সিলেট ভ্রমণ

রাতারগুল বিছানাকান্দি পান্থুমাই | সিলেট ভ্রমণ

বাংলাদেশের জনপ্রিয় ভ্রমণ গন্তব্য হলো সিলেট। মেঘালয়ের পাহাড় বেষ্টিত সিলেটের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে প্রচুর দর্শনীয় স্থান। আজকে আমরা জানবো সিলেট ভ্রমণ এর পর্যটন আকর্ষণ রাতারগুল বিছানাকান্দি ও পান্থুমাই ঝর্ণা ভ্রমণ সম্পর্কে। যেকোনো জায়গা ভ্রমণের ক্ষেত্রে পূর্ণতা আসে সঠিক ট্যুর প্ল্যানে। যে জায়গাটা আপনি রিলাক্সে একদিনে ঘুরতে পারবেন, ভুলভাল ট্যুর প্ল্যান করলে সেটা ঘুরতে দুইদিন লাগে। একদিনে কিভাবে বিছনাকান্দি রাতারগুল এবং পান্তুমাই ঝর্ণা থেকে ঘুরে আসা যায় সে বিষয়টির খুটিনাটি নিয়েই আজকের আলোচনা।

কখন যাবেন

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে এখানে সারা বছরই পর্যটকরা ছুটে আসেন। তবে সিলেট ভ্রমণ এর উপযুক্ত সময় বর্ষাকাল। বর্ষায় মেঘালয় পাহাড় সাজে সবুজের আবরণে। ঝর্ণা ও পাথরের উপত্যকা থাকে পূর্ণ যৌবণা। সব মিলিয়ে এখানকার দর্শনীয় স্থানগুলো যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে উপচে পড়ে! তাই এক কথায় বলা চলে মে থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত সিলেট ভ্রমণের উপযুক্ত সময়।

বিছনাকান্দি

বিছনাকান্দি (Bichanakandi) সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার রুস্তমপুর ইউনিয়নে অবস্থিত৷ ঢাকা থেকে ৩১৫ কিলোমিটার এবং সিলেট থেকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। । বিছানাকান্দির তিনদিকে মেঘালয়ের সুউচ্চ পাহাড়। সেখান থেকে নেমে আসা অসংখ্য ঝর্ণাধারা, আর যতদুর চোখ যায় শুধু পাথরের সমারোহ। ঝর্ণার পানি যখন পাথরের গায়ে ধাক্কা লেগে প্রবাহিত হয়, তখন কলকল শব্দের মোহনীয় আবেশ ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে।

রাতারগুল

রাতারগুল (Ratargul) দেশের সবচেয়ে বড় সোয়াম্প ফরেস্ট। অনেকে রাতারগুলকে বাংলার আমাজন নামে অভিহিত করেন। সিলেট শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে গোয়াইনঘাট উপজেলায় এ বনের অবস্থান। অরণ্যের মধ্যে ঘুরে ঘুরে প্রকৃতির আরো নিকটে যেতে হলে আপনাকে ডিঙি নৌকায় চড়তে হবে। কোনো এক বৃষ্টির দিনে ডিঙি নৌকায় রাতারগুলে ঘুরে বেড়ানোর সময় আপনার মনে হবে চমৎকার এক জলে ভাসা জীবন!

পান্থুমাই ঝর্ণা

পান্তুমাই ঝর্ণা (Panthumai Waterfall) গোয়াইনঘাট উপজেলার পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের একটি গ্রামে অবস্থিত। বিছনাকান্দি থেকে নৌকা নিয়ে যাওয়া যায় এই ঝর্ণার কাছে। তবে ঝর্ণার খুব কাছাকাছি যাওয়া যায় না। ঝর্ণাটি ভারতে অবস্থিত। ভারতে এই ঝর্ণা বোরহিল নামে পরিচিত৷

কিভাবে যাবেন সিলেট

রাতারগুল বিছানাকান্দি পান্থুমাই যেতে হলে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে প্রথমে সিলেট আসতে হবে। ঢাকার সায়েদাবাদ, মহাখালী ও ফকিরাপুল বাসস্ট্যান্ড থেকে নিয়মিত বিরতিতে সিলেটের বাস ছাড়ে। ইউনিক, শ্যামলী, গ্রিন লাইন, সৌদিয়া, এনা পরিবহন ও লন্ডন এক্সপ্রেস সহ দেশের সব বড় কোম্পানির বাস আছে সিলেট রুটে। এই রুটে নন এসি বাসের ভাড়া ৪৫০ থেকে ৪৮০ টাকা। এসি বাস এর ভাড়া ৯০০ থেকে ১২০০ টাকা। বাসে ঢাকা থেকে সিলেট পৌঁছাতে সময় লাগে সাড়ে ৫ থেকে ৭ ঘন্টা।

ঢাকা থেকে ট্রেনে সিলেট

ঢাকা সিলেট রুটে প্রতিদিন ৪টি আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে। কমলাপুর থেকে সকাল ৬:৪০ মিনিটে পারাবত, দুপুর ১২:০০ টায় জয়ন্তিকা, বিকাল ৪:০০টায় কালনী এবং রাত ৯:৫০ মিনিটে উপবন এক্সপ্রেস ছেড়ে যায়। ট্রেনের ভাড়া পড়বে আসনভেদে জনপ্রতি ২৬৫ টাকা থেকে ১১০০ টাকা। ঢাকা থেকে ট্রেনে সিলেট যেতে ৭/৮ ঘন্টা সময় লাগে। সেক্ষেত্রে রাতের উপবন এক্সপ্রেসে যাওয়া সুবিধাজনক। সারারাত জার্নি করে ভোরে সিলেট পৌঁছানো যায়।

চট্টগ্রাম থেকে সিলেট

চট্টগ্রাম থেকে সৌদিয়া, বিআরটিসি ও এনা পরিবহণের সিলেট রুটে বাস রয়েছে। ভাড়া ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা। এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে সোমবার বাদে প্রতিদিন সকাল ৮:১৫ মিনিটে পাহাড়িকা এবং শনিবার বাদে প্রতিদিন রাত ৯:৪৫ মিনিটে উদয়ন এক্সপ্রেস সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ভাড়া সিটের শ্রেণীভেদে ১৪৫ থেকে ১২০০ টাকা। চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে সিলেট যেতে সময় লাগে ৯ থেকে ১১ ঘন্টা।

সিলেট থেকে ট্যুর প্ল্যান

তিনটি স্থান (রাতারগুল বিছানাকান্দি পান্থুমাই) ভ্রমণ করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আপনি সময়টা কিভাবে ব্যবহার করছেন। সময়ের সঠিক ব্যবহারে আপনি খুব ভালো ভাবেই ঘুরতে পারেন একদিনে এই তিনটি জায়গায়। সেক্ষেত্রে সিলেট পৌঁছে হোটেল ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে আপনার দলের সদস্য সংখ্যাভিত্তিতে সিএনজি অথবা লেগুনা বা মাইক্রোবাস রিজার্ভ করে নিতে পারেন। রিজার্ভ সিএনজি ভাড়া নিবে ১৬০০ থেকে ২০০০ টাকা সারাদিনের জন্য। তবে ভাড়া করার সময় অবশ্যই কথা বলে নিবেন যে একসাথে রাতারগুল এবং বিছনাকান্দি এই দুই জায়গা দেখবেন। একইভাবে লেগুনা রিজার্ভ নিলে ভাড়া পড়বে ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকার মধ্যে। সিএনজি বা মাইক্রোবাস রিজার্ভ করতে পারবেন সিলেট শহরের আম্বরখানা পয়েন্টের স্ট্যান্ড থেকে আর লেগুনা রিজার্ভ করতে হবে সোবহানীঘাট পয়েন্ট এর শিশুপার্কের সামনের লেগুনা স্ট্যান্ড থেকে। গাড়ি রিজার্ভ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রওয়ানা দেওয়া ভালো।

এখানে বলে রাখা আপনি দুইভাবে যেতে পারবেন। প্রথমে রাতারগুল পরে বিছনাকান্দি ও পান্তুমাই, কিংবা প্রথমে বিছনাকান্দি ও পান্তুমাই পরবর্তীতে রাতারগুল। ভ্রমণকারীরা সাধারণত প্রথমে রাতারগুল দেখতে চায়। বিকেলটা বিছানাকান্দির স্বচ্চ জলে কাটিয়ে দিবে বলে।

সিলেট থেকে রাতারগুল

সিলেট শহর থেকে রওয়ানা দেওয়ার পর রাতারগুল পৌঁছাতে ১ ঘন্টার একটু বেশি সময় লাগবে। রাতারগুল নৌকাঘাট হচ্ছে তিনটি। মোটরঘাট, মাঝের ঘাট এবং চৌরঙ্গী ঘাট। তিনটি ঘাটের মধ্যে সবচেয়ে শেষের ঘাট চৌরঙ্গী ঘাট। এইখান থেকে  নৌকা ভাড়া তুলনামূলক সস্তা। এক নৌকায় একসাথে ৫ জন উঠা যায়। নৌকাভাড়া ৬০০ থেকে ৭৫০ টাকা। নৌকা দেড় ঘন্টার মত সময় নিয়ে জলাবনে ঘুরাবে। রাতারগুল ঘুরে আবার ঘাটে ফিরে আসুন। এর পরের গন্তব্য বিছানাকান্দি।

বিছানাকান্দি যাওয়ার জন্য গাড়ি নিয়ে চলে আসতে হবে হাদারপাড় বাজার। এখানে নামার পর আপনি নৌকাঘাট পেয়ে যাবেন। তবে হাদারপাড় পৌঁছানোর তিন কিলোমিটার আগে পীরের বাজারেও চাইলে নেমে যেতে পারেন। পীরের বাজারেও বড় একটা নৌকাঘাট আছে। চাইলে এখান থেকেও আপনি নৌকা নিয়ে বিছনাকান্দি যেতে পারবেন। রাতারগুল থেকে হাঁদারপাড় যেতে দুই ঘন্টা সময় লাগে।

হাদারপাড় বা পীরের বাজার ঘাট থেকে রিজার্ভ নৌকাভাড়া স্থানীয় চেয়ারম্যান এবং ট্যুরিস্ট পুলিশ কর্তৃক নির্ধারিত ১৫৫০ টাকা। এক নৌকায় যেতে পারবেন ১০ জন। মাঝির সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে ১২ জন পর্যন্ত বসতে পারবেন। ইঞ্জিনচালিত এসব নৌকায় বিছনাকান্দি যেতে সময় লাগবে প্রায় ৪০ মিনিট।

বিছানাকান্দিতে ৪০ মিনিট সময় কাটিয়ে নৌকা নিয়ে চলে যান পান্থুমাই এর উদ্দেশ্যে। বিছানাকান্দিতে এর বেশি সময় দিলে পান্থুমাই ভ্রমণের সময় থাকবেনা হাতে। বিছানাকান্দি থেকে পান্থুমাই যেতে নৌকায় ১ ঘন্টা সময় লাগবে।

রাতারগুল
রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট

কোথায় থাকবেন

আম্বরখানা, দরগাহ গেইট, জিন্দাবাজার এসব এলাকায় অনেক হোটেল পাওয়া যাবে। এর মধ্যে হোটেল পলাশ ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল হিল টাউন, হোটেল ব্রিটানিয়া, হোটেল সুপ্রিম, হোটেল ডালাস ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এগুলো জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট হোটেল। এখানে ক্যাটাগরি ভেদে ১২০০ থেকে ৩০০০ টাকার মধ্যে রুম পাওয়া যাবে।

বিলাসবহুল হোটেলের মধ্যে রয়েছে হোটেল রোজ ভিউ কমপ্লেক্স, হোটেল নির্ভানা ইন, হোটেল গ্র‍্যান্ড প্যালেস, হোটেল নূরজাহান ইত্যাদি। রুম ভাড়া ৪৫০০ থেকে ১২০০০ টাকার মধ্যে। সিজন অনুযায়ী রুম ভাড়ায় তারতম্য হয়।

একদম সস্তার মধ্যে সিলেট ভ্রমণ এর সময় থাকতে চাইলে দরগাহ গেইট এলাকায় অনেকগুলো হোটেল রয়েছে। আপনার পছন্দমতো হোটেল নিতে পারবেন ওখান থেকে।

কি খাবেন কোথায় খাবেন

বিছনাকান্দিতে দুটি ভাসমান রেস্টুরেন্ট রয়েছে। চাইলে ওখানে দুপুরের খাবার খেতে পারেন। খরচ পড়বে জনপ্রতি ১২০ থেকে ২০০ টাকা। মুরগীর মাংস, গরুর মাংস, মাছ, ভর্তা ইত্যাদি মেনু পাওয়া যাবে এখানে। হাদারপাড় বাজারেও কিছু খাবার দোকান আছে। বেশিরভাগ দোকানেই খিচুড়ি হয় বেশি। দাম পড়বে ৫০-১০০ টাকার মধ্যে।

এছাড়া সিলেট শহরে অনেকগুলো বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট আছে। পাঁচ ভাই, পানসী, ভোজন বাড়ি, পালকি, এগুলো সবচেয়ে জনপ্রিয়। বিভিন্ন প্রকার ভর্তার সাথে আপনার পছন্দ মতো মেনু পাবেন এখানে। খরচ হবে জনপ্রতি ১০০-২৫০ টাকার মতন। এই রেস্টুরেন্টগুলোতে ২৯ রকমের ভর্তা আছে! চাইলে সকালের নাস্তাও এইসব রেস্টুরেন্টে সেরে নিতে পারবেন।

ভ্রমণ টিপস ও সতর্কতা

*নৌকা ও সিএনজি রিজার্ভের সময় ভালোভাবে দরদাম করে নিবেন।
*সাতার না জানলে বেশি পানিতে নামা থেকে বিরত থাকুন।
* বর্ষাকালে পানির প্রবাহ বেশি থাকায় সাঁতার জানলেও গভীর পানিতে না নামাই নিরাপদ।
* দলগতভাবে ভ্রমণ করুন, এতে খরচ অনেকাংশে কম হবে।
*বিছনাকান্দিতে প্রচুর পাথর, হাটাচলার সময় তাই একটু সাবধানে থাকতে হবে। পিচ্ছিল পাথরে যেকোন সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
* স্থানীয়দের সাথে বিনয়ী থাকুন।
* চেষ্টা করবেন সময়ের ব্যাপারে সচেতন থাকার
*পান্তুমাই ঝর্ণার বেশি কাছে যাবেন না। সীমান্ত এলাকায় যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা শ্রেয়।
* রাতারগুলে বর্ষায় বিভিন্ন প্রজাতির সাপ গাছে গাছে ঘুরে বেড়ায়। তাই গাছে হাত দেওয়া কিংবা চড়ে বসা থেকে বিরত থাকুন।
* পরিবেশ এবং প্রকৃতির ক্ষতি হয় এমন কিছু করবেন না।

অনেকেই ঝামেলা এড়ানোর জন্য ট্রাভেল এজেন্সির সাথে ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন। তারা দেশের সবচেয়ে ফিমেইল ফ্রেন্ডলি ট্যুর অর্গানাইজার গ্রিন বেল্ট এর এক্সক্লুসিভ সিলেট ট্যুর প্যাকেজটি দেখতে পারেন।

আশেপাশের দর্শনীয় স্থান

সিলেটে রয়েছে অনেকগুলো দর্শনীয় স্থান। এর মধ্যে গোয়াইনঘাটের জাফলং সবচেয়ে জনপ্রিয়। এছাড়া জাফলংয়ের কাছে রয়েছে সংগ্রামপুঞ্জী মায়ারী ঝর্ণা। যেটি পিয়াইন নদী পার হয়ে ১৫ কিঃমিঃ হাঁটলেই পাওয়া যাবে। এটি মূলত ভারতের অংশে পড়েছে। তবে নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত যেতে পারবেন। অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে খাসিয়া পুঞ্জি, তামাবিল জিরো পয়েন্ট এবং লালাখাল। এছাড়া আছে সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা, বিছানাকান্দির কাছে পান্থুমাই ঝর্ণা। সারি নদীর লালাখাল, কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর

আরো পড়ুন

 

 

Exit mobile version