কেওক্রাডং

ছবি : তানজিম

কেওক্রাডং

একসময় কেওক্রাডং বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পাহাড় হিসেবে স্বীকৃত ছিলো। আধুনিক উচ্চতা পরিমাপক পদ্ধতিতে জরিপ করার পর এটির অবস্থান এখন পঞ্চম। তারপরও কেওক্রাডং কে বাংলাদেশের ছাদ হিসেবে অভিহিত করা যায়। এই পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আপনার যতদূর চোখ যাবে, ততদূর শুধু পাহাড়ের সমুদ্র দেখতে পাবেন। এখানে মেঘ ভেসে বেড়ায় যখন তখন। মেঘের সাথে বন পাহাড়ের মিতালী দেখতে আপনাকে কেওক্রাডং ভ্রমণ এ অন্তত একবার আসতেই হবে। কেওক্রাডং শব্দটি এসেছে মারমা ভাষা থেকে। এর অর্থ উঁচু পাথরের পাহাড়।

কেওক্রাডং যাওয়ার উপায়

কেওক্রাডং যেতে হলে প্রথমে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে আপনাকে বান্দরবান আসতে হবে। রাতের বাসে আসাই ভালো। ঢাকা থেকে এসি – নন এসি সব ধরণের বাসই বান্দরবান যায়। নন এসির মধ্যে শ্যামলী, সৌদিয়া, ইউনিক, ডলফিন, সেন্টমার্টিন, এস আলম ইত্যাদি পরিবহনের বাস পাবেন। বাস ছাড়ে কলাবাগান, ফকিরাপুল ও সায়েদাবাদ থেকে। রাত এগারোটার মধ্যে লাস্ট বাস ছেড়ে যায়। ভাড়া ৫৮০ থেকে ৬২০ টাকা। এসি বাসের ভাড়া ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে।

ট্রেনে যেতে চাইলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী যেকোনো ট্রেনে উঠতে হবে। সোনার বাংলা এক্সপ্রেস, সূবর্ণ এক্সপ্রেস, তূর্ণা নিশীথা, চট্টলা, মহানগর ও গোধুলী সহ অনেকগুলো ট্রেইন ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ট্রেন ও আসন ভেদে ভাড়া ২০০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে।

চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবানের বাস ছাড়ে নতুন ব্রিজ, দামপাড়া ও বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল থেকে। বহদ্দারহাট থেকে ৩০ মিনিট পরপর ‘পূর্বাণী’ ও ‘পূরবী’ নামে দুটি পরিবহনের বাস ছাড়ে। ভাড়া ২২০ টাকা।

বান্দরবান থেকে রুমা বাজার

বান্দরবান থেকে কেওক্রাডং যেতে হলে প্রথমে রুমা বাজার যেতে হবে। রুমা বাজার জেলা শহর থেকে ৫০ কিঃমিঃ দূরে। বাসে বা জিপে করে রুমা যাওয়া যায়। বান্দরবান থেকে ১ ঘন্টা পরপর রুমার বাস ছাড়ে। ভাড়া ১২০ টাকা। যেতে সময় লাগবে ৩ ঘন্টার মতো। বিকাল ৩টার মধ্যে লাস্ট বাস ছেড়ে যায়।

জিপে করে রুমা যেতে চাইলে রিজার্ভ নিতে হবে। ভাড়া পড়বে সিজন ভেদে ২৫০০ থেকে ৪০০০ টাকার মধ্যে। এক জিপে ১২/১৩ জন বসা যায়। যেতে সময় লাগবে ২ ঘন্টার মতো। শীতের সিজনে এই রুটে লোকাল জিপ পাওয়া যায়। জনপ্রতি ৮০ থেকে ১২০ টাকা ভাড়া নেয়।

রুমা বাজার থেকে বগালেক

রুমা বাজার পৌঁছে আপনার প্রথমে গাইড ঠিক করতে হবে কেওক্রাডং যাওয়ার জন্য। গাইড সমিতির অফিস থেকে রেজিস্টার্ড গাইড ঠিক করতে পারবেন। রেজিস্টার্ড গাইড ছাড়া আপনি কেওক্রাডং যাওয়ার অনুমতি পাবেন না। এরপর রুমা বাজার আর্মি ক্যাম্পে সবার নাম ফোন নাম্বার সহ বিস্তারিত লিখে জমা দিতে হবে। আপনার হয়ে গাইডই এই কাজগুলো করবে। গাইড ফি আপনি কতদিন থাকবেন তার উপর নির্ভর করে ১৬০০ থেকে ২৬০০ টাকা পর্যন্ত হয়। এছাড়া গাইডের থাকা খাওয়ার সকল খরচ আপনাকেই বহন করতে হবে। কেওক্রাডং যাওয়ার কয়েকজন রেজিস্টার্ড গাইডের নাম্বার-

সুফল বড়ুয়া 01843-229547, ইসমাইল 01869-364977
প্রকাশ 01887-659360, হারুন 01828-872894
বাবুল 01552-432937, রঞ্জন 01827-713975
তাপস বড়ুয়া 01884756482

কেওক্রাডং যেতে প্রথমে পড়বে বগালেক। ওই রাতটা বগালেক থেকে পরদিন ভোরে কেওক্রাডং এর উদ্দেশ্যে ট্রেকিং শুরু করতে হয়। রুমা বাজার থেকে বগালেক পর্যন্ত জিপে যেতে যেতে পারবেন। ভাড়া ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকা। এক জিপে ১২/১৩ জন যাওয়া যায়। আপনার টিমে সদস্য সংখ্যা কম হলে অন্য কারো সাথে জিপ শেয়ার করতে পারেন। এছাড়া ১ ঘন্টা পরপর লোকাল জিপ ছাড়ে। ওগুলোতেও যেতে পারেন। ভাড়া ১০০ টাকা। বিকাল ৪টার পর রুমা যেতে বগালেকের উদ্দেশ্যে কোনো গাড়ি যেতে দেয় না আর্মি। তাই আপনাকে সকল কাজ ৪টার আগেই শেষ করতে হবে। রুমা থেকে বগালেকের দূরত্ব ১৭ কিঃমিঃ। যেতে ১ ঘন্টার মতো সময় লাগে।

বগালেক থেকে কেওক্রাডং

বগালেক পৌঁছে কোনো একটা আদিবাসী কটেজে উঠে রাতটা বগালেকের মনোরম পরিবেশে কাটিয়ে দিন। পরদিন ভোরে উঠে রওনা করতে হবে কেওক্রাডং এর উদ্দেশ্যে। বাগালেক থেকে দুইভাবে কেওক্রাডং যাওয়া যায়। হয় ট্রেকিং করে, অথবা জিপে করে। ট্রেকিং করে যেতে ৩ থেকে ৪ ঘন্টা সময় লাগে। পাড়ি দিতে হয় ছোট বড় বেশ কয়েকটা পাহাড়। জিপে গেলে সোয়া ১ ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যায় কেওক্রাডং এর পাদদেশে। শুধুমাত্র শুকনো মৌসুমে এই রুটে কিছু ফোর হুইলার গাড়ি পাবেন। বর্ষা মৌসুমে গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকে।

কেওক্রাডং এর চূড়ায় কিছুটা সময় কাটিয়ে সন্ধ্যার মধ্যে বগালেক চলে আসতে পারবেন। রাতটা বগালেকে কাটিয়ে দিয়ে পরদিন বান্দরবানের উদ্দেশ্যে রওনা করতে পারেন। তবে সবচেয়ে ভালো একটা রাত কেওক্রাডংয়ের উপরে কাটিয়ে দিলে। তাহলে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দেখা পাবেন দেশের পঞ্চম উচ্চতম শৃঙ্গ থেকে। কেওক্রাডংয়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে দেশের সবগুলো সর্বোচ্চ পাহাড় চূড়া দেখা যায়।

কেওক্রাডংয়ে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা

কেওক্রাডংয়ে থাকার জন্য কয়েকটা আদিবাসী কটেজ আছে। ওসব কটেজেই থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। থাকার জন্য জনপ্রতি খরচ হবে ১৫০ টাকা। খাওয়ার খরচ প্রতিবেলা ১০০ থেকে ২০০ টাকা।

বগালেকে থাকার জন্য আদিবাসীদের ছোট ছোট বেশ কিছু কটেজ আছে। ওগুলোতেই রাত্রি যাপন করতে হবে। এতে জনপ্রতি খরচ হবে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। এক রুমে ৫/৬ জন করে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। ফিমেইলদের জন্য আলাদা থাকার ব্যবস্থা। আর কাপল হলে আলাদা কাপল কটেজ পাওয়া যায়। সবকিছু আগে থেকে গাইডকে বলে রাখলে সে ব্যবস্থা করে রাখবে। অথবা আপনি চাইলে ওখানে গিয়েও ঠিক করতে পারবেন। ঢাকা থেকে কটেজ ঠিক করতে চাইলে বুুকিংয়ের জন্য ফোন দিতে পারেন লারাম বম- 01552376551, বা সিয়াম দিদির 01840721590 নাম্বারে।

খাওয়ার ব্যবস্থা আছে আদিবাসী ঘর ও কটেজগুলোতে। জনপ্রতি খাওয়ার খরচ পড়বে প্রতিবেলা ৮০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে। খাবার হয় প্যাকেজ সিস্টেমে। মেনু হিসেবে ভাত, ডাল, ভর্তা, ডিম মুরগী ইত্যাদি পাওয়া যায়। খাবার কতজন খাবেন, কী দিয়ে খাবেন ইত্যাদি আগে থেকে অর্ডার করতে হয়। গাইডকে বললেই হবে, সে অর্ডার করে দিবে। অথবা চাইলে আপনি নিজেও কথা বলে অর্ডার করতে পারেন। কটেজগুলোতে নিজস্ব বারবিকিউর ব্যবস্থা আছে। রাতে বগালেক পাড়ে মনোরম পরিবেশে বারবিকিউ পার্টি করে নিজেদের মধ্যে আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারবেন।

কখন যাবেন কেওক্রাডং

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চূড়াগুলোর মধ্যে কেওক্রাডং সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সুন্দরতম। তাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অমোঘ টানে বছরজুড়ে এখানে এডভেঞ্চারপ্রেমীরা ছুটে আসেন। বর্ষায় প্রকৃতি সতেজ থাকে বলে পাহাড় সবচেয়ে বেশি সুন্দর। তবে এসময় বেশিরভাগ রুমা বাজারের পর জিপ চলাচল বন্ধ থাকে। ফলে রুমা থেকে কেওক্রাডং পর্যন্ত পুরো পথটাই হেঁটে আসা যাওয়া করতে হয়। ট্রেকিংয়ের পূর্ব অভিজ্ঞতা ও শক্ত মানসিকতা না থাকলে বর্ষায় কেওক্রাডং ভ্রমণ এ না যাওয়াই ভালো। যারা ট্রেকিংয়ে নতুন ও কম সময়ে কেওক্রাডং থেকে ঘুরে আসতে চান তাদের জন্য শুকনো মৌমুমই বেস্ট। অর্থাৎ বলা চলে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত কেওক্রাডং ভ্রমণ এর ভালো সময়।

কেওক্রাডং ভ্রমণ টিপস

*রুমাবাজারের পর বিদ্যুত নেই। কটেজগুলোতে সোলার প্যানেলে পাওয়ার সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা আছে। তবে সাথে করে পাওয়ার ব্যাংক নিয়ে গেলে ভালো।

* রবি ও টেলিটক বাদে অন্য ফোনের নেটওয়ার্ক নেই বগালেকে। আর কেওক্রাডংয়ে কোনো ফোনেরই নেটওয়ার্ক নেই।

* বগালেকে গোসল করতে চাইলে সাবধানে করবেন। সবসময় সতর্ক থাকা ভালো। সাঁতার দিতে গিয়ে অতীতে একাধিক মৃত্যু দেখেছে বগালেক।

*সাথে এনআইডি কার্ড রাখুন। এনআইডি না থাকলে যেকোনো ফটোআইডি কার্ডেও কাজ চলবে।

*যাত্রাপথে জিপের ছাদে উঠবেন না। এটি করতে আর্মির পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা আছে। তাছাড়া পাহাড়ি পথে জিপের ছাদে উঠা বিপদজনক।

*আদিবাসীদের ছবি তোলার ক্ষেত্রে অনুমতি নিতে ভুলবেন না। এটা সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান। আপনার কাণ্ডজ্ঞান আপনার ব্যাক্তিত্বকে রিপ্রেজেন্ট করে।

*পাহাড়িদের কালচারের প্রতি সম্মান দেখান। এমন কিছু বলবেন না, যেটি অন্যকেউ আপনাকে বললে আপনারও খারাপ লাগতো।

*যেখানে সেখানে ময়লা না ফেলা আপনার ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক। সেটি শুধু পাহাড়ে নয়, এমনকি শহরেও।

আশেপাশে কী কী দেখার আছে
বগালেক থেকে কেওক্রাডং যাওয়ার পথে দেখতে পারবেন চিংড়ি ঝর্ণা। এছাড়া বান্দরবানের অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলোর ভ্রমণ তথ্য এখানে পড়ুন

আরো পড়ুন
⦿ নাফাখুম