আন্দিজ ৪

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ২

লিখেছেন - আজিম রহমানAugust 15, 2020

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – পর্ব ১

এ অন্য এক পৃথিবী; ঘন মেঘমালা আকাশ আর মাটির ভালবাসায় সেতুবন্ধন হয়ে জড়িয়ে আছে দিগন্ত জুড়ে। পাহাড়ের চূড়ায় চুড়ায় মেঘ-দৈত্যদের অলস পদচারণ প্রকৃতির নৈসর্গিক স্তব্ধতাকে স্বপ্নিল ফ্রেমে বন্দী করে তৈরি করেছে বিস্ময়কর প্যানোরমা। প্রথম ক’টা মিনিট মুখে কথা ফুটে না। এ যেন সূরা আর সাকির অনাদিকালের মিলন-মেলা। মাচু পিচু – ইনকাদের হারিয়ে যাওয়া শহর। স্প্যনিস দখলদারদের হিংস্রতা হতে বাচতে গিয়ে নিজেদের অজান্তেই তৈরি করে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম আশ্চর্য এক স্থাপনা।

চারদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। চূড়াগুলো বাহু-লগ্না হয়ে ডুবে আছে মেঘ সমুদ্রে। ইচ্ছে করলেই এক খণ্ড মেঘ হাতে বাড়িয়ে কাছে টানা যায়। আদর করা যায়। গলার সূর উঁচু করে হাঁক দিলে সে হাঁক পাহাড়ে পাহাড়ে আছড়ে পরে। ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে তীর ভাঙ্গা তরঙ্গের মত। চারদিকে এক ধরনের ভৌতিক নীরবতা। সাথে প্রকৃতি এবং মানুষের নীরব বুঝাপড়ার বিশাল এক ক্যানভাস। ইনকা সাম্রাজ্যের বিশালতার কাছে গিজ গিজ করা পর্যটকদের ফিসফাস হাজার রজনীর আরব্য উপন্যাসের কথাই মনে করিয়ে দেয়। নিপুণ কারিগরের নিশ্ছিদ্র পরিকল্পনায় হাতেগড়া পাথরের প্রাসাদগুলো সময়ের স্তব্ধ সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে দিগন্ত জুড়ে। প্রথম যে ধাক্কাটা এসে মগজে আঘাত হানে তাহলো, কি করে এত উচ্চতায় এই বিশাল পাথরগুলোকে উঠানো হল! প্রযুক্তি বলে জাগতিক পৃথিবীতে কিছু থাকতে পারে এমন ধারণা ঐ নিষিদ্ধ অরণ্য পর্যন্ত পৌঁছানোর কথা নয়। হাত এবং মগজের চাতুর্যপূর্ণ নৈপুণ্যে পাথরগুলোকে উঠানো হয়েছে একটার উপর আরেকটা। শক্ত কাদামাটি দিয়ে আটকানো হয়েছে হাজার বছরের বন্ধনে।

একদিকে রাজপ্রাসাদ, অন্যদিকে সাধারণ ইনকাদের বসতি এবং পাশাপাশি বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উন্নয়নে গবেষণাগার সবকিছু মিলে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ সাম্রাজ্যের কথাই মনে করিয়ে দেয়। বলা হয়ে থাকে পেরুর মাটিতে স্প্যানিশ উপনিবেশবাদের আগমনের একশত বছর আগেই এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়, কারও মতে দখলদার বাহিনীর নৃশংসতা হতে বাচার জন্যে ইনকারা পালিয়ে আশ্রয় নেয় মাচু পিচুতে। পরবর্তীতে বসন্তের মত মহামারিতে বিলীন হয়ে যায় জনসংখ্যা। পরিত্যক্ত হয়ে গাছপালা আর পাহাড়ের আড়ালে চাপা পরে যায় ইনকাদের আশ্চর্য স্থাপনা মাচা পিচু। ১৯১১ সালে মার্কিন ইতিহাসবিদ হিরাম বিংগ্নহাম ইনকা সভ্যতার উপর গবেষণা চালাতে গিয়ে বেশ ক’বার এলাকাটিতে জরিপ চালান। এমনই এক আর্কিওলজিক্যাল জরিপে স্থানীয় কুয়্যেচোয়া গোত্রের ১১ বছর বয়সী বালক পাবলিত আলভারেজ হিরামকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় মাচা পিচুর ট্রেইলে। আধুনিক সভ্যতা বিস্ময় এবং হতবাক হয়ে স্বাগত জানায় হিরামের এই আবিষ্কারকে।

চারদিকে হরেক রকম ভাষা আর ক্যামেরার ক্লিক শব্দে নেশা ধরে আসে নিজের অজান্তেই। সরু এবং সংকীর্ণ পথ বেয়ে অনেকে পাহাড়ের চূড়ার দিকে হাঁটছে ইনকা ট্রেইল জয়ের লক্ষ্যে। এমনই এক মিশনে গেল সপ্তাহে দু’জন ইংরেজ পর্বতারোহী পা পিছলে হারিয়ে গেছে পাহাড়ের মৃত্যু খাদে। কোন কিছুই মানুষের অজানাকে জানার আর অচেনাকে চেনার অদম্য বাসনা আটকাতে পারেনা, মৃত্যুভয় জেনেও কিশোর হতে শুরু করে বুড়োর দলও নিজকে সাক্ষী করতে চাইছে সভ্যতার এই মহা-বিস্ময়ের সাথে।

বেলা গড়াতে ঘন মেঘ কুন্ডুলী ক্লান্ত বলাকাদের মত উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে। পাহাড়ের চূড়াগুলো সহসাই মুক্তি পেল মেঘের আগ্রাসন হতে। সাথে সাথে সূর্যের আলো ভাসিয়ে নিলো লোকালয়। কেউ যেন ছবি তোলার প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিল ক্ষণিকের জন্যে। ক্যামেরা ক্লিক ক্লিক শব্দ আর ফ্ল্যাশ লাইটের ঝলকানো আলোতে মায়াবী পরিবেশে হতে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আমাদের নিয়ে এলো জাগতিক পৃথিবীতে। কিছুক্ষণ আগের কনকনে শীত ছাপিয়ে এবার ঝাঁকিয়ে বসলো ভ্যাপসা গরম। ট্যুর গাইডের বিরামহীন বর্ণনা একসময় রাজ্যের বিরক্তির নিয়ে এলো। ভাল লাগছিল না ভাঙ্গা ইংরেজিতে ইনকাদের ইতিহাস। মনে হল যাবার আগে প্রকৃতিকে নিজের মত করে কাছে না পেলে এ যাত্রা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ছিটকে পরলাম গ্রুপ হতে। এবার উঁচুতে উঠার পালা। একটার পর একটা বিপদজনক সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে শেষপর্যন্ত সূর্যঘড়ির চূড়ায় এসে হাঁপিয়ে পরলাম। এটাই ছিল জনবসতির সর্বোচ্চ চূড়া। সামনে, পিছনে, ডানে এবং বায়ে শুধুই মৃত্যুফাঁদ, ভারসাম্যের সামান্য হেরফের হলেই আমার আমিত্বে নামবে অমেঘো পরিণতি, ডেথ উদআউট ট্রেইস!

চোখ চোখ দু’টো বন্ধ করে নিজকে হাল্কা করে নিলাম। পাখীর ডানার মত হাত দু’টো ছড়িয়ে জোড়ে চীৎকার দিতেই সে চীৎকার লক্ষ প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এলো নিজের কাছে। কেন জানি মনে হল আমি এবং আমার ঈশ্বর এখন খুব কাছাকাছি এবং আমার চীৎকার ঈশ্বরের দরবারে পৌছাতে কোন অসুবিধা হচ্ছেনা।

বেলা পরে আসছিল, তাই ফেরার আয়োজন করতে হল। প্রধান ফটক পার হয়ে বাইরে বেরুতেই দেখলাম ২০ডলারের একটা বাফে। ক্ষুধায় পেট উঁচু স্বরে কথা বলতে শুরু করে দিল। খুব রসিক মেজাজে ভূড়িভোজের পর উল্টো পথ ধরলাম। পাহাড় হতে নামতে হবে বাসে চড়ে, তারপর ট্রেন। কুস্‌কো পৌছতে রাত হয়ে যাবে তাতে কোন সন্দেহ রইল না। ট্রেনে বসে হঠাৎ করেই মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। চারদিকের শুনশান নীরবতা দেখতে ভাল লাগছিল না। নিজকে বুঝাতে পারলাম না কেন এই বিষণ্ণতা! তবে কি এতদিনের লালিত স্বপ্ন আর কোনদিন দেখবোনা বলেই এই ভাবাবেগ? পৃথিবীর এই অঞ্চলগুলোতে আর কোনদিন পা ফেলবোনা বলেই হয়ত এ সাময়িক আচ্ছন্নতা। কিন্তু কে জানত দু’বছর পরেই আবার আমাকে আসতে হবে এখানে। মাচু পিচুর পাহাড় এবং মেঘেদের লুকোচুরির কোন এক বাঁকে আমার ভালবাসার মানুষকে আংটি পরিয়ে নিবেদন করব বিয়ে প্রস্তাব! সে অন্য এক কাহিনী, অন্য এক অধ্যায় যার সাথে এ লেখার কোন সম্পর্ক নেই। সময় সুযোগ পেলে তা নিয়েও হয়ত লেখা যাবে।

আন্দিজ পর্বতমালা ৫

হোটেলে ফিরতে রাত দশটা বেজে গেল। রাতের খাবার শেষে সকাল সকাল শুয়ে পরার সিদ্ধান্ত নিলাম। খুব সকালে বাস ধরতে হবে। পরবর্তী ঠিকানা লেক টিটিকাকা, পেরুর সীমান্ত শহর পুনো।

নক্ষত্র মেলায় ডুবে যাওয়া দূরের আকাশটাকে মনে হচ্ছিলো রহস্যময় নারীর তুলতুলে শরীরের মত। জ্বল জ্বল করা তারা গুলো মুচকি হেসে আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল অবৈধ অভিসারে। সেপ্টেম্বরের বসন্তের রাত পৃথিবীর এ অংশটায়। কনকনে শীতের রেশ এখনো প্রকৃতি জুড়ে। আরও একটা কম্বল নিতে হল সূই’এর মত হুল ফোটানো শীত হতে বাচার জন্যে। লেক টিটিকাকায় ছোট্ট একটা ইঞ্জিন বোটের ডেকে শুয়ে দূরের আকাশটা দেখতে দেখতে নিজের ভেতর একধরনের ভোতা অনুভূতির জন্ম নিচ্ছিল। চারদিকের ভৌতিক নীরবতা আর মধ্য গগনের তারাগুলো দারুণ এক কাব্যিক পরিবেশ সৃষ্টি করছিল যদিও। না চাইলেও তার চেহারাটা ঘুরে ফিরে মগজের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল ঝাঁপিত জীবন। ক্লান্ত মনে হল নিজকে।

সূর্য উঠার আগেই ঝটপট নাস্তা সেরে বাস ষ্টেশনে দৌড়াতে হয়েছে পুনো গামী শেষ বাসটা ধরার জন্যে। ১০ ঘণ্টার লম্বা জার্নি। বলিভিয়ার পথে পেরুর শেষ শহর। মাচু পিচু হতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। কুসকোর ঘন কুয়াশায় জার্নির শেষটা ছিল বেশ ভীতিকর। সময় ছিল আমার এক নাম্বার শত্রু। এত অল্প সময়ে এত বড় আয়োজন শরীরে উপর বয়ে দিচ্ছিল কাল বৈশাখী।

সহসাই দিগন্ত রেখায় মিলিয়ে গেল লোকালয়। জানালার ওপাশটায় পাহাড়ের রাজ্য এসে গ্রাস করে নিলো আমাদের চলা। থরে থরে সাজানো আন্দিজের চূড়া গুলো চলন্ত ছবির মত হারিয়ে যাচ্ছিল জানালার ওপাশ দিয়ে। নেশা ধরা প্যানোরমা। আমি যেন শুধু গিলছি আর আন্দিজকে বুকের ভেতর আঁকড়ে ধরছি শক্ত করে। রাজ্যের তন্দ্রা এসে ভর করলো। বাসের কর্কশ ব্রেকে তন্দ্রা টুটে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। দুপুরের খাবার খেতে হবে। ছোট্ট একটা লোকালয়ে আমাদের যাত্রা বিরতি। বাহারি পোশাকের ক’জন এন্ডিয়ান মহিলা গান গেয়ে আমন্ত্রণ জানালো খাবার টেবিলে। হরেক রকম খাবারে ভরা বাফে। জিবে পানি এগে গেল মেনুতে চোখ বুলিয়ে। ক্ষুধার্ত শেয়ালের মত ঝাঁপিয়ে পরলাম প্লেটের উপর। শেষ কবে ভাল খাবার মুখে উঠেছে মনে করতে পারলাম না। টেবিলের আশে পাশে ঘোরাফেরা করছিল একদল আলপাকা, জিরাফের মত উঁচু গলার একধরনের ভেড়া। পর্যটকদের মনোরঞ্জনের খুঁটিনাটি দেখে মুগ্ধ হতে হল। শ্রদ্ধায় মাথা নত করতে ইচ্ছে হল পেরুর মানুষের কাছে। বাস যখন ছাড়বে অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল…দন্ত-বিহীন এবং শীতে তামাটে হয়ে যাওয়া একদল শিশু বিরল প্রজাতির পাহাড়ি ফুল ধরিয়ে দিয়ে বিদায় জানালো আমাদের। আবারও গেয়ে উঠলো এন্ডিয়ান মেয়েগুলো। ধীরে ধীরে বিন্দুর মত ছোট হয়ে পাহাড় রাজ্যে মিলিয়ে গেল জীবনের এই সুন্দর মুহূর্তগুলো। আবারও পথ চলা।

সূর্যের তেজ ধীরে ধীরে পড়ে আসছিল। এনাকন্ডা সাপের মত ঘন কুয়াশা এসে গ্রাস করে নিলো আমাদের বাসটাকে। হঠাৎ করে মনে হল চারদিকে শুধু ঘন অন্ধকার। থেমে গেল আমাদের চলা। ভয় পেয়ে গেলাম। এ লোকালয়ে ডাকাতদের উৎপাতের কথা অনেক উপন্যাসে পড়েছি, ছবিতে দেখেছি। বাসের অন্য যাত্রীদের চোখেও দেখলাম একই ভীতি। হঠাৎ করে আসা সাপটা আবার হঠাৎ করেই আন্দিজের চোরা পথে হারিয়ে গেল। আলো দেখতে পেলাম বিপদজনক বাকে। বাসটা গতি বাড়িয়ে দ্রুত পৌঁছে গেল একটা চূড়ায়। সূর্যাস্ত দেখবো আমারা। বোবা হয়ে গেলাম অবিস্মরণীয় দৃশ্য দেখে। বরফে আচ্ছাদিত চূড়াগুলোর কোলে অসহায়ের মত ঘুমিয়ে পড়ছে শেষ বিকেলের সূর্যটা। রক্তিম আভায় ভেসে যাচ্ছে সাদা পালকের মত বরফগুলো। যুদ্ধে পর্যুদস্ত সৈনিকের মত আত্নসমর্পন করলো এতক্ষণ ধরে রাজত্ব করা পাহাড়ি সূর্যটা। হাল্কা অন্ধকার এসে চাদরের মত ঢেকে দিল চূড়াগুলো। দূরে ভেসে উঠলো টিটিকাকার হ্রদের সমুদ্র সমান চেহারাটা। দৃশ্যপটে টিমটিম করে জ্বলে উঠলো পুনো শহরের নিয়ন বাতিগুলো। এতক্ষণ পর লোকালয়ের গন্ধ পেয়ে মনটা ঝলমল করে উঠলো।

লেক টিটিকাকা, সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ১২,৫০০ ফিট (৩৮০০ মি) উচ্চতায় পৃথিবীর সবচেয়ে চলাচল যোগ্য লেক। বৃষ্টি আর আন্দিজের বরফ গলা পানির ফসল হচ্ছে প্রকৃতির এই নয়নাভিরাম দৃশ্যপট। লেকের অন্য ধারে বলিভিয়া। অনেক পর্যটক এ লেক দিয়ে পাড়ি জমায় আরও উঁচুতে অবস্থিত লা-পাস’এ।

আমার নামের ছোট একটা সাইন নিয়ে মধ্য বয়সী এক মহিলাকে এদিক ওদিক তাকাতে দেখলাম। হাত বাড়িয়ে ইশারা দিতেই নিজের পরিচয় দিল, গাইড। হোটেল বুক করা ছিল লিমা হতেই। ডকুমেন্টের ঝামেলা সেরে রুমে ঢুকতেই রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করলো। বিধ্বস্ত মনে হল নিজকে। এবার বিশ্রামের পালা।

দরজায় নক করে রুমে ঢুকল আমার গাইড। স্তম্ভিত হয়ে গেলাম দুঃসংবাদটা পেয়ে… বলিভিয়ায় সাধারণ ধর্মঘট চলছে গত ৭দিন ধরে। কবে ভাঙ্গবে কেউ জানেনা। আর তাই পুনো হতে ছেড়ে যাওয়া বাস গুলো বসে আছে হাত-পা গুটিয়ে। অংক কষার চেষ্টা করলাম নিউ ইয়র্ক ফিরে যাওয়ার। মেলাতে পারলাম না কোন কিছু। বন্দী হয়ে গেলাম আন্দিজের পাহাড়ি  অনিশ্চয়তার কাছে।

বলিভিয়ায় ৭ দিন ধরে সাধারণ ধর্মঘট চলছে খবরটা নিশ্চয় কুসকো এবং লিমার ট্রাভেল এজেন্টদের জানা ছিল, অথচ টিকেট বিক্রির সময় প্রসঙ্গটা নিয়ে কেউ কথা বলেনি। মনটা খারাপ হয়ে গেল অনিশ্চয়তার গ্যড়াকলে আটকে গিয়ে। হোটেল কাউন্টারে খোজ নিয়ে ধর্মঘটের বিস্তারিত জানার চেষ্টা করলাম। বেশ ক’দিন ধরেই ধর্মঘট চলছে। বলিভিয়া শুধু দক্ষিণ আমেরিকারই নয় বরং পৃথিবীর অন্যতম গরীব দেশ। ক্ষমতা নিয়ে দুটি রাজনৈতিক দল এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে কাড়াকাড়ির ফলে এ দেশটি ইতিমধ্যে সামরিক অভ্যুত্থানে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মর্যাদা লাভ করেছে। দারিদ্র এবং দুর্নীতির ভীত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে কতটা শক্ত মাটির উপর দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের পাশাপাশি বলিভিয়াও তার বাস্তব প্রমাণ। ৯ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশে প্রাকৃতিক সম্পদের কোন কমতি নেই, অথচ দুর্নীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রার মান একেবারেই অমানুষিক। ট্রেড ইউনিয়ন গুলো এ যাত্রায় দু’টো দাবি নিয়ে হরতাল করছে; এক, তেলের দাম কমাতে হবে, দুই, প্রাকৃতিক গ্যাসকে জাতীয়করণ করতে হবে। এ নিয়ে সরকার এবং শ্রমিক সংগঠনগুলো একে অপরের মুখোমুখি দাড়িয়ে, কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজী নয়। দেশটার সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট যাচাই না করে ভ্রমণ করার পরিকল্পনার জন্যে নিজকে ছাড়া অন্য কাউকে দায়ী করতে পারলামনা। হোটেল ম্যানেজার জানাল যেহেতু কাল শনিবার হয়ত ধর্মঘট কিছুটা শিথিল হতে পারে, এবং এমনটা হলে তারা যেভাবেই হোক আমাকে একটা বাসে উঠিয়ে দেবে। কিছুটা আশান্বিত হয়ে রাতের খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে গেলাম।

চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সাথে শক্ত তামাটে পাথরের রাস্তাগুলো হাল্কা নিয়ন আলোতে এক ধরনের রহস্য সৃষ্টি করছে যা হলিউডের ভৌতিক ছায়াছবির কথাই মনে করিয়ে দেয়। প্রচণ্ড শীত। পথচারীদের সবার মুখ বিভিন্ন কারুকার্যের চাদরে ঢাকা। দু’কান ছড়িয়ে দু’দিকের ল্যাজ সহ মাথার টুপি ছোটবেলায় দেখা দক্ষিণ আমেরিকার ছায়াছবির যেন বাস্তব প্রতিফলন। সবকিছু ছাপিয়ে চেহারার যতটুকুই বেরিয়ে আসছে তাতে প্রকৃতির সাথে লড়াই করে বেচে থাকার কঠিন ছাপ। এক টুকরো কাপড়ে সন্তানদের পিঠে ঝুলিয়ে মহিলাদের পথচলা অবচেতন মনে কল্পনা করলে ভ্যান গগের কোন অসমাপ্ত ছবির দৃশ্যপট মনে করিয়ে দেবে। শহরের রাস্তাগুলো সাগরের ঢেউয়ের মত উঁচু নিচু, সাপের মত আঁকাবাঁকা। কিছুদূর হাঁটলেই বুকের বা পাশে দাপাদাপি শুরু হয়। পা জড়িয়ে আসে। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে এত উঁচুতে আছি চাইলেও তা ভুলে যাবার নয়।

দু’তিন ব্লক হাটতেই ’পইয়্যো লা ব্রাসা’ নামের হোটেলটা চোখে পরল। পয়্যো লা ব্রাসা, অর্থাৎ ফ্রাইড চিকেন। দক্ষিণ আমেরিকার দেশে দেশে ফ্রাইড চিকেনের এত কদর চোখে না দেখলে তা বিশ্বাস করা মুস্কিল। সুইং দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই অন্য এক পুনোর চেহারা ফুটে উঠল। গিজ গিজ করছে খদ্দেরের ভিড়ে। ধোয়া এবং ভাজা মুরগীর গন্ধে চারদিক মৌ মৌ করছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই এক তরুণী এগিয়ে এলো। হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাল। সাধারণ মানের হোটেল। চেয়ার-টেবিলে দৈন্যতার ছোঁয়া। কিন্তু চারপাশের মানুষগুলোর খাওয়ার ভেতর কোন ফাঁক ফোকর খুঁজে পেলামনা। ওরা খাচ্ছে আর জীবনকে উপভোগ করছে নিজের মত করে। জোড়া জোড়া তরুণ তরুণী টেবিলে খাবার ভুলে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে একে অপরের দিকে। মা-বাবা সন্তানাদি নিয়ে উপভোগ করছে রাতের খাবার। চারদিকে চ্যাচাম্যাচি হৈ চৈ।

অর্ডার নিতে আগের সে তরুণী এগিয়ে আসতেই দমে গেলাম… কি ভাবে অর্ডার করবো! নিশ্চয় সে ইংরেজি জানেনা আর আমারও স্প্যানিশের দখল যথেষ্ট নয়। সমস্যা হল, পেরুভিয়ানদের অনেকের চেহারাই আমাদের মত, এবং আমাকে তাদেরই একজন ভেবে তরুণী গলগল করে স্প্যানিশ বলে গেল। মুচকি হেসে জবাব দিলাম, ‘ইয়ো ন হাবলা স্প্যনিয়ল‘। চোখ বড় করে হো হো করে হেসে উঠল। আমি স্প্যানিশ জানিনা এমনটা সে মোটেও আশা করেনি। বাঁকা একটা হাসি দিয়ে হারিয়ে গেল খদ্দেরের ভিড়ে। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো ততোধিক সুন্দরী এক তরুণী সাথে নিয়ে। ’ম্যা আই হেল্প ইউ সিনয়্যর?’ হাতে চাঁদ পেলাম যেন। কোয়ার্টার চিকেন, পটেটো ফ্রাই এবং ইন্‌কা কোলার অর্ডার দিয়ে আলাপ শুরু করলাম তরুণীর সাথে। আমি নিউ ইয়র্ক হতে এ অঞ্চলে এসেছি জেনে বিস্ময় প্রকাশ করল, আমার অবস্থা খুলে বলতেই সান্ত্বনা দিতে চাইল। তৈলাক্ত খাবার, বেশী খাওয়া গেলনা। সবশেষে এককাপ ধূমায়িত কফি নিয়ে অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলাম পৃথিবীর এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জীবন। আমাদের জীবন হতে খুব কি একটা তারতম্য? মনে হলনা!
আশাতীত টিপস পেয়ে তরুণীর সাদা চেহারা একেবারে লাল হয়ে গেল। মুচকি হেসে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল… ‘পরের বার আসলে ওয়েন্ডিকে খোজ কর। শুভরাত্রি জানিয়ে আবারও হারিয়ে গেলাম আলো আধারে ভরা ভূতুরে শহরে।

কুয়াশার চাদরে ঢাকা আন্দিজের চূড়াগুলো দিগন্তরেখায় খুঁজে পেতে কষ্ট হল। নিকষ কালো অন্ধকার গ্রাস করে নিয়েছে সবকিছু। রাস্তায় মানুষের সংখ্যাও বিপদজনক ভাবে কমে গেছে। উদ্দেশ্যবিহীন আরও কিছুটা পথ হাটাহাটি করার সিদ্ধান্ত নিলাম। এ ফাকে মনটাও বেশ হাল্কা হয়ে এলো। ক্ষতি কি আগামীকাল যদি বলিভিয়া যাওয়া না হয়! আর সময়মত নিউ ইয়র্ক ফিরে না গেলে চাকরীটা চলে যাবে এইতো! তাতে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে ভেবে পেলামনা। চাকরী আরেকটা খুঁজতে হবে এই যা। মনে মনে ছক আকা শুরু করলাম আগামীকালের। নৌকায় করে লেক টিটিকাকা দিয়ে লা পাস যাওয়ার চিন্তাও মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করল। সত্যি বলতে কি এমন একটা অনিশ্চয়তা হঠাৎ করেই ভাল লাগতে শুরু করল।

শহরে বিদ্যুতের আসা যাওয়া এই প্রথম খেয়াল করলাম। রাস্তার বাতিগুলো নিভে গেল বিনা নোটিশে। ভুতের বিশ্বাস থাকলে হয়ত সামনে যাওয়া হতনা। হঠাৎ করে বাইসাইকেলের আওয়াজে পিলে চমকে উঠল। সামনে একটা কাঁচা বাজারে আলোর দেখা পেয়ে ঢুকে গেলাম। বিক্রেতার দল সাড়ি সাড়ি পণ্য সাজিয়ে বসে আছে শেষ খদ্দেরের আশায়। টিমটিম করে কেরোসিনের কুপি জ্বলছে প্রতিটি দোকানে। বয়সের ভারে নূয্য দোকানীর দল একই সাথে মসলার পাশাপাশি গিনিপিগ এবং শুয়োরের মাংস বিক্রি করছে। উদভ্রান্তের মত হাটাহাটি করলাম কিছুক্ষণ। এমন একটা বাজারের সাথে কেন জানিনা ’৭১’এ দাদাবাড়িতে দেখা কাচা বাজারের মিল খুঁজে পেলাম। দু’টো প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও কোথা যেন যোগসূত্র ছিল। রাত বাড়ছিল দ্রুত, এবার হোটেলে ফিরে যাওয়ার পালা।

লেক টিটিকাকার পাড় ঘিরে হাটাহাটি শেষে হোটেলে ফিরতেই খবরটা পেলাম। খুব ভোরে দু’টো বাস যাচ্ছে লা পাস। আমিও একটা বাসের যাত্রী হতে যাচ্ছি। ভ্রমণটা হবে খুবই রিস্কি। শেষ পর্যন্ত গন্তব্যে পৌছাতে পারব কিনা তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। আমাকে সকাল ৫টার ভেতর তৈরি থাকতে হবে। খবরটা শুনে কেন জানি মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। এতক্ষণ ধরে আকা কল্পনাগুলো শুধু কল্পনা হয়েই থাকবে হয়ত এ জন্যে। এক কাপ ককো টি কোন রকমে গিলে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পরলাম। এবারের যাত্রা কোপাকাবানা হয়ে বলিভিয়ার রাজধানী লা পাস।

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৩
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৪
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৫