়ালীদের সকল কাজ বন্ধ হবার অবস্থা হয়েছে শুনে তাঁরা সেখানেই যাবেন বলে স্থির করলেন। টেলিভিশনের ছবি তুলতে এসেছেন, দুঃসাহস যতটা আছে এখানকার ভয়াবহতার ধারণা ততটা নেই। তাঁদেরকে আঠারবেকীতে নিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে উচিত ছিল না, কিন্তু হতভাগ্য জেলে-বাওয়ালীদেরকে ধূর্ত মানুষখেকোর খোরাক করে রেখে বনের অন্য কোন নিরাপদ জায়গায় গেলেও আমি বোধ হয় শাস্তি পেতাম না। মনের এক দিকের অনিচ্ছার উপরে আরেক দিকের ইচ্ছাই জয়ী হল এবং সম্ভাব্য বিপদের কথা সবই উল্লেখ করার পরে জার্মান দলকে শেষ পর্যন্ত আমি আঠারবেকীতে নিয়ে গেলাম।

এই সময়ের মধ্যে বাঘ আরো মানুষ খেয়েছে, বাওয়ালী-জেলেরা প্রতিদিন বন ত্যাগ করছে। বন অফিসের এবং পেশাদার শিকারীগণও আপ্রাণ চেষ্টা করেও কেউ এই মানুষখেকোটিকে একটি গুলি করার সুযোগ পাননি, যদিও তাঁরা বৃঘের পায়ের চিহ্ন দেখে সন্ধান করেছেন, রাত জেগেছেন এবং অনেক বিপদেরও ঝুঁকি নিয়েছেন।

সব বাঘ মানুষখেকো হয় না, যেটা হয় বুড়া হলে হয়। শরীরের শক্তি কমে গেলে যখন আর দ্রুতগামী হরিণ ধরতে পারে না, শুয়োর ধরতে পারে না, তখনি বাঘ মানুষ ধরে খায়, কারণ মানুষ অসহায় প্রাণী। আর, একবার মানুষখেকো হলে তখন বাঘ কেবল মানুষই খায়, অন্য কোন প্রাণী ধরতে যায় না। আঠারবেকীর মানুষখেকো বাঘ বিশজন জেলে ও বাওয়ালীকে মেরে আতঙ্কজনক রেকর্ড করে ফেলে এবং তা মাত্র মাস দেড়-দুই সময়ের মধ্যে সুন্দরবনের ইতিহাসে সে রকম ব্যাপক ভীতি আর অচল অবস্থা আর কখনো সৃষ্টি হয়নি। জার্মান টেলিভিশন দলকে নিয়ে আঠারবেকীতে পৌছেই আমরা যে জোড়া ঘটনার খবর পেলাম তার বর্ণনা না করে পারছি না।

একজন হিন্দু নমশুদ্র, সবার কাছে গুণীন বলে পরিচিত ছিল। গুণীন এজন্যে যে, তিনি বনের হিংস্র জীবজন্তু বশীভূত করার মন্ত্র জানতেন। অনেক বাওয়ালী ও জেলে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে বা তাঁর কাছ থেকে মন্ত্রপূতঃ লাল কাপড়ের টুকরা নিয়ে বনে কাজ করতে যেত এবং কাজের স্থানে কাপড়টি নিশানের মত করে গেড়ে রাখত। এতকাল পর্যন্ত কোনদিন তাঁর মন্ত্রের কার্যকারিতা মিথ্যা প্রমাণিত হয়নি বলে এই গুণীন বাওয়ালী এবং জেলেদের কাছে বিশেষ শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি ছিলেন যে তিনি একবার মন্ত্র পড়ে দিলে তাতে বনের দেবী বনবিবি বশীভূত হন; বাঘের সাধ্য নেই যে আর কাছে আসে। বনের বিশালত্ব, অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ, জনমানবহীনতা, হিংস্র মানুষখেকো বাঘ, অজগর, কুমীর ও হাঙরের যত্রতত্র উপস্থিতির জন্যে মানুষের মনে যে অসহায়ত্ববোধ জাগে, গুণীনগণের যাদুটোনা সেখানে স্বভাবত কিঞ্চিত নিরাপত্তাবোধ আনে এবং মানুষকে বনে কাজ করার শক্তি জোগায়। কিন্তু এই খ্যাতনামা গুণীনের মন্ত্রবল শেষ পর্যন্ত তাঁর নিজের জীবনেই অসার বলে প্রমাণিত হয় এবং তা এই আঠারবেকীতে।

পৃষ্ঠা ১৮

গুণীনরা বাওয়ালীদের সঙ্গে লাকড়ি, গোলপাতা কাটার যায়গাতে যান। এই গুণীনও বাওয়ালী দল নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু বন অফিস এবার তাঁকে টিকিট দিতে অস্বীকার করে। কর্মকর্তা গুণীনকে দোলনপীরের খাল ছাড়া অন্য কোন খালের টিকিট নিতে বললেন, কেন না গত মাস দেড়েকের মধ্যে দোলনপীরে বেশীরকম মানুষ মারা পড়েছে। কিন্তু গুণীন দোলনপীরেরই টিকিট চান, সেখানে গোলপাতা বেশী আছে এবং মন্ত্র দিয়ে তিনি এলাকা আটক করে নিবেন, বাঘের আর কোন শক্তি থাকবে না। তখন নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেই বন কর্মকর্তা সেই বাওয়ালী দলকে পাঁচটি নৌকা নিয়ে পাতা কাটার পারমিট দেন।

চার ডিঙি এবং একটি বড়, মোট পাঁচ নৌকায় পনেরজন বাওয়ালী রাত্রিবেলা দোলনপীরের খালে গিয়ে নৌকা গাড়ে। রাত্রেই গুণীন মন্ত্র দিয়ে সেই এলাকা ‘আটক’ করে ফেলেন এবং সকাল সাতটার সময়ে বাওয়ালীরা খালের পাড় থেকে পাতা কাটতে শুরু করে। দুপুর পর্যন্ত নির্বিঘ্নে কাজ করে তারা বড় নৌকাতে এসে ভাত খায়। পান তামাক খেয়ে পড়ন্ত বেলায় আবার কাজে লাগে এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রচুর পাতা কাটে— গোলপাতা সেখানে যথেষ্টই ছিল। রাতে মন্ত্রের উপরে আস্থাশীল পনেরজন লোকই বড় নৌকায় নির্বিঘ্নে ঘুমায়।

সকালে কারো মনেই আর তেমন কোন ভয় নেই, সেদিন তারা আরো কিছুটা উজানে পাতা কাটতে যাবে। সবার আগে গুণীনের নৌকা, বৈঠা হাতে গলুই-পাছায় দুইজন বাওয়ালী এবং মাঝখানে তিনি বসা। তখন ভাটার সময় বলে কিছুদূর গিয়েই নৌকা খালে আটকে যায়। পাছার বাওয়ালী একটা বিড়ি ধরায় তিনজনেই টানবে বলে, হঠাৎ পাড় থেকে বাঘ লাফ দিয়ে গুণীনকে ধরে। আক্রমণের চোটে নৌকা কাত হয়ে যায় আর শিকারসহ বাঘ খালের পানিতে গিয়ে পড়ে। মৃত্যুরূপ মহাবিপদ যখন একেবারে সামনে এসে পড়ে মানুষ কখনো তখন অবিশ্বাস্যরকমের সাহসী হয়ে উঠে। পাছার বাওয়ালী চীৎকার করতে করতে হাতের বৈঠা দিয়ে বাঘের মাথায় পিটাতে শুরু করে।

মুহূর্তের মধ্যে বাঘ গুণীনকে ছেড়ে দিয়ে পিছনের দুই পায়ে খাড়া হয়ে উঠে এবং বাওয়ালীর মাথা কামড়ে ধরে পাড়ে উঠে অদৃশ্য হয়ে যায়। সমস্ত ঘটনাটি মাত্র মিনিটখানেক সময়ের মধ্যে ঘটে। চৌদ্দজন বাওয়ালী গুণীনকে নিয়ে দুই মাইল দূরে আঠারবেকীতে ছোট কৃপ অফিসে আসে। কিন্তু গুণীন পথেই মারা যান, একটা কথাও বলতে পারেননি। পানি থেকে নৌকায় তোলার পরে অল্পক্ষণ কেবল একটা অস্পষ্ট গোঙানি ছিল।

খবর পেয়ে, গুণীনের লাশ দেখে, আর এক মুহূর্ত দেরী না করে অন্ততঃ ত্রিশজন বাওয়ালীকে সঙ্গে নিয়ে আমি রওনা হয়ে গেলাম। বন অফিসের আরও ছয়জন রওয়ানা হলেন আমার সঙ্গে বন্দুক নিয়ে। আগেই বলেছি যে, সুন্দরবনে চলাচলের একমাত্র উপায় হচ্ছে নৌকা। রাস্তাঘাট বলতে কিছু নেই কোনখানে। দুর্গম বনে কোথাও বাঘে মানুষ খেলে তার খবর পেতে এবং তার অকুস্থলে গিয়ে পৌছতে যে সময় অবধারিতভাবে পার হয়ে যায় তারপরে প্রায়ই বাঘ আর সেখানে থাকে না; শিকার খেয়ে কেবল হাড়গোড়গুলো ফেলে রেখে যায়। সেদিন বাওয়ালীরা গুণীনের লাশ আঠারবেকীর ছোট অফিসে নিয়ে এসেছিল বেলা দুইটায়, জোর ডিঙি বেয়ে গেলে আমরা এক ঘন্টার মধ্যে দোলনপীরের খালের উজানে পৌছতে পারব এবং ভয়ঙ্কর মানুষখেকোকে সামনাসামনি দেখার, এমন কি কিসমতে থাকলে হয়ত বা গুলি করারও সুযোগ পাব বলে আশা করলাম।

পৃষ্ঠা ১৯

ভাটি খাল বেয়েই আমাদের ডিঙিগুলো সেদিন বিজলীর মত ছুটল এবং বেলা আন্দাজ তিনটার মধ্যেই ঘটনার স্থানে গিয়ে পৌছলাম। নরম মাটিতে তখন বাঘের একেবারে তাজা পারা, দেখামাত্র আমি চিনতে পারলাম যে, এ সেই একই মানুষখেকো বাঘ। উপস্থিত সকলেই বলল যে, এত বড় পারা তারা জীবনে কোনদিন দেখেনি। গুণীনের নৌকার যে একমাত্র ভাগ্যবান বাওয়ালী প্রাণে বেঁচে গেছে সে ভয়ে তখন এমন বিমূঢ় হয়ে গেছে যে ‘বিশাল বড় বাঘ!’ এর বেশী আর কিছুই বর্ণনা করতে পারল না। সে রকম মনের অবস্থাই তার ছিল না।

আমরা পঁয়ত্রিশজন মানুষ হাঁক-ডাক হৈ-চৈ করে বনের ভিতরে এগিয়ে চললাম। কাদার মধ্যে বাঘের পায়ের চিহ্ন পরিষ্কার পড়ে ছিল। মানুষখেকো বাঘ সাধারণত দাপটের সঙ্গে হাঁটে, সাধারণ বাঘ তা করে না। এ বাঘও যাওয়ালীকে মুখে নিয়ে অতি দাপটের সঙ্গে মাটিতে আঁচড়ে আঁচড়ে হেঁটে গেছে। ফলে নরম মাটিতে ও কাদাতে সেই স্পষ্ট পারা অনুসরণ করা আমাদের সহজ হল। তাছাড়া মাটিতে, গাছের পাতায় ও গুড়িতে যথেষ্ট তাজা রক্তও লেগে ছিল। বাওয়ালীর পায়ের আঙুল কোথাও কোথাও কাদাতে হাঁচড়ে গিয়েছিল, সেই চিহ্নও ছিল আমি রইলাম সকলের সামনে আর, যদিই বা বাঘ কাউকে আক্রমণ করে তবে সম্পূর্ণ সম্ভাবনায় পিছনেরজনকে ধরবে, এজন্যে সকলের পিছনে বন্দুক হাতে রইলেন বন অফিসের দুইজন শিকারী।

গভীর বনের মধ্য দিয়ে প্রায় সিকি মাইল যাওয়ার পরে আমরা বাওয়ালীর লাশ পেলাম। নৌকা থেকে এখান পর্যন্ত বাঘ এক হাঁটায় এসেছে, পথে কোনখানে থামেনি বা একবারের জন্যে মুখের শিকার মাটিতে রাখেনি। এ থেকেও বাঘের বিপুল শক্তি এবং আকারের বিশালত্বের একটা আন্দাজ করতে পারলাম । অর্থাৎ একেবারে অভ্রান্তভাবে এ সেই একই মানুষখেকো বাঘ।

বাওয়ালীর লাশ দুই পা গুটানো অবস্থায় পড়ে ছিল, কোমর ও পেট থেকে কয়েক খাবলায় তিন-চার সেরমত গোশত খেয়ে ফেলেছে, মাথা কামড়ে ধরে যে এনেছে তা একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।

 চারপাশে ছোট ও মাঝারি গরান গাছই বেশী ছিল, তাই বন গভীর হওয়া সত্ত্বেও বসার বা মাচা বাঁধার কোন সুবিধা হল না। বেশ দূরে একটা কেওড়া গাছ ছিল, অনেক উঁচু এবং মাটি থেকে তের-চৌদ্দ হাত উপরে গাছটার তে-ডালায় বিনা মাচায়ও বসার সুবিধা ছিল আমি সেখানে বসেই রাত্রে বাঘের অপেক্ষা করব বলে স্থির করলাম। বাঘ অবশ্যই বাওয়ালীর দেহের বাদবাকী অংশ খেতে আসবে। দীর্ঘদিন পরিশ্রম ও কষ্টের পরে অবশেষে আজ সুযোগ পাওয়া গেল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, হয়ে গেল ভিন্ন এবং অপ্রত্যাশিত এক সমস্যা। কোন একজন শিকারী বা বাওয়ালী রাত্রে আমার সঙ্গে থাকতে রাজী হল না। আর একজন কাউকে সঙ্গে না নিয়ে সম্পূর্ণ একাকী শিকার করতে বসা আমার বংশের রীতি নয়, কোন একজন মানুষ সঙ্গী হিসাবে থাকতেই হবে।

পৃষ্ঠা ২০

বহু অনুরোধ করলাম, বাঘ মারার নিশ্চিত সম্ভাবনার কথা বুঝিয়ে বললাম, আমার বন্দুক, তাজা এল. জি. কার্তুজ দেখালাম, গাছের উঁচু ডালের সঙ্গে কোমর বেঁধে নিরাপদে বসে থাকতে বললাম, কিন্তু সবই বৃথা হল। এই মানুষখেকো অগুনতি মানুষ খেয়ে যে মারাত্মক ভয়ের সৃষ্টি করে ফেলেছে সে কারণেই কাউকে, এমন কি কোন একজন শিকারীকেও, রাজী করাতে পারলাম না। একেবারে নিতান্ত বাধ্য হয়েই সুন্দরবনের শ্রেষ্ঠ শিকারীবংশের লোক হয়েও ভয়াবহ মানুষখেকো বাঘ মারার নিশ্চত সুযোগ আমাকে ছেড়ে দিতে হল এজন্যে যে কোন দোষারোপ আমি মাথা পেতে নিতে রাজী আছি। সুন্দরবন জনমানবহীন ও পথঘাটহীন মহা অরণ্য, এখানকার শিকারের রীতি ভিন্ন। আর সেজন্যেই অন্ততঃ একজন কাউকে সঙ্গী না নিয়ে বাঘ শিকার করার রেওয়াজ আমাদের বংশে নেই। বাধ্য হয়েই সন্ধ্যার আগে বাওয়ালীর লাশ নিয়ে আমরা আঠারবেকী কূপ অফিসে ফিরে এলাম ।

জার্মান টেলিভিশন দল প্রচুর ছবি তুলল। আঠারবেকীর যত গভীর, গহন জায়গা ছিল সব কিছুরই ছবি তুলল। হরিণ, বানর, সাপ, কুমীর ও পাখীর ছবি। আমার ছবিও তুলল । কিন্তু দুঃখের বিষয় বাঘ দেখাতে পারলাম না। তাঁদের সাহসের তারিফ না করে পারা যায় না। এই এলাকায় একটি মানুষখেকো বাঘ মাত্র দেড়-দুই মাসে অসংখ্য মানুষ খেয়ে ফেলেছে শুনে দলের শিকারীগন সেই বাঘ মারার জন্যে আন্তরিকভাবে আগ্রহী হয়ে উঠেন। সকল বিপদ উপেক্ষা করে সম্ভাব্য কয়েকটি স্থানে তাঁরা বাঘের মোকাবিলা করতেও চেষ্টা করেন। কিন্তু সুন্দরবনে মানুষখেকো বাঘ শিকারের রীতি ভিন্ন। একদিন এক অতি বিপজ্জনক স্থানে কয়েক ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করে অবশেষে অনেক দূরে রেঞ্জের বাইরে—একটি বাঘ তাঁদের দেখাতে পেরেছিলাম; কিন্তু সেটি ছিল এক ছোট বাঘ, বছর তিনেক বয়সের।

অবশেষে জার্মান দল তাদের কাজ শেষ করে খুলনা রওনা হয়ে গেল। যাবার সময়ে মেম সাহেব, মিসেস লেচেনপার্গ, আমাকে একটি টাইপ করা প্রশংসাপত্র দিয়ে গেলেন, আমি সেটি যত্নের সঙ্গে রেখে দিয়েছি।

তাঁরা চলে যাওয়ার ঠিক পরের দিনই আঠারবেকী খালের ধারে বাঘ একজনকে নিয়ে যায়। সকাল আটটার দিকে কয়েকজন বাওয়ালী খালের পাড়ে গোলপাতা কাটছিল, বাঘ মাত্র পাঁচ-ছয় হাত দূর থেকে লাফ দিয়ে এসে বাওয়ালীর ঘাড়ে পড়ে এবং সবার চোখের সামনে থেকে ইতভাগ্যকে নিয়ে যায়। সঙ্গের বাওয়ালীরা বনে ঢুকতে সাহস না পেয়ে এক মাইল দূরে আমাদের সরকারী বোটে এসে খবর দেয়।

এক মুহূর্ত দেরী না করে আমি বারোজন বাওয়ালীসহ ডিঙি করে রওনা হলাম। দোনলা বন্দুক আর কয়েকটি এল.জি. কার্তুজ নিলাম এবং আধঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে সেই খালের ধারে গিয়ে পৌছলাম। ত্রিশ-বত্রিশ বছরের যুবক বাওয়ালী পাতা কাটছিল ডান হাতে, বাঘ মাত্র ছয় হাত দূরে তার বাম পাশের একটা ঝোপের ভিতরে ওঁত পেতে বসেছিল, সেখান থেকে এক লাফে তাকে ধরে। যেখান থেকে লাফ দিয়েছিল, পায়ের ভয়ানক দাপটে কাদামাটি লেখানে গর্ত হয়ে গেছে। তার গোলকাটা দা তখনো গাছের গোড়াতেই পড়ে ছিল, সেখানে প্রচুর রক্ত।

পৃষ্ঠা ২১

একেবারে বরাবর সোজা পুবে গেছে। জঙ্গল ভেঙে হাত দশেক এগুতেই প্রথমে মাটিতে পড়ে থাকা লুঙ্গিটা পেলাম-রক্তে ভিজা। নরম কাদা ও মাটিতে একেবারে পরিষ্কার বাঘের পারা, আমি দশ হাত দূর থেকে এই চিহ্ন দেখলেও বলতে পারতাম যে, এটা সেই বিশালাকার মানুষখেকোর পারা যে আঠারবেকীতে এই নিয়ে তেইশজন জেলে আর বাওয়ালীকে খেয়েছে এতদিনের মধ্যে আমি বা আমরা কোন একজন শিকারী এই বাঘ চোখে দেখতে পাইনি। পায়ের চিহ্ন দেখে আর বাওয়ালীদের মুখের বর্ণনা থেকেই কেবল জেনেছি যে আঠারবেকীর এই মানুষখেকো হচ্ছে বাঘা।

সবার আগে আমি অতি সাবধানে এগুতে লাগলাম। গোল গাছ থেকে গেওয়া, গরান বন পার হয়ে একটানা এক হেতাল ঝোপ পড়ল, কতকটা সরু সরু খেজুর গাছের কাঁটাওয়ালা এই গাছ অত্যন্ত ঘন হয়ে জন্মায় । বহু কষ্টে সেই দুর্ভেদ্য হেতাল পার হতেই পড়ল আবার বিস্তৃত হুদো বন, তার ভিতর দিয়ে নিয়ে গেছে। হুদো পার হতেই একটা ছোট্ট নালা পড়ল, সেটাও পার হয়ে আরো কিছুদূর জঙ্গলের ভিতরে একটা আঁটো জায়গাতে গিয়ে লাশ পেলাম। দেখলাম হতভাগ্য বাওয়ালীর দেহ হাঁটু গুটানো, ঘাড় কাত করা অবস্থায় পড়ে রয়েছে, পেট আর উরুর গোশত সবই খেয়ে ফেলেছে। মানুষ মেরে বাঘ প্রায় সব সময়েই প্রথমে উরু আর পেটের গোশত খায়।

বাঘ এখান থেকে গেছে পূব দিকে, কিন্তু এটা নিশ্চতই বুঝতে পারলাম যে, পোয়া মাইলের ভিতরে—হয়ত বা আরো কাছেই-কোনখানে ঘাপটি মেরে রয়েছে। আমি মৃত বাওয়ালীর আত্মীয়-স্বজনদের কাছে অনুরোধ করে সন্ধ্যা পর্যন্ত লাশ সেখানেই রাখার সম্মতি আদায় করলাম। আর এতজনের মধ্যে মাত্র একজন সাহসী বাওয়ালীকে আমার সঙ্গে থাকতে রাজী করাতে পারলাম; আমারও একজনই সঙ্গী দরকার ছিল। তখন বেলা তিনটা, সুন্দরবনে আরো আড়াই ঘন্টা আলো থাকবে এবং সেই সময়ের মধ্যে বাঘকে গুলি করার একটা সুযোগ নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে বলে আশা করতে পারলাম। তা না হলে আত্মীয়-স্বজনেরা ফিরে এসে লাশ নিয়ে যাবেই এবং আরো কোন একজন হতভাগ্য বাওয়ালী বাঘের মুখে না যাওয়া পর্যন্ত আমি দ্বিতীয় একটি সুযোগ পাব না।

বাওয়ালীর দেহ আঁটো জায়গায় থাকলেও ষাট-সত্তর হাতের মধ্যে কোন সুবিধাজনক গাছ ছিল না যে শরীর লুকিয়ে ডালে বসা যায়। একটা বড় বাইন গাছ কাছাকাছি জায়গায় থাকলেও বসার কোন সুবিধা হল না। এ ছাড়া চতুর্দিকেই শুধু গরান, গেওয়া, ধুন্দুল ও সরু সরু সুন্দরী গাছ। এক উপায় ছিল যে কোন একটি গাছে পিঠ ঠেকিয়ে মাটিতে বসা; কিন্তু তাতে আমি দেখার আগে বাঘ আমাকে দেখে ফেলবে এবং হয় আমি মারাত্মকরকম বিপদে পড়ব আর না হয় তো অনর্থকই সময় নষ্ট করা হবে, বাঘ আসবে না। আরেক উপায় ছিল যদি বাওয়ালীর লাশ যেখানে ছিল সেখান থেকে সরিয়ে কোন সুবিধাজনক জায়গায় রেখে আমি ঝাঁকড়া গাছে উঠে বসি, কিন্তু মানুষখেকো বাঘ এমনি সতর্ক ও সচেতন হয় যে তার শিকার পাঁচ হাত দূরে সরানো দেখলেও সন্দেহ করবে এবং চলে যাবে। কাজেই লাশ বাঘ যেখানে ফেলে গেছে ঠিক সেখানেই রাখতে হবে।

বসার আর একটিমাত্র স্থানই ছিল—যদিও খুবই বিপজ্জনক স্থান—তা হল নালার ঢাল; পাড় থেকে নীচের ঢালুতে শুয়ে পাড়ের উপরে শুধু মাথা জাগিয়ে বাঘের জন্যে অপেক্ষা করা। বেশী সময় ছিল না, তাই তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে সব বাওয়ালীদেরকে আমি জোরে হৈ-চৈ করতে করতে নৌকায় চলে যেতে বললাম, যেন বাঘ বুঝতে পারে যে মানুষ যারা এসেছিল তারা দলেবলে চলে গেছে। তারা জোরে জোরে কথা বলতে বলতে, ডাকাডাকি করতে করতে নালা পার হয়ে ডিঙিতে চলে গেল। গুলির আওয়াজ শুনলে তারা আসবে, আর নয়ত একেবারে সন্ধ্যায় এসে লাশ নিয়ে যাবে।

পৃষ্ঠা ২২

নালার পাড়ে একটা ছোট ঝোপের ভিতরে শুয়ে পড়লাম। আমার বুক থেকে মাথা পর্যন্ত কেবল পাড়ের উপরে প্রায় পাড়ের সমান সমান হয়ে রইল—বাকী শরীর বিছিয়ে দিলাম নালার ঢালে। ঝোপের ভিতর দিয়ে কেবল বন্দুকের নলের আগা খোলাতে রইল যদি ইতিমধ্যেই না দেখে ফেলে থাকে তাহলে বাঘ খুব লক্ষ্য না করলে ঝোপের ভিতরে ও খালের ঢালে আমাদের দুইজনকে বা আমার বন্দুক দেখতে পাবে না। বাওয়ালীকে আমার বাম পাশে চুপ করে শুয়ে পড়তে বললাম। সে সামনে, বাম দিকে এবং মাঝে মাঝে পিছনের নালার দিকে লক্ষ্য রাখবে। বাঘ দেখলে বা কোন নড়াচড়া দেখলেই,

কথা বলবে না, ফিফিস্ত্ত করবে না, কেবল আঙুল টিপে আমাকে দেখাবে। বাওয়ালীর অর্ধভুক্ত দেহ এখন আমাদের থেকে পনের-ষোল হাত দূরে সোজা পূবে । বাঘ আমাদের আসার আওয়াজ শুনে মরি ফেলে গেছে যে সে-ও একেবারে সোজা পূর্ব দিকে যে পথে গেছে এখন যদি সেই পথেই আবার আসে তাহলে আমাকে বন্দুক একটুও ঘুরাতে হবে না; নল, মরি আর বাঘ এক সরল রেখায় থাকবে। আর যদি বাঘ ডান বা বামদিক থেকে ঘুরা পথে আসে তাহলেই কেবল আমাকে বন্দুকের নল ঘুরাতে হবে।

ধূর্ত নরখাদক এরমধ্যে আমাদের অবস্থান দেখে থাকলে একটা খুব দূর-সম্ভাবনা ছিল যে চক্কর দিবে, অর্থাৎ দূর দিয়ে নালা পার হয়ে পিছন থেকে এসে আমাদের উপরে পড়বে। কিন্তু বিশাল বড় বাঘ হলেও এক লাফে সেই নালা পার হতে পারবে না, দুই লাফ দিতে হবে এবং সে ক্ষেত্রে ভাটা নালার কাদাতে বা এই পাড়ের অংশে ঝপ্ শব্দ শুনে ঘুরে দাঁড়ানোর একটা সুযোগ আমি পাবই। অবশ্য সেটা ছিল খুবই দূর সম্ভাবনা। প্রায় এক ঘন্টা, সোয়া ঘন্টার মধ্যে আমার দুই চোখের পাতা বোধ হয় একবারও পড়েনি। বনের মধ্যে কোন দিকে একটি শব্দও উঠেনি, কেবল বাতাসে পাতা কাঁপার আওয়াজ ছিল। নালার উল্টা পাড়ে, তা-ও প্রায় সিকি মাইল দূরে হবে, একবার একটা মোরগের ডাক শোনলাম, কিন্তু সেটাকে কোন ভয়ার্ত ডাক বলে মনে হয়নি।

আমার মনে বরাবরই কেন জানি একটা ধারণা ছিল যে, বাঘ পূব দিকে যে গেছে আবার সেই পূব দিক থেকেই আসবে। ঠিক সেদিক থেকেই এল । প্রায় দুইশ হাত সোজা পূবে গাছের ডালে এক বানর খক! খক! করে ডেকে উঠল, ভয়ার্ত ডাক শোনামাত্র আমি বুঝতে পারলাম যে বাঘ আসছে। প্রতিটি মুহূর্তের প্রত্যাশায় রুদ্ধ নিঃশ্বাসে বন্দুকের কুন্দা কাঁধে ঠেকিয়ে মরিসোজা চোখ রেখে চেয়ে রইলাম। দশ মিনিট পরে বাঘ দেখলাম, পূব দিক থেকে সোজা আসছে। মরি থেকে হাত দশেকের মধ্যে এসে থমকে দাঁড়াল, বাওয়ালীর দেহটা দেখল, একবার ডানে একবার বামে মুখ ঘুরাল এবং তারপর আরো প্রায় ছয় হাত এগিয়ে এল ।

কট্-কট্ করে একটা বনমোরগ ডেকে উঠল ডান পাশে, তৎক্ষণাৎ থমকে দাঁড়িয়ে বাঘ সেদিকে মুখ ঘুরাল। সোজা ঘাড়ে গুলি করলাম। দোনলা বেলজিয়াম বন্দুকের এল.জি-র গুলি, বাঘ যেখনে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই পড়ে গেল। গর্! গর! করে একটা গোঙানি শোনলাম মিনিটখানেক, তারপর বিশাল আকারের মানুষখেকো বাঘটা নিথর হয়ে পড়ে রইল।

পৃষ্ঠা ২৩

উঠে খালের পাড়ে দাঁড়ালাম এবং দ্বিতীয় নলের গুলি বুকে মারলাম, বাঘ আর একটা পা-ও নাড়ল না। দুই নলে আবার কার্তুজ ভরে তখনো শুয়ে থাকা বাওয়ালীকে টেনে তোললাম এবং বাঘের শরীর বরাবর বন্দুক ধরে দুইজনে অতি সাবধানে কাছে এগুলাম। ভলক দিয়ে রক্ত ছুটছে আর চোখ বুজে পড়ে আছে মরা বাঘ। বন্দুকটা মাটিতে রেখে দুই হাতের তালু গোলাকার করে মুখে ধরে পাঁচবার ডাক দিলাম, ‘আল্লা আল্লা-আল্লা-আল্লা-আল্লাহ্!’ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অনেক পিছন থেকে বাওয়ালীদের ‘আল্লা আল্লা!’ ডাক শোনলাম। তখন বেলা সোয়া চারটা।

তেইশজন জেলে-বাওয়ালীকে খেয়েছে সেই মানুষখোকোটিকে আমি এই প্রথম দেখতে পেলাম। বুড়া বাঘা। সামনের কয়েকটা দাঁত নেই। শরীরের কয়েক জায়গায় ছাল উঠে গেছে, মানুষ ধরতে গিয়ে লাফ দিয়ে যে পড়েছে, গাছের শূলার বা চোখা ডালের খোঁচা লেগে লেগে ছাল চলে গেছে। বাওয়ালীরা “আল্লা-আল্লা!” ডাক দিতে দিতে সুন্দরবন ভেঙে এসে হাজির হল। বাঘ দেখে প্রথমে কিছুক্ষণ তারা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর হঠাৎ উল্লাসে ফেটে পড়ল। মরা বাওয়ালীর আত্মীয়েরা কাঁদতে লাগল ।

জানাজা পড়ে হতভাগ্য বাওয়ালীর লাশ আমরা খালের পাড়েই একটা পরিষ্কার জায়গায় দাফন করলাম। আর বাঘের চার পা লতা দিয়ে বেঁধে, পায়ের ফাঁকে খুব শক্ত একটা মোটা ডাল দিয়ে ছয়জন বলিষ্ঠ বাওয়ালী বাঘকে বহন করে নিয়ে এল নৌকায় । রাত্রেই আমরা পৌছলাম বুড়ী গোয়ালিনী বন অফিসে এবং তৎক্ষণাৎ ওয়ারলেস করে খবর পৌছানো হল খুলনা বিভাগীয় বন অফিসে। ফিতা দিয়ে মেপে দেখা গেল পৌনে বারো ফুট লম্বা; এত বিশাল আকারের বাঘ কমই চোখে পড়েছে আমার।

পরদিন সকালে শত শত লোকের সামনে এই বাঘ ছোলাই করা হল সেই দিনই বহু লোকের সামনে অনেক ঘটা করে বন দফতর থেকে আমাকে তখনকার নগদ ৫০০ টাকা পুরস্কার দেওয়া হল, আমার ফটোও তোলা হল। মহা ত্রাস দূর হয়ে গেলে অতঃপর সুন্দরবনের আঠারবেকী মৌজায় জেলে-বাওয়ালীরা আবার নিশ্চিন্তমনে তাদের রুজি-রোজগার করতে শুরু করল ।

এরপরে খবরের কাগজের কয়েকজন ভাই আমার মুখ থেকে এই বাঘ শিকারের কাহিনী সংগ্রহ করে ঢাকার পত্রিকায় ছাপান। সে সব খবরের কোন কোনটি আমি কেটে রেখে দিয়েছিলাম । ইত্তেফাকের একটি সংবাদের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে আমি এই কাহিনী সমাপ্ত করব। 

“সুন্দরবনের দুর্ধর্ষ শিকারী। রোমাঞ্চকর কাহিনীর নায়ক পচাব্দী (নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরীত) খুলনা, ২৪শে। পচাব্দী নামটি সুন্দরবনের গল্পকথায় পরিণত হইয়াছে। বস্তুতঃ এই নামটি সুন্দরবনের রয়াল বেঙ্গল টাইগারের নিকটও আতঙ্কের কারণ। পচাব্দী গাজী সম্প্রতি সুন্দরবনের বুড়ী গোয়ালিনী রেঞ্জে একটি বার ফুট দীর্ঘ বাঘ মারিয়াছেন। খুলনা বিভাগীয় বন অফিসার জনাব এ. আলীম বলেন যে, সুন্দরবনের ইতিহাসে এ পর্যন্ত যতগুলো বাঘ মারা হইয়াছে ইহা তার মধ্যে দীর্ঘতম। তিনি আরও বলেন যে, ইহা বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ বাঘ। গত দুই মাস ধরিয়া এই মানুষখেকো বাঘটি সুন্দরবন এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করিয়া রাখিয়াছিল এবং এ পর্যন্ত বাঘটি ২১ (২৩) জনের প্রাণনাশ করিয়াছে।”

দ্বিতীয় পর্ব: সুন্দরবনের মানুষখেকো – পর্ব ২
তৃতীয় পর্ব: গোলখালীর বিভীষিকা – পর্ব ৩

বইয়ের পরবর্তী অংশ ওয়েবসাইটে আপলোড করা হবে শীঘ্রই। চোখ রাখুন ভ্রমণ গ্রুপ Green Belt The Travelers ফেসবুক গ্রুপে।

আরো পড়ুন

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ১

কুস্কো এয়ারপোর্টে নামতেই আমার নামের সাইন নিয়ে মধ্য বয়সী এক মহিলাকে এদিক ওদিক তাকাতে দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। হাত তুলে ইশারা করতে এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দিল, দোভাষী এবং ট্যুর গাইড। লিমার ট্রাভেল এজেন্টকে আগা-গোঁড়া বিশ্বাস করতে পারিনি বলে নিজকে ধিক্কার দিলাম, ট্যুরের পুরু টাকাটা আগাম তুলে দিতেও কেন জানি মন সায় দিচ্ছিলনা। তবু দিতে হল কারণ এ ছাড়া দ্বিতীয় কোন পছন্দ আমার সামনে খোলা ছিলনা। পৃথিবীর এ প্রান্তের মানুষগুলোর সাথে নিউ ইয়র্কে পরিচয় থাকলেও স্বদেশে তাদের পরিচয় কতটা বান্ধবসূলভ হবে তার কোন ধারণা ছিলনা। সবকিছু কথামত কাজ করায় বিদেশ বিভূঁইয়ে সাহসটা বোধহয় একটু বেড়েই গেল। দক্ষিণ আমেরিকার পেরু নামের দেশটার মানুষগুলোর আচরণে প্রথম হতেই বেশ মুগ্ধ হতে বাধ্য হলাম।

১৯৯০ মডেলের নড়বড়ে টয়োটা সিডানে নড়ে-চড়ে বসতেই অবাক হয়ে খেয়াল করলাম এ যে দেখছি পুরোপুরি গ্রীষ্মকাল! অথচ ঘণ্টা দুয়েক আগে ফেলে আসা রাজধানী লিমায় তখন ছিল কনকনে শীত। ভাঙা ইংরেজিতে পরিচয় পর্ব সেরে প্রথমেই জানতে চাইলাম আমার ট্যুর আইটেনের‌্যারী। যেহেতু সপ্তাহান্তে আমাকে নিউ ইয়র্কের রিটার্ন ফ্লাইট ধরতে হবে তাই আশ্বস্ত হতে চাইলাম কোথাও কোন ত্রুটি নেই। আসলেই কোন ফাঁক ফোকর খুঁজে পেলামনা, ঠাণ্ডা হয়ে গাড়ির বাইরে চোখ ফেরাতেই মনটা হাল্কা হয়ে গেল। থরে থরে সাজানো আন্দিজের চূড়া, তার পদতলে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে ইন্‌কা সভ্যতার ঐতিহাসিক সাক্ষী কুস্‌কো নগরী, পেরুর দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ৩৫০০ মিটার উচ্চতায় উরুবাম্বা ভ্যালির পাদদেশ জুড়ে প্রাচীন সভ্যতা এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি দেখতে পৃথিবীর এ অঞ্চলটায় ভ্রমণকারীদের ভিড় লেগে থাকে বছর জুড়ে।

১০ মিনিটের ভেতর পৌঁছে গেলাম হোটেলে। ’হোটেল রয়্যাল ইন্‌কা-২’, অতিরিক্ত কোন জৌলুষ ছাড়াই হোটেলটার আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলাম। রুমের সুবিশাল কাচের জানালাটা খুলে দিতেই চোখের সামনে লুটিয়ে পরল পাহাড় আর মেঘ রাজ্যের মিলন মেলা, দিগন্ত রেখায় ঈগল পাখীদের উদ্দেশ্যহীন বিচরণ পরিবেশটায় এক ধরনের ভৌতিকতা এনে দিল। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম অনেকক্ষণ, আন্দিজের আগ্রাসী চূড়া আর সুবিশাল আকাশ ফুড়ে কেন জানি মেঘনা পাড়ের গ্রামের সেই ছোট্ট বাড়িটায় ফিরে যেতে মন চাইছিল। এ এক ধরনের নস্টালজিয়া বোধহয় সব বাংলাদেশীকেই কম বেশী তাড়িয়ে বেড়ায়। সূর্য মধ্য গগনে উঠার আগেই সাক্সাই ওয়্যামান (পেরুভিয়ানরা ঠাট্টা করে বলে থাকে সেক্সি ওম্যান!) নামের একটা ঐতিহাসিক ভ্যালি দেখতে চলে গেলাম ।

সন্ধ্যা নামতেই প্রচণ্ড শীতে গ্রাস করে নিল লোকালয়, আন্দিজের চূড়াগুলো ঢেকে গেল কুয়াশার চাদরে। শহরের আলো আধারী নিয়ন বাতিগুলোকেও গ্রাস করে নিল ঘন কাল কুয়াশা। দুপুরের ভ্যাপসা গরমের কুস্‌কো শহর রাত হতেই ভোজবাজির মত মিলিয়ে গেল প্রকৃতির কোলে। আমার শুধু অবাক হওয়ার পালা, কোনটা রেখে কোনটা দেখব! হোটেলের লোকজন জানাল শহরের প্রধান চত্বরে আজ রাতে ইন্‌কাদের বিশেষ অনুষ্ঠান হচ্ছে, বাহারি পোশাক এবং আঞ্চলিক গানের তালে তালে ইন্‌কাদের দেখতে চাইলে আজকের রাতটাই বিশেষ রাত। কিন্তু উপায় ছিলনা, আমাকে সকাল সকাল বিছানায় যেতে হবে। হোটেলে পা রাখতেই দেখা পেলাম সকালের ট্যুর গাইডের। এক কাপ বিদঘুটে রঙের চা বাড়িয়ে দিল, কোঁকা টি। হাই আলটিট্যুডে কোঁকা টি এক ধরনের এন্টডোট হিসাবে কাজ করে। চুমুক দিতেই বিস্বাদে তিতিয়ে গেল মুখ, কিন্তু ইসাবেলার (গাইড) হুশিয়ারিতে পুরো কাপটাই শেষ করতে হল।
ভোর ৭টায় উঠতে হবে তাই রাতের খাবার খেয়ে সকাল সকাল ঘুমিয়ে পরলাম। পরবর্তী ঠিকানা মাচা পিচু।

মধ্যরাতে প্রচণ্ড মাথা ব্যথায় ঘুম ভেঙে গেল, দম বন্ধ হয়ে আসছিল যেন। কি করবো বুঝতে পারছিলামনা। এ শরীর নিয়ে ভোরের ট্রেন জার্নিটা অসম্ভব বলেই মনে হল। এমন একটা পরিস্থিতি যে হতে পারে তা একেবারে অজানা ছিলনা। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে এত উঁচুতে শ্বাস নেয়া কষ্টকর আগেই জানতাম কিন্তু এতটা হবে ভাবতে পারিনি। কোকা টি’র রহস্যটা বুঝতে একটু বোধহয় দেরীই হয়ে গেল। খুবই হাই ডোজের দুটো ’এডভিল’ খেয়ে লাশ হয়ে পড়ে রইলাম দক্ষিণ আমেরিকার কোন এক অজানা-অচেনা হোটেলে।

ওয়্যক-আপ কলে ঘুম ভাঙতেই বেশ হাল্কা মনে হল নিজকে। মধ্যরাতের অভিজ্ঞতাটা দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই ভাবতে চাইলাম-না। এক কাপ চা ঝটপট চুমুক দিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে ধাবিত হলাম রেল ষ্টেশনের দিকে। ট্রেন মিস করা চলবেনা কিছুতেই। কাক-ডাকা ভোরের মায়াবী পরিবেশ ভেদ করে পেরু রেলের ঝকঝকে ট্রেনটাকে প্লাটফরমে দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল প্রশান্তিতে, মাচা পিচু দেখা হচ্ছে তাহলে এ যাত্রায়। মাচা পিচু – অথবা দ্যা লস্ট সিটি অব ইন্‌কাস। কুস্‌কো হতে ৭০ মাইল উত্তর-পূবে সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে প্রায় ২,৫ কিলোমিটার উচ্চতায় আশ্চর্য এক আর্কিওলজিক্যাল আবিষ্কার। স্প্যানিশ উপনিবেশবাদের ধ্বংস যজ্ঞ হতে রক্ষা পেতে ইন্‌কারা পাহাড়ের বিশাল উচ্চতায় এমন একটা নিশ্ছিদ্র আশ্রয় কি করে তৈরি করেছিল তা আবিষ্কারকদের জন্যে আজও এক বিশাল বিস্ময়। ১৯১১ সালে মার্কিন ইতিহাসবিদ হিরাম বিংগহাম ইনকাদের ট্রেইল খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কারের করেন পৃথিবীর অন্যতম এই আশ্চর্য সৃষ্টি। এর আর্কিওলজিক্যাল গুরুত্ব এবং স্থাপনার কারিগরি দিক নিয়ে এখনো চলছে আলোচনা, গবেষণা এবং বিতর্ক।

ঘন কুয়াশার বুক চিড়ে সকালের আলো ইতিউতি করছিল দিগন্ত রেখায়। ঘুম ভাঙছে পাহাড়ি মানুষের। উপত্যকার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা বাড়ি ঘরে মিট মিট করছে বিদ্যুৎ বাতি। ট্রেনটা অদ্ভুত কায়দায় পাহাড়ের উচ্চতা অতিক্রম করছে, একবার সামনে আবার পিছনে, হেলে দুলে এগিয়ে চলছে সাপের মত। একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় উঠে স্বাভাবিক যাত্রা শুরু হল। আন্দিজ পর্বতমালার বুক চিড়ে এগিয়ে চলল আমাদের ট্রেন।

খুব ছোট হতেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে অনেক প্রশ্ন করেছি, সৌরজগতের সৃষ্টি নিয়ে বহু তত্ত্বে হাবু ডুবু খেয়েছি। ঠিক ঐ মুহূর্তে কেন জানি কোন কিছুতে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিল। প্রকৃতির এ মোহনীয় সৌন্দর্য আপনা হতে সৃষ্টি হতে পারে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল। ট্রেনের পাশাপাশি কল কল করে বয়ে চলছে পাহাড়ি খরস্রোতা ওর‌্যোবাম্বা নদী। এবং সে নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট লোকালয়। অদ্ভুত কায়দায় সন্তানকে এক টুকরো কাপড়ে বেধে পিঠে করে পাহাড় বেয়ে যাচ্ছে মা, হাতে কুড়ানো লাকড়ি। সমস্ত মুখে কঠিন লড়াইয়ের ছাপ। নেশা ধরে যায় এসব দেখতে।

হোস্টেজ এসে সকালের নাস্তা অফার করলো। প্রকৃতির নৈসর্গিক মিলন মেলায় জাগতিক খাওয়া দাওয়া কেমন যেন বেখাপ্পা মনে হল, মনে হল কেউ যেন ঘুমাচ্ছে আর আমরা তার ঘুম ভাঙ্গাচ্ছি অনাকাঙ্ক্ষিত আগ্রাসনে। হা হয়ে থেমে গেল আমার খাওয়া, সাদা ধবধবে বরফে ঢাকা পাহাড়ের চূড়া হতে সূর্যের আলোর বিকিরণ হচ্ছে, মনে হচ্ছে আয়না দিয়ে কেউ বোকা বানাচ্ছে আমাদের। মাথার উপর আকাশ মাঝে মধ্যে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের আগ্রাসনে, সবুজের মেঘমালায় থরে থরে সাজানো বিভিন্ন চূড়া। হাল্কা ’এল কন্ডের পাসা’ গানের সূরটা ঐশ্বরিক এক আবহ সৃষ্টি করলো ট্রেনের কামরায়, ১০-১৫ জন যাত্রীর মুখের ভাষা কোন এক জাদু মন্ত্রে আটকে গেল। সারা জীবন রোমাঞ্চিত হয়েছি মেঘের বিশালতা নিয়ে, কিন্তু পাহাড়ের বিশালতার কাছে মেঘের এমন বাধাহীন সমর্পণ দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। রাশি রাশি মেঘ অসহায়ের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে পাহাড়ের গলা সমান উচ্চতায়।

কোন কারণ ছাড়াই থেমে গেল ট্রেনটা, বেশ কিছুক্ষণ আটকে রইলাম একটা জায়গায়। ভয় থাকলেও নেমে পড়লাম ট্রেন হতে। কুস্‌কো হোটেলের সবাই আমাকে সাবধান করে দিয়েছিল এ ধরনের এডভেঞ্চার হতে বিরত থাকার জন্যে। নিকট অতীতে মাওবাদী আবিমেইল গুজমান এবং তার সাইনিংপাথ গেরিলাদের চোরা হামলার এটাই না-কি ছিল মোক্ষম পথ। কে শোনে কার কথা, হুরমুর করে নেমে পড়লো সবাই। একদিকে পাহাড়ি নদীর কল কল শব্দ, অন্যদিকে বন্য পাখীদের কিচিরমিচির গান, আর চারদিকে ভৌতিক নিঃশব্দতায় আন্দিজ পর্বতের বিশালতা। এগুলো বর্ণনার ভাষা আমার মত কাঁচা লেখকদের কলম যথেষ্ট নয়। এসব দেখা যায়, অনুভব করা যায় কিন্তু ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। হাল্কা একটা হুইসিল দিয়ে আমাদের কামরায় ফিরে যাওয়ার নোটিশ দিল ট্রেন চালক। হোস্টেজ এসে জানালো সামনে ওইয়াটাইটামবো নামের বড় একটা ষ্টেশনে থামবে ট্রেনটা এবং এর জন্যে আমাদের খাড়া হয়ে অনেক নীচে নামতে হবে। রেললাইনে কাজ হচ্ছে, তাই এ অপ্রত্যাশিত বিরতি।

সীটে বসে সান্‌রুফ দিয়ে আকাশ দেখতে শুরু করলাম। মড়মড় শব্দে নড়ে উঠলো রেললাইনের কাঠগুলো, নীচে নামছি আমরা। কিছুদূর যেতেই চোখে পড়লো ষ্টেশনটা। বাহারি পোশাকে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে অপেক্ষা করছে এক গাদা এন্ডিয়ান তরুণী। নামতে হবে আমাকে, ভেতর থেকে তাগাদা অনুভব করলাম ছবি তোলার এটাই মহেন্দ্রক্ষণ।

ওইয়াটাইটাম্বো ষ্টেশনে ট্রেনটা থামতেই দু’দিক হতে ঝাঁপিয়ে পড়লো ফেরিওয়ালাদের কাফেলা। ৪/৫ বছরের ছোট বাচ্চা হতে ৮০ বছরের বৃদ্ধা। হাতে হরেক রকমের সওদা; কম্বল, স্কার্ফ, আলপাকা পশুর লোম দিয়ে তৈরি বাহারি শীতকালীন পোশাক। অনেকের পিঠে ঝোলানো ছোট ছোট বাচ্চা। কুস্‌কো হতে যারা বাসে করে মাচু পিচু যাচ্ছে তারা এ ষ্টেশনে ট্রেন ধরছে। চারদিকে হৈ হোল্লর, চেঁচামেচি। যে পাহাড়ি নদী এতক্ষণ ডান-বা করে সাপের মত আমাদের অনুসরণ করছিলো খুব কাছ হতে তাকে দেখলাম। ষ্টেশনটার বুক চিড়ে উন্মাদের মত নামে যাচ্ছে যেন। পানির এত রাক্ষুসে শক্তি থাকতে পারে পাহাড়ি নদীর তাণ্ডব না দেখলে ধারণা করা অসম্ভব। এলোমেলো হাটা হাটি করলাম কিছুক্ষণ প্লাটফরমের বাইরে, দু’টো চাবির রিং কিনলাম নিউ ইয়র্কের বন্ধুদের জন্যে। পাহাড় পাহাড় আর পাহাড়, এ যেন পাহাড়ের সমুদ্র। আন্দিজের এ অংশটার সাথে পেরুর অন্য এলাকার, ইকুইডোর এবং বলিভিয়ার আন্দিজের ব্যাপক তফাৎ; এখানে পাহাড়ের শরীর সবটা ঢেকে আছে সবুজের আচ্ছাদনে, আর বাকি আন্দিজ শুধুই তামাটে, গাছপালা বিহীন উলঙ্গ এক দৈত্য যেন। একটা জিনিষ দেখে চমকিত হলাম, প্রেসিডেন্ট প্রার্থী আলেহান্দ্রো তলেদোকে ভোট দেয়ার জন্যে দেয়ালে দেয়ালে চিকা। বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো, নির্বাচনে আমাদের বাড়ির দেয়ালটার করুন চেহারাটা চাইলেও ভুলা সম্ভব ছিলনা।

মিনিট বিশেক পরে হিস হিস করে এগিয়ে চলল আমাদের ট্রেনটা। আমার ট্যুর গাইড আকাশ ফুরে কোত্থেকে উদয় হল যেন, কুসকো ষ্টেশনে তার সাথে শেষ দেখা এবং কথা ছিল মাচু পিচু ষ্টেশনে আমাকে খুঁজে বের করবে। বিদেশে বিভুয়ে হারিয়ে যাওয়ার ভয় অনেক আগেই কেটে গেছে। পকেটে দু’একটা ক্রেডিট কার্ড আর চলনসই ইংরেজি জানা থাকলে হারানোটা কোন সমস্যাই না, বরঞ্চ এ এক ধরনের এডভেঞ্চার। ব্রীফ করলো আমার ট্যুরের পরবর্তী অংশটুকু। বেশ ক’টা টিকেট ধরিয়ে দিল কাজে লাগবে বলে। এক ধরনের অস্থিরতা পেয়ে বসলো আমায়। তর সইছে না যেন। ট্রেনের জানালায় মাথা গলিয়ে উৎসুক হয়ে কি যেন খুঁজছে সবাই। একই প্রশ্ন সবার চোখে মুখে, আর কতদূর? দূর হতে ষ্টেশনটা দেখে মনটা একটু দমে গেল। এ যে দেখছি একেবারেই সাধারণ। অসংখ্য মানুষের মিছিল, ফেরিওয়ালাদের ভিড় আর থরে থরে সাজানো দোকান পাটের মিছিলে স্বপ্নের মাচু পিচুকে খুঁজে পেলামনা। প্লাটফরমে পা রাখতেই ঠাণ্ডা একটা পাহাড়ি বাতাস সমস্ত শরীরকে ঝাঁকি দিয়ে গেল। পেরুর জাতীয় পোশাক আর বাদ্যযন্ত্র নিয়ে অপেক্ষা করছে একটা গ্রুপ। ঝন ঝন করে উঠলো তাদের বাদ্যযন্ত্র। পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এলো সে সূরের মূর্ছনা। চমকে উঠলাম আমি, আরে তাইতো, ঠিক এরকম একটা দৃশ্যইতো দেখেছিলাম অস্ট্রেলিয়ার এসবিএস টিভিতে যা পৃথিবীর এ প্রান্তে আসতে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। আকাশের দিকে চাইলাম। ছেড়া ছেড়া মেঘ ছাড়াও বিন্দু রেখার মত ছোট একটা বাসের চলাচল চোখে পড়লো। নিথর হয়ে আসলো হাত-পা, আমাকে উঠতে হবে ঐ উচ্চতায়। তারপরই কেবল দেখা মেলবে হারানো ইনকা রাজ্যের।

হরেক রকমের ভাষা আর মানুষের কোলাহলে মুখরিত হয়ে উঠলো রেল ষ্টেশন। খালি পা আর অর্ধ উলঙ্গ পশ্চিমা দুনিয়ার বাহারি ভ্রমণকারীদের নিয়ে স্থানীয়দের তেমন কোন মাতামাতি লক্ষ্য করলাম না। হয়ত সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে মেনে নিয়েছে সবকিছু। আবাসিক হোটেল গুলোর অবস্থা অনেকটা ঢাকার মগবাজার মোড়ের হোটেল গুলোর মতই শ্রীহীন, বয়সের ভারে নূয্য। পাশাপাশি ঝকঝকে বিশ্বমানের হোটেল গুলো বেশ ফাকা মনে হল। একটা জিনিষ ভ্রমণ করলে শেখা যায়, যারা নিয়মিত পৃথিবীর অলি গলি চষে বেড়ায় তাদের কাছে হোটেলটা শুধু রাতটা কাটানোর একটা আশ্রয় মাত্র, এর কোয়ালিটি নিয়ে ব্যক প্যাকার্সরা খুব একটা মাথা ঘামায় না। এমনটা যেমন কোলকাতার সদর ষ্ট্রীটে দেখেছি এখানেও এর কোন ব্যতিক্রম চোখে পরলনা।

আমার ট্যুর গাইড এসে মাচু পিচুর উপর প্রফেশনাল এক গাইডের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল, স্থানীয় এ্যক্সেন্টের ইংরেজি বুঝতে খুব যে একটা সুবিধা হবেনা তা নিয়ে একটু চিন্তায় পরে গেলাম। মিনিট দশেক পায়ে হেটে বাসে চড়ে বসলাম। হিসাব করে দেখলাম ড্রাইভারের পাশের সীটটা হচ্ছে মোক্ষম জায়গা, প্রায় গায়ের জোড়ে দখল করে নিলাম কাঙ্ক্ষিত সীটটা। শুরু হল যাত্রা। ভার্টিক্যাল জার্নি বলে কোন টার্ম আছে কিনা জানিনা, বাসের সামনের চাকা আর পিছনের চাকার ভেতর ৪৫ ডিগ্রী তফাৎ নিয়ে এ যাত্রাকে অন্যকোন নামে আখ্যায়িত করার ভাষা খুঁজে পেলামনা।

রোম শিউড়ে উঠার মত যাত্রা। সরু এবং আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ। উলটো পথে কোন যানবাহন আসলে পিলে চমকে উঠে, এই বুঝি গড়িয়ে পরলাম পাহাড়ের মৃত্যু ফাঁদে! মাটি এবং ধূলার রাস্তা মাঝে মধ্যে বিপদজনক বাক। সামনের সীটে বসে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া ট্রেন ষ্টেশনটাকে মনে হল এক খণ্ড কাপড়। শ্বাস বন্ধ করে শুধুই ডানে বায়ে চোখ ফেরালাম, কোথায় সে মাচু পিচু!

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ২
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৩
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৪
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৫

দেখে এলাম নাফাখুম জলপ্রপাত

যে ঝিরি পথ পায়ে হেটে পার হওয়া যায় শুনেছি, সেই ঝিরি পথ নদী হয়ে ওঠায় আশ্চর্য হলাম খুব। পায়ে হেঁটে নয় আমরা ট্রলারে সেই ঝিরিপথ ধরে এগিয়ে চললাম। মজাই লাগছিল, জীবনে প্রথম আমার এমন অভিজ্ঞতা, পাহাড়েই এসেছি এই প্রথম। আমাকে গাইড করবে বলে যার আগমন আহারে বেচারা, আমারই তাকে গাইড করতে হচ্ছে। ফেরার পথে তার সেকি এক চিৎপটাং অবস্থা। তবে ভয় যে পাইনি বলা যাবে না। ট্রলারে যাত্রা শেষ হতেই শুরু হলো ট্রেকিং। ঝিরির পানিতে পা দেয়া মাত্রই পা দুটো শিরশির করে উঠলে। একটু ফসকালে পানিতে  ধপাস জেনে হাতে বাঁশের কঞ্চি তুলে নিলাম। ওহহাে, আমি কিন্তু সাঁতারজানি না। মনে মনে বলি বাপু সাবধান পা ফসকালে নির্ঘাত ডুবে মরবে। এভাবেই নানান ভাবনা চিন্তায় হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম যেখানে তাকে আমার পুলসিরাত বলেই মনে হল, ঝিরির এপার ওপার দড়ি বাঁধা।

দড়ির সামনে পেছনে তাকালেই দেখা মেলে তুষার স্রোতের ঘূর্ণি ভেদ করে । সেই দড়ি ধরে সৃষ্টিকর্তার নাম নিয়ে এগিয়ে চললাম। রশিতে হাত লাগানাে আর এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করি অত আর ভয় করছে না! প্রশ্ন করতেই পারেন কই যাচ্ছি। যাচ্ছি নাফাখুম, এসেছি গতরাতে। সারাপথ খুব ভালােয় ভালােয় এগিয়ে বৃষ্টিতে পড়লাম থানচি এসে। তবু পাহাড় আর জলপ্রপাতের টান বলে কথা। আমার সারাটাদিন মেঘলা আকাশ বৃষ্টি তোমাকে দিলাম বলে ট্রলারে চাপলাম। মনে মনে বললাম ভয়ের কিছু নাই, মরতে তাে হবেই, সে রাতে আমরা রেমাক্রি ছিলাম। পরদিনও বৃষ্টি কমার নাম নিলাে না। শেষমেষ বৃষ্টিকে সখা করেই নাফাখুমের পথ ধরলাম।

দড়ি বেঁধে খাল পার হওয়া।

জোঁককে আমি ভয় পাই খুব, সে জন্যই মনে হয় জোক আমার ধারে কাছেই ছিলাে না। তবে আমাদের দলের দুজনকে জোক কামড়ে ধরেছিল। আমি কখনােই অতিসতর্ক ছিলাম না। ট্রলার থেকে নেমেই নির্ভাবনায় এগিয়ে চলছিলাম। কর্দমাক্ত গভীর জঙ্গল এর মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছিলাম বাঁশের কঞ্চি গেঁথে গেঁথে। কখনও কখনও গাছের ডালপালা জড়িয়ে ধরে চড়াই পার হচ্ছিলাম। এভাবেই ঘন্টা দেড়েক ক্লান্তিকর পথ চলার পর সেই পুলসিরাত মনে করা দড়ি বা রশির সামনে এসে কিছু সময়ের জন্য ভীষন চিন্তায় পড়ে যাই। অবশেষে সাহস করে সেই দড়িও পার হয়ে যাই।

এভাবেই আরো ঘন্টাখানেক চলার পর তীব্র গর্জন কানে আসে। বৃষ্টি হচ্ছে তখনাে সুতরাং দৌড়ে ছুটে যাবার উপায় ছিলাে না। কেননা ক্রমাগত একটানা ক্লান্তিকর চড়াই ভেঙ্গে, কখনো পাথরের উপর আবার কখনাে কর্দমাক্ত পিচ্ছিল পথ ধরে দৌড়ে ছুটে চলা আমাদের জন্য দূরহ ছিলাে বটে। তবু আমরা দ্রম্নত পা চালাই। এভাবেই এক সময় নজরে আসে নাফাখুম জলপ্রপাতের জলধারা। আরাে কিছু পথ যেতে চোখ আর সরতে চাচ্ছিলো না। সবাই জলপ্রপাতের গর্জনে দিশেহারা হই, আবার সতর্কতাও ছিলাে। কেননা অঝাের না হলেও বৃষ্টি তখনাে ছিলাে। আর পিঞ্ছিল পাথরের ওপর দিয়ে দৌড়ে ছুটাও সম্ভব ছিলাে না। তবু আমরা দ্রুত এগিয়ে যাই, তারপর তাে ফেরার কথাই ভুলে যাই ভুলে যাই বৃষ্টির পানিতে মােবাইল বা ক্যামেরা ভিজে ওঠার কথা। এসব কিছু ভুলে ছবি তুলে চলি একটানা সঙ্গে নাফাখুমের জলধারা দেখি মুগ্ধ নয়নে। এদিকে বৃষ্টির বেগ বাড়ছিল সঙ্গে রেমাক্রি ঝিরির পানিও ফুলে ফেঁপে উঠছিল। গাইডের তাড়া খেয়ে নাফাখুম কে বিদায় বলে ফিরতি পথ ধরি

বর্ষার নাফাখুম ঝর্ণা।

কিভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে বান্দরবান। ঢাকা বান্দরবান বাস ভাড়া ননএসি ৬৬০ টাকা। বান্দরবান থেকে বাসে বা দল ভারী হলে চাঁন্দের গাড়িতে থানচি। দল ছোট হলে বাসে যেতে পারবেন। বাসে অবশ্য সময় অনেক বেশি লাগে। বাস ভাড়া জনপ্রতি ২০০ টাকা। চান্দের গাড়ি বা জীপ ভাড়া রিজার্ভ ৪০০০  থেকে ৫০০০ টাকার মতো। থানচি রাত্রিযাপন করে অথবা সেদিনই ট্রলারে চেপে তিন্দু হয়ে চলে আসেন রেমাক্রি। রেমাক্রি পৌছে পরদিন সকাল সকাল বের হয়ে চলে যান নাফাখুম। পুরাে বেলা সেখানে কাটিয়ে দুপুরের পর ফিরতি পথ ধরুন। নাফাখুমের পথে পর্যাপ্ত পানি আর শুকনা খাবার অবশ্যই সঙ্গে রাখবেন। লাইফ জ্যাকেট সঙ্গে রাখবেন। পরিবেশ নষ্ট হওয়ার মত তেমন কিছু করবেন না এবং অপচনশীল কিছু বনে কিংবা জলপ্রপাতের আশেপাশে এবং রেমাক্রি খালে ফেলবেন না! নাফাখুম ভ্রমণের পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন এখানে দেখুন।

আরো পড়ুন

নাফাখুম ভায়া আলীকদম ট্রিপ কথন

যেসব স্থান ঘুরলাম :

⦿আলীকদম ডিম পাহাড় ⦿তিন্দু বড় পাথর/রাজা পাথর ⦿রেমাক্রি ফলস ⦿নাফাখুম জলপ্রপাত ⦿নাফাখুম পাড়া ⦿চিম্বুক পাহাড়

শুরুতেই স্পটগুলাে নিয়ে সংক্ষেপে বলে রাখি

ডিম পাহাড়: পাহাড় আলীকদম এবং থানচি উপজেলার ঠিক মাঝখানে অবস্থিত। এই পাহাড় দিয়েই দুই থানার সীমানা নির্ধারিত হয়েছে। এই পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে সমুদ্র সমতল থেকে আড়াই হাজার ফুট উঁচুতে নির্মাণ করা হয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু সড়কপথ। আড়াই হাজার ফুট উঁচু এ পাহাড় চূড়ার আকৃতি দেখতে ডিমের মতাে হওয়ায় স্থানীয়রা একে ডিম পাহাড় নামেই চেনে।

তিন্দু বড় পাথর/রাজা পাথর: সাঙ্গু নদী বান্দরবান জেলার প্রধানতম নদী। সাঙ্গু নদীর তলদেশে ছােট আর মাঝারি পাথরের ওপর শ্যাওলার আধিপত্য। এ নদীরই উজানের দিকে একটি এলাকার নাম তিন্দু। তিন্দু মাতৃতান্ত্রিক মারমা ও মুরংদের আবাসস্থল। এখানে প্রায় ৮০০ থেকে ১ হাজার উপজাতি বসবাস করে। তিন্দু থেকে বড় পাথর ঘণ্টাখানেকের পথ। এই এলাকায় বড় আকারের বেশ অনেকগুলাে পাথর রয়েছে। আকারভেদে এলাকাবাসীরা এদের কয়েকটিকে ভিন্ন ভিন্ন নামে অভিহিত করেছেন। যেমনঃ রাজা পাথর, রানী পাথর, রাজার ছােট ভাই পাথর, কলসী পাথর ইত্যাদি। এলাকাটি স্থানীয়দের কাছে বেশ পবিত্র ও পূজনীয়। এখানে বেশ কিছু খাবার দোকান ও থাকার ঘরও রয়েছে।

রেমাক্রি ফলস: থানচি বাজার থেকে ইঞ্জিন বােটে চড়ে দুই/আড়াই ঘন্টার সাঙ্গু নদীপথ অতিক্রম করে নৌকা রেমাক্রির যে স্থানে থামাবে সেখানেই চোখে পড়বে রেমাক্রি ফলস এর মনােরম দৃশ্য। যদিও বর্ষা ছাড়া ফলস এ বেশি পানি থাকে না তবে বসন্তের ফলস কিন্তু কম সুন্দর নয়! এখান থেকেই শুরু রেমাক্রি খাল আর খালের ধার ঘেষেই রয়েছে বেশ কয়েকটি রিসাের্ট, যেখানে আগে বুকিং দিয়ে অনেকেই রাত কাটিয়ে থাকেন। খাবারের অনেকগুলাে দোকান এখানে পেয়ে যাবেন।

ছবি: নাফাখুম ঝর্ণা

নাফাখুম: রেমাক্রি থেকে ২ ঘন্টা ট্রেকিং করলেই দেখা মিলবে এই নাফাখুমের। মারমা ভাষায় খুম মানে জলপ্রপাত। রেমাক্রি খালের পানি এই জায়গায় এসে হঠাৎ করেই বাঁক খেয়ে নিচের দিকে ২৫-৩০ ফুট নেমে গিয়ে সৃষ্টি করেছে অপার্থিব নাফাখুম। খুমের ঠিক পাশেই কিছুটা পাহাড় বেয়ে উঠলেই নাফাখুম পাড়া। সেখানেই আমরা রাত কাটিয়েছিলাম। এই পাড়াতে কয়েকটা খাবারের দোকানও রয়েছে। গাইডকে শুধু আগে থেকে বলে রাখতে হবে যে কয়বেলা খাব, কি খাব, কয়জন খাব। বাকিটা উনিই ব্যবস্থা করবেন।

চিম্বুক পাহাড়: থানচি থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। আর বান্দরবান জেলা শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই পাহাড়ের উচ্চতা প্রায় ২৫০০ ফুট। পাহাড়ের চূড়া থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য যে কাউকেই মুগ্ধ করবে। এছাড়া চিম্বুকের এই রাস্তা ধরেই যাওয়া যায় আরাে কিছু দর্শনীয় স্থানে। যেমন- মিলনছড়ি, শৈলপ্রপাত, নীলগিরি, নীলাচল, মেঘলা, নীল দিগন্ত, বগালেক, কেওক্রাডং

ভ্রমণবৃত্তান্ত

ভ্রমণব্যাপ্তি: ২৭/০২/২০২০ রাত ৯.৪০ থেকে ০১/০৩/২০২০ ভাের ৬ টা

ভ্ৰমণসঙ্গী: আমি সহ ৭ জন ও গাইড বিরাজ দা

এই ট্রিপটা আমার জন্য ছিল একটা ড্রিম ট্রিপ। কারন নাফাখুম জলপ্রপাত আমার অন্যতম একটা ড্রিম প্লেস তাও লিপ ইয়ার ডেট অন্তর্ভুক্ত ছিল (২৯ ফেব্রুয়ারি)। এই তারিখটা যতবারই লাইফে আসবে ততবারই আমার মনে পড়বে, এই দিনে নাফাখুমে ভাের দেখেছিলাম, সাথে সুন্দর মনের মানুষ ছিলেন, সেই সাথে সাংগু নদী ও পাহাড় ছিল, আর ছিলো ভাল লাগা অবিরাম। তবে, নাফাখুম যাবার বেস্ট সময় হচ্ছে বর্ষা শেষ হবার ঠিক পর থেকে শীতের আগে অবধি সময়ে। তখন পাহাড়ের সতেজ সবুজ ভাবটা বজায় থাকে, পানির পরিমাণও সন্তোষজনক থাকে।

২৭/০২/২০২০- রাত ৯.৪০ এ কলাবাগান থেকে হানিফ বাসে যাত্রা আরম্ভ। ১ম ব্রেক কুমিল্লায় নুরজাহান হােটেলে। অতঃপর লােহাগাড়ায় ২য় ব্রেক শেষে গাড়ি টেনে চলে আসলাে আলীকদম। কি অসাধারন সকাল। কুয়াশা ঘেরা পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথের ধারে গাছের ফাঁক দিয়ে স্নিগ্ধ আলাে উকি দিচ্ছে। সকাল ৭ টায় আলীকদম নামলাম। চান্দের গাড়ি নিয়ে ড্রাইভার মাইকেল আগেই রেডী। সময় নষ্ট না করে গাড়ি নিয়ে চলে গেলাম নাস্তা করতে, নাস্তা সেরে সােজা ডিম পাহাড়। গান বাজনা সহযােগে পাহাড়ি কলার স্বাদ নিতে নিতে চলে এলাম ডিম পাহাড়। মন মত সাইট সিন ও ফটোসেশান চলল। আলীকদম বাসস্টপ থেকে ডিম পাহাড় হয়ে থানচি পৌঁছাতে চান্দের গাড়িতে ১ ঘন্টা ও বাইকে ৩০ মিনিট সময় লাগে। যেহেতু আমরা চান্দের গাড়িযােগে গিয়েছিলাম ও মাঝে কয়েকবার নেমেছিলাম তাই থানচি পৌঁছালাম সকাল ১০.৩০ এ। সেখানে শুরুতেই বাসায় ফোনে যােগাযােগ সেরে নিলাম। কেননা এর পর একেবারেই নেটের বাইরে যাচ্ছি।

তথ্যকেন্দ্রের যাবতীয় ফরমালিটি শেষে থানচি বাজার থেকে ৭০ টাকা দিয়ে লাইফ জ্যাকেট ভাড়া নিয়ে সাঙ্গুর স্বাদ নিতে বােটে চড়ে বসলাম। সময় ভেদে ৫০ টাকাতেও লাইফ জ্যাকেট ভাড়া দেন। তারা। প্রচণ্ড কড়া রােদ। তবে ২ পাশের উঁচু পাহাড় ও বাতাস সেই সাথে নদীর মন মাতানাে দৃশ্য এক শব্দে মনোমুগ্ধকর। এই পর্যন্ত যত নদী দেখেছি তার মধ্যে সাঙ্গু আমার কাছে সবচেয়ে ভাল লেগেছে! ২য় মুলাকাত সাঙ্গু সাথে। মাঝে একবার বােট থেকে নামতে হল, তিন্দু পাড়ায়, দুপুর ১টা, সবাই ক্ষুধার্ত, তাই লাঞ্চটা ওখানেই করে নিলাম। একেবারে ফ্রেশ সবজি, মাছ, মুরগী। ডেসার্টে পাহাড়ি পাকা পেঁপে। লাঞ্চ শেষে সামান্য রেস্ট নিয়ে বাকি ৫০% বােট জার্নি। ২টা বােট রেমাক্রি ফলস ঘেষে স্টপ হল দুপুর ৩ টায়।

ছবি: তিন্দু বড় পাথর এলাকা

সবাই ট্রেকিং এর জন্য প্রস্তুতি নিয়ে চললাম স্বপ্নপুরীর দিকে.. আমাদের লক্ষ্য ছিল সবার সুবিধা বিবেচনা করে ধীরে সঙ্গে আগাবাে। কোনাে তাড়াহুড়াে নেই। সন্ধ্যা ৬ টার মধ্যে নাফাখুম পাড়ায় পা রাখতে পারলেই হল। নাফাখুমের দর্শন পেলাম ৫.৪৫ এ। এখানে যা না বললেই নয়- ২/৩ জায়গায় ট্রেকিং ওয়ে এমন ছিল যে আরেকজনের হেল্প ছাড়া পার হওয়া এট লিস্ট আমার দ্বারা ব্যাগ নিয়ে সন্ভব নয়। এক্ষেত্রে প্রত্যেকেই যথেষ্ট হেয্ফুল ছিলেন। একজনের কথা এখনাে সেভাবে উল্লেখ করা হয়নি, গাইড বিরাজ দা- কথা কম কাজ বেশি টাইপ মানুষ। যেটা আসলেই প্রশংসনীয়। বিরাজ দার ফোন নাম্বারটা দিয়ে রাখি, কেউ নাফাখুম গেলে বিরাজ দাকে নক করতে পারেন। গাইড বিরাজ দা- +8801538135801

আচ্ছা কোথায় ছিলাম. ও হ্যা, নাফাখুমে! সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে নাফাখুম এর দেখা পেয়ে সবাই যে যার মত জলপ্রপাত এর পাশে বসে মুগ্ধতার রস আস্বাদন করে নিলাম। ১৫ মিনিট জিরিয়ে উপরে নাফাখুম পাড়ায় নির্ধারিত ঘরে প্রবেশ করলাম। এই প্রথম পাহাড়বাসীদের ঘরে আমি রাত কাটাতে যাচ্ছি। নেটের বাইরে, কোলাহলমুক্ত পরিবেশে, সেই শান্তিময় অনুভূতি লিখে বা ছবির দ্বারা প্রকাশ সম্ভব নয়, এটা একেবারেই নিজস্ব বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়া বােঝার সাধ্য নেই।

পাশাপাশি ২টা বেশ বড় বড় ডরমেটরি টাইপ ঘর আমাদের জন্য বরাদ্দ। এক ঘরে ছেলেরা, আরেক ঘরে মেয়েরা। ঘর থেকে নেমে একটু সামনে উঠানের পাশেই ওয়াশরুম। আর হাত মুখ ধােয়ার পানির ব্যবস্থা আগে থেকেই করে রেখেছিলেন বিরাজ দা। ঘরের সামনেই উঠানে রাখা ছিল ১ ড্রাম পানি, মগ। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল “ঢাকায় ফিরে যাওয়াটা কি খুব দরকার? বাকি লাইনে এখানে কাটানো যায়? কি নেই এখানে! সঙ্গীদের কন্টিনিউয়াস ডাকে বাস্তব জগতে ফিরে আসলাম। মুড়ি মাখানাে খাওয়ার ডাক আসলাে। ফ্রেশ হয়ে চলে গেলাম পাশের রুমে নাস্তা করতে। বিরাজ দা সহ ৮ জনের চা নাস্তার আড্ডায় সারাদিনের ক্লান্তি অনেকটাই কেটে গেল। তখন অবধি এলাকাটা শান্তই ছিল, কোনাে হৈ চৈ নেই। তবে আমাদের জন্য সেই শান্ত ভাব বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না! জিপসি, খঞ্জনী ও ঝুনঝুনি এসব হাতের সামনে থাকলে কি পরিবেশ শান্ত থাকে! আমি আবার কার্ড ও নিয়ে গিয়েছিলাম, স্পেড ট্রাম্প খেলা হল কয়েক হাত। তবে কোনাে গেইম টার্গেট নয়, কারন আডডা জমাতে গানের কলির বিকল্প নেই। ছেলেরা একদল, মেয়েরা একদল। এবার ডিনারের পালা। ডিনারে ছিল জুম চাষের ভাত, অমায়িক স্বাদের ডাল, আলু ভর্তা ও পাহাড়ী মােরগ! আমরা ডিনার শেষে ক্যাম্প ফ্যায়ারিং উপভােগ করে রাতের অন্ধকারে টর্চ হাতে নেমে গেলাম নাফাখুম জলপ্রপাতের অমায়িক রূপ ধারন করতে, সেই সাথে কোটি কোটি তারা ফ্রি। চাঁদ ছিল না বললেই চলে তবে সেটার বিশেষ অভাববােধ হয় নি আমার।

আমি অন্ধকার বেশি পছন্দ করি। তারার কি আলো সেই আলোতে জলপ্রপাতকে এত্ত স্নিগ্ধ লাগছিল। সাথে ট্রিপমেটদের খালী গলায় গান! আমারাে মনে বেজে উঠলাে “ও যে মানে না। মানা…..”

রাত ১১টা সবার চোখের পাতায় ঘুম নেমে আসছে, কাল আবার সকালে ট্রেকিং আছে। নাফাখুম জলপ্রপাতকে গুড নাইট জানিয়ে উঠে আসলাম পাড়ায় শেষ হল ২৮/০২/২০২০। রাজার হালে ঘুম দিলাম একটা। জ্বি, আমার কাছে এই এপার্টমেন্ট ঘুম সাধারণ ঘুম, আসল ঘুম তাে পাহাড়ের কোলে ঘুম।

২৯/০২/২০২০– ভাের ৬ টায় উঠে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে, ব্যাগ গুছিয়ে ৭ টায় পাড়া থেকে নামলাম জলপ্রপাতে ফটোসেশান ও সাইট সিন করতে। ৯ টায় চা নাস্তা সেরে রেমাক্রির উদ্দ্যেশ্য ট্রেকিং শুরু, এবার আর বেশি সময় লাগলো না, ২ ঘন্টায় রেমাক্রি।

ছবি: ডিম পাহাড়

রেমাক্রি কিছুক্ষন জিরিয়ে বােট যােগে থানচি। হুম, খারাপ তাে লাগছিলই! নাফাখুমকে বিদায় জানাতে!.. তবে এটাই লাইফ, মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই! রাজা পাথরে কেউ কেউ গােসল সেরে নিলেন, অবশ্যই লাইফ জ্যাকেটসহ ও গাইডের নির্দেশিত স্থান ছাড়া অন্য কোথাও নয়! থানচি পৌঁছে লাঞ্চ সেরে নিলাম। এবার যাত্রা চান্দের গাড়িতে বান্দরবান। এটাই প্ল্যান ছিল-ডিম পাহাড় হয়ে যাওয়া আর বান্দরবান চিম্বুকের রাস্তা হয়ে আসা। আলীকদম টু থানচি ৩০ কি.মি. পক্ষান্তরে থানচি টু বান্দরবান (ভায়া চিম্বুক) ৮৭ কিমি.। এবারাে সারা রাস্তায় গান-আড্ডায় মেতে ছিলাম সবাই। পাহাড়ি রাস্তা সব সময়ই আমার মন কাড়ে। সামনে যেতে যেতে সুর্য ডুবে যাবার সময় ঘনিয়ে আসলাে। তখন চিম্বুকের অঞ্চলে আছি আমরা। গাড়ি থামিয়ে মুগ্ধ হয়ে সূর্যাস্ত উপভােগ করলাম। অন্ধকার নেমে আসলাে। গাড়ি ছুটছে বান্দরবানের দিকে।

মনে হচ্ছিল রাস্তাটা যদি কখনােই শেষ না হত….! সন্ধ্যা ৭ টায় হিল ভিউ হােটেলে এসে গাড়িকে বিদায় জানানাে হল। ট্রিপ মিটার ৩০ মিনিটে বার্মিজ মার্কেট থেকে টুকটাক কেনাকাটা সেরে নিলেন। হােটেলের নিচেই কিছু বার্মিজ কাপড়ের দোকান আছে। হিল ভিউতে ডিনার শেষে খাবার টেবিলে ট্রিপ নিয়ে মত বিনিময় দ্বারা ট্রিপের সমাপ্তি ঘটলাে! রাত ৮.৩০ এ শ্যামলি বাস যােগে ঢাকা। বেরসিক শ্যামলী ভোর ৪,৩০ এই টিটি পাড়া নামিয়ে দিলাে। আমরা নেমে কাউন্টারে আলাে হবার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। অপেক্ষা অতি দ্রুতই শেষ হয়ে গেল। একে একে সবাই রেগুলার লাইফে চলে গেলাম, পেছনে থেকে গেলাে নাফাখুম ও ভাল লাগার কিছু মুহূর্ত!

আমাদের নাফাখুম খরচ (৭জনের টিম)

যাওয়াঃ হানিফ (ঢাকা টু আলীকদম) ৮৫০ টাকা জনপ্রতি।

আসাঃ শ্যামলি (বান্দরবান টু ঢাকা) ৬৫০ টাকা জনপ্রতি।

চান্দের গাড়ি (আলীকদম টু থানচি) ৫০০০টাকা।

চান্দের গাড়ি (থানচি টু বান্দরবান) ৫৫০০ টাকা।

বােট (যাওয়া ও আসা) ২ বোট = ৯০০০ টাকা।

গাইড ২৫০০ টাকা।

রিসাের্ট (১ রাত) ১৫০টাকা জনপ্রতি।

খাবার খরচ জনপ্রতি ৭০০ টাকা।

৭ জনের পার হেড ৫৫০০ টাকা।

যারা নাফাখুমে যাবেন ভাবছেন তাদের উদ্দ্যেশ্যে কিছু কথা

  • সাথে অবশ্যই জাতীয় পরিচয় পত্রের ৩টি ফটোকপি নিয়ে যাবেন
  • ব্যাগ ২ কেজির বেশি ভারী করবেন না
  • ট্রেকিং জুতা কন্ষ্টেবল যেন হয় সেটা খেয়াল রাখবেন
  • ট্রেকিং স্টিক রেমাক্রি থেকে গাইডের সাহায্যে যােগাড় করে নেবেন
  • লাইফ জ্যাকেট ছাড়া বােটে উঠবেন না
  • অতিরিক্ত ছবি তুলে সময় নষ্ট না করে সাইট সিন ও সংগীদের সাথে সময় কাটানাের ট্রাই করবেন, ভাল লাগবে
  • ট্রেকিং ওয়েতে ভারী খাবার না খেয়ে ড্রাই ফুড ও পাহাড়ী ফ্রেশ ফল খাবেন
  • ওয়েদার আপডেট দেখে যাবেন, ঝড় বৃষ্টিতে এখানে যাওয়া মােটেই নিরাপদ নয় যেখানে সেখানে অপচনশীল ময়লা আবর্জনা ফেলবেন না
  • স্থানীয়দের সাথে বাজে ব্যবহার করবেন না।

 

ভ্রমণ গাইডলাইন পড়ুন

সীতাকুন্ড ইকোপার্ক ও গুলিয়াখালী বিচে একদিন

একটা ব্যাগ কাঁধে চেপে সন্ধায় আমি বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। চারিদিকে সন্ধার আঁধার নামা শুরু করলেও আমার মধ্যে তখন ভোরের আলোর মতো উচ্ছ্বাস কাজ করছে। বেশ উচ্ছ্বসিত মনে বাইক নিয়ে সোজা চলে গেলাম মিরপুর। সেখান থেকে টিমমেটকে নিয়ে শাহবাগ এসে দেখলাম দু’টো হাইএস দাঁড়িয়ে আছে, বেশকিছু মানুষও আছে। ও হ্যা, আমার এই ভ্রমণটি হয়েছিল একটি ভ্রমণ দলের সাথে। সবাইকে যার যার মতো সিট দেয়া হল। একজন মানুষ বেশি হওয়াতে সিট সংকটে পড়তে হল। কি আর করা! শেষে এই পাতলা, ছোটখাটো গড়নের মানুষটির জায়গা হল ড্রাইভারের সাথে থাকা এক্সট্রা সিটে। এটাই হুটহাট ভ্রমণের মজা। যেখানে যেমন সেখানে তেমন মানিয়ে নেয়া। রাত ১১ টায় আমাদের গাড়ি চলতে শুরু করলো চট্রগ্রামের উদ্দেশ্যে।

সবাই বেশ অল্প সময়ের মধ্যেই পরিচিত হয়ে গেলো। গল্পগাছা, হাসি তামাশা, গান আড্ডা হল। সময়ের সাথে সাথে প্লে-লিস্ট পরিবর্তন হতে লাগলো। ফোক থেকে সফট মেলোডি। অল্প অল্প করে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। ড্রাইভার খুব দক্ষতার সাাথে গাাড়ি চালাচ্ছেন। আমার পাশের জন ম্যাপ দেখছে। এক এক করে টিমের সবাই ঘুমিয়ে পড়লো। কেবল আমরা তিনজনই সফট মেলোডির সাথে রাস্তা আর বৃষ্টি দেখছি। আহা সে কি দারুণ অনুভূতি! কোন একটা সময় আমারও চোখ লেগে এলো। রাত তিনটার দিকে টিমমেটের ডাকে আমার ঘুম ভাঙলো। আমরা একটা জায়গায় থেমেছি কিছুক্ষণের জন্য। কেউ চা খাচ্ছে, কেউ কফি খাচ্ছে। লোকজনদের থেকে খানিক আলাদা হয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। রাতেই এই সময়টাতেই সারাদিনের হিসাব নিকাশ নিরিবিলি করা যায়। ব্রেক শেষে আবার রওনা হলাম।

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আমরা সীতাকুণ্ড স্থানীয় বাজারে নামলাম নাশতা করতে। নাশতা রেডি হতে হতে সবাই ফ্রেশ হয়ে খানিক হাটাহাটি করতে করতে ভোর দেখছে, সাথে ভোরের শুভ্র বাতাস। এখন ধূসর আলো কেটে হালকা হলুদ আলো চারিদিকে। নাশতা করে আমরা আবার গাড়িতে উঠে চলে গেলাম সীতাকুন্ড ইকোপার্ক‘এ। চট্রগ্রাম শহর থেকে ৩৫ কি.মি. উত্তরে ঢাকা- চট্রগ্রাম মহাসড়কের পূর্ব পাশে সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক অবস্থিত। আমরা যাচ্ছি সহস্রধারা-সুপ্তধারা ঝর্ণা দেখতে৷ ইকোপার্কের মূল গেট থেকে সহস্রধারার দূরত্ব ৫ কিলোমিটার। আমরা প্রায় চলে আসাতে সবার ভেতরই বেশ উত্তেজনা কাজ করছে। এবার গাড়ি থেকে নেমে হাটার পালা।

ছবি: সহস্রধারা ঝর্ণা

ওপর থেকে সহস্রধারা ঝর্ণায় নামতে সিড়ি ৪৮৭ টি৷ সোজা একটানা সিড়ি, ঝিরিপথ নেই। এই সিড়ি নামতে যতোটা না কষ্ট তার চেয়ে বেশি কষ্ট উঠতে। তার ওপর ঝর্ণায় জোকের ভয়। নামার আগে কেউ কেউ পায়ে তেল লাগাচ্ছে, কেউ লবণ পানি ঢালছে। সবার এতো আয়োজন দেখে আমি একটু ঘাবড়েই গেলাম! মনে হচ্ছিল না যেন কত জোক সেখানে! সবার প্রস্তুতি শেষ হলে সিড়ি ধরে হাটা শুরু করলাম। পথে একটা জবা ফুল পেলাম। খোপায় গেথে গুণগুণ করে গান গাইছি আর নামছি। বেশ আনন্দ লাগছে। একটা সময় দূর থেকে জলের শব্দ পাচ্ছি। তখন সবাই খুব উচ্ছ্বসিত। মাথার ওপর খটখটা রোদ তবুও সবাই খুব দ্রুত নামছে৷ ভীষণ গরমে জল তৃষ্ণার মতো ঝর্ণার কাছে আসতেই কয়েকজন পানিতে লাফিয়ে পড়লো! আমি ঝর্ণার ওপরে তাকালাম। সূর্যের রশ্নি জলের সাথে পাল্লা দিয়ে লুকোচুরি খেলছে। আশানুরূপ জল না পেলেও জলগুলোকে স্বর্ণের দানার মতো লাগছে।

আমাদের টিম লিডার আমাকে ঝর্ণায় নামতে দিলো না। বাকীরা জলে লুটোপুটি খাচ্ছে। তাঁর ওপর আমার ভীষণ রাগ হচ্ছে। আমি তাঁর পাশে বসে রাগে দাঁতে দাঁত চেপে খিটমিট করছি। সে বলল যারা এখানে বেশি এনার্জি লস করছে তারা আরেকটা ঝর্ণায় যেতে পারবে না। ভেজা কাপড়ে উপরে উঠতে উঠতেই হাঁপিয়ে যাবে। সুপ্তধারা ঝর্ণাটা আরও সুন্দর। সেটাতে নেমো৷ এই ভ্রমণে সবচেয়ে বিরক্তির বিষয় ছিল কয়েকজন ভ্রমণের শুরু থেকে অনবরত ছবি তুলে যাচ্ছিলো, যার কারণে বাকী সকলকে জায়গায় জায়গায় থামতে হচ্ছিলো। এরা উপভোগে যতটা না আগ্রহী তারচেয়ে বেশি আগ্রহী উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে ছবি তুলতে। ঘন্টা খানেক থাকার পর আমরা আবার সিড়ি ধরে উপরে উঠছি। এটা বেশ কষ্টকর। আমি একটানাই উঠছি। কোথাও থামছি না। থামলেই ক্লান্তি উপভোগ করতে হয়। একটানা উঠতে থাকায় সবার আগে উপরে উঠে আসলাম।

এক ঝর্ণাতে নেমেই একেক জনের অবস্থা কাহিল। সবাই বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। ঘন্টা খানেক পর আমরা আরেক ঝর্ণার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। কথার সাথে মিল পেয়ে গেলাম। কিছু মানুষ ক্লান্ত হওয়ায় আমাদের গাড়িতে রয়ে গেলো। সহস্রধারা এবং সুপ্তধারা ঝর্ণার মধ্যে দূরত্ব ২ কিলোমিটার। সহস্রধারা ঝর্ণাটি সুপ্তধারা ঝর্ণার জল থেকেই সৃষ্ট। দ্বিতীয় দফায় সবাই জোকের ভয়ে তেল লাগানো। আমরা সুপ্তধারার সিড়ি ধরে নামা শুরু করলাম। সুপ্তধারার সিড়ি ৪২২ টি। এবারও আগে আগে নেমে গেলাম। এরপর ঝিরিপথ। এরমাঝেই বৃষ্টি নামায় পানি বেড়ে গেলো৷ এই জায়গাটুকু পার হওয়া কঠিনই ছিল। লিডারের হাত ধরে ধরে পার হলাম। সবকিছুর শুরু অর্থাৎ এক্সপেরিমেন্ট আমাকে দিয়েই করা হচ্ছে! এরমাঝেই আরেকদল মেয়ে ঝিরিপথে স্রোত বাড়ায় চিৎকার শুরু করলো। আমাদের থেকে কয়েকজন তাদের সাহায্য করলো পার হতে।

ঝর্ণার মায়া

আমরা হাটতে হাটতে চলে এসেছি কাঙ্ক্ষিত সুপ্তধারায়। বিশাল হুংকার দিয়ে পাহাড়ের বুক চিরে জল গড়িয়ে পড়ছে। অপূর্ব তার রূপ! এবার আর আমাকে আটকালো না। আমরা শীতল জলে ভিজলাম। এতোক্ষণে মনে হচ্ছিলো সারাদিনের কষ্ট সার্থক হল। বেশ কিছুক্ষণ ভেজার পর দেখলাম আকাশ মেঘলা হয়ে আসছে। জল ঘোলাটে হয়ে আসছে। ঝড় নামলে ঝর্ণাতে যেকোন দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। আমরা সেখান থেকে রওনা হবার সিদ্ধান্ত নিলাম। এবার ফিরতি ঝিরি পথ পাড়ি দিয়ে সিড়ি দিয়ে উঠতে আমারও ক্লান্ত লাগছে৷ তবুও উঠছি। পাশেই আরেক দল আমার সাথে সাথে উঠছে। শেষমেশ আমরা উপরে উঠে এলাম। উপরে এসে দেখলাম যে আপু পায়ে সবচেয়ে বেশী তেল মেখেছিলেন সে আপুকেই সবচেয়ে বেশী জোক ধরেছে। সেসব ছাড়িয়ে আমরা ইকোপার্কের মূল গেটে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করলাম। দুপুরে স্থানীয় হোটেলে খেয়ে আমরা গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত এর উদ্দেশ্যে রওনা হব।

আমরা বেশ ক’জন শাড়ি পড়লাম। সমুদ্র বিলাসে শাড়ি না পড়লে কি চলে নাকি! আমি অবশ্য প্রায়ই শাড়ি পড়ি। পাবলিক ওয়াশরুমে শাড়ি পড়ার এক অসাধারণ ক্ষমতা অর্জন করেছি। সীতাকুণ্ড বাজার থেকে গুলিয়াখালি সি বীচের দূরত্ব মাত্র ৫ কিলোমিটার। স্থানীয়দের কাছে ‘মুরাদপুর বীচ’ নামেও পরিচিত। গুলিয়াখালী সী বিচের একদিকে দিগন্তজোড়া সাগর জলরাশি আর অন্য দিকে কেওড়া বন। এখানে ম্যানগ্রোভ ও সোয়াম ফরেস্টের মতো পরিবেশ পাওয়া যায়। আমরা গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতে যাবার জন্য গাড়ি পার্ক করে একটা ট্রলার ভাড়া করলাম। এখানে জোয়ার ভাটার হিসেব আছে। মাঝি বলে দিল দু এক ঘন্টা পর ভাটা শুরু হবে তখন আর ট্রলার চলবে না কাদাপানিতে হেটে যেতে হবে। ট্রলার থেকে নামার পর দেখলাম সবুজ ঘাসের গালিচা যেন বিছানো! তার পরেই ঢেউ আছড়ে পড়ছে তীরে। এই প্রথম আমার সমুদ্র দেখা! বড় তৃপ্তিময় ছিল সে সময়! কিন্তু সময় যেন খুব দ্রুত কেটে গেলো! সন্ধা নামবে নামবে করছে। এদিকে ভাটাও শুরু হল। দু তিনজন প্রায় ঠেলে ট্রলার নিয়ে আসলো। আমরা রাতে খেয়ে আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।

ভ্রমণ গাইডলাইন পড়ুন

টাঙ্গুয়ার হাওর এর দিনলিপি

আসলে হঠাৎ প্ল্যান গুলো সব সময় ভালো হয়। ভার্সিটিতে ক্লাস নিতে নিতে একদিন হুট করেই দেখলাম সামনে একটা তিনদিনের বন্ধ আছে। ভাবলাম এই তিনদিন কোথাও ঘুরে আসি। কই যাব ভাবতেই হুট হাট আমাদের প্ল্যান সুনামগঞ্জ টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরতে যাব। ফেনী থেকে প্রথমে গেলাম ঢাকা, সেখানে ছোট খালামনির বাসায় সুন্দর একটা দিন কাটিয়ে পরদিন রাতে চড়ে বসলাম সুনামগঞ্জ এর বাসে। বাস আমাদের একদম ভোরেই সুনামগঞ্জ নামিয়ে দিলো। তখন সময়টা ২০১৮ সালের অক্টোবর মাস। একটু একটু শীতের আমেজ, ভোরবেলা চারদিকে হালকা কুয়াশা।

সুনামগঞ্জ নেমে প্রথমেই চলে গেলাম হোটেল টাঙ্গুয়া ইন এ। সেখানে গিয়ে নাস্তা করলাম। নাস্তা করে চোখে মুখে একটু পানি দিয়ে ফ্রেশ হলাম। এবার লেগুনা দিয়ে যাত্রা শুরু তাহিরপুরের দিকে। যেতে যেতে পথের দুইপাশে একবার স্বাগত জানালো লাল শাপলার বিল, একবার স্বাগত জানালো সাদা শাপলার বিল। পথের দু’পাশে সৌন্দর্য সেভাবে উপভোগ করতে পারিনি কারণ রাস্তা ছিল খুব বেশি পরিমাণে খারাপ। প্রায় দুই ঘন্টার জার্নি শেষে এসে পৌছালাম টাঙ্গুয়ার হাওর পাড়ে। সেখানে আগে থেকেই বোট রিজার্ভ করা ছিল।

নৌকাতে উঠতে যাবো এমন সময় দেখি একজন মানুষকে পরিচিত পরিচিত লাগে। তিনি এবং আমি আমরা দুজনে মানুষটার দিকে দিকে এগিয়ে গেলাম এবং গিয়ে এতটাই অবাক হলাম যে বলার মত না। তিনি হচ্ছেন আমাদের কলেজ শিক্ষক, অত্যন্ত প্রিয় একজন শিক্ষক ছিলেন। উনার কাছে আমরা পড়েছিলাম। আমাদের দুজনকে খুব আদর করতেন তিনি। তিনি এবং আমাদের অন্যান্য শিক্ষকরা মিলে ঘুরতে এসেছেন টাঙ্গুয়ার হাওরে। বাসা থেকে এত দূরে এখানে এসে এভাবে শিক্ষকদের সাথে দেখা হয়ে যাবে ভাবতেই পারিনি। খুব খুশি হলেন আমাদেরকে দেখে, বেশ কিছু ছবি তোলা হলো। এরপর উনারা উনাদের বোটে চলে গেলেন আমরা আমাদের নৌকায় গেলাম। এবার নৌকায় যাত্রা শুরু।

ছবি : লাকমাছড়া

ধীরে ধীরে নৌকা যতই হাওড়ের ভিতর দিকে যাচ্ছে ততই পানি নীল সবুজ হচ্ছে। দুইপাশে মেঘালয়ের সবুজ পাহাড় গুলো। নিচে নীল জল।নির্জন দুপুরে খাবার খেলাম রান্না করা হাঁসের মাংস ভাত দিয়ে। খাবারটা মনে হল যেন অমৃত। মাঝি ভাইর হাতে জাদু আছে। দুপুরের পরেই গেলাম টেকের ঘাট। তখন কি যেন একটা পূজা চলছিল। সেই পূজা, দেবী বিসর্জন দেখলাম। উপর থেকে তাকালেই পাশে মেঘালয়ের নীল সবুজ পাহাড় গুলো। এত সুন্দর, এত সুন্দর আমাদের দেশ !!! দুচোখ ভরে মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। টেকের ঘাট ঘুরে ছবি তুলে সন্ধ্যার মধ্যেই নৌকায় ফেরত আসলাম। সিদ্ধান্ত হলো রাতে নৌকাতে থাকবো।

রাতে খেলাম খুব তাড়াতাড়ি। রাত ৯ টার মধ্যেই হোটেল টাঙ্গুয়া ইনে খাওয়া-দাওয়া শেষ, এবার বোটে এসে বসলাম। ট্যুরমেট দের সাথে কিছুক্ষণ লুডু খেললাম। রাত যত বাড়ছিল শীত ও ততই বাড়ছিলো। একসময় ছাদে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আকাশ ভরা তারার আলো আর ভরা পূর্ণিমা। চারদিকে কোন শব্দ নেই, ঠিক হাওরের মাঝখানে নৌকায় আমরা কিছু মানুষ। আকাশে থালার মত বড় চাঁদ, আমার হাত ধরে আছে প্রিয় মানুষটা, মুহূর্তটা যেন থমকে আছে। এইরকম মুহূর্তের জন্যই কি হাজার বেঁচে থাকতে পারে মানুষ???!!!!

রাত এগারোটার দিকে খুব ঘুম পাচ্ছিল। বারোটা সাড়ে বারোটা করে বোটে ঘুমোতে গেলাম। ঘুম ভাঙলো খুব ভোরে। ভোরে ঘুম ভাঙ্গার পরে এবার হোটেলে গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে আবার বোটে করে যাত্রা শুরু। এবার প্রথমেই গেলাম শিমুল বাগান। অক্টোবর মাস হওয়াতে তখন শিমুল ফুল পাইনি কিন্তু চারপাশে যেন সবুজের সমারোহ। চোখের প্রশান্তি বলে একেই। চোখ জুড়িয়ে দিচ্ছিল সবুজ। একটা ভেড়ার বাচ্চাকে পেয়ে আদর করে দিলাম খুব। এবার এখানে কিছুক্ষণ ঘুরে গেলাম যাদুকাটা নদীতে। টিলার উপর থেকে জাদুকাটা নদী এত সুন্দর লাগছিল, নীল এবং সবুজ জল। একটা জায়গা ছিল টিলার উপরে যেটাতে একটা পাথর ছিল, পাথরটার একপাশে লেখা বাংলাদেশ আরেক পাশে লেখা ইন্ডিয়া। মানে সেটা ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ জিরো পয়েন্ট।

ছবি: যাদুকাটা নদী

সুনামগঞ্জ এর জাদুকাটা নদীটির পাশেই প্রায় ১৫০ ফুট উচ্চতার এই টিলাটি রয়েছে। স্থানীয়রা এই টিলাটিকে বারিক টিলা বলে থাকে। এই টিলায় অবস্থিত পিলারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। এই পাথর টার এক পাশে ইন্ডিয়া এক পাশে বাংলাদেশ। ইন্ডিয়ার পাশে গিয়ে যখন ছবি তুলছিলাম ট্রাভেল মেট রা মজা করে বলছিলো, ” আপু আর যাইয়েন না, বিজিবির গুলি খাবেন।” আমি বলছিলাম “একদিন ফলো মি টু ইন্ডিয়া এলবাম দিব”!

সেই সংকল্প পুরন করলাম ঠিক এক বছর পর ২০১৯ সালের নভেম্বরে। সেখানে ঘুরে আবার কিছু ছবি তুলে অবশেষে তাহিরপুরে ফিরে আসলাম। এরপর আবার লেগুনা দিয়ে সুনামগঞ্জ শহরে ফিরে এসে বাসে করে ফিরে আসলাম নগর সভ্যতায়। নৌকায় ভাসা এই ক’টা দিনের স্মৃতি মনে থাকবে সারা জীবনভর। জীবনটা নেহাতই মন্দ নয় আলহামদুলিল্লাহ।

তবে যেটা খারাপ লেগেছে এত সুন্দর টাঙ্গুয়ার হাওর। কিন্তু হাওরের জলে ভাসে বিরিয়ানির প্যাকেট, বাচ্চাদের পেমপার্স, প্লাস্টিকের বোতল ইত্যাদি ইত্যাদি। আচ্ছা আমরা ঘুরতে যাই মনের শান্তির জন্য কিন্তু পরিবেশকে শান্তি কেন দেইনা বলতে পারেন??? বিদ্র. আমরা যাই পরিবেশটা দেখতে, যেটা দেখে আমরা মনে শান্তি পাচ্ছি সেটাকে পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব আমাদেরই। আমরা কেন পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখিনা।

উম্মে আইমুন এর অন্যান্য লেখা

 

ভ্রমণ গাইডলাইন পড়ুন

নিঝুম দ্বীপ এর নির্জনতায়

হুট করেই জানুয়ারী মাসের শুরুতে ভূত চাপলো যে নিঝুম দ্বীপ যাব। দেশের এত জায়গায় গেলাম আর নিজ জেলার সবচেয়ে জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট এ যাব না তা কি হয়? ব্যস আর কি প্ল্যান করে জানুয়ারির শেষে রওয়ানা দিলাম নিঝুম দ্বীপ এর উদ্দেশ্যে। আমার প্রথম লঞ্চ জার্নি। সদরঘাট এ গিয়ে লঞ্চ এ উঠে যাত্রা হলো শুরু। কেবিন নেওয়া সত্ত্বেও ডেকে ট্রাভেল করতে কেমন লাগে সেটা দেখতে থাকলাম কিছুক্ষণ ডেকে। কত রকমের কত মানুষ কত অদ্ভুত কাজ কারবার। টিভিতে চলছে শাকিব খানের মুভি। অতিরিক্ত শব্দ, আলোতে একটু পরই শুরু হয়ে গেলো আমার বিখ্যাত মাইগ্রেন। অষুধ খেয়ে গিয়ে এরপর কেবিনে শুয়ে পড়লাম। ঘুম আসে না৷ কিছুক্ষন এপাশ ওপাশ করার পর আস্তে চোখ লেগে এলো. ঘড়িতে এলার্ম দিলাম ভোর পাঁচটার। যদিও পাঁচটার অনেক আগেই ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভেঙ্গে বাইরে উঁকি দিলাম। আস্তে আস্তে একটু একটু করে আলো ফুটলো। দেখলাম যে লঞ্চ দাঁড়িয়ে আছে। এরপর লঞ্চঘাটে নামলাম, এরপর দুটো সিএনজি করে যাত্রা শুরু।

রাস্তার দুই পাশে সুন্দর কিন্তু রাস্তা টা অনেক খারাপ, খুব ঝাঁকুনি হচ্ছিল সিএনজিতে। আশেপাশের সুন্দর দৃশ্য অবলোকন করতে করতে একটা ঘাটে পৌছালাম।এবার পৌঁছে সেখান থেকে নৌকো করে পার হলাম নদী। এরপর ওই পাশে গিয়ে আবার সিএনজি নিয়ে পৌঁছলাম নিঝুম দ্বীপ। নিঝুম দ্বীপে গিয়ে প্রথমে চলে গেলাম যেখানে ক্যাম্প করবো সেখানে। ওখানে বন বিভাগের কর্মীদের আগেই বলে রাখা হয়েছিল যে রাতে তাবুতে থাকব। উনারা তাবু করে রেখেছিলেন। খুব ভালো লাগলো চারপাশটা একটু ঘুরে ফিরে এবার আমরা ঘুরতে বের হলাম বনে। অটো করে একটু সামনে গিয়ে অটো থেকে রাস্তার পাশে নেমে শুরু হলো জঙ্গল সাফারি। নিরব নিস্তব্ধ বনের ভিতর হাটি। আরেকটু পর পরই খাল পার হবার জন্যে একটা বড় গাছের গুড়ি ফেলে রাখছে। আর কোন কিছু নেই দুইপাশে ধরে হাটার। আমরা শহুরে মানুষদের জন্য এই গুড়ি পার হওয়া হচ্ছে যুদ্ধ। দুটো বাচ্চা ছেলে ছিল স্থানীয় আমাদের অনেক হেল্প করল। সেই গাছের গুড়ি পার হয়ে বনের ভিতর ঘুরে দেখলাম। চোখ জুড়ানো সবুজের মায়া।

নির্জন বন

হরিণ দেখতে পাইনি কিন্ত আশেপাশে পাখি দেখেছি প্রচুর । একটু ঘুরে এরপর দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। প্রায় ২৪ ঘন্টা পরে আবার ভারী খাবার খাওয়া হলো। সেই সাথে খেলাম মহিষের দুধের দই, খুব ভালই লাগলো, প্রথমবার খাওয়া টেস্ট। এবার নৌকা করে যাত্রা শুরু চৌধুরী খাল আর কবিরাজ খালে। কবিরাজ খাল এ ছোট ছোট নৌকা দিয়ে যত খালের ভিতরে যাচ্ছিলাম নদীর দুই পাশে শ্বাসমূল গুলো আর কাদা। নদীর সেই কাদা মাড়িয়ে বনের ভিতরে ঢুকলাম কিন্তু হরিণ এর দেখা পেলাম না।এবার চৌধুরী খালে যেতেই দেখলাম যে নদীর পাশে বসে আছে দুটো হরিন। আমাদেরকে আসতে দেখে এরপর দিলো ভোঁদৌড়। এক দৌড়ে বনের ভেতর। এরপর যতই বনে ঢুকে ঘুরে ঘুরে খুজি আর দেখা পেলাম না হরিনের। শেষ বিকেলে গেলাম বিচে। সেখানে একটা শিমুল তুলা গাছ কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই গাছের নিচে একটু ফটোগ্রাফি করা হলো। এখানে স্থানীয় এক চাচার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করে এবার ক্যাম্পে আসলাম।

ক্যাম্প এ এসে ফ্রেশ হয়ে এবার বাজার সহ চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখলাম, চা নাস্তা করলাম। করার পরে শুরু হল বারবিকিউ। এবার বারবিকিউ এর পাশে বসে গল্প করা, তারপর সবাই মিলে মাদুর বিছিয়ে মাটিতে বসে বারবিকিউ খাওয়া। খেয়ে দেয়ে খেজুর রস খাওয়ার অভিযানে বের হলাম কিন্তু একজনকে ও পেলাম না এত রাতে রস বিক্রি করার জন্য। রাত একটা পর্যন্ত বাইরে ঘুরে ঘুরে এবার তাবুতে এসে পড়লাম আর ভাবলাম যে জীবনে কখনো কাঁচা খেজুরের রস খাইনি এবারও কি খাওয়া হবে না। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো। ঘুম থেকে উঠে ওয়াচ টাওয়ারে উঠে পুরো দ্বীপ দেখলাম। এদিন আমরা চলে যাব তাই সবার থেকে বিদায় নিয়ে ঠিক হলো যে এবার আমরা ঘাটে যাওয়ার সময় রস খাওয়া হয়ে যাবে। যাওয়ার সময় এবার এক বাড়িতে ঢুকলাম খেজুর গাছের কোন অভাব নেই, প্রত্যেকটা গাছে রসের হাড়ি ঝুলছে, অনেক বড় তেতুল গাছে তেতুল ধরে আছে, টার্কি মুরগি পালন আরো অনেক কিছু আছে। সেই বাড়িতে সেখানে গিয়েই প্রথম কাঁচা খেজুর রস খেলাম।রস টা একটু টক মিষ্টি স্বাদযুক্ত, প্রথমবার খেলাম খুব ভালো লাগলো। এরপর ওই বাড়ির মানুষ গুলোকে খেজুরের রসের দাম দিয়ে তাদের থেকে বিদায় নিলাম।

ছবি: উম্মে আইমুন।

এবার যাত্রা শুরু সিএনজি করে নদীর পাড়ে। গিয়ে ঠিক হলো যে ট্রলারে করে হাতিয়া যাব। ট্রলারে উঠে বসে রইলাম কিন্তু ট্রলার তো আর ছাড়ে না। একের পর এক মানুষ উঠেছে তো উঠেছেই। একটা সময় ট্রলার অতিরিক্ত মানুষের চাপে এক পাশে কাত হয়ে গেলো। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে আমরা ট্রলারে যাব না ঠিক করে, স্পিডবোটে করে নদীর অপর পাশে এসে আবার সিএনজি করে যাত্রা শুরু করলাম। হাতিয়া এসে নাস্তা করলাম। নাস্তা করে এবার একটু হাতিয়াতে ঘুরেফিরে লঞ্চে উঠলাম। এখন দুপুর একটার লঞ্চে উঠার কারণে চারপাশ টা ভালভাবে দেখতে দেখতে যেতে পারছিলাম। এরপর আস্তে আস্তে লঞ্চ সামনে আগানোর সাথে সাথেই দেখলাম মনপুরা দ্বীপ সহ বিভিন্ন চর।

লঞ্চে বিভিন্ন খাবার-দাবার খাচ্ছিলাম, একপাশে সবুজ বন আর চারদিকে বাতাসে। দেখতে দেখতে যাত্রাটা খুব ভালোই লাগছিল। একসময় একটা নৌকা ভর্তি ইলিশ এসে লঞ্চের গায়ে ভিড়লো। সমস্ত ইলিশ উঠানো হলো লঞ্চে। এবার রাত্রে কিভাবে ঘুমানো হবে হবে সেটা নিয়ে চিন্তা করা হলো। আমরা মেয়েরা দুজন একটা কেবিনে আর ছেলেরা দুজন আরেক টা কেবিনে, বাকি ছেলেরা সবাই কেবিনের বাইরে লঞ্চের ভিতর তাবু ফেলে তার ভিতরে বিছানা করে সবাই ঘুমিয়ে গেল। খুব সকাল বেলা লঞ্চ এসে থামলো সদর ঘাট। ভোর সবাইকে বিদায় দিয়েছে। এ ট্যুরে আসলে ঢাকা থেকে নিঝুম দ্বীপে গেলে সবচেয়ে বেশি সময়টা চলে যায় লঞ্চে। আমরা বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টায় বাসা থেকে বের হয়েছিলাম, সদরঘাট থেকে লঞ্চে উঠলাম চারটায়। লঞ্চ বিকেল পাঁচটা বাজে ছেড়েছে সেই লঞ্চ পরদিন সকাল পাঁচটায় গিয়ে পৌঁছেছে সেখান থেকে সিএনজি গাড়ি সবকিছু করে আমরা যখন নিঝুম দ্বীপ পৌছালাম তখন সময় দুপুর ১২ টা। ২৪ ঘন্টা সফর যাওয়া এবং আসার সময় লেগেছে। যদিও জার্নি টা খারাপ ছিল না।

নিঝুম দ্বীপ অনেক বেশি সুন্দর চারদিকে সবুজের সমারোহ আর বনের হরিণ দেখতে পাইনি কিন্তু বনবিভাগের লোকের একটা হরিনকে পালে সেই হরিন টা বারবার দেখতে পেয়েছি। আমাদের নিজের দেশ টা অনেক বেশি সুন্দর। দেশকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদেরই, তাই ময়লা আবর্জনা যেখানে সেখানে না ফেলে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলুন। হ্যাপি ট্রাভেলিং।

উম্মে আইমুন এর অন্যান্য লেখা

 

ভ্রমণ গাইডলাইন পড়ুন 

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ২

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – পর্ব ১

এ অন্য এক পৃথিবী; ঘন মেঘমালা আকাশ আর মাটির ভালবাসায় সেতুবন্ধন হয়ে জড়িয়ে আছে দিগন্ত জুড়ে। পাহাড়ের চূড়ায় চুড়ায় মেঘ-দৈত্যদের অলস পদচারণ প্রকৃতির নৈসর্গিক স্তব্ধতাকে স্বপ্নিল ফ্রেমে বন্দী করে তৈরি করেছে বিস্ময়কর প্যানোরমা। প্রথম ক’টা মিনিট মুখে কথা ফুটে না। এ যেন সূরা আর সাকির অনাদিকালের মিলন-মেলা। মাচু পিচু – ইনকাদের হারিয়ে যাওয়া শহর। স্প্যনিস দখলদারদের হিংস্রতা হতে বাচতে গিয়ে নিজেদের অজান্তেই তৈরি করে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম আশ্চর্য এক স্থাপনা।

চারদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। চূড়াগুলো বাহু-লগ্না হয়ে ডুবে আছে মেঘ সমুদ্রে। ইচ্ছে করলেই এক খণ্ড মেঘ হাতে বাড়িয়ে কাছে টানা যায়। আদর করা যায়। গলার সূর উঁচু করে হাঁক দিলে সে হাঁক পাহাড়ে পাহাড়ে আছড়ে পরে। ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে তীর ভাঙ্গা তরঙ্গের মত। চারদিকে এক ধরনের ভৌতিক নীরবতা। সাথে প্রকৃতি এবং মানুষের নীরব বুঝাপড়ার বিশাল এক ক্যানভাস। ইনকা সাম্রাজ্যের বিশালতার কাছে গিজ গিজ করা পর্যটকদের ফিসফাস হাজার রজনীর আরব্য উপন্যাসের কথাই মনে করিয়ে দেয়। নিপুণ কারিগরের নিশ্ছিদ্র পরিকল্পনায় হাতেগড়া পাথরের প্রাসাদগুলো সময়ের স্তব্ধ সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে দিগন্ত জুড়ে। প্রথম যে ধাক্কাটা এসে মগজে আঘাত হানে তাহলো, কি করে এত উচ্চতায় এই বিশাল পাথরগুলোকে উঠানো হল! প্রযুক্তি বলে জাগতিক পৃথিবীতে কিছু থাকতে পারে এমন ধারণা ঐ নিষিদ্ধ অরণ্য পর্যন্ত পৌঁছানোর কথা নয়। হাত এবং মগজের চাতুর্যপূর্ণ নৈপুণ্যে পাথরগুলোকে উঠানো হয়েছে একটার উপর আরেকটা। শক্ত কাদামাটি দিয়ে আটকানো হয়েছে হাজার বছরের বন্ধনে।

একদিকে রাজপ্রাসাদ, অন্যদিকে সাধারণ ইনকাদের বসতি এবং পাশাপাশি বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উন্নয়নে গবেষণাগার সবকিছু মিলে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ সাম্রাজ্যের কথাই মনে করিয়ে দেয়। বলা হয়ে থাকে পেরুর মাটিতে স্প্যানিশ উপনিবেশবাদের আগমনের একশত বছর আগেই এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়, কারও মতে দখলদার বাহিনীর নৃশংসতা হতে বাচার জন্যে ইনকারা পালিয়ে আশ্রয় নেয় মাচু পিচুতে। পরবর্তীতে বসন্তের মত মহামারিতে বিলীন হয়ে যায় জনসংখ্যা। পরিত্যক্ত হয়ে গাছপালা আর পাহাড়ের আড়ালে চাপা পরে যায় ইনকাদের আশ্চর্য স্থাপনা মাচা পিচু। ১৯১১ সালে মার্কিন ইতিহাসবিদ হিরাম বিংগ্নহাম ইনকা সভ্যতার উপর গবেষণা চালাতে গিয়ে বেশ ক’বার এলাকাটিতে জরিপ চালান। এমনই এক আর্কিওলজিক্যাল জরিপে স্থানীয় কুয়্যেচোয়া গোত্রের ১১ বছর বয়সী বালক পাবলিত আলভারেজ হিরামকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় মাচা পিচুর ট্রেইলে। আধুনিক সভ্যতা বিস্ময় এবং হতবাক হয়ে স্বাগত জানায় হিরামের এই আবিষ্কারকে।

চারদিকে হরেক রকম ভাষা আর ক্যামেরার ক্লিক শব্দে নেশা ধরে আসে নিজের অজান্তেই। সরু এবং সংকীর্ণ পথ বেয়ে অনেকে পাহাড়ের চূড়ার দিকে হাঁটছে ইনকা ট্রেইল জয়ের লক্ষ্যে। এমনই এক মিশনে গেল সপ্তাহে দু’জন ইংরেজ পর্বতারোহী পা পিছলে হারিয়ে গেছে পাহাড়ের মৃত্যু খাদে। কোন কিছুই মানুষের অজানাকে জানার আর অচেনাকে চেনার অদম্য বাসনা আটকাতে পারেনা, মৃত্যুভয় জেনেও কিশোর হতে শুরু করে বুড়োর দলও নিজকে সাক্ষী করতে চাইছে সভ্যতার এই মহা-বিস্ময়ের সাথে।

বেলা গড়াতে ঘন মেঘ কুন্ডুলী ক্লান্ত বলাকাদের মত উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে। পাহাড়ের চূড়াগুলো সহসাই মুক্তি পেল মেঘের আগ্রাসন হতে। সাথে সাথে সূর্যের আলো ভাসিয়ে নিলো লোকালয়। কেউ যেন ছবি তোলার প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিল ক্ষণিকের জন্যে। ক্যামেরা ক্লিক ক্লিক শব্দ আর ফ্ল্যাশ লাইটের ঝলকানো আলোতে মায়াবী পরিবেশে হতে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আমাদের নিয়ে এলো জাগতিক পৃথিবীতে। কিছুক্ষণ আগের কনকনে শীত ছাপিয়ে এবার ঝাঁকিয়ে বসলো ভ্যাপসা গরম। ট্যুর গাইডের বিরামহীন বর্ণনা একসময় রাজ্যের বিরক্তির নিয়ে এলো। ভাল লাগছিল না ভাঙ্গা ইংরেজিতে ইনকাদের ইতিহাস। মনে হল যাবার আগে প্রকৃতিকে নিজের মত করে কাছে না পেলে এ যাত্রা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ছিটকে পরলাম গ্রুপ হতে। এবার উঁচুতে উঠার পালা। একটার পর একটা বিপদজনক সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে শেষপর্যন্ত সূর্যঘড়ির চূড়ায় এসে হাঁপিয়ে পরলাম। এটাই ছিল জনবসতির সর্বোচ্চ চূড়া। সামনে, পিছনে, ডানে এবং বায়ে শুধুই মৃত্যুফাঁদ, ভারসাম্যের সামান্য হেরফের হলেই আমার আমিত্বে নামবে অমেঘো পরিণতি, ডেথ উদআউট ট্রেইস!

চোখ চোখ দু’টো বন্ধ করে নিজকে হাল্কা করে নিলাম। পাখীর ডানার মত হাত দু’টো ছড়িয়ে জোড়ে চীৎকার দিতেই সে চীৎকার লক্ষ প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এলো নিজের কাছে। কেন জানি মনে হল আমি এবং আমার ঈশ্বর এখন খুব কাছাকাছি এবং আমার চীৎকার ঈশ্বরের দরবারে পৌছাতে কোন অসুবিধা হচ্ছেনা।

বেলা পরে আসছিল, তাই ফেরার আয়োজন করতে হল। প্রধান ফটক পার হয়ে বাইরে বেরুতেই দেখলাম ২০ডলারের একটা বাফে। ক্ষুধায় পেট উঁচু স্বরে কথা বলতে শুরু করে দিল। খুব রসিক মেজাজে ভূড়িভোজের পর উল্টো পথ ধরলাম। পাহাড় হতে নামতে হবে বাসে চড়ে, তারপর ট্রেন। কুস্‌কো পৌছতে রাত হয়ে যাবে তাতে কোন সন্দেহ রইল না। ট্রেনে বসে হঠাৎ করেই মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। চারদিকের শুনশান নীরবতা দেখতে ভাল লাগছিল না। নিজকে বুঝাতে পারলাম না কেন এই বিষণ্ণতা! তবে কি এতদিনের লালিত স্বপ্ন আর কোনদিন দেখবোনা বলেই এই ভাবাবেগ? পৃথিবীর এই অঞ্চলগুলোতে আর কোনদিন পা ফেলবোনা বলেই হয়ত এ সাময়িক আচ্ছন্নতা। কিন্তু কে জানত দু’বছর পরেই আবার আমাকে আসতে হবে এখানে। মাচু পিচুর পাহাড় এবং মেঘেদের লুকোচুরির কোন এক বাঁকে আমার ভালবাসার মানুষকে আংটি পরিয়ে নিবেদন করব বিয়ে প্রস্তাব! সে অন্য এক কাহিনী, অন্য এক অধ্যায় যার সাথে এ লেখার কোন সম্পর্ক নেই। সময় সুযোগ পেলে তা নিয়েও হয়ত লেখা যাবে।

হোটেলে ফিরতে রাত দশটা বেজে গেল। রাতের খাবার শেষে সকাল সকাল শুয়ে পরার সিদ্ধান্ত নিলাম। খুব সকালে বাস ধরতে হবে। পরবর্তী ঠিকানা লেক টিটিকাকা, পেরুর সীমান্ত শহর পুনো।

নক্ষত্র মেলায় ডুবে যাওয়া দূরের আকাশটাকে মনে হচ্ছিলো রহস্যময় নারীর তুলতুলে শরীরের মত। জ্বল জ্বল করা তারা গুলো মুচকি হেসে আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল অবৈধ অভিসারে। সেপ্টেম্বরের বসন্তের রাত পৃথিবীর এ অংশটায়। কনকনে শীতের রেশ এখনো প্রকৃতি জুড়ে। আরও একটা কম্বল নিতে হল সূই’এর মত হুল ফোটানো শীত হতে বাচার জন্যে। লেক টিটিকাকায় ছোট্ট একটা ইঞ্জিন বোটের ডেকে শুয়ে দূরের আকাশটা দেখতে দেখতে নিজের ভেতর একধরনের ভোতা অনুভূতির জন্ম নিচ্ছিল। চারদিকের ভৌতিক নীরবতা আর মধ্য গগনের তারাগুলো দারুণ এক কাব্যিক পরিবেশ সৃষ্টি করছিল যদিও। না চাইলেও তার চেহারাটা ঘুরে ফিরে মগজের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল ঝাঁপিত জীবন। ক্লান্ত মনে হল নিজকে।

সূর্য উঠার আগেই ঝটপট নাস্তা সেরে বাস ষ্টেশনে দৌড়াতে হয়েছে পুনো গামী শেষ বাসটা ধরার জন্যে। ১০ ঘণ্টার লম্বা জার্নি। বলিভিয়ার পথে পেরুর শেষ শহর। মাচু পিচু হতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। কুসকোর ঘন কুয়াশায় জার্নির শেষটা ছিল বেশ ভীতিকর। সময় ছিল আমার এক নাম্বার শত্রু। এত অল্প সময়ে এত বড় আয়োজন শরীরে উপর বয়ে দিচ্ছিল কাল বৈশাখী।

সহসাই দিগন্ত রেখায় মিলিয়ে গেল লোকালয়। জানালার ওপাশটায় পাহাড়ের রাজ্য এসে গ্রাস করে নিলো আমাদের চলা। থরে থরে সাজানো আন্দিজের চূড়া গুলো চলন্ত ছবির মত হারিয়ে যাচ্ছিল জানালার ওপাশ দিয়ে। নেশা ধরা প্যানোরমা। আমি যেন শুধু গিলছি আর আন্দিজকে বুকের ভেতর আঁকড়ে ধরছি শক্ত করে। রাজ্যের তন্দ্রা এসে ভর করলো। বাসের কর্কশ ব্রেকে তন্দ্রা টুটে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। দুপুরের খাবার খেতে হবে। ছোট্ট একটা লোকালয়ে আমাদের যাত্রা বিরতি। বাহারি পোশাকের ক’জন এন্ডিয়ান মহিলা গান গেয়ে আমন্ত্রণ জানালো খাবার টেবিলে। হরেক রকম খাবারে ভরা বাফে। জিবে পানি এগে গেল মেনুতে চোখ বুলিয়ে। ক্ষুধার্ত শেয়ালের মত ঝাঁপিয়ে পরলাম প্লেটের উপর। শেষ কবে ভাল খাবার মুখে উঠেছে মনে করতে পারলাম না। টেবিলের আশে পাশে ঘোরাফেরা করছিল একদল আলপাকা, জিরাফের মত উঁচু গলার একধরনের ভেড়া। পর্যটকদের মনোরঞ্জনের খুঁটিনাটি দেখে মুগ্ধ হতে হল। শ্রদ্ধায় মাথা নত করতে ইচ্ছে হল পেরুর মানুষের কাছে। বাস যখন ছাড়বে অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল…দন্ত-বিহীন এবং শীতে তামাটে হয়ে যাওয়া একদল শিশু বিরল প্রজাতির পাহাড়ি ফুল ধরিয়ে দিয়ে বিদায় জানালো আমাদের। আবারও গেয়ে উঠলো এন্ডিয়ান মেয়েগুলো। ধীরে ধীরে বিন্দুর মত ছোট হয়ে পাহাড় রাজ্যে মিলিয়ে গেল জীবনের এই সুন্দর মুহূর্তগুলো। আবারও পথ চলা।

সূর্যের তেজ ধীরে ধীরে পড়ে আসছিল। এনাকন্ডা সাপের মত ঘন কুয়াশা এসে গ্রাস করে নিলো আমাদের বাসটাকে। হঠাৎ করে মনে হল চারদিকে শুধু ঘন অন্ধকার। থেমে গেল আমাদের চলা। ভয় পেয়ে গেলাম। এ লোকালয়ে ডাকাতদের উৎপাতের কথা অনেক উপন্যাসে পড়েছি, ছবিতে দেখেছি। বাসের অন্য যাত্রীদের চোখেও দেখলাম একই ভীতি। হঠাৎ করে আসা সাপটা আবার হঠাৎ করেই আন্দিজের চোরা পথে হারিয়ে গেল। আলো দেখতে পেলাম বিপদজনক বাকে। বাসটা গতি বাড়িয়ে দ্রুত পৌঁছে গেল একটা চূড়ায়। সূর্যাস্ত দেখবো আমারা। বোবা হয়ে গেলাম অবিস্মরণীয় দৃশ্য দেখে। বরফে আচ্ছাদিত চূড়াগুলোর কোলে অসহায়ের মত ঘুমিয়ে পড়ছে শেষ বিকেলের সূর্যটা। রক্তিম আভায় ভেসে যাচ্ছে সাদা পালকের মত বরফগুলো। যুদ্ধে পর্যুদস্ত সৈনিকের মত আত্নসমর্পন করলো এতক্ষণ ধরে রাজত্ব করা পাহাড়ি সূর্যটা। হাল্কা অন্ধকার এসে চাদরের মত ঢেকে দিল চূড়াগুলো। দূরে ভেসে উঠলো টিটিকাকার হ্রদের সমুদ্র সমান চেহারাটা। দৃশ্যপটে টিমটিম করে জ্বলে উঠলো পুনো শহরের নিয়ন বাতিগুলো। এতক্ষণ পর লোকালয়ের গন্ধ পেয়ে মনটা ঝলমল করে উঠলো।

লেক টিটিকাকা, সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ১২,৫০০ ফিট (৩৮০০ মি) উচ্চতায় পৃথিবীর সবচেয়ে চলাচল যোগ্য লেক। বৃষ্টি আর আন্দিজের বরফ গলা পানির ফসল হচ্ছে প্রকৃতির এই নয়নাভিরাম দৃশ্যপট। লেকের অন্য ধারে বলিভিয়া। অনেক পর্যটক এ লেক দিয়ে পাড়ি জমায় আরও উঁচুতে অবস্থিত লা-পাস’এ।

আমার নামের ছোট একটা সাইন নিয়ে মধ্য বয়সী এক মহিলাকে এদিক ওদিক তাকাতে দেখলাম। হাত বাড়িয়ে ইশারা দিতেই নিজের পরিচয় দিল, গাইড। হোটেল বুক করা ছিল লিমা হতেই। ডকুমেন্টের ঝামেলা সেরে রুমে ঢুকতেই রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করলো। বিধ্বস্ত মনে হল নিজকে। এবার বিশ্রামের পালা।

দরজায় নক করে রুমে ঢুকল আমার গাইড। স্তম্ভিত হয়ে গেলাম দুঃসংবাদটা পেয়ে… বলিভিয়ায় সাধারণ ধর্মঘট চলছে গত ৭দিন ধরে। কবে ভাঙ্গবে কেউ জানেনা। আর তাই পুনো হতে ছেড়ে যাওয়া বাস গুলো বসে আছে হাত-পা গুটিয়ে। অংক কষার চেষ্টা করলাম নিউ ইয়র্ক ফিরে যাওয়ার। মেলাতে পারলাম না কোন কিছু। বন্দী হয়ে গেলাম আন্দিজের পাহাড়ি  অনিশ্চয়তার কাছে।

বলিভিয়ায় ৭ দিন ধরে সাধারণ ধর্মঘট চলছে খবরটা নিশ্চয় কুসকো এবং লিমার ট্রাভেল এজেন্টদের জানা ছিল, অথচ টিকেট বিক্রির সময় প্রসঙ্গটা নিয়ে কেউ কথা বলেনি। মনটা খারাপ হয়ে গেল অনিশ্চয়তার গ্যড়াকলে আটকে গিয়ে। হোটেল কাউন্টারে খোজ নিয়ে ধর্মঘটের বিস্তারিত জানার চেষ্টা করলাম। বেশ ক’দিন ধরেই ধর্মঘট চলছে। বলিভিয়া শুধু দক্ষিণ আমেরিকারই নয় বরং পৃথিবীর অন্যতম গরীব দেশ। ক্ষমতা নিয়ে দুটি রাজনৈতিক দল এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে কাড়াকাড়ির ফলে এ দেশটি ইতিমধ্যে সামরিক অভ্যুত্থানে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মর্যাদা লাভ করেছে। দারিদ্র এবং দুর্নীতির ভীত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে কতটা শক্ত মাটির উপর দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের পাশাপাশি বলিভিয়াও তার বাস্তব প্রমাণ। ৯ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশে প্রাকৃতিক সম্পদের কোন কমতি নেই, অথচ দুর্নীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রার মান একেবারেই অমানুষিক। ট্রেড ইউনিয়ন গুলো এ যাত্রায় দু’টো দাবি নিয়ে হরতাল করছে; এক, তেলের দাম কমাতে হবে, দুই, প্রাকৃতিক গ্যাসকে জাতীয়করণ করতে হবে। এ নিয়ে সরকার এবং শ্রমিক সংগঠনগুলো একে অপরের মুখোমুখি দাড়িয়ে, কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজী নয়। দেশটার সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট যাচাই না করে ভ্রমণ করার পরিকল্পনার জন্যে নিজকে ছাড়া অন্য কাউকে দায়ী করতে পারলামনা। হোটেল ম্যানেজার জানাল যেহেতু কাল শনিবার হয়ত ধর্মঘট কিছুটা শিথিল হতে পারে, এবং এমনটা হলে তারা যেভাবেই হোক আমাকে একটা বাসে উঠিয়ে দেবে। কিছুটা আশান্বিত হয়ে রাতের খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে গেলাম।

চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সাথে শক্ত তামাটে পাথরের রাস্তাগুলো হাল্কা নিয়ন আলোতে এক ধরনের রহস্য সৃষ্টি করছে যা হলিউডের ভৌতিক ছায়াছবির কথাই মনে করিয়ে দেয়। প্রচণ্ড শীত। পথচারীদের সবার মুখ বিভিন্ন কারুকার্যের চাদরে ঢাকা। দু’কান ছড়িয়ে দু’দিকের ল্যাজ সহ মাথার টুপি ছোটবেলায় দেখা দক্ষিণ আমেরিকার ছায়াছবির যেন বাস্তব প্রতিফলন। সবকিছু ছাপিয়ে চেহারার যতটুকুই বেরিয়ে আসছে তাতে প্রকৃতির সাথে লড়াই করে বেচে থাকার কঠিন ছাপ। এক টুকরো কাপড়ে সন্তানদের পিঠে ঝুলিয়ে মহিলাদের পথচলা অবচেতন মনে কল্পনা করলে ভ্যান গগের কোন অসমাপ্ত ছবির দৃশ্যপট মনে করিয়ে দেবে। শহরের রাস্তাগুলো সাগরের ঢেউয়ের মত উঁচু নিচু, সাপের মত আঁকাবাঁকা। কিছুদূর হাঁটলেই বুকের বা পাশে দাপাদাপি শুরু হয়। পা জড়িয়ে আসে। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে এত উঁচুতে আছি চাইলেও তা ভুলে যাবার নয়।

দু’তিন ব্লক হাটতেই ’পইয়্যো লা ব্রাসা’ নামের হোটেলটা চোখে পরল। পয়্যো লা ব্রাসা, অর্থাৎ ফ্রাইড চিকেন। দক্ষিণ আমেরিকার দেশে দেশে ফ্রাইড চিকেনের এত কদর চোখে না দেখলে তা বিশ্বাস করা মুস্কিল। সুইং দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই অন্য এক পুনোর চেহারা ফুটে উঠল। গিজ গিজ করছে খদ্দেরের ভিড়ে। ধোয়া এবং ভাজা মুরগীর গন্ধে চারদিক মৌ মৌ করছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই এক তরুণী এগিয়ে এলো। হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাল। সাধারণ মানের হোটেল। চেয়ার-টেবিলে দৈন্যতার ছোঁয়া। কিন্তু চারপাশের মানুষগুলোর খাওয়ার ভেতর কোন ফাঁক ফোকর খুঁজে পেলামনা। ওরা খাচ্ছে আর জীবনকে উপভোগ করছে নিজের মত করে। জোড়া জোড়া তরুণ তরুণী টেবিলে খাবার ভুলে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে একে অপরের দিকে। মা-বাবা সন্তানাদি নিয়ে উপভোগ করছে রাতের খাবার। চারদিকে চ্যাচাম্যাচি হৈ চৈ।

অর্ডার নিতে আগের সে তরুণী এগিয়ে আসতেই দমে গেলাম… কি ভাবে অর্ডার করবো! নিশ্চয় সে ইংরেজি জানেনা আর আমারও স্প্যানিশের দখল যথেষ্ট নয়। সমস্যা হল, পেরুভিয়ানদের অনেকের চেহারাই আমাদের মত, এবং আমাকে তাদেরই একজন ভেবে তরুণী গলগল করে স্প্যানিশ বলে গেল। মুচকি হেসে জবাব দিলাম, ‘ইয়ো ন হাবলা স্প্যনিয়ল‘। চোখ বড় করে হো হো করে হেসে উঠল। আমি স্প্যানিশ জানিনা এমনটা সে মোটেও আশা করেনি। বাঁকা একটা হাসি দিয়ে হারিয়ে গেল খদ্দেরের ভিড়ে। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো ততোধিক সুন্দরী এক তরুণী সাথে নিয়ে। ’ম্যা আই হেল্প ইউ সিনয়্যর?’ হাতে চাঁদ পেলাম যেন। কোয়ার্টার চিকেন, পটেটো ফ্রাই এবং ইন্‌কা কোলার অর্ডার দিয়ে আলাপ শুরু করলাম তরুণীর সাথে। আমি নিউ ইয়র্ক হতে এ অঞ্চলে এসেছি জেনে বিস্ময় প্রকাশ করল, আমার অবস্থা খুলে বলতেই সান্ত্বনা দিতে চাইল। তৈলাক্ত খাবার, বেশী খাওয়া গেলনা। সবশেষে এককাপ ধূমায়িত কফি নিয়ে অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলাম পৃথিবীর এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জীবন। আমাদের জীবন হতে খুব কি একটা তারতম্য? মনে হলনা!
আশাতীত টিপস পেয়ে তরুণীর সাদা চেহারা একেবারে লাল হয়ে গেল। মুচকি হেসে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল… ‘পরের বার আসলে ওয়েন্ডিকে খোজ কর। শুভরাত্রি জানিয়ে আবারও হারিয়ে গেলাম আলো আধারে ভরা ভূতুরে শহরে।

কুয়াশার চাদরে ঢাকা আন্দিজের চূড়াগুলো দিগন্তরেখায় খুঁজে পেতে কষ্ট হল। নিকষ কালো অন্ধকার গ্রাস করে নিয়েছে সবকিছু। রাস্তায় মানুষের সংখ্যাও বিপদজনক ভাবে কমে গেছে। উদ্দেশ্যবিহীন আরও কিছুটা পথ হাটাহাটি করার সিদ্ধান্ত নিলাম। এ ফাকে মনটাও বেশ হাল্কা হয়ে এলো। ক্ষতি কি আগামীকাল যদি বলিভিয়া যাওয়া না হয়! আর সময়মত নিউ ইয়র্ক ফিরে না গেলে চাকরীটা চলে যাবে এইতো! তাতে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে ভেবে পেলামনা। চাকরী আরেকটা খুঁজতে হবে এই যা। মনে মনে ছক আকা শুরু করলাম আগামীকালের। নৌকায় করে লেক টিটিকাকা দিয়ে লা পাস যাওয়ার চিন্তাও মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করল। সত্যি বলতে কি এমন একটা অনিশ্চয়তা হঠাৎ করেই ভাল লাগতে শুরু করল।

শহরে বিদ্যুতের আসা যাওয়া এই প্রথম খেয়াল করলাম। রাস্তার বাতিগুলো নিভে গেল বিনা নোটিশে। ভুতের বিশ্বাস থাকলে হয়ত সামনে যাওয়া হতনা। হঠাৎ করে বাইসাইকেলের আওয়াজে পিলে চমকে উঠল। সামনে একটা কাঁচা বাজারে আলোর দেখা পেয়ে ঢুকে গেলাম। বিক্রেতার দল সাড়ি সাড়ি পণ্য সাজিয়ে বসে আছে শেষ খদ্দেরের আশায়। টিমটিম করে কেরোসিনের কুপি জ্বলছে প্রতিটি দোকানে। বয়সের ভারে নূয্য দোকানীর দল একই সাথে মসলার পাশাপাশি গিনিপিগ এবং শুয়োরের মাংস বিক্রি করছে। উদভ্রান্তের মত হাটাহাটি করলাম কিছুক্ষণ। এমন একটা বাজারের সাথে কেন জানিনা ’৭১’এ দাদাবাড়িতে দেখা কাচা বাজারের মিল খুঁজে পেলাম। দু’টো প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও কোথা যেন যোগসূত্র ছিল। রাত বাড়ছিল দ্রুত, এবার হোটেলে ফিরে যাওয়ার পালা।

লেক টিটিকাকার পাড় ঘিরে হাটাহাটি শেষে হোটেলে ফিরতেই খবরটা পেলাম। খুব ভোরে দু’টো বাস যাচ্ছে লা পাস। আমিও একটা বাসের যাত্রী হতে যাচ্ছি। ভ্রমণটা হবে খুবই রিস্কি। শেষ পর্যন্ত গন্তব্যে পৌছাতে পারব কিনা তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। আমাকে সকাল ৫টার ভেতর তৈরি থাকতে হবে। খবরটা শুনে কেন জানি মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। এতক্ষণ ধরে আকা কল্পনাগুলো শুধু কল্পনা হয়েই থাকবে হয়ত এ জন্যে। এক কাপ ককো টি কোন রকমে গিলে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পরলাম। এবারের যাত্রা কোপাকাবানা হয়ে বলিভিয়ার রাজধানী লা পাস।

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৩
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৪
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৫

মুহুরী প্রজেক্ট এবং সোনাগাজী উপকূলে একদিন

কামলা সমাজের যা হয় আরকি, হাতে সময় খুবই কম। কই যাই কই যাই করতেই, সবেধন সাধের অফ ডে টাও চলে যায়। এই কই যাই কই যাই করা কামলা সমাজের জন্য একদিনের মাঝেই ঘুরে আসার মত অসাধারণ এক জায়গা ফেনীর মুহুরী প্রজেক্ট। শুরু টা ঢাকার টিটি পাড়া হতে। কারন এখান থেকেই ছাড়ে ফেনীর প্রায় সকল বাস। যদিও বা উত্তরা  ও মিরপুর হতেও কিছু কিছু ছাড়ে।

এক শুক্রবার সাত সকালে বেরিয়ে পড়লাম বাসা হতে।  প্রাথমিক লক্ষ্য টিটি পাড়া, কারন সেখান থেকেই প্রতি ১৫ মিনিট পর পর নন এসি ও ১ ঘন্টা পর পর এসি বাস ছেড়ে যায় ফেনীর উদ্দেশ্যে। গিয়েই কাটতে হয় টিকিট। তাই এই সিস্টেমের ভাল মন্দ দুটো দিক’ই পাবেন ফিল করতে। যাইহোক দিনটা যেহেতু শুক্রবার সাত সকালে ভালই ছিল যাত্রী চাপ, অন্যদিকে বাসে ফাঁকা সিট নেই। তাই ৭ টার আগে গিয়ে পৌছালেও আমার ভাগে পড়লো ৮:৩০ এর এসি বাস। বাস ভাড়া মাত্র ৩৫০ টাকা। যথা সময়ে বাসে চেপে বসলাম আর বাস ছুটতে শুরু করলো ফেনীর উদ্দেশ্যে। পথে অবশ্য কুমিল্লায় ব্রেক ১৫ মিনিটের। ঘড়ির কাটা যখন জানান দিলো ৩ ঘন্টা পার বাসে বসেই। ঠিক তখনি পৌছালাম ফেনীতে। খুবি ছোট্ট কিন্তু সাজানো গোছানো শহর ফেনী। ওই এক রাস্তা ধরে ছুটে চললেই পেয়ে যাবেন মোটামুটি সবকিছু। রাজারঝির দীঘি ছাড়া ফেনী শহরে দেখার মতো ততোটা কিছু নেই। তাই ফ্রেশ হয়ে, খেয়ে দেয়ে, নামাজ পড়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম। এবার ছুটে চলা ফেনী ও চিটাগাং এর সংযোগ স্থল মুহুরী প্রজেক্টে। এটি ফেনী জেলা শহর হতে মাত্র ২৯ কিলোমিটার দূরে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার অবস্থিত। মুহুরী প্রজেক্ট বাংলাদেশের ২য় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প।  এই জায়গাতেই আছে বাংলাদেশের ১ম বায়ু বিদ্যুত কেন্দ্র। আছে  আছে দেশের সবচেয়ে বড় মৎস্য জোন।  আর হ্যা এই সবই বর্তমান সময়ের আলোচিত ফেনী নদীকে ঘিরেই।

মুহুরী প্রজেক্ট

১৯৭৭-৭৮ অর্থ বছরে মুহুরী সেচ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় এবং ১৯৮৫-৮৬ অর্থ বছরে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই সেচ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ফেনী নদী, মুহুরী নদী এবং কালিদাস পাহালিয়া নদীর সম্মিলিত প্রবাহকে আড়ি বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে ৪০ ফোক্ট বিশিষ্ট একটি বৃহদাকার পানি নিয়ন্ত্রণ কাঠামো তৈরী করা হয়। এর মাধ্যমে ফেনী জেলার ফেনী সদর, ছাগলনাইয়া, পরশুরাম, ফুলগাজী, সোনাগাজী এবং চট্রগ্রাম জেলার মিরসরাই উপজেলার কিয়দংশ এর সুফল ভোগ করে। এসব এলাকায় বর্ষা মৌসুমে বন্যার প্রকোপ কমানো ও আমন ফসলে অতিরিক্ত সেচ সুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল মুহুরী সেচ প্রকল্প। অসাধারণ পরিস্কার নীল আকাশ আর বাঁধ থেকে বের হওয়া পানির প্রবল তেজ, অন্য দিকে শান্ত পানির লেক। চাইলেই নৌকায় চড়ে করে নিতে পারেন খানিকটা নৌবিহার।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর মুহুরী প্রজেক্ট এর রেগুলেটরের চারদিকে বাঁধ দিয়ে ঘেরা কৃত্রিম জলরাশি। আছে বনায়ন, মাছের অভয়ারণ্য, পাখির কলকাকলি। বাঁধের দুপাশে নীচে খেকে পাথর দিয়ে বাঁধানো এবং উপরদিকে দুর্বা ঘাসের পরিপাটি বিছানা। মুহুরী নদীর জলরাশিতে নৌভ্রমণের সময় খুব কাছ থেকে বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস এবং শীতে প্রায় ৫০ জাতের পাখির দেখা মেলে। আর তাই আসছে শীতে কই যাই কই যাই লিস্টে রাখতে পারেন মুহুরী প্রজেক্টের নাম।

এই মুহুরী প্রজেক্ট এলাকা, বর্তমানে মৎস্য চাষে বিপ্লব ঘটিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় মৎস্য জোন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এখানেই দেশের অনেক নামিদামি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে মৎস্য প্রকল্প গড়ে তুলেছে।

ছবি: ফেনীতে একদিন

এই মুহুরী প্রকল্পের পাশেই প্রায় ৫০০ গজ দূরে থাকা খোয়াজের লামছি গ্রামে আছে বাংলাদেশের প্রথম বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। প্রকল্প এলাকার পাশ দিয়ে ফেনী নদী বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। দক্ষিণে বিস্তীর্ন মাঠ এবং বন বিভাগের সবুজ বেষ্টনী আর এরই মাঝে বাংলাদেশের প্রথম বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র। ২২৫ কিলোওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ৪ টি টারবাইন বসানো আছে যা দিয়ে সর্বোচ্চ ০.৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।  বিকালে ওই মুহুরী প্রজেক্ট ঘুরেই পাশের বাজারে টুকটাক পেট ঠান্ডা করে ধরতে পারেন ফিরতি পথ। শহরে পৌছে উঠে পড়তে পারেন ঢাকা গামী স্টার লাইন বা এনা বাসে। ৩-৪ ঘন্টার মধ্যেই পৌছে যাবেন ঢাকাতে। আর এর মাধ্যমেই শর্ট কাটে একটু দূরের, একদিনের এক জমপেস ট্যুর দিয়ে ফেলতে পারেন। সকালে রওনা দিয়েই সারা দিন ঘুরে ফিরে খেয়ে দেয়ে রাতের মধ্যে যারা ফিরতে চান পরের দিন আবার কামলা খাটায় ব্যাক যাওয়ার জন্য তাদের জন্য একদিনের ট্যুরের জন্য বেস্ট ডেসটিনেশন হতে পারে ফেনী।

কিভাবে যাবেন

ফেনী হতে সোনাগাজী উপজেলা পর্যন্ত বাসে। তারপর সোনাগাজী হতে সিএনজিতে মুহুরী প্রজেক্ট যেতে পারেন। লোকাল সিএনজিতে জনপ্রতি ভাড়া ৪০ থেকে ৫০ টাকা। কিংবা ফেনী হতে সরাসরি সিএনজি বা কার মাইক্রো বাস ভাড়া করেই চলে যেতে পারেন মুহুরী প্রজেক্টে। যাইহোক, ঘুরতে যান ট্যুরে যান, ট্র‍্যাকিং এ যান, যেখানে মন চায়, যেভাবে মন চায় যান। কিন্তু প্লিজ লাগে,  প্রকৃতির জন্য ক্ষতিকর এমন কিছুই কইরেন না।

ভ্রমণ গাইডলাইন পড়ুন

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৩

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – পর্ব ১
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – পর্ব ২

অনিশ্চয়তার বেড়াজালে আটকে গেল ঘুমের পৃথিবী। এপাশ ওপাশ করেই কাটিয়ে দিলাম বাকি রাতটা। শেষ রাতের দিকে তন্দ্রা মত আসতেই ঘড় ঘড় শব্দে বেজে উঠল এলার্ম ঘড়িটা। মিনিট খানেকের ভেতর রিসিপশন ডেস্ক হতে কেউ একজন ওয়েক-আপ কল দিয়ে জানিয়ে দিল এবার উঠতে হবে। রাজ্যের আলসেমি এসে ভর করলো শরীরের উপর। সাথে মাথাটাও ঘুরছে পাগলা ষাঁড়ের মত। উঠে পরলাম অনিচ্ছা সত্ত্বেও। বাথটাবে গরম পানি ছেড়ে শরীরটাকে ডুবিয়ে রাখলাম অনেকক্ষণ। এত সকালে হোটেল ক্যান্টিন খোলা থাকবে কিনা সন্দেহ হল। ব্রেকফাস্ট নিয়ে বেশ একটু চিন্তায় পরে গেলাম।

রুমের বিশাল পর্দাটা সড়াতেই আন্দিজের চূড়ায় ঘুমন্ত সূর্যটার দেখা মিলল। ঘন কুয়াশা এবং খণ্ড খণ্ড মেঘের কোল ঘেঁষে শুয়ে থাকা লাল আভাটা উঠি উঠি করছে কেবল। হঠাৎ মনে হল সূর্যোদয়ের এমন একটা মায়াবী দৃশ্য দেখেই বোধহয় বাকি দিনটা কাটিয়ে দেয়া যাবে, দরকার কি বলিভিয়া যাওয়ার! আবারও ফোন পেলাম রিসিপশন হতে, ক্যান্টিন খোলা হয়েছে, চাইলে নাস্তা করতে পারি। এলোমেলো চিন্তা সরিয়ে বাস্তবে ফিরে এলাম। নাস্তা মিস করা যাবেনা। শুকনো দু’টুকরো রুটি, সাথে মাখন আর গরম এক কাপ কফি, এই ছিল হোটেলের ফ্রি ব্রেকফাস্ট। নাস্তা সেরে রুমে ফিরে আসতেই বেশ তরতাজা মনে হল নিজকে। রাতেই লাগেজ গুছিয়ে রেখেছি, তাই এ নিয়ে মাথা ঘামাতে হলোনা। সূর্য উঠার পর্বটা মিস করতে চাইলাম না এ যাত্রায়। সাথে একটা দূরবীন ছিল, ওটা নিয়ে দাড়িয়ে গেলাম জানালার পাশে। সবকিছু কেমন যেন গোলমেলে মনে হল; কুয়াশা সাথে লড়ছে সূর্যটা, মাঝে মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে খণ্ড খণ্ড কালো মেঘ। পাহাড়ের কোলে চাইলেই দেখা যাচ্ছে সেই সব মেঘদের ছায়া। কোটি কোটি সূর্য রশ্মি বাধ ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে চাইছে মেঘ রাজ্যের মায়াবী বন্ধন হতে। ফাকে ফাকে উকি দিচ্ছে লাভার মত জ্বলন্ত সূর্যটা। বেশীক্ষণ স্থায়ী হলোনা এ অসম লড়াই। সূর্যের তীব্রতার কাছে ভেসে গেল মেঘমালার হাল্কা প্রতিরোধ। পাহাড়ের চূড়াগুলো বেরিয়ে এলো কুয়াশার বুক চিড়ে। ধীরে ধীরে সকাল হয়ে গেল আন্দিজের এ অংশটায়। রাতের পুনোকে চেনা গেলনা দিনের আলোতে।

যতই বেলা বাড়ছে সাথে বাড়ছে আমার টেনশন। দোভাষীনির দেখা নেই। কথা ছিল ৮টার ভেতর বাস ষ্টেশন থাকব আমি। ঠিক ৮টা ১০’এ হাঁপাতে হাঁপাতে হাজির হলেন জনাবা। কথা না বলে শুধু ইশারা দিল, দৌড়াও। পরি মরি করে ছুটলাম। অনেকটা হিন্দি সিনেমার থ্রিলিং সিকোয়েন্সের মত মনে হল দু’জনের এ দৌড়। লাগেজ নিয়ে দৌড়ানো খুব একটা সহজ মনে হলনা। বিশেষ করে সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে এত উঁচুতে দৌড়াতে গেলে শ্বাস ছোট হয়ে আসে। নাক মুখ হতে রক্ত বেরিয়ে আসে বিনা নোটিশে। কুলিয়ে উঠলাম না, তাই দৌড়ে হার মানতে হল দোভাষিনীর কাছে। বাসটা প্রায় ছেড়ে যাচ্ছে… অন্তিম মুহূর্তে পড়িমরি করে কোনরকমে উঠে পরলাম। ততক্ষণে মুখ বেয়ে লালা পরতে শুরু করেছে, চাইলেও জ্বিহবাকে সঠিক জায়গায় ধরে রাখা যাচ্ছিলোনা। হঠাৎ করে মারত্মক পিপাসা পেল। কিন্তু তৃষ্ণা মেটাবার কোন কিছু সাথে আনা হয়নি, তাই নিজকে সান্ত্বনা দিলাম অবুঝ শিশুর মত। যেমনটা চেয়েছিলাম জানালার পাশেই আমার সীট। একটু গুছিয়ে বসতেই চোখ গেল পাশের সহযাত্রীর দিকে। অত্যন্ত ধারালো এক সুন্দরী। বাঁশের মত লিকলিকে শরীর, টাইট জিনস এবং কোমরের অনেক উঁচু পর্যন্ত একটা হাল্কা টি-শার্ট। মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম আমার ট্যুর গাইডকে।

আমার অবস্থা যাচাই করে হাই হ্যালো বলার আগেই ঠাণ্ডা এক বোতল কোমল পানীয় এগিয়ে দিল। লৌকিকতা করার মত অবস্থা ছিলনা, তাই কোন মতে হাল্কা একটা ধন্যবাদ জানিয়ে ঘট ঘট করে গিলতে শুরু করে দিলাম পানীয়। ‘তুমি আন্দিজের এ দিকটায় কি এই প্রথম?’, চোস্ত মার্কিন উচ্চারণের ইংরেজিতে জানতে চাইল তরুণী। ‘হ্যাঁ, এই প্রথম, কিন্তু তুমি জানলে কেমন করে? জিজ্ঞেস করলাম আমি। উত্তরে যা বলল তা শুনে মাথা আমার চড়কগাছ। এ অঞ্চলে ভ্রমণ করতে গেলে সাথে থাকা চাই যথেষ্ট শুকনো খাবার এবং পানীয়। অথচ আমার সাথে আছে কেবল ৪টা আপেল, তাও আবার কুসকো হতে কেনা। ’আমার নাম ভিক্টোরিয়া’, হাত বাড়িয়ে নিজের পরিচয় নিশ্চিত করল এই রহস্যময়ী। পেশায় একজন আইনজীবী, লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের বেটেন-রুজ শহরে বাস। অবাক হয়ে গেলাম একজন আইনজীবীর এ ধরনের পোশাক দেখে। সেও বুঝতে পারল বোধহয় আমার কনফিউশন। বত্রিশ দাঁত বের করে উত্তর দিল, ‘আমি ছ’মাস আইন প্র্যাকটিস করি আর ছ’মাস ঘুরে বেড়াই মুক্ত বিহঙ্গের মত’, বেশ ঘটা করে নিজকে প্রকাশ করল আমার সহযাত্রী। নড়েচড়ে বসলাম আমি। জার্নিটা মনে হল বেশ লোভনীয় হতে যাচ্ছে।

প্রাথমিক ধাক্কা সামলে ঠিকঠাক হয়ে বসতেই ড্রাইভার জানাল দুঃসংবাদটা, আমরা কোপাকাবানা হয়ে লা পাস যাচ্ছিনা। ও পথ নাকি ধর্মঘটকারীদের দখলে চলে গেছে। রক্তারক্তির খবরও নাকি বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। অজানা আশংকায় মনটা অস্থির হয়ে উঠল। এমন একটা ঘোলাটে পরিবেশে বলিভিয়া যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে কিনা বুঝতে পারলাম না! কোপাকাবানা নামটার সাথে অনেক দিনের পরিচয়। বেশ ক’টা বিখ্যাত স্থাপনা আছে দেখার মত। ১৬০০ শতাব্দীর স্প্যানিশদের তৈরি Basilica of Our Lady of Copacabana পর্যটকদের কাছে খুবই পরিচিত নাম। গির্জাটা দেখতে মৌমাছির মত ভিড় জমায় পৃথিবীর এ কোনায়। তা ছাড়া লেক টিটিকাকার তীরে এটাই বলিভিয়ার মূল শহর। শহরটার সৌন্দর্য নিয়ে ভ্রমণ দুনিয়ায় অনেক উপকথা চালু আছে। লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দূর করলাম কোপাকাবানা না দেখার দুঃখ। খুব একটা লম্বা হলোনা জার্নিটা। ৩০ মিনিটের ভেতর পেরু-বলিভিয়ার সীমান্ত শহর দেসাগুয়াদে্‌র পৌঁছে গেলাম। নড়বড়ে একটা কাঠের সেতুর সামনে এসে বাসটা থেমে গেল। এখানেই পেরুর শেষ। সেতুর ওপারে বলিভিয়া। অন্য একটা বাস ধরতে হবে সীমান্তের ওপার হতে। বলিভিয়ান বাস।

’তুমি কি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক’, প্রশ্ন করল আমার সহযাত্রী ভিক্টোরিয়া।

’না, আমি অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্টে ভ্রমণ করছি, অবশ্য নিউ ইয়র্ক ফিরে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বের শপথ নিতে যাচ্ছি’ উত্তর দিয়ে কারণ জানতে চাইলাম এমন প্রশ্নের।

ভিক্টোরিয়া জানাল, পৃথিবীর এ অঞ্চলে মার্কিন পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণ খুব একটা নিরাপদ নয়। বলিভিয়ান আন্দিজের অনেক বিপদজনক বাঁক আছে, যেখানে ওৎ পেতে থাকে অপহরণকারীর দল। অপহরণ ব্যবসায় মার্কিন নাগরিকদের চাহিদা নাকি সবার শীর্ষে। আমার জ্যাকেটে যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা সম্বলিত একটা পিন দেখে ভিক্টোরিয়া অনুরোধ করল খুলে ফেলার জন্যে। এসব শুনে একেবারেই হতাশ হয়ে পরলাম। এলাম নতুন কিছু দেখব বলে অথচ পদে পদে দেখছি ভয়ঙ্কর সব বাধা। হা হা করে হেসে উঠল মেয়েটা/ বোধহয় বুঝতে পেরেছে আমার মনের অবস্থা।

’ভয় পেওনা, এ গুলোই কিন্তু আন্দিজ দেখার আনন্দ, তাছাড়া তোমার চেহারা অনেকটাই বলিভিয়ানদের মত, বিপদ আসলে মিশে যেও ওদের ভিড়ে’, বলতে গিয়ে হাসিতে ফেটে পরল।

এমন বিপদজনক সুন্দরী যদি ৬ মাস আন্দিজের বাঁকে বিচরণের পরও জীবিত থাকে, তা হলে আমার কেন বিপদ হবে, এমন একটা সমীকরণের ফলাফল বের করে নিজেই নিজকে আস্বস্ত করলাম।

বাস হতে বেরুতেই আন্দিজের ঠাণ্ডা বাতাস শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল। ইতিমধ্যে জেগে উঠেছে সীমান্ত এলাকার জনপদ। চারদিক গিজগিজ করছে মানুষের ভিড়ে। ভ্যান গাড়ি, সাইকেল, অটো রিক্সা, বাস, ট্রাক, হরেক রকম যানবাহন আর পায়ে হেটে হাজার হাজার মানুষ অতিক্রম করছে দুই দেশের সীমান্ত। চারদিকে মনে হল ধূলিঝড় বইছে যেন। মাঝ খানে কয়েক শ ফুট নো ম্যানস্‌ ল্যান্ড। শ্রীহীন ছোট্ট একটা ছাপরা ঘরে ঢুকতে হল পাসপোর্টে পেরুর একজিট সিল নেয়ার জন্যে। অভিব্যক্তিহীন চাউনিতে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল ইমিগ্রেশন অফিসার। ধপাস শব্দে বসিয়ে দিল সীলটা। ’আডিওস‘, যান্ত্রিক পুতুলের মত উচ্চারন করল বিদায় বানী।

নো ম্যানস্‌ ল্যান্ডে দাড়াতেই শিরদাঁড়া বেয়ে অন্যরকম একটা অনুভূতি নেমে গেল। আমি এখন কোন দেশে? চোখের সামনে বলিভিয়া আগমনের শুভেচ্ছা। পিছন ফিরে তাকালেই দেখা যাচ্ছে পেরু ভ্রমণের ধন্যবাদ বানী। এই মুহূর্তে আমার কোন দেশ নেই! ভাবতেই মনে হল এ কয়েক শ ফুটের আমিই অলিখিত বাদশাহ্‌। এখানে নেই কোন ইমিগ্রেশন, নেই পুলিশের বাঁকা চাউনি। প্রফুল্ল মনে দূরত্বটুকু পার হলাম।

বলিভিয়া! অফিসিয়াল নাম প্লুরিন্যাশনাল ষ্ট্যেইট অব বলিভিয়া। কোন সমুদ্র বন্দর ছাড়াই মধ্য দক্ষিণ আমেরিকার একটি দেশ। দেশটার পূব এবং উত্তর দিকে ব্রাজিল, দক্ষিণে প্যরাগুয়ে এবং আর্জেন্টিনা, পশ্চিম দিকে চিলি এবং পেরু। ১৬ শতাব্দীতে স্প্যানিশরা দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশের মত এ দেশটিতেও নিজদের প্রভুত্ব কায়েম করে। ১৬ বছর এক নাগাড়ে যুদ্ধের পর ১৮০৯ সালে নিজদের স্বাধীন বলে ঘোষণা দেয় বলিভিয়ানরা। কবর রচিত হয় উপনিবেশবাদের। সাইমন বলিভারের নামে দেশটার নাম রাখা হয় বলিভিয়া। উপনিবেশবাদের বিদায় হলেও তাদের স্প্যানিশ ভাষাকে বিদায় জানাতে পারেনি এ দেশের মানুষ। যদিও শত বাধা বিপত্তি নিয়ে এখনো টিকে আছে এদের আঞ্চলিক ভাষা আয়মারা এবং কোয়েচুয়া। জনসংখ্যা মাত্র ৯০ লাখ।

কালো পোশাক এবং হাতে কালাশনিকভ রাইফেল নিয়ে অল্প ক’জন পুলিশ পাহারা দিচ্ছে সীমান্ত এলাকা। নিজদের মধ্যেই গল্পে নিয়ে ব্যস্ত ওরা, সীমান্ত পেরিয়ে কে এলো আর কে গেল তার দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। আমাদের দেশে টোল আদায়ের ঘরগুলোর মত ছোট্ট একটা বুথে ঢুকতে হল বলিভিয়ার ভিসা নিতে। ইমিগ্রেশনের সাথে একটা শব্দও বিনিময় হলোনা। ৩ মাসের ভিসা দিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হল দেশটায়। দাঁত বের করা হাসিতে গ্রাসিয়াস জানিয়ে পা রাখলাম আরও একটা নতুন দেশে, বলিভিয়া। কয়েক শ ফুট দূরেই দক্ষিণ আমেরিকার অন্য একটা দেশ পেরু, অথচ পার্থক্য চোখে পরার মত। চারদিকে অনিয়ম আর দৈণ্যতার রাজত্ব এখানে। ঠেলা রিক্সা, ভ্যান গাড়ি আর স্কুটারগুলো রাস্তা আটকে অপেক্ষা করছে যাত্রীর। একে অপরকে গালাগালি দিচ্ছে চড়া গলায়। আমাদের আরিচা ঘাটের মত ট্রাক আর বাসের কাফেলা দাড়িয়ে আছে সাড়িবদ্বভাবে। কিন্তু ড্রাইভারদের আশপাশ কোথাও দেখা গেলনা। আবারও অজানা আশংকায় মনটা কেপে উঠল। পুনো হতে ছেড়ে আসা বাস যাত্রীদের একটা জায়গায় জমা হতে দেখে ওদিকেই পা বাড়ালাম। সহযাত্রী ভিক্টোরিয়া আমাকে দেখে বত্রিশ দাঁত বের করে হাসল। তার পরনের কাপড় আরও বিপদজনক ভাবে কমে গেছে ইতিমধ্যে। অবাক হওয়ার মত কাণ্ড, এ সবের সময় পেল কখন মেয়েটা! অপেক্ষার যেন শেষ নেই। বাস আসার কোন লক্ষন দেখা গেলনা। চিন্তার রেখা ফুটে উঠল লা-পাসগামী যাত্রীদের কপালে। ঘন্টাখানেক পর ট্যুর কোম্পানির একজন এসে জানাল রাস্তায় প্রচণ্ড হাংগামা চলছে, এক সপ্তাহ হল এ লাইনে বাস চলাচল বন্ধ। বাধা পেরিয়ে দু’একটা বাস নাকি  চেষ্টা করেছিল লা-পাস পৌছার, কিন্তু হরতালকারীদের তাড়া খেয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে। সরকার এবং দেশের ট্রেড ইউনিয়নগুলোর মধ্যে বেশ কিছু ইস্যু নিয়ে টানাপোড়ন চলছে, তাই অনির্দিষ্ট কালের এই হরতাল। । পিন পতনের নীরবতা নেমে এলো যাত্রীদের মাঝে। আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল একটাই চিন্তা, আজ শনিবার এবং আমাকে সোমবার মধ্যরাতে লিমা হতে নিউ ইয়র্কের ফিরতি ফ্লাইট ধরতে হবে। ভিক্টোরিয়ার অট্ট হাসিতে চিন্তায় ছেদ পরল।

‘এতটা হতাশ হওয়ার কোন কারণ নেই, উপায় একটা নিশ্চয় বেরিয়ে আসবে’, ফুড় ফুড়ে মেজাজে বলল সে।

খুব কাছে এসে ফিস ফিস করে বলল, অতিরিক্ত কিছু পয়সা ঢালতে হবে আমাদের, তবেই নাকি হারামির বাচ্চারা নড়তে শুরু করবে।

মেয়েটার এমন আজব তথ্যে অবাক হলাম আমি, এ যে দেখছি বাংলাদেশের কার্বন কপি! ১০ ডলার করে চাঁদা উঠানো হল যাত্রীদের কাছ থেকে। সবাই বিদেশী, এ নিয়ে কেউ বেশী উচ্চবাচ্য করল না। মনে মনে ট্যুর কোম্পানির ১৪ গুষ্টি উদ্ধারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল যাত্রীদের ক্ষোভ। যাত্রী ড্রাইভারের মধ্যে গোপন শলা-পরামর্শ এবং লেনা-দেনা শেষ হওয়ার ১৫ মিনিটের মধ্যে ছোট আকারের দু’টা বাসকে দেখা গেল দিগন্ত রেখায়। একই কোম্পানির বাস। একেবারে যমজ ভাইয়ের মত। কিছু খাবার আর পানের জন্য দু বোতল পানি কিনে উঠে পরলাম একটা বাসে। ভিক্টোরিয়া আগেই উঠে গেছে এবং জানালার পাশের একটা সীট দখল নিয়ে অপেক্ষা করছে আমার। ধন্যবাদ জানিয়ে বসে পরলাম।

‘তোমাকে জানাইনি আতংকিত হবে বলে, রাস্তার অবস্থা কিন্তু আসলেই খারাপ, সব কিছুর জন্যে তৈরি থেক।’, বাসটা ছাড়তেই দুঃসংবাদটা দিল ভিক্টোরিয়া।

উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তার অবসান ঘটিয়ে ১৮ জন যাত্রী নিয়ে বাসটা নড়তে শুরু করল শেষ পর্যন্ত। স্বস্তির পাশাপাশি এক ধরনের নীরবতা গ্রাস করে নিলো বাসের পরিবেশ। কারও মুখে কোন কথা নেই। সবাই ক্লান্ত এবং সামনে কি অপেক্ষা করছে এ নিয়ে চিন্তিত। প্রায় ৫ ঘণ্টার জার্নি। কথা-ছিল সকাল ৮টায় পুনো হতে রওয়ানা হয়ে দুপুরের খাবার খাব লা-পাস’এ। হাত ঘড়িটার দিকে তাকালাম, সকাল ১১টা। সবকিছু ঠিক ঠাক চললে বিকাল ৪টার ভেতর লা-পাস পৌছার কথা। মনে মনে হিসাব কষলাম, একটু দেরী হলেও গন্তব্যে পৌঁছেই লাঞ্চ করব। সাথে ক’টা আপেল, কলা এবং দু’বোতল পানি আছে, চলে যাবে আপাতত। বাসে হিটার চালু আছে, পরনের গরম কাপড় খুলে হল্কা হয়ে বসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দৃষ্টি হতে মিলিয়ে গেল সীমান্ত শহরটা। যানবাহন আর মানুষের এলোমেলো চলাফেরা বদলে দিল আন্দিজের সুশৃঙ্খল চূড়াগুলো। পাহাড় আর পাহাড়! কোল ঘেঁষে বয়ে যাচ্ছে খরস্রোতা নদী। মাঝে মধ্যে ভূতের মত উদয় হচ্ছে দু’একজন আন্ডিয়ান তরুণ-তরুণী, হাতে চাষাবাদের যন্ত্রপাতি। কৃষিকাজ হচ্ছে হয়ত কোথাও। কিন্তু যতদূর চোখ যায় লোকালয়ের কোন চিহ্ন দেখা গেলনা।

আকাশটাকে আজ একটু বেশী রকম নীল মন হল। ভার্টিকেল এঙ্গেলে চোখ ঘুরালে শূন্যে উড়ে যাওয়া চিলগুলোকে মনে হবে স্থির হয়ে উড়ছে। দু’একটা চিল মাঝে মধ্যে গোত্তা মেরে নীচে নামছে শিকারের ধান্ধায়। রাস্তার সমান্তরালে বয়ে যাওয়া নদীটার দু’পাশে হঠাৎ করে আবাদি জমির উদয় হল। আলু, পেয়াজ আর ভুট্টার খণ্ড খণ্ড জমি। গাছের খোল ব্যবহার করে নদী হতে পানি উঠানোর ব্যবস্থা মনে করিয়ে দেয় জীবন এখানে বয়ে যাওয়া নদীর মত অত সহজ নয়। প্রতি খণ্ড চাষাবাদের পেছনে নিশ্চয় লুকিয়ে আছে পাহাড়ি মানুষের খেটে খাওয়া জীবনের দীর্ঘশ্বাস। নেশা ধরে আসে প্রকৃতির এই অন্তহীন ক্যানভাস একাধারে গিলতে গেলে। বাসের একটানা যান্ত্রিক শব্দে তন্দ্রা-মত এসে গেল। সকালে ঘটে যাওয়া উটকো ঝামেলাগুলো এই ফাকে মাথা হতে নেমে গেল। পাশে বসা বিপদজনক সুন্দরীকেও আন্দিজের বিশালতার কাছে খুব ছোট মনে হল। গাঁটের পয়সা খরচ করে এতদূর এসেছি আন্দিজের সানিন্ধ্য পেতে, স্থানীয় মানুষ এবং তাদের জীবনের সাথে পরিচিত হতে। সে দিকে মনোনিবেশ করে ভুলে গেলাম উটকো এক সুন্দরীর উপস্থিতি।

আন্দিজ! শব্দটার ভেতর লুকিয়ে আছে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা, অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার স্বপ্নিল হাতছানি। পাহাড় পর্বত ঘুরে বেড়ানো যাদের নেশা তাদের ধমনীতে এই নামটা এক ধরনের কম্পন তৈরি করে। যার উৎপত্তি প্রকৃতির প্রতি অকৃপণ ভালবাসা হতে। এন্ডিসের উপর একাধিক বই পড়েছি, ডকুমেন্টারি দেখেছি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করেছি এর কাব্যিক কল্পনায়। কিন্তু চোখে দেখার কাছে এগুলো এ মুহূর্তে অর্থহীন মনে হল। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে যাওয়া রাস্তাটার বর্ণনাও মনে হল বই, আর্টিকেল অথবা ডকুমেন্টারিতে জীবন্ত করতে পারেনি। বাইরের স্তব্ধতাকে মনে হল অতি যত্নের সাথে কেউ লালন করছে হাজার বছর ধরে। পাহাড়ের চূড়াগুলোকে মনে হবে নীরব সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে কোটি বছর উপর। কোন একটা চূড়ায় উঠে চীৎকার দিলে হয়ত শত শত প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসবে সে চীৎকার। ভাঙবে সহস্রাব্দীর ভৌতিক নীরবতা। আমাদের বাসটা উঁচু নিচু এবং আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে ছুটে চলল প্রচণ্ড গতিতে।

’তুমি কি একটা জিনিষ লক্ষ্য করেছ?’ ভিক্টোরিয়ার প্রশ্নে ছুটে গেল তন্দ্রা। নতুন কোন সমস্যার প্রসঙ্গ টানতে যাচ্ছে সে। গন্ধ পেলাম গলার সতর্ক সূরে। ’পাহাড় ছাড়া এ মুহূর্তে অন্যকিছু লক্ষ্য করছিনা আমি’, অনেকটা তিরিক্ষে মেজাজে উত্তর দিলাম। উত্তরে সে যা বলল তা সত্যি ভাবিয়ে তুলল। দু’লেনের রাস্তা, অথচ যানবাহন চলছে শুধু এক লেনে। অর্থাৎ বিপরীত দিক হতে কোন গাড়ি আসছে না। ভিক্টোরিয়ার ইংগিতটা বুঝতে অসুবিধা হলোনা। বাংলাদেশের মানুষ আমি, কিছুদিন আগে হাসিনার লাগাতার পর্ব ’উপভোগ’ করে এসেছি মাত্র। পূর্বাভিজ্ঞতা হতে বলতে পারি, সামনে সমস্যা। আকাশের পাখীগুলোকেও দেখলাম শুধু একদিকে উড়ে যাচ্ছে। ভিক্টোরিয়ার অভিজ্ঞতা বলছে, খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে। অন্য যাত্রীদেরও দেখলাম নড়েচড়ে বসতে, কৌতূহলী হয়ে উঠছে সবাই। দূর হয়ে যাওয়া উৎকণ্ঠা গুলো বিদ্যুৎ গতিতে ফিরে এলো নতুন করে।

ছোট দু’একটা পাথর দিয়ে শুরু। কিছুদূর যেতেই বাড়তে থাকল পাথরের সংখ্যা এবং এর আকৃতি। নিবিড়ভাবে বিছানো আছে সমস্ত পথজুড়ে। যেন বিশাল আয়তনের শিলাবৃষ্টি হয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। কিন্তু তাতে বাসের চাকা বিশেষ কোন বাধা পেলোনা। এগুতে থাকলাম আমরা। বিশাল একটা বাক পেরুতেই দৃশ্যটা ভেসে উঠল দিগন্ত রেখায়… শত শত গাড়ি। যতদূর চোখ যায় শুধু গাড়ি আর গাড়ি। থেমে আছে লাইন ধরে। মাইলের পর মাইল। ছোটখাটো পাথর নয়, বিশাল আকারের বোল্‌ডার দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে পথ। এক কদম এগোবার কোন উপায় নেই। আমাদের যমজ বাসটা  ঠিক পেছনে এসে হুমড়ি খেয়ে থেমে গেল। সোজা কথায় আটকে গেছি আমরা। আন্দিজের এই গহীন রাজ্যে জিম্মি হয়ে গেছি গরীব দেশের গরীবিপনার কাছে। আকাশ ভেঙ্গে পড়ল সবার মাথায়। আবারও আমার মাথা জুড়ে পুরানো চিন্তাটা ঘুরপাক খেতে শুরু করল, আজ শনিবার এবং সোমবার মধ্যরাতে লীমা হতে নিউ ইয়র্কের ফিরতি ফ্লাইট ধরতে হবে। ভিক্টোরিয়াকে দেখে মনে হল বেশ উপভোগ করছে সে নতুন বাস্তবতা। ‘আমি জানতাম এমনটা হবে, এ জন্যেই এদিকে আসা’, উৎফুল্ল হয়ে জানাল সে। কথা বলে জানা গেল ওকালতির পাশাপাশি দক্ষিণ আমেরিকার রাজনীতি নিয়ে বই লিখছে সে। এ অঞ্চলে ভেনিজুয়েলান নেতা হুগো সাভেজের প্রভাব তার আগ্রহ। বলিভিয়ায় এবো মরালেস নামের নতুন এক নেতার উত্থান হয়েছে, যে আদর্শ হিসাবে বেছে নিয়েছে হুগো সাভেজের কথিত সমাজতান্ত্রিক পথ। তার উত্থানকে কাছ হতে দেখার জন্যেই এই জার্নি। উদ্ভট পোশাক দেখে মেয়েটা সম্পর্কে আজেবাজে ধারণা করায় নিজকে অপরাধী মনে হল এ মুহূর্তে। ’চল সামনে গিয়ে দেখে আসি’, আহ্বান জানাল মেয়েটা। বাসের ট্যুর গাইড ইতিমধ্যে সাবধান করে দিয়েছে এ ধরনের এডভেঞ্চার হতে দূরে থাকতে।

’চল, ঘুরে আসি’, সায় দিয়ে নেমে পরলাম। সাথে যোগ দিল আরও গোটা তিনেক সহযাত্রী। চারদিক চোখ বুলাতেই কেন জানি ঢাকার কথা মনে হয়ে গেল। রাজনীতির গ্যারাকলে আটকে একদিন ৫ ঘণ্টা দাড়িয়ে থাকতে হয়েছিল কাঁচপুর ব্রিজের উপর। সামনে শেখ হাসিনার সমর্থনে মিছিল, কিছুক্ষণ পর শুরু হল ধাওয়া আর পালটা ধাওয়া, সাথে নির্বিচার ভাংচুর। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো অজান্তেই। আন্দিজের শো শো বাতাস আর চোখে মুখে শীতের কনকনে ঝাঁপটা ফিরিয়ে আনল কঠিন বাস্তবতায়। হঠাৎ করে কেন জানি গান গাইতে ইচ্ছা করল আমার, প্রিয় সেই গানটা; ’নাই টেলিফোন নাইরে পিওন নাইরে টেলিগ্রাম…। ভিক্টোরিয়া ফিস ফিস করে বলল, ‘মন খারাপ করে লাভ নেই, বরং উপভোগ কর যা দেখছ, এমন অভিজ্ঞতার সুযোগ জীবনে দ্বিতীয়টা নাও আসতে পারে‘।

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৪
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৫

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৪

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ১
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ২
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৩

মাইল খানেক হাটার পর জটলাটা চোখে পরল। ড্রাইভার এবং ট্যুর গাইডদের সাথে পাহাড়ি এলাকার মাম্বো জাম্বো টাইপের ক’জন কি নিয়ে যেন দরকষাকষি করছে। দু’পক্ষকেই বেশ উত্তেজিত মনে হল। বন্দী দশা সইতে না পেরে অনেক যাত্রীও নেমে এসেছে খোলা বাতাসে। অধৈর্য এবং উৎকণ্ঠার ছাপ সবার চোখে মুখে। ৭ দিন ধরেই চলছে অবরোধ নামের ক্যাট & মাউস গেইম। আজ শনিবার, অনেকেই ভেবেছিল অন্তত ছুটির দিনটায় রেহাই পাওয়া যাবে ধর্মঘটীদের টাগ অব ওয়্যার হতে। দেশের ট্রেড ইউনিয়নগুলো চাইছে বলিভিয়ান সরকার গ্যাস কোম্পানিগুলো জাতীয়করণ করুক। তাদের অভিযোগ, বিদেশীরা যুগ যুগ ধরে এ দেশের গ্যাস সম্পদ দুর্নীতিবাজ সরকারগুলোর সহযোগিতায় বিদেশে পাচার করে নিজদের পকেট ভারী করছে। পয়েন্ট অব নো রিটার্নে চলে গেছে আদিবাসীদের বেচে থাকা। মূলত তাদের স্বার্থেই এ ধর্মঘট। চারদিক তাকালে মনে হবে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কোন এক আশ্চর্য্যতম গলিতে বন্দী হয়ে গেছি আমারা। একদিকে আন্দিজের বিশালতা, পাশাপাশি মাইলের পর মাইল খোলা মাঠ, সমান্তরালে বয়ে যাচ্ছে খরস্রোতা নদী। এখানে আধূনিক প্রযুক্তি নির্বাসিত, নেই মুঠো ফোনের রাজত্ব। বহুদূরে ক’টা জংলী মহিষ এবং আলপাকাদের অলস চলাফেরা মনে করিয়ে দেয় সৌরজগতের অন্যকোন গ্রহ নক্ষত্র নয়, এ আমাদেরই প্রিয় পৃথিবীর কোথাও না কোথাও।

আন্দিজের যে বাকটাতে আমরা আটকে আছি তার শেষ প্রান্তটা বেশ অদ্ভুত দেখাল দূর হতে। রাস্তার দু’পাশের পাহাড়গুলো হঠাৎ করে যেন এক বিন্দুতে মিলে গেছে। গুহার মত দেখায় নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া পাকা রাস্তা হতে দেখলে। মোক্ষম জায়গা ট্রাফিক আটকানোর! হঠাৎ করে সামনের জটলায় সবাইকে কেমন উত্তেজিত মনে হল। মিনিট পাঁচেক না যেতেই এক দল অন্য দলকে ধাওয়া শুরু করে দিল। চারদিকে বন্য চীৎকারে খানখান হয়ে গেল আন্দিজের নির্জনতা। আঙ্গুল উঁচিয়ে পাহাড়ের দিক কি যেন দেখাতে চাইছে অনেকে। ও দিকে চোখ ফেরাতেই হিম হয়ে গেল সমস্ত শরীর। কিং কং কায়দায় হাতে পাথরের বড় বড় টুকরা এবং তীর ধনুক নিয়ে আদিবাসীরা ঘেরাও করে ফেলেছে আমাদের। ভেতরের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় একসাথে বলে উঠল পালাতে হবে আমাকে। শুধু আমি নই যতদূর চোখ যায় সবাই দেখলাম দৌড়াচ্ছে। পালাচ্ছে যুদ্ধের মাঠে পরাজিত সৈনিকদের মত। পেছনে ধেয়ে আসছে সাক্ষাৎ আজরাইল। কেউ একজন খোলা আকাশের নীচে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছিল, পরনের কাপড় ফেলে দৌড়াতে শুরু করল সে। লিউ টলষ্টয়ের কালজয়ী উপন্যাস ’ওয়্যার এন্ড পিস’ অবলম্বনে তৈরি ছায়াছবির পুনরাবৃত্তি হচ্ছে যেন এখানে। পরনের ভারী জ্যাকেট নিয়ে দৌড়াতে বেশ অসুবিধা দেখা দিল। ভাবলাম ছুড়ে ফেলি। কিন্তু তখনই দেখলাম ভয়াবহ দৃশ্যটা! পাহাড়ের উঁচু হতে ধেয়ে আসছে অসংখ্য পাথর। সাথে ধনুক হতে ছোড়া শত শত তীর। জ্যাকেট ফেলে দেয়ার চিন্তাটা বাদ দিলাম নিরাপত্তার কথা ভেবে। পাগলের মত বেশ কিছুটা পথ দৌড়ানোর পর বুঝতে পারলাম তীর ধনুকের বলয় হতে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। ওগুলো টার্গেট মিস করে লুটিয়ে পরছে পাথরের উপর। সাথে সৃষ্টি করছে এক ধরনের বন্য আওয়াজ। দৌড় থামানো গেলনা কারণ সামনে পেছনে সবাই এ কাজটা করছে জীবন বাজি রেখে। হঠাৎ মনে হল দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। থামতে বাধ্য হলাম। নাক হতে রক্তের ফোয়ারা বইতে শুরু করেছে ততক্ষণে। সমুদ্র পৃষ্ট হতে অনেক উঁচুতে আমরা, এমন একটা উচ্চতায় কেনীয়ান দৌড়বিদরাও দু’বার চিন্তা করবে ম্যারাথন দৌড়ে শামিল হতে। প্রায় জ্ঞান হারানোর মত অবস্থা। এক পা এগুনোর শক্তি অবিশিষ্ট নেই শরীরে। শুয়ে পরলাম বাধ্য হয়ে। জ্যাকেটটা টেনেটুনে মরার মত পরে রইলাম কিছুক্ষণ। দূরের চিলগুলোকে মনে হল আমার দিকেই তাকাচ্ছে যেন। চিল নয়, বড় বড় শকুন কোত্থেকে এসে হাজির। অনবরত চক্কর দিচ্ছে মাথার উপর। অনেক গল্প উপন্যাসে পড়েছি ক্ষুধার্ত শকুনের দল রক্তের গন্ধ পেলেই ছুটে আসে। খুবলে খায় খুঁজে পাওয়া শিকার। পাখীর শিকার হয়ে আন্দিজের এ অঞ্চলে কংকাল হওয়ার ইচ্ছা হলোনা, তাই জোর করে দাড়াতে হল। আমার মত বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত এবং প্রায় অর্ধমৃত অনেককেই দেখলাম টেনেটুনে হাঁটছে। সবাই কম বেশী আহত। অনেকের নাক দিয়েই রক্ত ঝরছে। বেশ কিছুটা হেটে প্রথম বাঁকটা পার হতেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। যতদূর চোখ যায় শুধু মাঠ আর মাঠ। কোন এক দৈব মন্ত্রবলে হাওয়া হয়ে গেছে  অপেক্ষমাণ বাসগুলো।

শুরু হল আসল চিন্তা। সাথে মানিব্যাগ ছাড়া অন্যকিছু নেই। পাসপোর্টটাও রেখে এসেছি বাসে। চিন্তার সব দুয়ার একসাথে বন্ধ হয়ে গেল যেন। কোথা হতে শুরু করব বুঝতে পারছিলামনা। মানিব্যাগ থাকলেও নগদ বলতে শ’খানেক ডলার, সাথে দু’টা ক্রেডিট কার্ড আর বলিভিয়ার কিছু বলিভিয়ানো। কিন্তু এসব কাজে লাগিয়ে কি করে লোকালয় পর্যন্ত পৌঁছবো তার কোন কাঠামো দাড় করাতে পারলাম না। এক কথায় আমি হারিয়ে গেছি আন্দিজ পর্বতমালার বাকে। মরে কংকাল হয়ে গেলেও কেউ আমার খোজ পাবেনা। মাথায় কোন কিছুই ঢুকতে চাইছে না। বসে পরলাম ধপাস করে। নাকের রক্তটা থামানো যাচ্ছেনা কিছুতেই। ভিক্টোরিয়ার কথা মনে হল হঠাৎ করে। সে সাথে থাকলে একটা কিছু বেরিয়ে আসত। কিন্তু মাইল-খানেকের ভেতর মেয়ে মানুষের কোন ছায়া দেখা গেলনা। কেন জানি মনে হল সে নিশ্চয় মিশে গেছে আদিবাসীদের সাথে। হয়ত তার মিশনটাই ছিল এখানে আসার এবং এই আউলা চক্কর কাছ হতে দেখার। মিনিট দশেক বিশ্রাম নিয়ে আবারও হাটতে শুরু করলাম। সামনে আরও একটা বাঁক। দেখতে হবে কি আছে ঐ বাঁকটার পর। গায়ের জোড় আর শরীরের জোর একসাথে করে কচ্ছপ গতিতে এগিয়ে চললাম।

বাঁকটা পার হতেই চোখে পরল দৃশ্যটা। মাইল দু’এক দূরে সাদা সাদা বিন্দুর মত দেখাচ্ছে অপেক্ষমাণ বাসগুলোকে। হঠাৎ মনে হল স্বপ্ন দেখছি! যেন অমল ধবল মেঘরাজ্যে উড়ছি আমি। সাথে বসন্তের পাগলা হাওয়া। জ্যাকেটটা খুলে মাথার উপর ঘুরাতে শুরু করলাম। দূর হতে কেউনা কেউ দেখে থাকবে নিশ্চয়ই। দু’মাইলের পথ, ইচ্ছে হল দু’মিনিটে পাড়ি দেই। আমার বিশ্রাম দরকার, সারা জীবনের বিশ্রাম। কিন্তু বাতাসের শো শো আওয়াজ আর হাড্ডি কাঁপানো কনকনে শীত বাধা হয়ে দাঁড়াল বাস ও বিশ্রামের মাঝে। মাথার উপর সূর্যটাকেও কেমন ক্লান্ত দেখাল। কিন্তু এ মুহূর্তে আমার ক্লান্ত হওয়া চলবে না… আজ শনিবার এবং সোমবার মধ্যরাতে লিমা হতে নিউ ইয়র্কের ফিরতি ফ্লাইট ধরতে হবে।

দূর হতে দু’মাইলের পথ মনে হলেও দূরত্ব বোধহয় এক মাইলের বেশী ছিলনা। ক্লান্ত, শ্রান্ত এবং বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে বাসটার কাছাকাছি আসতেই স্বাগত জানাল পটকা মাছের মত ফুলে উঠা কতগুলো মুখ। ডায়নামাইটের মত বিস্ফোরিত হল ট্যুর গাইড, সাথে গলা মেলাল ড্রাইভার এবং তার হেল্পর। দু’একজন যাত্রীও ইনিয়ে বিনিয়ে কি যেন বলতে চাইল। এতকিছু শোনার মত শরীর ছিলনা।  বসে পরলাম ধপাস করে এবং ভুলে যেতে চাইলাম গত কয়েক ঘণ্টায় ঘটে যাওয়া অলৌকিক ঘটনাগুলো। পাসপোর্টের কথা মনে হতেই হুস ফেরলো। লাগেজ খুলে জায়গা-মত হাত দিতেই অনুভব করলাম মূল্যবান ডকুমেন্টটার উপস্থিতি। সব আগের মতই আছে শুধু জীবন হতে খসে  ৩টা ঘণ্টার মত সময়। হেল্পার পানি এগিয়ে দিল নাক-মুখের রক্ত পরিষ্কার করার জন্যে। অনিচ্ছা স্বত্বেও নামতে হল বাস হতে।

পরিষ্কার হয়ে বাসে ফিরতেই হাজারো প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল সহযাত্রীরা। মূল প্রশ্ন, মেয়েটা কোথায়? ট্যুর গাইড সবার হয়ে অফিসিয়ালি করল প্রশ্নটা। আমি সাফ জানিয়ে দিলাম ভিক্টোরিয়া ছিল আমার সহযাত্রী মাত্র। বাসে পরিচয় এবং তার সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। আমার বক্তব্যের পক্ষে সমর্থন পাওয়া গেল দু’এক জন যাত্রীর। বাস ড্রাইভার জানাল আর মিনিট দশেক অপেক্ষা করবে, মেয়েটা না ফিরলে সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া তাদের গত্যন্তর নেই। ব্যাপারটা ভাবতেই আমি শিউরে উঠলাম, কি হত বাসটা যদি এই জনশূন্য এলাকায় আমাকে ফেলে চলে যেত! এবার আমার প্রশ্ন করার পালা, ভেতরের সব রাগ দলা করে ছুড়ে দিলাম ট্যুর গাইডের মুখে, কঠিন গলায় জানতে চাইলাম, আমাদের ফেলে বাসটা কেন পালিয়েছিল? এই প্রথম জানলাম একটা বাসের মূল্য আমার জীবনের চেয়ে অনেক বেশী। এমন একটা তথ্য দিতে ট্যুর গাইডের গলাটা সামান্য একটু কাঁপলোনা। হজম করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলনা। এ ধরনের কথাবার্তা তৃতীয় বিশ্বের অনৈতিক এবং মানসিকভাবে পঙ্গু মানুষগুলোর পক্ষেই বলা সম্ভব, এমনটা ভেবে নিজকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলাম।

আরও আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করল বাসটা। কিন্তু ভিক্টোরিয়ার  হদিস পাওয়া গেলনা। আমাদের যমজ বাসটা ইতিমধ্যে রওয়ানা হয়ে গেছে। ট্যুর গাইড জানাল মূল রাস্তা হতে বের হয়ে মাইল খানেক গেলে নতুন একটা ট্রেইল পাওয়া যাবে। এবং সে পথটা ধরতে পারলে আরও স্বল্প সময়ে আমরা লা-পাস পৌঁছতে পারব । আমার কাছে এসব কথা রূপকথার মত মনে হল। এখান হতে জাহান্নামের দিকে রওয়ানা দিলেও আমার কিছু আসে যায়না, লা-পাস পৌঁছার আগে বাস হতে আমি নামছি না। অপেক্ষা শেষে বাসটা রওয়ানা দিল উলটো পথে। যতক্ষণ সম্ভব জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলাম ফেলে আসা পথটার দিকে। রহস্যময়ী ভিক্টোরিয়ার হাজারো রহস্যের জন্ম দিয়ে হারিয়ে গেল আন্দিজের বাঁকে।

সামনের নড়বড়ে সেতুটা দেখে অন্তরাত্মা কেপে উঠল আমার। দৈত্যের তাণ্ডবে বয়ে যাওয়া খরস্রোতা নদীটা পার হতে গেলে সেতুটা অতিক্রম ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই। ড্রাইভারের তাগাদায় নামতে হল প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে। দূর হতে যতটা দুর্বল মনে হয়েছিল, বাস্তবে ততটা দুর্বল মনে হলোনা। কোন দৈব ঘটনা ছাড়াই পারাপার পর্ব শেষ হল। টেনেটুনে শরীরটাকে কোন রকমে বাসে ঠেলে বসে পরলাম আগের সীটটায়। শুরু হল আমাদের যাত্রা।

চোখ বুজে মৃতের মত পরে রইলাম অনেকক্ষণ। রাজ্যের ঘুম এসে ভর করল শরীরের উপর। পেটের ক্ষুধাও জানান দিচ্ছে নিজের অস্তিত্ব। ভয়, বিস্ময় আর অনিশ্চয়তা গ্রাস করে নিলো ষষ্ঠইন্দ্রীয়। চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে অনেক আগেই। এবার শরীরের পালা। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি টের পাইনি। চোখ খুলে জানালার বাইরে তাকাতে যে দৃশ্য চোখে পরল তা দেখে দূর হয়ে গেল সব ক্লান্তি। শুধু মাঠ আর মাঠ। সবুজের বুক-চিড়ে চলে গেছে সূক্ষ্ম একটা ট্রেইল। একদিকে বরফ আচ্ছাদিত আন্দিজের চূড়া।  নৈসর্গিক প্যানোরমার অন্যপাশেই অঘটনে ভরা পাকা হাইওয়ে। খোলা মাঠে এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছে ভেড়া এবং আলপাকার দল। মাঝে মধ্যে দু’একজন রাখাল অবাক হয়ে লক্ষ্য করছে আন্দিজের দুর্গম অঞ্চলে আমাদের অনিশ্চিত যাত্রা। নদীটাকে দেখা গেলনা কাছাকাছি কোথাও। খণ্ড খণ্ড জমিতে ভুট্টার চাষাবাদ দেখে আন্দাজ করা যায় খুব কাছ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে হয়ত। বন্য পশুর লাশ নিয়ে টানাটানি করছে শকুন, চিল আর কয়োটির দল। এমন দৃশ্য চোখে পরছে কিছুক্ষণ পর পর। দিগন্ত জুড়ে রাজত্ব করা সূর্যটাকে আগ্নেয়গিরি হতে বেরিয়ে আসা লাভার মত দেখালো। বাইরে কি আসলেই এত গরম? জানালাটা সামান্য খুলতেই আন্দিজের শো শো হাওয়া আর তীব্র শীত এসে ভরিয়ে দিল বাসের ভেতরটা। সামনের সীটে বসা অস্ট্রেলিয়ান স্বামী-স্ত্রী বিনীত অনুরোধ করল জানালাটা বন্ধ করতে। ভিক্টোরিয়ার কথা মনে হতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে থাকলে বিরামহীন ধারাবর্ণনায় মাতিয়ে রাখত বাসের নীরবতা। বিন্দু হতে বৃত্তের মত দিগন্তরেখায় ফুটে উঠলো সাদা ধবধবে বাসটার চেহারা। আমাদের যমজ বাস। ট্রেইলটাকে আড়াআড়িভাবে আটকে রেখে ঠায় দাড়িয়ে আছে মাঝ পথে। অভিজ্ঞ মন বলছে সামনে বিপদ!

আসলেই বিপদ… সামনের চাকা ফুটো হয়ে বাসটা প্রায় ছিটকে পরেছে ট্রেইল হতে। কাছাকাছি এসে নিথর হয়ে গেল আমাদেরটাও। যাত্রীরা নেমে গেল বিনা বাক্য ব্যয়ে। আমি বসে রইলাম অনাগত আশংকা নিয়ে। কিছুক্ষণ পর ট্যুর গাইড এসে জানালো চাইলে নীচে নামতে পারি। দুঃসংবাদ যে আসবে তা আমার আগেই জানা ছিল। চাকা বদলানো ঝগটা ভেঙ্গে গেছে ইতিমধ্যে! নেমে পরলাম ঘোর নেশাগ্রস্থের মত। নিজকেই দায়ী করলাম এমন গোলক ধাঁধায় আটকে যাওয়ার জন্যে। তবে ভাল সংবাদ বলতে যা বুঝায় তার একটা হল, রাস্তার ঠিক পাশেই ছোট একটা লোকালয় দেখা যাচ্ছে এবং হাত পাওয়ালা দু’একজন আদমকে দেখা যাচ্ছে ঘুরা ফেরা করতে। ইতিমধ্যে স্থানীয় একজন বাইসাইকেল নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেছে কোন এক রহস্যপুরী হতে নতুন একটা ঝগ আনবে বলে।

সময় বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সেই রাজপুত্রের আর দেখা নেই। ততক্ষণে ক্ষুধা বাবাজি পেটে ঢোল বাজাতে শুরু করে দিয়েছে। শক্ত কোন খাবার পেটে যায়নি অনেকক্ষণ। আমার হাতে মাত্র দু’টা আপেল। পানির শেষ খালি বোতলটা এখনো ডাস্টবিনে ফেলা হয়নি। চমৎকার একটা দৃশ্য দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল। দু’টা বাসের সব যাত্রীদের ষ্টকের খাবার এক জায়গায় করা হচ্ছে। দু’টা আপেল দিয়ে আমিও যোগ দিলাম অসময়ে গড়ে উঠা আন্তর্জাতিক সংহতিতে। আমি ছাড়া বাকি সবাইকে মনে হল আপদ-কালীন সময়ের প্রস্তুতি হয়েই যেন ভ্রমণে বের হয়েছে। সবাই পেট পূরে খেয়ে বেরিয়ে পরল পাশের লোকালয় দেখবে বলে। পরনের জ্যাকেটটা বিছিয়ে মাটিতে শুয়ে পরলাম একটু ঘুমবো বলে। ১৩ই অক্টোবর, ১৯৭২ সালে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটা মনে করার চেষ্টা করলাম। ৪৫ জন যাত্রী নিয়ে চিলি-গামী উরুগুয়ের একটা বিমান বিধ্বস্ত হয়েছিল আন্দিজের চূড়ায়। ১২ জন সাথে সাথে মারা যায়। বাকিরা মাইনাস ৩০ ডিগ্রী সেঃ তাপমাত্রার সাথে পাল্লা দিয়ে শুরু করে বাচার লড়াই। খাবার হিসাবে মৃত সহযাত্রীদের মাংস ভক্ষণ করতে বাধ্য হয় অনেকেই। এভাবে একটানা ৭২ দিন লড়াই করে শেষ পর্যন্ত ১৬ জন জীবন্ত ফিরে আসে মূল ভূখণ্ডে। পৃথিবী চমকে উঠে এমন একটা লোমহর্ষক জার্নির খবর পেয়ে। আমাদের ভাগ্য কি শেষ পর্যন্ত এমনটাই হতে যাচ্ছে? আবোল তাবোল ভাবনায় মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। প্রথমত আমরা আন্দিজের চূড়ায় নই, দ্বিতীয়ত পাশেই আছে লোকালয়, মূল রাস্তাটাও বেশী দূর নয়, তাছাড়া এটা ২০০৪ সাল, – এমন কতগুলি যুক্তি দাড় করিয়ে নিজেই নিজের কাছে প্রমাণ করলাম আমাদের ভাগ্য অতটা অনিশ্চিত নয়। বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে যোগ দিলাম বাকি যাত্রীদের কাফেলায়। এই প্রথম ক্যামেরাটা বের করলাম ছবি তুলব বলে।

শীতের দাপট মানুষগুলোর শরীর ঝলসে দিয়েছে বাদামী কাবাবের মত। প্রায় সবারই অনেকগুলো দাঁত নেই। নাক দিয়ে বেরুচ্ছে হরেক রকম তরল পদার্থ। দারিদ্র্যতার সাথে রুক্ষ্ন প্রকৃতি যোগ হলে মানুষের জীবন কতটা দুর্বিষহ হতে পারে আন্দিজের এ অঞ্চলটায় না এলে বোধহয় বুঝা যাবেনা। শত বছর বয়সী এক বৃদ্ধার বেশ কটা ছবি তুললাম। সেশন শেষ না হতেই হাত বাড়িয়ে দিল কিছু পয়সার জন্যে। সাথে কিছু স্থানীয় মুদ্রা ছিল, দশ বলিভিয়ানো দিয়ে বেরিয়ে আসলাম বৃদ্ধার আঙ্গিনা হতে। পানির কুয়া পাওয়া গেল একটা জায়গায়। সবার মত আমিও ভরে নিলাম আমার খালি বোতলটা। মনে হল উত্তর মেরুর বরফ গলিয়ে কেউ জমা করেছে কুয়াটায়, নিথর হিম শীতল পানি! সময়টা মন্দ কাটলোনা এমন অনিশ্চয়তার মাঝেও। এ ফাকে সহযাত্রী অনেকের সাথে নতুন করে পরিচয় হল। এক অপরের সাথে ছবি তুলল বিরল মুহূর্তগুলো ধরে রাখবে বলে।

বাতাসের শো শো আওয়াজ আর ধোয়াটে আবহাওয়ার ফাঁক গলে হলিউডের নায়কের মত বেরিয়ে এলো স্বপ্নের সেই রাজপুত্র। হাতে বিশাল একটা ঝগ। এ যেন শত বর্ষ অপেক্ষার পর এক পশলা বৃষ্টির আগমন। খুশীর ফোয়ারা বয়ে গেল যাত্রীদের মাঝে।

বেলা পরে আসছে। রওয়ানা হওয়ার উৎকণ্ঠা সবার চোখে মুখে। সূর্যাস্তের পর আন্দিজের এ এলাকাটা মোটেও নাকি নিরাপদ নয়। বন্য হায়েনা আর অপহরণকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয় অরক্ষিত মাঠ ঘাট । বলিভিয়া পৃথিবীর অন্যতম গরীব দেশ। দুর্নীতির হিংস্র থাবায় ক্ষতবিক্ষত এর রাজনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামো। সামরিক শাসনে দেশটির রয়েছে বিশ্ব রেকর্ড। এতগুলো বিদেশী পর্যটক এমন একটা অরক্ষিত এলাকায় আটকে থাকা মানে অপহরণকারীদের মুখে খাবার তুলে দেয়ার মত। ব্যাপারটা ভাল করেই জানা ছিল ট্যুর গাইডদের। চাকা বদল এবং ঠেলেঠুলে বাসটা রাস্তায় তুলতে প্রায় ঘণ্টা খানেক পেরিয়ে গেল। ড্রাইভার জানাল বেলা অনেক গড়িয়েছে, যে পথ ধরে যাচ্ছি সে পথটা সামনে মোটেও নিরাপদ নয়। ফিরে যেতে হবে আসল পথে। রাস্তার অবরোধের তীব্রতাও নাকি কমে এসেছে ইতিমধ্যে। সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত রওয়ানা হলাম আমরা। তবে এ যাত্রায় পিছনমূখী। আমার কেন জানি মনে হল এ কাহিনীর কোন শেষ নেই… সামনে পেছনে করে অনন্তকাল ধরে চলবে আমাদের যাত্রা! নিয়তির কাছে নিজকে সপে দিয়ে বোবার মত গিলতে শুরু করলাম আন্দিজের নৈসর্গিক স্তব্ধতা।

আবারও সেই বিভীষিকা! সেই লোমহর্ষক জায়গা!!! তবে গাড়ির সংখ্যা দেখে পরিস্থিতি সকালের মত ততটা জটিল মনে হলোনা। গাইড এসে জানাল ভয়ের কিছু নেই, কিছু লেনদেন করতে হবে শুধু। তৃতীয় বিশ্বের বিপ্লবী আন্দোলন! সবকিছুর শেষ মনে হয় একটা জায়গায়, পকেট! চোখের সামনে নতুন এক বাংলাদেশকে আবিষ্কার করলাম। বিছানো পাথরগুলো রাস্তা হতে সরিয়ে নেয়া হয়েছে ইতিমধ্যে। যদিও বাঁশ জাতীয় কিছু একটা দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে গোটা হাইওয়ে। হাতে লাঠি আর মাথায় লাল পটকার ’বিপ্লবী’রা সিংহের মত গর্জন করে বেড়াচ্ছে। ইশারা পেলে ঝাঁপিয়ে পরতে মিনিট খানেক সময় নেবে বলে মনে হলোনা। ডান হাতের ব্যাপারটা খুব দ্রুতই সম্পন্ন হয়ে গেল। গাইড জানাল দেসাগুয়াদে্‌রতে যাত্রী প্রতি ১০ ডলার উঠানো হয়েছিল এমন একটা আশংকার কারণে। এ মুহূর্তে কাউকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলোনা আমার। সবাইকে মনে হল একই চক্রের সদস্য, পর্যটকদের পকেট খসানোর সংঘবদ্ধ নীল নক্সা।

দৈত্য-দানব আর রাক্ষস-খোক্কসদের তাণ্ডব হতে মুক্তি পেলাম শেষ পর্যন্ত। সামনে নতুন কোন ঝামেলা নেই, এমনটা বলে ট্যুর গাইড আস্বস্ত করল আমাদের। সারাদিনের মধ্যে এই প্রথম বুক ভরে নিশ্বাস নিলাম! চোখ বুজে কল্পনা করলাম নিউ ইয়র্কের ছোট রুমটার কথা। আরও প্রায় ২ ঘণ্টার পথ। পেছনের ঝামেলা মাথা হতে নামিয়ে যাত্রীদের অনেকেই ব্যস্ত হয়ে পরল জানালার বাইরে রূপকথার আন্দিজের নিয়ে। আমি ভেজা মুরগীর মত ঝিমুতে শুরু করলাম। রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভিড় করল শরীরে। পাশের সীটটা খালি, দু’পা উঠিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পরলাম।

পাক্কা এক ঘণ্টা পর ঘুম ভাঙল। সূর্যটা নেতিয়ে পরেছে ততক্ষণে। চারদিকে শুনশান নীরবতা। আন্দিজের চূড়াগুলো ডুবে গেছে হাল্কা কুয়াশার কোলে। সূর্যের রক্তিম আভায় কুয়াশাগুলোকে আগ্নেয়গিরির রাক্ষুসে লাভার মত দেখাল। মাঝে মধ্যে দু’একটা বাড়ি ঘরের চিহ্ন দেখা গেল পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। যতই এগুচ্ছি বাড়তে থাকল জনবসতির ঘনত্ব। সামনের সহযাত্রী জানাল ’বিপ্লবীরা’ মাঝ পথে আরও একবার বাসটা থামিয়েছি। কি একটা কাগজ দেখাতে ছেড়ে দিয়েছে বিনা বাধায়। সহযাত্রীদের জানার কথা নয়, কিন্তু এই বাংলাদেশীর ভাল করেই জানা ছিল ঐ কাগজটার অর্থ এবং মূল্য। রাশিয়ায় পড়াশুনা শেষে ব্যবহারের জিনিষপত্র এবং একগাদা বই পাঠিয়ে ছিলাম জাহাজে করে। চট্টগ্রাম বন্দরের ঐতিহাসিক কালো অধ্যায় সমাপ্তি শেষে ট্রাকে করে ফিরছি ঢাকায়। বন্দর হতে বেরুতে না বেরুতে পুলিশ বাহিনী আটকে দিল আমাদের যাত্রা। ড্রাইভার জানাল টাকা দিতে হবে। গাই গুই করে কাজ হলোনা, পরিশোধ করতে হল পুলিশের ’পাওনা’। সব শেষ হতে একটা ক্লিয়ারেনস্‌ সার্টিফিকেট ধরিয়ে দিল ড্রাইভারের হাতে। এটাই নাকি সেই যাদু-মন্ত্র যার বলে পার হওয়া যাবে সামনের সাত সমুদ্র তের নদী। ঘটনাটা মনে হতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। উত্তর আর দক্ষিণ আমেরিকা, কাছের প্রতিবেশী দুই মহাদেশ, অথচ একেবারে উলটো তাদের জীবন যাত্রার মান!

ট্রাফিকের সংখ্যা দেখেই ধারণা করা যায়, আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি। পাহাড়ের বিপদজনক শেষ বাকটা পার হতেই চোখে পরল শহরটা, লা পাস। পাহাড়ি উপত্যকার খাদ ঘেঁষে থরে থরে সাজানো বাড়ি ঘর আর উঁচু দালান নিয়ে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে শহরটা। প্রায় ৮ লাখ লোকের বাস সমুদ্র পৃষ্ট হতে ৩৬৬০ মিটার উচ্চতার এই শহরে। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতম শহরের ভিত্তি স্থাপন করেছিল স্প্যানিশ দখলদাররা। সময়টা ছিল ১৫৪৮ সাল। এর আগে ইনকাদের কাছে এলাকার পরিচিতি ছিল চকেয়াপো হিসাবে। গ্রামটার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া চকেয়াপো নদীতেই প্রথম সোনা খুঁজে পায় উপনিবেশবাদীরা। ১৮৯৮ সালে লা পাস’কে বলিভিয়ার এডমিনিষ্ট্রেটিভ রাজধানী হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৪ সাল হতে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত মার্কিনীদের সহায়তায় একটা পর একটা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটতে থাকে দেশটায়। সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের উচ্চাভিলাষ ব্যাহত করে বলিভিয়ার গণতান্ত্রিক যাত্রা। সোনা, তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পদের মালিক হয়েও দেশটার সাধারণ মানুষ কখনোই দারিদ্র সীমা হতে বেরিয়ে আসতে পারেনি।

সূর্যটা ডুবু ডুবু করছে প্রায়। সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দেয়ার মত কণ্টকাকীর্ণ বিশাল এক পথ পাড়ি দিয়ে শহরের প্রবেশ মুখে ঢুকতেই পরিচিত দৃশ্যটা দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। খোলা আকাশের নীচে আবর্জনা ফেলার বিশাল আয়োজন। সব বয়সের শিশু, নারী এবং পুরুষের দল পিঠে ঝোলা চাপিয়ে হুমড়ি খেয়ে হাতড়াচ্ছে আবর্জনার স্তূপ। উচ্ছিষ্ট নিয়ে শকুন, কুকুর আর মানুষের কামড়া কামড়িতে বিষাক্ত হয়ে উঠছে চারদিকের পরিবেশ। দারিদ্রের এমন কুৎসিত চেহারা দেখা হয়নি অনেকদিন। এক সময় ঢাকার প্রবেশ মুখ যাত্রাবাড়ীতে দেখা যেত দারিদ্রের একই রূঢ় ছবি। পশ্চিম দুনিয়ার পর্যটকের দল হুমড়ি খেয়ে পরল ছবি তোলার জন্যে। আমি দু’চোখ বন্ধ করে ফিরে গেলাম জন্মভূমিতে। বোমা বিস্ফোরণের মত ভয়াবহ শব্দে কেপে উঠল আমাদের বাসটা। অনেকের হাত হতে ছিটকে পরল ক্যামেরা। কিছু বুঝার আগেই ড্রাইভার জানাল পেছনের চাকা পাংচার। চাকা বদলানোর কোন আয়োজন নেই বাসটায়, অথচ মূল শহর এখনো মাইল খানেকের পথ। ’এবার তোমাদের নামতে হবে এবং নিজ খরচে স্থানীয় যানবাহন ধরে পৌছতে হবে শহরের কেন্দ্রবিন্দু সানফ্রানসিসকো প্লাজায়’, ট্যুর গাইড মৃত্যু ঘোষণার মত সংবাদটা প্রকাশ করে হারিয়ে গেল জনারণ্যে।

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৫

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৫

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ১
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ২
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৩
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৪

আবারও অনিশ্চয়তা! কুফা যেন পিছু ছাড়ছে না কিছুতেই। একদিনে এত ঝামেলা সহ্য করার জন্যে চাই বায়োনিক শরীর! মাছে ভাতে বাঙ্গালীর শরীর এমন বিরামহীন হাঙ্গামার জন্যে মোটেও তৈরি নয়, এ সহজ সত্যটা আগেই বোধহয় বুঝা উচিৎ ছিল। অস্থিরতা ধীরে ধীরে হতাশায় পরিণত হল। হাতের লাগেজটা মাটিতে বিছিয়ে জিন্দা-লাশ হয়ে বসে পরলাম খোলা আকাশের নীচে। সূর্যটা বিদায় নিয়েছে অনেকক্ষণ হল। একদিকে হায়েনার মত আন্দিজের বিশাল চূড়া, বিপরীত দিকে লাখ লাখ নিয়ন বাতির রহস্যময় লা পাস নগরী। এ যেন কল্পরাজ্যের স্বপ্ন-পূরীর মত, চোখে দেখা যায় কিন্তু কাছে যাওয়ার উপায় নেই! যমজ বাসটাকে দেখা গেল বেশ কিছুক্ষণ পর। ক’জন যাত্রী উঠিয়ে ওটাও চলে গেল একই কথা বলে। মহিলাদের প্রাধান্যের কারণে আমার জায়গা হলোনা এ যাত্রায়। তীর্থের কাকের মত বসে রইলাম পরবর্তী বাসের আশায়। প্রায় ৪০ মিনিট পর থামল দ্বিতীয় বাসটা। এবার মিস হলে হয়ত সাড়াটা রাত এখানেই কাটাতে হতে পারে, তাই পরি মরি করে উঠে পরলাম। বসার জায়গা নেই, গাদাগাদি করে কোন রকমে দাড়িয়ে রইলাম লাগেজটা হাতে নিয়ে। যে সমস্যার কথা ভেবে এতক্ষণ উৎকণ্ঠিত ছিলাম এসে গেল সেই মহেন্দ্রক্ষণ! বাস কন্ডাক্টর জানতে চাইল, কোথায় যাচ্ছি আমরা? একজন আরেকজনের দিকে তাকাই, কিন্তু কারও মুখে কোন উত্তর পাওয়া গেলনা। সাহস করে আমিই বললাম, সানফ্রানসিসকো প্লাজা! ট্যুর গাইডের মুখে উচ্চারিত নামটা মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। সময় মত মনে করতে পারায় সহযাত্রীরা প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে। ভাড়া পরিশোধ করতে হল ডলারে। এক ডলার সমান কত বলিভিয়ানো আর কতই বা গন্তব্য-স্থলের ভাড়া তার কোন ধারণা না থাকায় ৫ ডলার নোটের সবটাই রেখে দিল ভাংতির অজুহাতে। এ সব নিয়ে চিন্তিত হওয়ার মত মানসিক অবস্থা ছিলনা কারও। শুধু তজ্‌বী গোনার মত বেহুশ হয়ে গুনছিলাম অন্তিম মুহূর্তের। এবং শেষ পর্যন্ত এলো সেই মুহূর্ত। বাস কন্ডাকটরদের কেউ একজন প্রায় গলাধাক্কা দিয়ে ছুড়ে ফেলল বাস হতে। লাগেজটাও ছিটকে পরল হাত হতে।

ব্যাগটা কুড়িয়ে সোজা হয়ে চারদিক চোখ ফেরাতে সহযাত্রীদের কাউকে খুঁজে পেলামনা কাছাকাছি। ওরা কেউ নামেনি। মনটা দমে গেল নতুন আশংকায়। সানফ্রানসিসকো প্লাজা! প্লাজার বিশাল ঘড়িটায় ঢং ঢং করে রাত ৯টা বাজার সময় সংকেত বেজে উঠল। ৪ ঘণ্টার পথ ১৫ ঘণ্টায় পাড়ি দিয়ে শেষ পর্যন্ত দাড়িয়ে আছি লা পাস শহরের কেন্দ্রস্থলে; ক্লান্ত, শ্রান্ত, অবসন্ন, বিষণ্ণ এবং বিধ্বস্ত! ধাতস্থ হতে ৫টা মিনিট কেটে গেল। এ ধরনের অমানুষিক অভিজ্ঞতা জীবনে এই প্রথম নয়। জার্মানির বার্লিন শহর তখনও এক হয়নি। ঐতিহাসিক বার্লিন দেয়াল পার হয়ে পশ্চিম বার্লিনের জুওলঝিশিয়া গার্টেন ষ্টেশনে হাজির হয়েছি নেদারল্যান্ডের হোক-ভ্যান-হল্যান্ড গামী ট্রেন ধরব বলে। শেষ গন্তব্য হারউইচ হয়ে লন্ডনের লিভারপুল ষ্টেশন। পূর্ব বার্লিনে অযথা ঘুরাঘুরির কারণে শেষ ট্রেনটা মিস হয়ে যায়। হোটেল ভাড়ার যথেষ্ট টাকা নেই হাতে, তাই ষ্টেশনে রাত কাটাবার সিদ্ধান্ত নেই বাধ্য হয়ে। সেপ্টেম্বরের শুরু, কনকনে শীত আর পুলিশের অত্যাচারে সাড়াটা রাত দৌড়ের উপর কাটাতে হয়। সকালের প্রথম ট্রেনটা ধরতে বেলা বেজে যায় ১১টা।

ভেঙ্গে পরলে চলবে না। এখনও অনেক পথ পাড়ি দেয়া বাকি। নিজকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলাম! প্লাজায় ঠায় দাড়িয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। কোনদিকে গেলে হোটেল মিলবে তার কোন হদিস করতে পারলাম না। হরেক রকম মানুষের ভীরে গিজগিজ করছে চারদিক। সাহস করে একজনকে জিজ্ঞাস করতে বাধ্য হলাম, ‘দন্ডে এস্তা এলো হোতেল?‘। অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী সন্দেহ নেই, কিন্তু এই অল্পতাই অনেক সময় বিশাল কাজে আসে, বিশেষ করে অজানা অচেনা ভাষার দেশে। কাজ হল এ যাত্রায়! আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখানোর চেষ্টা বুঝতে অসুবিধা হলোনা আমার। হাটতে শুরু করলাম হোটেলের সন্ধানে। কয়েক গজ যেতেই রাস্তাটা ৪৫ ডিগ্রী কোণ হয়ে উপরে উঠতে শুরু করল। জ্বিহ্‌বাকে জায়গা মত ধরে রাখায় অসুবিধা দেখা দিল। ম্যারাথন দৌড়ের গতিকে পাল্লা দিয়ে হার্ট-বীটও বাড়তে থাকল। মুখের থুথুতে এই প্রথম লবণের অস্তিত্ব অনুভব করলাম। প্রথম হোটেলটা চোখে পরল কাইয়ে পতোসির উপর, ’হোটেল প্রেসিদেন্তে’। ভাগ্য এ যাত্রায় বিমুখ করল আমায়, সীট নেই একটাও। দূরে অন্য একটা হোটেলের সাইন দেখে আশান্বিত হয়ে রওয়ানা দিলাম সে দিকে। আরও অনেক উপরে উঠতে হবে। শরীরের শেষ শক্তি ব্যয় করে হোটেল দরজায় হাজির হতেই দেখি দরজা বন্ধ! প্রচণ্ড শব্দে নক করে ইয়া নফ্‌সি ইয়া নফ্‌সি ঝপতে থাকলাম। কেউ এগিয়ে এলো মা। ঘুসি মারতে বাধ্য হলাম। রাজ্যের ক্ষুধা মগজের চিন্তা শক্তিকে গ্রাস করে নিয়েছে ইতিমধ্যে। খুট করে ছোট বুথের মত জানালা খুলে উঁকি দিল কেউ একজন। ’সিনিওরা, উস্তেদ হাবলা ইংলেজ?’। অন্য একজন মাথা বের করে জানাল ’পকি্‌ত‘, অর্থাৎ অল্প স্বল্প। সীট পাওয়া গেল ৬ তলায়, আলাদা বাথরুম। এটা আসলে একটা হোস্টেল, ভাড়া মাত্র ৭ ডলার। হঠাৎ মনে হল পৃথিবীটা আসলে অতটা খারাপ নয় যতটা আমি ভাবছি!

’হোস্তাল নাইরা’, আসলেই নাইড়্যা (ন্যাড়া), ভেতরের সবকিছুতে অযত্ন, অবহেলা আর দারিদ্রের ছাপ। এলিভেটর নেই, তাই সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে হল ৬ তলায়। চাবি ঘুরিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করতে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরল, খুলছে না দরজা! নীচে নামা এ মুহূর্তে অসম্ভব আমার পক্ষে! বসে পরলাম দরোজার সামনে। আধা ঘণ্টা পর রুম সার্ভিসের একজনকে দেখা গেল নতুন গ্রাহকের সাথে উপরে উঠতে। হাউমাউ করে বুঝাতে চাইলাম আমার অবস্থা। সুন্দর একটা হাসি দিয়ে অপেক্ষা করতে বলল। আরও প্রায় ১৫ মিনিট পর প্রায় ৮০ বছরের এক বৃদ্ধাকে দেখা গেল সিঁড়ি ভাঙ্গছে। পাগলের মত হাঁপাচ্ছে সে। শেষ পর্যন্ত অন্য একটা রুমে ঠাঁই নিতে হল। ধবধবে সাদা বিছানা, রঙ্গিন টিভি আর বড় মত আয়নাটা দেখে চোখে পানি আসার মত অবস্থা। হঠাৎ মনে হল আমার বিশ্বজয়ের এখানেই বোধহয় সমাপ্তি! এবার বিশ্রামের পালা!!

শরীরে শুটকির গন্ধ, পরনের কাপড়ে দশ ইঞ্চি ধূলা, জুতা জোড়া বলছে এইমাত্র হালচাষ শেষে ঘরে ফিরেছি, এমন একটা অবস্থায় বিছানায় গেলে সহসাই ঘুম ভাঙ্গবেনা। তাই সাদা শুভ্র বিছানাটায় ঝাঁপিয়ে পরার লোভ সামলাতে হল জোড় করে। প্রথমত গোসল করতে হবে যে কোন মূল্যে। পেট শান্ত করাও জরুরী হয়ে পরেছে। প্রায়োরিটি সেট করে প্রথমে গোসলখানায় ঢুকে পরলাম। আধা ঘণ্টা মরার মত দাড়িয়ে রইলাম ঝরনাটার নীচে। গরম পানির উষ্ণ ছোঁয়ায় দিনের ক্লান্তি অনেকটাই কেটে গেছে মনে হল। পোশাক বদলে রাতের খাবারের সন্ধানে বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সিঁড়ি ভাঙ্গা এখন আর ততটা কঠিন মনে হলোনা। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল হোটেল ফটকে! বন্ধ হয়ে গেছে রাতের জন্যে। অল্প ইংরেজি জানা মহিলার দেখা পাওয়া গেল লবিতে। সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি জানতে পেরে তার চোখে মুখে মমতা ঝড়ে পরল। আমাকে সাথে নিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া ক্যান্টিনটায় ঢুকে পরল। দশ মিনিটের ভেতর গরম সুপ, সিদ্ধ আলু এবং সাথে মুরগীর ফ্রাই নিয়ে হাজির হতেই হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পরলাম প্লেটে। খাওয়া শেষ হতে মনে হল হাত-পা কাঁপছে আমার। চক্কর দিয়ে মাথাটাও ঘুরছে। এক কাপ কফি নিয়ে মহিলা কখন পাশে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। ’খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে, উপরে যাও এবং ভাল করে ঘুমিয়ে নাও, সব ঠিক হয়ে যাবে’, মা’র মমতা নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল মহিলা। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো আমার। এবার ঘুমের পালা।

সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে গেল ওয়েক-আপ কল ছাড়াই। হাত ঘড়িটা বলছে স্থানীয় সময় সকাল ৬টা। খুব একটা বেশী সময় ঘুমিয়েছি বলে মনে হলোনা। গতকালের ঘটনাগুলো এ মুহূর্তে দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই ভাবতে ইচ্ছে করলোনা। এতদিন জেনেছি এক জায়গায় দু’বার বজ্রপাত হয়না, আজ বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল আমারও পরপর দুটো দিন খারাপ যেতে পারেনা। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম ঘটনাবহুল আরও একটা দিনের প্রস্তুতি নিতে। মনে মনে দিনটার একটা ছক একে নিলাম; প্রথমে নিশ্চিত করতে হবে সময় মত পেরুর রাজধানী লিমা ফিরে যাওয়া; দ্বিতীয়ত, শহরটা দেখতে হবে যে কোন মূল্যে।

এধরনের সস্তা হোটেলে থাকার এ একটা ভাল দিক, বিনামূল্যে ব্রেকফাস্ট! যদিও তা আহামরি কিছু নয়, কিন্তু সময় মত হাতের কাছে পাওয়াটাই অনেককিছু, বিশেষকরে ডলার পাউন্ডের দেশে। ফ্রেশ হয়ে নীচে নামতে নামতে ৭টা বেজে গেল। টোষ্টেড রুটির উপর মাখন, সাথে ডিমের অমলেট… সবশেষে এক কাপ ধূমায়িত কফি। মন্দ না ফ্রি নাস্তার জন্যে। পকেটে পাসপোর্টটা আরও একবার পরীক্ষা করে বেরিয়ে পরলাম রাস্তায়। রোববার সকাল। উত্তর আমেরিকার হিসাব মত সময়টা হওয়া চাই একেবারেই জনশূন্য। কিন্তু এখানে দেখলাম ঠিক তার উল্টো। চারদিক লোকে লোকারণ্য। হাটতে হাটতে হাজির হলাম রাতে যেখানটায় আমাকে বাস হতে ছুড়ে ফেলা হয়েছিল। ঢালু রাস্তা, হাটতে গেলে মনে হবে কেউ যেন পিছন হতে ধাক্কা মারছে। গড় গড় করে নেমে গেলাম উচ্চতা হতে। সান ফ্রান্‌সিসকো প্লাজায় দৃশ্যটা দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল। হরেক রকম পোশাক পরে একদল বৃদ্ব-বৃদ্ধা নাচছে। বলিভিয়ানরা দৈর্ঘ্যে প্রায় সবাই ছোট, কিন্তু প্রস্থে বেশ নাদুস নুদুস। বাদ্যযন্ত্র প্রায় সবার হাতে। ৩-৪ জন মিহি-সুরে গান গাইছে। এ রকম প্রায় ৩/৪ গ্রুপে আলাদা হয়ে গোটা ৫০ মানুষ উপভোগ করছে রোববারের অলস সকাল। একজনকে জিজ্ঞাস করে জানা গেল একটু পর এরা সবাই চার্চে যাবে। ঈশ্বরকে আগাম ধন্যবাদ জানাতে এই আয়োজন। বিভিন্ন এঙ্গেল হতে বেশ ক’টা ছবি তুললাম। আমার মত বেশ ক’জন টুরিস্টকেও দেখলাম প্রাণভরে উপভোগ করছে সকালের এই আয়োজন। ৮টা বাজতেই হুস হল। ফিরে যাওয়ার টিকেট কেনা হয়নি এখনো।

মাথা ঠাণ্ডা রেখে প্ল্যান শুরু করলাম কোথা হতে শুরু করা যায়। কিছুদূর না যেতেই দেখা মিলল স্থানীয় পুলিশ ষ্টেশনটার। দৈব জিনিষে বিশ্বাস ছিলনা কোন কালেই, কিন্তু এ যাত্রায় মনে হলে দিনটা ভাল যাওয়ার এ যেন ঐশ্বরিক ইংগিত। সাত পাঁচ না ভেবে ঢুকে পরলাম। ‘উস্তেদ হাবলা ইংলেজ?‘ দাঁড়াও বলে ভেতরে গিয়ে নিয়ে আসল ইংরেজি জানা এক মহিলা পুলিশকে। খুলে বললাম আমার কাহিনী। উত্তরে ভদ্রমহিলা যা বলল তাতে আশান্বিত হওয়ার কোন কারণ খুঁজে পেলামনা। আজ রোববার, খাবার দোকান ছাড়া লা পাস শহরের সবকিছু বন্ধ! গতকালের মত সবকিছুতেই আতংকিত না হয়ে জানতে চাইলাম কোথা গেলে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সাহায্য মিলতে পারে। ফাইভ স্টার হোটেল হতে পারে পারফেক্ট স্পট, এমনটাই ধারণা পাওয়া গেল পুলিশ ষ্টেশনে। তথাস্তু! সব দ্বিধা দন্ধ আছড়ে ফেলে লম্বা একটা ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে পরলাম ফাইভ স্টার হোটেলের খোঁজে। আন্দিজের মৃদু মন্দ বাতাসে হাটতে মন্দ লাগছিলোনা। এক ধরনের কাব্যিক আনন্দ পেলাম সুমুদ্রপৃষ্ট হতে এতটা উচ্চতায় ঘুরে বেড়াতে। না, কোন কিছুতেই আজ মন খারাপ হচ্ছেনা। দূর হতে পড়তে অসুবিধা হলোনা দালানটার মাথায় সাইনবোর্ডটা, র‌্যাডিশন। ভেতরে ঢুকতেই ফাইভ স্টার আরামের গন্ধ পাওয়া গেল চারদিকে। হোটেলটার নিজস্ব ট্রাভেল এজেন্সিটাতে বড় একটা তালা ঝুলতে দেখে মনটা বেশ দমে গেল। ফ্রন্ট ডেস্কে আলাপ করে জানা গেল সোমবার সকাল ছাড়া কাজ হবেনা। নিজের কাহিনী সবটা খুলে বলতে ডেস্কে বসা ল্যাটিন সুন্দরীর মন গলাতে পেরেছি মনে হল। মুহূর্তের মধ্যে গোটা দশেক ফোন করে গাই গুই করে স্প্যানিশ ভাষায় কি বললো কিছুই বুঝা গেলনা। কিন্তু কাজের কাজ হল শেষ পর্যন্ত। ’লান চিলি’ নামের এয়ার লাইনের টিকেট পাওয়া গেল। দাম নিয়মিত দামের প্রায় ৩ গুন। আলহামদুল্লিলাহ্‌ বলে জবাই হওয়ার স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য হলাম। সকাল ৭ টার ফ্লাইট, এয়ারপোর্ট থাকতে হবে ৬টার ভেতর। সুন্দরী জানাল সোমবার সকালে নতুন করে শুরু হতে যাচ্ছে অনির্দিষ্ট কালের ধর্মঘট। মন মনে বললাম, লা ক্যুম দ্বিনুকুম ওলয়্যাদিন …। আমাকে আর পাচ্ছোনা তোমরা! টিকেটের ঝামেলা শেষ হতেই মনে হল গোটা আন্দিজ পাহাড় নেমে গেছে মাথা হতে। এবার যে উদ্দেশ্যে এখানে আসা তা পূর্ণ করার পালা। এ ব্যাপারে সাহায্য চাইলাম ফ্রন্ট ডেস্কের কাছেই। তোতা পাখীর মত একগাদা ট্যুরের আমলনামা ধরিয়ে দিল হাতে। ধারণাটা হঠাৎ করেই মাথায় খেলল, প্রথমবার সিংগাপুর গিয়েও এর সাহায্য নিয়েছিলাম। সারাদিনের জন্যে বিশ্বাসযোগ্য একজন ক্যাব ড্রাইভার দরকার আমার! জানাতেই বত্রিশ পাটি দাঁত উদাম করে হেসে উঠল উদ্ধার দেবী। হোটেলের নিজস্ব ড্রাইভার কার্লোস বসে আছে ৭ দিন ধরে। হাঙ্গামার কারণে টুরিস্টদের দেখা নেই, আমই চাইলেই নিতে পারি। ৬০ ডলারে ফয়সালা হয়ে গেল। সেকেন্ডের ভেতর মাটি ফুড়ে হাজির হলেন আমার সারাদিনের কেনা গোলাম কার্লোস হেরনান্‌ডেস।

বিয়েন বেনিদছ্‌ আ লা পাস’, হাত বাড়িয়ে লা পাস’এ আমাকে স্বাগত জানাল কার্লোস। ’গ্রাসিয়াস সিনওর’, ধন্যবাদ জানিয়ে আমিও হাত বাড়িয়ে দিলাম। স্প্যানিশ ভাষায় জানতে চাইলাম তার নাম, এবং তাতেই সে ধরে নিলো এ আমার ন্যাচারাল ভাষা। দক্ষিণ আমেরিকা আসব বলে প্রয়োজনীয় ক’টা বাক্য রপ্ত করেছিলাম সেই নিউ ইয়র্ক বসেই। কিন্তু কার্লোসের বকবকানির উত্তর দিতে গিয়ে সহসাই আবিষ্কার করলাম আমার স্প্যানিশের ভাণ্ডার একেবারেই ঠুনকো। কিছুদূর এগুতেই জানিয়ে দিলাম, নো স্প্যানিশ por favor(প্লীজ)। বেচারা তাতে মোটেও দমে গেল বলে মনে হলোনা, বরং বকর বকর আরও বাড়িয়ে কান ঝালাপালা করে ফেলল। উপায় না দেখে আমিও কথা বলার ষ্ট্রাটেজি বদলে ফেললাম, মিঃ হেরনান্‌ডেজের সাথে এখন হতে বাংলায় কথা বলব আমি! আমার সূদীর্ঘ ভ্রমন জীবনে অনেকবারই ব্যবহার করেছি এ কৌশল। মৌখিক যোগাযোগে ভাষার গ্যাপ থাকলে নির্জলা বাংলা ব্যবহার এক ধরনের ঐশ্বরিক তৃপ্তি দেয়!

হাতের কাছেই সান ফ্রানসিস্কো প্লাজা। আমার ড্রাইভার-কাম-ট্যুর গাইড এখান হতেই শুরু করতে চাইল শহর ভ্রমন। খাঁটি বাংলায় বললাম, ’মিয়াভাই, ঘন্টাখানেক আগে ঘুরে গেছি এই স্কয়ার, যাওয়ার আর দরকার নাই‘। আগা মাথা কিছু না বুঝে গাড়ির দরজা খুলে আহ্বান জানাল সান ফ্রানসিস্কো কলোনিয়াল চার্চটা ঘুরে আসার জন্যে। না গেলে হয়ত ভুলই করতাম। দেখার মত জিনিষ। পরবর্তী ঠিকানা প্লাজা মুরিয়েয়ো। এই প্লাজার চারদিক ঘিরে আছে অনেকগুলো সরকারী ভবন, তারমধ্যে জাতীয় কংগ্রেস ভবন এবং প্রেসিডেন্ট ভবন অন্যতম। লন্ডনের ট্রাফলগয়ার স্কয়ারের মত শত শত কবুতর উড়ে বেড়াচ্ছে যত্র তত্র। খাবার দিলে ওরা হাতে, শরীরে বসে পর্যটকদের আনন্দ যোগায়। টুরিস্টদের ভীরে গিজ গিজ করছে স্কয়ারটা। বেশ ক’টা ছবি তুলে বিদায় নিলাম জায়েন ষ্ট্রীটের উদ্দেশ্যে। পথেই দেখলাম এভিনিউর নামটা, বুশ এভিনিউ। এবার আর বাংলা নয়, ভাঙ্গা স্প্যানিশেই কার্লোসকে জিজ্ঞেস করলাম, ’তে গুস্তা বুশ মুচঅ?’ অর্থাৎ, বুশকে কি তোমাদের খুব পছন্দ? পাহাড়ি খাদ বেয়ে উপরের দিকে উঠছিলাম আমরা, কায়দা করে গাড়িটাকে এক জায়গায় থামিয়ে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল সে আমার দিকে, বিশ্রী একটা গালি দিল প্রেসিডেন্ট বুশকে, আমাকে সাবধান করে দিল লা পাসে এ ধরনের মন্তব্য করা হতে বিরত থাকতে। ভুলেই গিয়েছিলাম বলিভিয়া ভেনিজুয়েলান প্রেসিডেন্ট হুগো সাভেজের সমাজতান্ত্রিক জ্বরে আক্রান্ত এবং এই নতুন কাস্ত্রোর লোকাল এজেন্ট এবো মরালেসের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। মাথা ঠাণ্ডা হতেই কার্লোস জানাল বুশ এভিনিউর নাম করণ করা হয়েছে আসলে তাদেরই এক জেনারেলের নামে, যার পুরো নাম খেরমান বুশ। দক্ষিণ আমেরিকার রাজনীতি নিয়ে কথা বলার সময় এবং জায়গা এটা নয়, তাই চুপ করে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। তিওয়ানাকো কালচারের ওপেন-এয়ার মিউজিয়াম আমাদের পরবর্তী ঠিকানা। তারপর মেনুতে ছিল ওব্রাখেস, কালাকোতা এবং লা ফ্লোরিডা আবাসিক এলাকা ভ্রমন। মুন ভ্যালির মাটির ধ্বস দেখার মধ্য দিয়ে আমাদের ট্যুর শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু কার্লোস এখানেই থামল না, আঁকাবাঁকা পথ ধরে পাহাড়ে ভাঙ্গতে শুরু করল প্রচণ্ড গতিতে। প্রথমেই থামল এমন একটা উচ্চতায় যেখান হতে পুরো লা লাজ শহরের প্যানোরমা দেখা যায় ফ্রেমে বাধানো ছবির মত। গাড়ি থামিয়ে সেও এগিয়ে এলো আমার সাথে। নির্দিষ্ট একটা জায়গায় আঙ্গুল দেখিয়ে তাকাতে বলল আমায়। বিন্দুর মত দেখাল দূরের স্টেডিয়ামটাকে। এক ধরনের গর্ব খেলে গেল কার্লোসের চোখে মুখে। এই সেই বিখ্যাত স্টেডিয়াম যেখানে অনুষ্ঠিত হয় বলিভিয়ার ন্যাশনাল ফুটবল স্পেক্টাকেল। প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম আমি ফুটবল পাগল দক্ষিণ আমেরিকার কোন একটা দেশে এখন। সমুদ্র পৃষ্ট হতে পৃথিবীর যে কোন স্টেডিয়ামের চাইতে সবচেয়ে বেশী উচ্চতায় অবস্থিত এই স্টেডিয়াম। নাম শুনেছি অনেক, রাশিয়ায় থাকতে টিভিতে সরাসরি খেলাও দেখেছি অনেকবার। কার্লোসকে ধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে গেলাম গাড়ির দিকে। তাকে খুব একটা খুশী মনে হলোনা ফুটবল নিয়ে আমার এই ভাবলেশহীন অভিব্যক্তিতে।

আমরা এগিয়ে গেলাম ট্যুরের শেষ গন্তব্যস্থল পরিদর্শনে। সান পেড্রো পাহাড়ের উপর কোচাবাম্বা এলাকায় ’ক্রেষ্টো দ্যা লা কনকরডিয়া’ স্ট্যাচু শহর হতে বেশ কিছুটা দূরে। যিশু খ্রিষ্টের এই মূর্তি ব্রাজিলের রিও দ্যা জেনেরোর ’ক্রাইস্ট দ্যা রিডিমারের’ চাইতেও কয়েক ফুট লম্বা। প্রায় ৪১ মিটার লম্বা এটাই বিশ্বের সর্ব বৃহৎ যীশুর স্ট্যাচু। উচ্চতায় পৌঁছে গাড়ি থামতেই চোখ জুড়িয়ে গেল দৃশ্যটা দেখে। খণ্ড খণ্ড মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে চারদিক। ইচ্ছে করলেই হাত দিয়ে ছোঁয়া যায় এক খণ্ড মেঘ। বিশাল উচ্চতা হতে নীচে লোকালয়ের দিকে তাকালে রক্ত হিম হয়ে আসে। এত উঁচুতেও আলপাকা এবং জামাদের দেখা গেল এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করতে। ছবি তুললাম মন ভরে। হঠাৎ করেই বিশাল এক খণ্ড মেঘ ঢেকে দিল মাথার উপরটা, চারদিকে নেমে এলো এক ধরনের বোবা অন্ধকার। ভয়টা ভূতের মত চেপে বসল মাথায়! আমার হাতে দু’টা ভিডিও ক্যমেরা, একটা ডিজিটাল ষ্টীল ক্যমেরা এবং পকেটে অনেকগুলো টাকা। কি হবে যদি এই অজানা অচেনা ড্রাইভারের মাথায় লোভ চেপে বসে? হাল্কা একটা ধাক্কা দিলেই যথেষ্ট, ইতিহাস হয়ে যাব আমি আন্দিজের বিপদজনক বাঁকে। বলিভিয়া পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র এবং চরিত্রহীন দেশ, এখানে কাউকে বিশ্বাস করাটা হবে বোকামির শামিল। উঠে দাঁড়ালাম মূর্তিটার বিশাল পাদদেশ হতে। ড্রাইভার বললাম, ‘বামুস‘ (চল)। কোন অঘটন ছাড়াই পৌঁছে গেলাম হোটেলে। বিদায়ের আগে কার্লোসই জানতে চাইল সকালে এয়ারপোর্ট যাওয়ার যানবাহন ঠিক করা আছে কিনা। ভাল কথা মনে করিয়ে দিল সে, ধন্যবাদ জানিয়ে তাকেই আসতে বললাম সকাল ৪টার ভেতর।

সন্ধ্যাটা এলোমেলো ঘুরে বেড়ালাম ডাউন টাউনে। মূল রাস্তায় এক মহিলা মুচির ছবি তুলতে গেলে তেড়ে এলো মারতে, দৌড়ে আশ্রয় নিলাম পার্শ্ববর্তী হোটেলে। তবে এখানেই সমাপ্তি টানলাম না ভাল একটা দিনের। সন্ধ্যা নামার সাথে আবারও আন্দিজ হতে নেমে এলো ঘন কালো কুয়াশা, ভোজবাজির মত কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেল চারদিকের সবকিছু। অনেক সন্ধান অনুসন্ধানের পর একটা চীনা রেস্তোরা খুঁজে পাওয়া গেল বেশ কিছুটা দূরে। অস্ট্রেলিয়ান এক দম্পতিকে সাথে নিয়ে অনেকদিন পর রাতের আহারে ভূরি ভোজ করলাম মনের আনন্দে। ৯টা বাজতেই চারদিকে বেজে উঠল হরতাল দামামা, তৈরি হচ্ছে লা পাস কালকের জন্যে। আর কোন রিস্ক না নিয়ে ঘরে ফিরে গেলাম বিনা এডভেঞ্চারে। ১০টার ভেতর শুয়ে পরলাম খুব সকালে উঠতে হবে বলে।

ভোরে ঘুম ভাঙ্গল ওয়েক-আপ কলে, নীচে ক্যাব নিয়ে অপেক্ষা করছে কার্লোস। হোটেল ভাড়া পরিশোধ করে যথেষ্ট সময় হাতে নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্য। লা পাস এয়ারপোর্টের চারদিকের বিস্ময়কর সৌন্দর্য বেশীক্ষণ উপভোগ করার সময় পাওয়া গেলনা, চারদিকে হরতাল শুরুর চাপা উত্তেজনা। ইমিগ্রেশন পার হয়ে ভেতরে ঢুকে পরলাম নিরাপত্তার কথা ভেবে। যাত্রী সহ ’লান চিলির’ ফ্লাইট আকাশে উঠতেই হাফ-ছেড়ে বাঁচলাম, কিন্তু মনটাও কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেল সাথে। বিমানের জানালা ধরে তাকিয়ে থাকতে সেলুলয়েডের ফিতার মত রি-ক্যাপ হতে শুরু করল ফেলা আসা ২/৩ দিনের স্মৃতি। দেসাগুয়াদেরর অজানা আশংকা, আন্দিজের অচেনা বাঁকে জীবন বাঁচানোর ম্যারাথন দৌড়, বিকট শব্দে বাসের চাকা পাংচার, খাদ্য এবং পানি ছাড়া আন্দিজের বাকে বিপদজনক বিকেল সহ টুকরো টুকরো অনেক ঘটনা। সবচেয়ে বেশী মনে পরল হারিয়ে যাওয়া রহস্যময়ী ভিক্টোরিয়ার কথা। স্মৃতির অলিগলি হাতড়াতে কোনদিন কি ফিরে আসা হবে পৃথিবীর এ প্রান্তে?

লা পাস ‘এলো আলতো’ এয়ারপোর্ট হতে লিমা ’হোরহে চাভেজ‘ এয়ারপোর্ট ২ ঘণ্টার পথ। দেশ দু’টোর মধ্যে রয়েছে ১ ঘণ্টা সময় ব্যবধান। সাধারণ মানের এক প্যাকেট পটেটো চিপস, সাথে মিনি গ্লাসে এক গ্লাস ইনকা কোলা, আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে এ ধরনের দায়সারা গোছের আপ্যায়নে বেশ হতাশ হলাম। এতগুলো ডলার খসে গেল মাত্র দুই ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে হবে, ভেতরের এই অসন্তুষ্টিটা কাটা গায়ে নুন ছেটানোর মত যন্ত্রণা দিচ্ছিল বার বার। দৃশ্যটা প্রথমবারও লক্ষ্য করেছি, লিমা এয়ারপোর্টকে ঘিরে থাকা আন্দিজের চূড়াগুলো ঘন মেঘের স্তর ভেদ করে আকাশে উঠে গেছে। হঠাৎ করে দেখলে দৈত্য দানবের মত মনে হবে। প্রাক ধারণা না থাকলে চূড়াগুলি ভয় ধরিয়ে দেয় ফ্লাইট সেফটির আশংকায়। সীট নিয়ে ভাল করে বসার আগেই মন হল হল ল্যান্ড করছি আমরা।

৯টার ভেতর ঝামেলা চুকিয়ে বেরিয়ে এলাম এয়ারপোর্ট হতে। নিউ ইয়র্কের ফ্লাইট রাত ১২টায়; মাঝখানের ১৫ ঘণ্টা কোথা যাব, কি করব ভেবে চিন্তিত হয়ে পরলাম। ইচ্ছা ছিল এয়ারপোর্ট লাউঞ্জেই কাটিয়ে দেব সময়টা, কিন্তু এত লম্বা সময়ের কথা মনে হতেই দ্বিধায় পরে গেলাম। রাতে ভাল ঘুম হয়নি, তা ছাড়া সামনে পরে আছে আরও ৭ ঘণ্টার ফ্লাইট। এত ধকল শরীরে সইবার নয়, তাই হিসাব শেষে হোটেলে উঠার সিদ্ধান্ত নিলাম। টুরিস্ট ব্যুরোর ডেস্কে গিয়ে সন্ধান চাইলাম কাছাকাছি সস্তা হোটেলের। আগের বার বোকার মত ৭৫ ডলার দিয়ে লিমার সবচেয়ে অভিজাত এলাকা মিরাফ্লোরেসে হোটেল বুক করেছিলাম। ডেস্কের লাস্যময়ী তরুণী এক সপ্তাহের ভেতর দ্বিতীয় বার স্বাগত জানিয়ে আগের হোটেলে যেতে চাই কিনা জিজ্ঞেস করল। ৩৫ ডলারে এয়ারপোর্টের সবচেয়ে কাছের হোটেলটায় বুকিং দিয়ে ক্যাব নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেলাম।

রাজধানী লিমা ইতিমধ্যে জেগে উঠেছে। অগুনিত যানবাহন, গিজ গিজ করা মানুষের ভিড়। এয়ারপোর্টের কাছাকাছি রাস্তাগুলো হঠাৎ করে দেখলে ঢাকার কোন রাস্তা বলে ভুল হতে পারে। এলোমেলো ট্রাফিক, শ্রীহীন ইমারত, যত্রতত্র নির্বাচনী চিকা, লক্কড় ঝক্কড় মিনিবাস এবং রাস্তায় পরিকল্পনাহীন দোকান পাট, নির্ঘাত ঢাকার ছবি! শুধু পার্থক্য এর চতুর্দিকের প্যনোরমা। আন্দিজের বিশাল বিশাল চূড়ায় নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে সকালের সূর্য। এক ধরনের ঘন কুয়াশা রাজত্ব করছে শহর জুড়ে। একটু এগিয়ে হাইওয়ে ধরতেই পার্থক্যটা প্রকট হয়ে উঠল, ঢাকায় এ ধরনের নিয়ন্ত্রিত ট্রাফিক চলাচল অকল্পনীয়। পনের মিনিটের ভেতর হাজির হলাম হোটেলটার সামনে। হোটেল ’ম্যানহাটন’, নির্জন পরিবেশে বেশ খোলামেলা জায়গায় হোটেলটাকে দেখে পছন্দ হয়ে গেল।

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই ৩২ দাঁত বের করে স্বাগত জানাল অবিকল বাঙ্গালী চেহারার এক তরুণী।

আমার ভ্রমণ কাহিনীর এখানেই বোধহয় সমাপ্তি টানা যায়, কারণ এর পরের ১৫ঘন্টায় যা ঘটবে তার সাথে ভ্রমণের কোন সম্পর্ক নেই। লম্বা একটা ঘুম সেরে নীচে নামতেই আলাপ হবে সকালের সেই মেয়েটার সাথে। সে আলাপ চলবে টানা ৩ ঘণ্টা। এবং এই ৩ ঘণ্টায় বীজ বপিত হবে নতুন এক কাহিনীর। এ কাহিনীর ট্রেইল ধরে আমাকে আবারও ফিরে আসতে হবে লিমায়। স্মৃতির অলিগলি হাতড়াতে আবারও যেতে হবে কুসকো, মাচা পিচু, পদানত হবে আন্দিজের নতুন নতুন চূড়া। পাড়ি দিতে হবে কলার দেশ ইকুয়েডর, ড্রাগের স্বর্গভূমি কলম্বিয়া সহ আন্দিজের আরও অনেক বাঁক। এ নিয়ে হয়ত লেখা যেতে পারে বিশাল ক্যানভাসের আরও একটা কাহিনী, যা ভ্রমণের পাশাপাশি ছুঁয়ে যাবে প্রেম, ভালবাসার মত নাটকীয় বিষয়গুলি।

– সমাপ্তি

লেখাটা শেষ করে গিন্নীকে আনতে যেতে হবে। সে এখন কাজে। এবং আমার গিন্নীই সেই জন যার সাথে দেখা হয়েছিল লিমার সেই হোটেলটায়।

error: Content is protected !!
Exit mobile version