বিছনাকান্দি (Bisnakandi) সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় অবস্থিত। ঢাকা থেকে ৩১৫ কিলোমিটার এবং সিলেট থেকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। । বিছানাকান্দির তিনদিকে মেঘালয়ের সুউচ্চ পাহাড়। সেখান থেকে নেমে আসা অসংখ্য ঝর্ণাধারা, আর যতদুর চোখ যায় শুধু পাথরের সমারোহ। ঝর্ণার পানি যখন পাথরের গায়ে ধাক্কা লেগে প্রবাহিত হয়, তখন কলকল শব্দের মোহনীয় আবেশ ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। সেই পাথুরে জলে পা ডুবিয়ে আপনার নিজেকে মনে হবে পৃথিবীর সুখীতম মানব! যেন আকাশের গায়ে পাহাড় হেলান দিয়ে আছে, আর তার পায়ের কাছে আপনি আছেন পাথরের বিছানায়। পড়ুন বিছানাকান্দি ভ্রমণ এর বিস্তারিত গাইডলাইন।
বিছানাকান্দি ভ্রমণের উপযুক্ত সময়
সিলেটকে বলা যায় সৌন্দর্যের রাণী। প্রকৃতির অমোঘ টানে সারা বছরই পর্যটকরা বিছানাকান্দি ভ্রমণ এ ছুটে আসেন। তবে এর প্রকৃত রূপ দেখা যায় বর্ষায়। তখন বিছানাকান্দিতে মেঘ ভেসে বেড়ায় যখন তখন। পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা মেঘ আর পূর্ণযৌবনা ঝর্ণাধারার জলে ডুবে থাকা পাথরগুলো এখানে অপার্থিব সৌন্দর্যের জন্ম দেয়। তাই এক কথায় বলা যায় মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিছানাকান্দি ভ্রমণ এর ভালো সময়।
কিভাবে বিছানাকান্দি যাবেন
বিছানাকান্দি যেতে হলে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে প্রথমে সিলেট আসতে হবে। ঢাকার সায়েদাবাদ, মহাখালী ও ফকিরাপুল বাসস্ট্যান্ড থেকে নিয়মিত বিরতিতে সিলেটের বাস ছাড়ে। ইউনিক, শ্যামলী, গ্রিন লাইন, সৌদিয়া, এনা পরিবহন ও লন্ডন এক্সপ্রেস সহ দেশের সব বড় কোম্পানির বাস আছে সিলেট রুটে। এই রুটে নন এসি বাসের ভাড়া ৪৫০ থেকে ৪৮০ টাকা। এসি বাস এর ভাড়া ৯০০ থেকে ১২০০ টাকা। বাসে ঢাকা থেকে সিলেট পৌঁছাতে সময় লাগে সাড়ে ৫ থেকে ৭ ঘন্টা।
ঢাকা থেকে ট্রেনে সিলেট
ঢাকা সিলেট রুটে প্রতিদিন ৪টি আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে। কমলাপুর থেকে সকাল ৬:৪০ মিনিটে পারাবত, দুপুর ১২:০০ টায় জয়ন্তিকা, বিকাল ৪:০০টায় কালনী এবং রাত ৯:৫০ মিনিটে উপবন এক্সপ্রেস ছেড়ে যায়। ট্রেনের ভাড়া পড়বে আসনভেদে জনপ্রতি ২৬৫ টাকা থেকে ১১০০ টাকা। ঢাকা থেকে ট্রেনে সিলেট যেতে ৭/৮ ঘন্টা সময় লাগে। সেক্ষেত্রে রাতের উপবন এক্সপ্রেসে যাওয়া সুবিধাজনক। সারারাত জার্নি করে ভোরে সিলেট পৌঁছানো যায়।
চট্টগ্রাম থেকে সিলেট
চট্টগ্রাম থেকে সৌদিয়া, বিআরটিসি ও এনা পরিবহণের সিলেট রুটে বাস রয়েছে। ভাড়া ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা। এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে সোমবার বাদে প্রতিদিন সকাল ৮:১৫ মিনিটে পাহাড়িকা এবং শনিবার বাদে প্রতিদিন রাত ৯:৪৫ মিনিটে উদয়ন এক্সপ্রেস সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ভাড়া সিটের শ্রেণীভেদে ১৪৫ থেকে ১২০০ টাকা। চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে সিলেট যেতে সময় লাগে ৯ থেকে ১১ ঘন্টা।
সিলেট থেকে বিছনাকান্দি
বিছনাকান্দি যেতে হলে সর্বপ্রথম আপনাকে সিলেট নগরীর আম্বরখানা পয়েন্ট যেতে হবে। সেখানে বিমানবন্দর রোডের মুখে সিএনজি স্টেশন রয়েছে। এই স্টেশন থেকে লোকাল সিএনজি যায় হাদারপাড় বাজার পর্যন্ত। ভাড়া জনপ্রতি ১০০-১২০ টাকা। চাইলে আপনি পুরো সিএনজি রিজার্ভ নিতে পারবেন। সেক্ষেত্রে মাথাপিছু পাঁচজন হিসাব করে যে ভাড়া আসবে তারচেয়ে খানিক বেশি দেওয়া লাগতে পারে। রিজার্ভ নিতে চাইলে সিএনজি ছাড়াও লেগুনা ও মাইক্রোবাস ভাড়া পাবেন। হাদারপাড় বাজারে নামার পর আপনি নৌকাঘাট পেয়ে যাবেন। তবে হাদারপাড় যাওয়ার তিন কিলোমিটার আগে পীরের বাজারেও চাইলে নেমে যেতে পারেন। এখানে অনেক নৌকা নিয়ে বড় একটা নৌকাঘাট আছে। চাইলে এখান থেকেও আপনি নৌকা নিয়ে বিছনাকান্দি যেতে পারবেন। সিলেট শহর থেকে হাঁদারপাড় যেতে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা সময় লাগে। ফিরতেও একই সময় লাগবে। তাই ট্যুর প্ল্যান করার সময় যাওয়া আসার দীর্ঘ সময়টি হিসেবের মধ্যে রাখুন।
বিছানাকান্দির নৌকা ভাড়া
হাদারপাড় বা পীরের বাজার ঘাট থেকে রিজার্ভ নৌকাভাড়া স্থানীয় চেয়ারম্যান এবং ট্যুরিস্ট পুলিশ কর্তৃক নির্ধারিত ১৫৫০ টাকা। এক নৌকায় যেতে পারবেন ১০ জন। মাঝির সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে ১২ জন পর্যন্ত বসতে পারবেন। ইঞ্জিনচালিত এসব নৌকায় বিছনাকান্দি যেতে সময় লাগবে প্রায় ৪০ মিনিট। বিছনাকান্দি ঘুরে এসে একইভাবে আপনি সিলেট ফিরতে পারেন হাদারপাড় কিংবা পীরের বাজার থেকে সিএনজি নিয়ে।
সিলেটে কোথায় থাকবেন
বিছানাকান্দি ভ্রমণ এর জন্য সিলেট শহরকে আপনার কেন্দ্রস্থল বিবেচনা করতে হবে। সিলেট শহরে প্রচুর হোটেল রয়েছে। আম্বরখানা, দরগাহ গেইট, জিন্দাবাজার এসব এলাকায় অনেক হোটেল পাওয়া যাবে। এর মধ্যে হোটেল পলাশ ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল হিল টাউন, হোটেল ব্রিটানিয়া, হোটেল সুপ্রিম, হোটেল ডালাস ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এগুলো জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট হোটেল। এখানে ক্যাটাগরি ভেদে ১২০০ থেকে ৩০০০ টাকার মধ্যে রুম পাওয়া যাবে।
বিলাসবহুল হোটেলের মধ্যে রয়েছে হোটেল রোজ ভিউ কমপ্লেক্স, হোটেল নির্ভানা ইন, হোটেল গ্র্যান্ড প্যালেস, হোটেল নূরজাহান ইত্যাদি। রুম ভাড়া ৪৫০০ থেকে ১২০০০ টাকার মধ্যে। সিজন অনুযায়ী রুম ভাড়ায় তারতম্য হয়।
একদম সস্তার মধ্যে সিলেটের দরগাহ গেইট এলাকায় অনেকগুলো হোটেল রয়েছে। আপনার সাধ্যমতন হোটেল ভাড়া করতে পারবেন ওখান থেকে।
কি খাবেন কোথায় খাবেন
বিছনাকান্দিতে দুটি ভাসমান রেস্টুরেন্ট রয়েছে। চাইলে ওখানে দুপুরের খাবার খেতে পারেন। খরচ পড়বে জনপ্রতি ১২০ থেকে ২০০ টাকা। মুরগীর মাংস, গরুর মাংস, মাছ, ভর্তা ইত্যাদি মেনু পাওয়া যাবে এখানে। হাদারপাড় বাজারেও কিছু খাবার দোকান আছে। বেশিরভাগ দোকানেই খিচুড়ি হয় বেশি। দাম পড়বে ৫০-১০০ টাকার মধ্যে।
এছাড়া সিলেট শহরে অনেকগুলো বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট আছে। পাঁচ ভাই, পানসী, ভোজন বাড়ি, পালকি, এগুলো সবচেয়ে জনপ্রিয়। বিভিন্ন প্রকার ভর্তার সাথে আপনার পছন্দ মতো মেনু পাবেন এখানে। খরচ হবে জনপ্রতি ১০০-২৫০ টাকার মতন। এই রেস্টুরেন্টগুলোতে ২৯ রকমের ভর্তা আছে! চাইলে সকালের নাস্তাও এইসব রেস্টুরেন্টে সেরে নিতে পারবেন।
বিছনাকান্দি ভ্রমণ টিপস ও সতর্কতা
*নৌকা ও সিএনজি রিজার্ভের সময় ভালোভাবে দরদাম করে নিবেন।
*সাতার না জানলে বেশি পানিতে নামা থেকে বিরত থাকুন।
* বর্ষাকালে পানির প্রবাহ বেশি থাকায় সাঁতার জানলেও গভীর পানিতে না নামাই নিরাপদ।
* দলগতভাবে ভ্রমণ করুন, এতে খরচ অনেকাংশে কম হবে।
*বিছনাকান্দিতে প্রচুর পাথর, হাটাচলার সময় তাই একটু সাবধানে থাকতে হবে। পিচ্ছিল পাথরে যেকোন সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
* স্থানীয়দের সাথে বিনয়ী থাকুন।
* চেষ্টা করবেন সন্ধ্যার আগে সিলেট ফিরে আসার।
*চাইলে একইদিনে রাতারগুল এবং বিছনাকান্দি ভ্রমণ করতে পারবেন।
* পরিবেশ এবং প্রকৃতির ক্ষতি হয় এমন কিছু করবেন না।
অনেকেই ঝামেলা এড়ানোর জন্য ট্রাভেল এজেন্সির সাথে ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন। তারা দেশের সবচেয়ে ফিমেইল ফ্রেন্ডলি ট্যুর অর্গানাইজার গ্রিন বেল্ট এর এক্সক্লুসিভ সিলেট ট্যুর প্যাকেজটি দেখতে পারেন।
আশেপাশের দর্শনীয় স্থান
সিলেটে রয়েছে অনেকগুলো দর্শনীয় স্থান। এর মধ্যে গোয়াইনঘাটের জাফলং সবচেয়ে জনপ্রিয়। এছাড়া জাফলংয়ের কাছে রয়েছে সংগ্রামপুঞ্জী মায়ারী ঝর্ণা। যেটি পিয়াইন নদী পার হয়ে ১৫ কিঃমিঃ হাঁটলেই পাওয়া যাবে। এটি মূলত ভারতের অংশে পড়েছে। তবে নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত যেতে পারবেন। অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে খাসিয়া পুঞ্জি, তামাবিল জিরো পয়েন্ট এবং লালাখাল। এছাড়া আছে সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা, বিছানাকান্দির কাছে পান্থুমাই ঝর্ণা। সারি নদীর লালাখাল, গোয়াইনঘাটের জাফলং, কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর। এছাড়া যেতে পারেন রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট।
আরো পড়ুন