নিঝুম দ্বীপ

নিঝুম দ্বীপে ক্য্যাম্পিং

নিঝুম দ্বীপ এর নির্জনতায়

লিখেছেন - উম্মে আইমুনSeptember 3, 2020

হুট করেই জানুয়ারী মাসের শুরুতে ভূত চাপলো যে নিঝুম দ্বীপ যাব। দেশের এত জায়গায় গেলাম আর নিজ জেলার সবচেয়ে জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট এ যাব না তা কি হয়? ব্যস আর কি প্ল্যান করে জানুয়ারির শেষে রওয়ানা দিলাম নিঝুম দ্বীপ এর উদ্দেশ্যে। আমার প্রথম লঞ্চ জার্নি। সদরঘাট এ গিয়ে লঞ্চ এ উঠে যাত্রা হলো শুরু। কেবিন নেওয়া সত্ত্বেও ডেকে ট্রাভেল করতে কেমন লাগে সেটা দেখতে থাকলাম কিছুক্ষণ ডেকে। কত রকমের কত মানুষ কত অদ্ভুত কাজ কারবার। টিভিতে চলছে শাকিব খানের মুভি। অতিরিক্ত শব্দ, আলোতে একটু পরই শুরু হয়ে গেলো আমার বিখ্যাত মাইগ্রেন। অষুধ খেয়ে গিয়ে এরপর কেবিনে শুয়ে পড়লাম। ঘুম আসে না৷ কিছুক্ষন এপাশ ওপাশ করার পর আস্তে চোখ লেগে এলো. ঘড়িতে এলার্ম দিলাম ভোর পাঁচটার। যদিও পাঁচটার অনেক আগেই ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভেঙ্গে বাইরে উঁকি দিলাম। আস্তে আস্তে একটু একটু করে আলো ফুটলো। দেখলাম যে লঞ্চ দাঁড়িয়ে আছে। এরপর লঞ্চঘাটে নামলাম, এরপর দুটো সিএনজি করে যাত্রা শুরু।

রাস্তার দুই পাশে সুন্দর কিন্তু রাস্তা টা অনেক খারাপ, খুব ঝাঁকুনি হচ্ছিল সিএনজিতে। আশেপাশের সুন্দর দৃশ্য অবলোকন করতে করতে একটা ঘাটে পৌছালাম।এবার পৌঁছে সেখান থেকে নৌকো করে পার হলাম নদী। এরপর ওই পাশে গিয়ে আবার সিএনজি নিয়ে পৌঁছলাম নিঝুম দ্বীপ। নিঝুম দ্বীপে গিয়ে প্রথমে চলে গেলাম যেখানে ক্যাম্প করবো সেখানে। ওখানে বন বিভাগের কর্মীদের আগেই বলে রাখা হয়েছিল যে রাতে তাবুতে থাকব। উনারা তাবু করে রেখেছিলেন। খুব ভালো লাগলো চারপাশটা একটু ঘুরে ফিরে এবার আমরা ঘুরতে বের হলাম বনে। অটো করে একটু সামনে গিয়ে অটো থেকে রাস্তার পাশে নেমে শুরু হলো জঙ্গল সাফারি। নিরব নিস্তব্ধ বনের ভিতর হাটি। আরেকটু পর পরই খাল পার হবার জন্যে একটা বড় গাছের গুড়ি ফেলে রাখছে। আর কোন কিছু নেই দুইপাশে ধরে হাটার। আমরা শহুরে মানুষদের জন্য এই গুড়ি পার হওয়া হচ্ছে যুদ্ধ। দুটো বাচ্চা ছেলে ছিল স্থানীয় আমাদের অনেক হেল্প করল। সেই গাছের গুড়ি পার হয়ে বনের ভিতর ঘুরে দেখলাম। চোখ জুড়ানো সবুজের মায়া।

Nijhum Dwip

নির্জন বন

হরিণ দেখতে পাইনি কিন্ত আশেপাশে পাখি দেখেছি প্রচুর । একটু ঘুরে এরপর দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। প্রায় ২৪ ঘন্টা পরে আবার ভারী খাবার খাওয়া হলো। সেই সাথে খেলাম মহিষের দুধের দই, খুব ভালই লাগলো, প্রথমবার খাওয়া টেস্ট। এবার নৌকা করে যাত্রা শুরু চৌধুরী খাল আর কবিরাজ খালে। কবিরাজ খাল এ ছোট ছোট নৌকা দিয়ে যত খালের ভিতরে যাচ্ছিলাম নদীর দুই পাশে শ্বাসমূল গুলো আর কাদা। নদীর সেই কাদা মাড়িয়ে বনের ভিতরে ঢুকলাম কিন্তু হরিণ এর দেখা পেলাম না।এবার চৌধুরী খালে যেতেই দেখলাম যে নদীর পাশে বসে আছে দুটো হরিন। আমাদেরকে আসতে দেখে এরপর দিলো ভোঁদৌড়। এক দৌড়ে বনের ভেতর। এরপর যতই বনে ঢুকে ঘুরে ঘুরে খুজি আর দেখা পেলাম না হরিনের। শেষ বিকেলে গেলাম বিচে। সেখানে একটা শিমুল তুলা গাছ কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই গাছের নিচে একটু ফটোগ্রাফি করা হলো। এখানে স্থানীয় এক চাচার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করে এবার ক্যাম্পে আসলাম।

ক্যাম্প এ এসে ফ্রেশ হয়ে এবার বাজার সহ চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখলাম, চা নাস্তা করলাম। করার পরে শুরু হল বারবিকিউ। এবার বারবিকিউ এর পাশে বসে গল্প করা, তারপর সবাই মিলে মাদুর বিছিয়ে মাটিতে বসে বারবিকিউ খাওয়া। খেয়ে দেয়ে খেজুর রস খাওয়ার অভিযানে বের হলাম কিন্তু একজনকে ও পেলাম না এত রাতে রস বিক্রি করার জন্য। রাত একটা পর্যন্ত বাইরে ঘুরে ঘুরে এবার তাবুতে এসে পড়লাম আর ভাবলাম যে জীবনে কখনো কাঁচা খেজুরের রস খাইনি এবারও কি খাওয়া হবে না। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো। ঘুম থেকে উঠে ওয়াচ টাওয়ারে উঠে পুরো দ্বীপ দেখলাম। এদিন আমরা চলে যাব তাই সবার থেকে বিদায় নিয়ে ঠিক হলো যে এবার আমরা ঘাটে যাওয়ার সময় রস খাওয়া হয়ে যাবে। যাওয়ার সময় এবার এক বাড়িতে ঢুকলাম খেজুর গাছের কোন অভাব নেই, প্রত্যেকটা গাছে রসের হাড়ি ঝুলছে, অনেক বড় তেতুল গাছে তেতুল ধরে আছে, টার্কি মুরগি পালন আরো অনেক কিছু আছে। সেই বাড়িতে সেখানে গিয়েই প্রথম কাঁচা খেজুর রস খেলাম।রস টা একটু টক মিষ্টি স্বাদযুক্ত, প্রথমবার খেলাম খুব ভালো লাগলো। এরপর ওই বাড়ির মানুষ গুলোকে খেজুরের রসের দাম দিয়ে তাদের থেকে বিদায় নিলাম।

Nijhum Dwip

ছবি: উম্মে আইমুন।

এবার যাত্রা শুরু সিএনজি করে নদীর পাড়ে। গিয়ে ঠিক হলো যে ট্রলারে করে হাতিয়া যাব। ট্রলারে উঠে বসে রইলাম কিন্তু ট্রলার তো আর ছাড়ে না। একের পর এক মানুষ উঠেছে তো উঠেছেই। একটা সময় ট্রলার অতিরিক্ত মানুষের চাপে এক পাশে কাত হয়ে গেলো। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে আমরা ট্রলারে যাব না ঠিক করে, স্পিডবোটে করে নদীর অপর পাশে এসে আবার সিএনজি করে যাত্রা শুরু করলাম। হাতিয়া এসে নাস্তা করলাম। নাস্তা করে এবার একটু হাতিয়াতে ঘুরেফিরে লঞ্চে উঠলাম। এখন দুপুর একটার লঞ্চে উঠার কারণে চারপাশ টা ভালভাবে দেখতে দেখতে যেতে পারছিলাম। এরপর আস্তে আস্তে লঞ্চ সামনে আগানোর সাথে সাথেই দেখলাম মনপুরা দ্বীপ সহ বিভিন্ন চর।

লঞ্চে বিভিন্ন খাবার-দাবার খাচ্ছিলাম, একপাশে সবুজ বন আর চারদিকে বাতাসে। দেখতে দেখতে যাত্রাটা খুব ভালোই লাগছিল। একসময় একটা নৌকা ভর্তি ইলিশ এসে লঞ্চের গায়ে ভিড়লো। সমস্ত ইলিশ উঠানো হলো লঞ্চে। এবার রাত্রে কিভাবে ঘুমানো হবে হবে সেটা নিয়ে চিন্তা করা হলো। আমরা মেয়েরা দুজন একটা কেবিনে আর ছেলেরা দুজন আরেক টা কেবিনে, বাকি ছেলেরা সবাই কেবিনের বাইরে লঞ্চের ভিতর তাবু ফেলে তার ভিতরে বিছানা করে সবাই ঘুমিয়ে গেল। খুব সকাল বেলা লঞ্চ এসে থামলো সদর ঘাট। ভোর সবাইকে বিদায় দিয়েছে। এ ট্যুরে আসলে ঢাকা থেকে নিঝুম দ্বীপে গেলে সবচেয়ে বেশি সময়টা চলে যায় লঞ্চে। আমরা বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টায় বাসা থেকে বের হয়েছিলাম, সদরঘাট থেকে লঞ্চে উঠলাম চারটায়। লঞ্চ বিকেল পাঁচটা বাজে ছেড়েছে সেই লঞ্চ পরদিন সকাল পাঁচটায় গিয়ে পৌঁছেছে সেখান থেকে সিএনজি গাড়ি সবকিছু করে আমরা যখন নিঝুম দ্বীপ পৌছালাম তখন সময় দুপুর ১২ টা। ২৪ ঘন্টা সফর যাওয়া এবং আসার সময় লেগেছে। যদিও জার্নি টা খারাপ ছিল না।

নিঝুম দ্বীপ অনেক বেশি সুন্দর চারদিকে সবুজের সমারোহ আর বনের হরিণ দেখতে পাইনি কিন্তু বনবিভাগের লোকের একটা হরিনকে পালে সেই হরিন টা বারবার দেখতে পেয়েছি। আমাদের নিজের দেশ টা অনেক বেশি সুন্দর। দেশকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদেরই, তাই ময়লা আবর্জনা যেখানে সেখানে না ফেলে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলুন। হ্যাপি ট্রাভেলিং।

উম্মে আইমুন এর অন্যান্য লেখা

 

ভ্রমণ গাইডলাইন পড়ুন