রাতারগুল

রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট

রাতারগুল

রাতারগুল দেশের সবচেয়ে বড় সোয়াম্প ফরেস্ট (Ratargul Swamp Forest)। ক্লান্তিকর ব্যস্ততা থেকে খানিক অবকাশে ঘুরে বেড়ানোর জন্য এটি সিলেটের অসাধারণ একটি জায়গা। অনেকে রাতারগুলকে বাংলার আমাজন নামে অভিহিত করেন। সিলেট শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে গোয়াইনঘাট উপজেলায় এ বনের অবস্থান। অরণ্যের মধ্যে ঘুরে ঘুরে প্রকৃতির আরো নিকটে যেতে হলে আপনাকে ডিঙি নৌকায় চড়তে হবে। কোনো এক বৃষ্টির দিনে ডিঙি নৌকায় রাতারগুলে ঘুরে বেড়ানোর সময় আপনার মনে হবে চমৎকার এক জলে ভাসা জীবন!

প্রাণী বৈচিত্রে ভরপুর এই বনে রয়েছে নানান প্রজাতির পাখি। এর মধ্যে মাছরাঙা, বিভিন্ন প্রজাতির বক, ঘুঘু, ফিঙে, বালিহাঁস, পানকৌড়ি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বন্যপ্রাণীর মধ্যে আছে— বানর, উদবিড়াল, কাঠবেড়ালি, মেছোবাঘ ইত্যাদি। এছাড়া বিভিন্ন প্রজাতির সাপ ও গুঁইসাপের অভায়শ্রম এই বন।এখানে  ডালে ডালে বিচরণ নানা প্রজাতির পাখি আর বানরের। ভেতরের দিকে কিছু জায়গায় জঙ্গলের গভীরতা এত বেশি যে, সূর্যের আলো গাছের পাতা ভেদ করে জল ছুঁতে পারে না।

কখন রাতাগুল যাবেন

সৌন্দর্যের টানে এখানে কমবেশি সারাবছরই ভ্রমণপিপাসুরা ঘুরতে আসেন। তবে রাতারগুলের প্রকৃত সৌন্দর্যের দেখা মেলে বর্ষাকালে। তখন গাছগুলোর অর্ধেক পানিতে ডুবে থাকে বলে এক মোহনীয় রূপের সৃষ্টি হয়। তাই এককথায় বলা চলে মে থেকে নভেম্বরের শুরু পর্যন্ত রাতারগুল ভ্রমণের উপযুক্ত সময়।

কিভাবে রাতারগুল যাবেন

রাতারগুল যেতে হলে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে আপনাকে প্রথমে সিলেট আসতে হবে। ঢাকার সায়েদাবাদ, মহাখালী ও ফকিরাপুল বাসস্ট্যান্ড থেকে নিয়মিত বিরতিতে সিলেটের বাস ছাড়ে। ইউনিক, শ্যামলী, গ্রিন লাইন, সৌদিয়া, এনা পরিবহন ও লন্ডন এক্সপ্রেস সহ দেশের সব বড় কোম্পানির সিলেট রুটে বাস আছে । এই রুটে নন এসি বাসের ভাড়া ৪৫০ থেকে ৪৮০ টাকা। এসি বাস এর ভাড়া ৯০০ থেকে ১২০০ টাকা। বাসে ঢাকা থেকে সিলেট পৌঁছাতে সময় লাগে সাড়ে ৫ থেকে ৭ ঘন্টা।

ঢাকা থেকে ট্রেনে সিলেট

ঢাকা সিলেট রুটে প্রতিদিন ৪টি আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে। কমলাপুর থেকে সকাল ৬:৪০ মিনিটে পারাবত, দুপুর ১২:০০ টায় জয়ন্তিকা, বিকাল ৪:০০টায় কালনী এবং রাত ৯:৫০ মিনিটে উপবন এক্সপ্রেস ছেড়ে যায়। আপনি ট্রেনে উঠতে পারবেন ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশন থেকেও। ট্রেনের ভাড়া পড়বে আসনভেদে জনপ্রতি ২৬৫ টাকা থেকে ১১০০ টাকা। ঢাকা থেকে ট্রেনে সিলেট যেতে ৭/৮ ঘন্টা সময় লাগে। সেক্ষেত্রে রাতের উপবন এক্সপ্রেসে যাওয়া সুবিধাজনক। সারারাত জার্নি করে ভোরে সিলেট পৌঁছানো যায়।

চট্টগ্রাম থেকে সিলেট

চট্টগ্রাম থেকে সৌদিয়া, বিআরটিসি ও এনা পরিবহণের সিলেট রুটে বাস রয়েছে। ভাড়া ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা। এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে সোমবার বাদে প্রতিদিন সকাল ৮:১৫ মিনিটে পাহাড়িকা এবং শনিবার বাদে প্রতিদিন রাত ৯:৪৫ মিনিটে উদয়ন এক্সপ্রেস সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ভাড়া সিটের শ্রেণীভেদে ১৪৫ থেকে ১২০০ টাকা। চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে সিলেট যেতে সময় লাগে ৯ থেকে ১১ ঘন্টা।

সিলেট থেকে রাতারগুল

রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট যেতে হলে সর্বপ্রথম আপনাকে সিলেট নগরীর আম্বরখানা পয়েন্ট যেতে হবে। সেখানে বিমানবন্দর রোডের মুখে সিএনজি স্টেশন রয়েছে। এই স্টেশন থেকে লোকাল সিএনজি যায় রাতারগুল বাজার পর্যন্ত। ভাড়া জনপ্রতি ৬০-৮০ টাকা। চাইলে আপনি পুরো সিএনজি রিজার্ভ নিতে পারবেন। সেক্ষেত্রে মাথাপিছু ৫ জন হিসাব করে যে ভাড়া আসবে তারচেয়ে খানিক বেশি দেওয়া লাগতে পারে। সময় লাগবে একঘন্টার একটু বেশি।

লোকাল সিএনজিতে এলে রাতারগুল বাজারে নামিয়ে দিবে। সেখান থেকে আপনাকে যেতে হবে রাতারগুল নৌকা ঘাটে। বাজার থেকে ঘাট পর্যন্ত আপনি ব্যাটারি চালিত অটোরিক্সা রিজার্ভ নিতে পারবেন। ভাড়া নিবে সর্বোচ্চ ৫০ টাকা। এছাড়া সিলেট থেকে সিএনজি, লেগুনা ও মাইক্রোবাস রিজার্ভ নিলে সরাসরি ঘাট পর্যন্ত যায়।

রাতারগুল নৌকাঘাট হচ্ছে তিনটি। মোটরঘাট, মাঝের ঘাট এবং চৌরঙ্গী ঘাট। তিনটি ঘাটের মধ্যে সবচেয়ে শেষের ঘাট চৌরঙ্গী ঘাট। এইখান থেকে নৌকা ভাড়া তুলনামূলক সস্তা। এক নৌকায় একসাথে ৫ জন উঠা যায়। নৌকাভাড়া ৬০০ থেকে ৭৫০ টাকা। নৌকা দেড় ঘন্টার মত সময় নিয়ে জলাবনে ঘুরাবে।

সিলেটে কোথায় থাকবেন

রাতারগুল ভ্রমণের জন্য সিলেট শহরকে আপনার কেন্দ্রস্থল বিবেচনা করতে হবে। সিলেট শহরে প্রচুর হোটেল রয়েছে। আম্বরখানা, দরগাহ গেইট, জিন্দাবাজার এসব এলাকায় অনেক হোটেল পাওয়া যাবে। এর মধ্যে হোটেল পলাশ ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল হিল টাউন, হোটেল ব্রিটানিয়া, হোটেল সুপ্রিম, হোটেল ডালাস ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এগুলো জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট হোটেল। এখানে ক্যাটাগরি ভেদে ১২০০ থেকে ৩০০০ টাকার মধ্যে রুম পাওয়া যাবে।

বিলাসবহুল হোটেলের মধ্যে রয়েছে হোটেল রোজ ভিউ কমপ্লেক্স, হোটেল নির্ভানা ইন, হোটেল গ্র‍্যান্ড প্যালেস, হোটেল নূরজাহান ইত্যাদি। রুম ভাড়া ৪৫০০ থেকে ১২০০০ টাকার মধ্যে। সিজন অনুযায়ী রুম ভাড়ায় তারতম্য হয়।

একদম সস্তার মধ্যে সিলেটের দরগাহ গেইট এলাকায় অনেকগুলো হোটেল রয়েছে। আপনার সাধ্যমতো হোটেল ভাড়া করতে পারবেন ওখান থেকে।

কি খাবেন কোথায় খাবেন

রাতারগুলে দুপুরে খাবার মতো কোনো রেস্টুরেন্ট নেই। যারা রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট থেকে বিছানাকান্দি যাবেন, তারা বিছানাকান্দিতে লাঞ্চ করতে পারবেন। অন্যথায় খাবারের প্ল্যান সিলেট শহরে রাখাই ভালো। সিলেটে অনেকগুলো বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট আছে। পাঁচ ভাই, পানসী, ভোজন বাড়ি, পালকি, এগুলো সবচেয়ে জনপ্রিয়। বিভিন্ন প্রকার ভর্তার সাথে আপনার পছন্দ মতো মেনু পাবেন এখানে। খরচ হবে জনপ্রতি ১২০ থেকে ২৫০ টাকার মতন। এই রেস্টুরেন্টগুলোতে ২৯ রকমের ভর্তা আছে! চাইলে সকালের নাস্তাও এইসব রেস্টুরেন্টে সেরে নিতে পারবেন।

সাবধানতা ও টিপস

রাতারগুল বেড়ানোর উপযুক্ত সময় বর্ষাকাল। তখন বনের চারিদিকে জলে পূর্ণ থাকে বলে ভ্রমণকালীন সময় কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। বর্ষায় বন ডুবে গেলে বেশিরভাগ সাপ আশ্রয় নেয় গাছের ডাল কিংবা শুকনো অংশে। তাই চারপাশ খেয়াল করে চলতে হবে। এ ছাড়া এ সময় জোঁকেরও উপদ্রব আছে। সাঁতার না জানলে সঙ্গে লাইফ জ্যাকেট রাখা জরুরি। এ ছাড়া ছাতা সাথে রাখা ভালো। যেকোনোসময় যেকোথাও ভ্রমণের সময় একটা ব্যাপার মাথায় রাখবেন, কোনো অবস্থাতেই স্থানীয়দের সাথে খারাপ আচরণ করা যাবেনা। পৃথিবীর যে প্রান্তেই ভ্রমণ করুন – স্থানীয়দের প্রতি বিনয়ী থাকুন।

অনেকেই ঝামেলা এড়ানোর জন্য ট্রাভেল এজেন্সির সাথে ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন। তারা দেশের সবচেয়ে ফিমেইল ফ্রেন্ডলি ট্যুর অর্গানাইজার গ্রিন বেল্ট এর এক্সক্লুসিভ সিলেট ট্যুর প্যাকেজটি দেখতে পারেন।

আশেপাশের দর্শনীয় স্থান

সিলেটে রয়েছে অনেকগুলো দর্শনীয় স্থান। এর মধ্যে গোয়াইনঘাটের জাফলং সবচেয়ে জনপ্রিয়। এছাড়া জাফলংয়ের কাছে রয়েছে সংগ্রামপুঞ্জী মায়ারী ঝর্ণা। যেটি পিয়াইন নদী পার হয়ে ১৫ কিঃমিঃ হাঁটলেই পাওয়া যাবে। এটি মূলত ভারতের অংশে পড়েছে। তবে নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত যেতে পারবেন। অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে খাসিয়া পুঞ্জি, তামাবিল জিরো পয়েন্ট এবং লালাখাল। এছাড়া আছে সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা, বিছানাকান্দির কাছে পান্থুমাই ঝর্ণা। সারি নদীর লালাখাল,  গোয়াইনঘাটের জাফলং, কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর। এছাড়া যেতে পারেন গোয়াইনঘাট এর বিছানাকান্দি

আরো পড়ুন