বগালেক

ছবি : সুমাইয়া জাহান

বগালেক

বগালেক বান্দরবানের রুমা উপজেলার কেওক্রাডং পাহাড় রেঞ্জে অবস্থিত একটি লেক। বান্দরবান সদর থেকে প্রায় ৭০ কিঃমিঃ ও রুমা উপজেলা থেকে ১৭ কিঃমিঃ দূরত্বে এর অবস্থান। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২৪০০ ফিট উচ্চতার এই লেক ভূতত্ত্ববিদদের মতে প্রায় ২ হাজার বছর আগে উল্কাপিন্ডের পতনে প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্টি হয়। অনেকের মতে এটি মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামূখ। এটি ড্রাগন লেক ও বগাকাইন লেক নামেও পরিচিত।

দীর্ঘ ভ্রমণ ক্লান্তি শেষে এই লেকের সামনে আসার পর আপনি যাত্রাপথের সমস্ত কষ্ট ভুলে যাবেন। বগালেক ও তার আশেপাশের মোহময়ী প্রকৃতি এক নিমেষে আপনার মন ভালো করে দিবে। দিনের একেক সময় এখানে প্রকৃতি একেক রূপ ধারণ করে। সন্ধ্যার পর আপনার সামনে খুলে যাবে আকাশ ভরা নক্ষত্রের ডালি। দূষণমুক্ত পরিবেশ ও ভৌগলিক অবস্থানের কারণে প্রতিদিনই এখানে আকাশে তারার দেখা মেলে। আর কোনো এক জোছনা রাত যদি আপনি বগালেকে কাটাতে পারেন, সেটা আপনার জীবনের উল্লেখযোগ্য স্মৃতি হিসেবে থেকে যাবে। চাঁদের আলো যখন লেকের পনিতে ঢেউ খেলে, পাহাড়ি নিস্তব্ধ পরিবেশ তখন মোহনীয় রূপ ধারণ করে। চলুন জেনে নিই বগালেক ভ্রমণ এর বিস্তারিত।

বগালেক ভ্রমণ এর উপযুক্ত সময়

সৌন্দর্যের টানা বছরজুড়ে এখানে প্রকৃতিপ্রেমীরা ছুটে আসে। তবে বর্ষায় রুমাগামী জিপ প্রায়ই কাইক্ষংঝির পর্যন্ত যায়, এরপর ইঞ্জিন নৌকায় ১ঘন্টার বেশি পথ পড়ি দিয়ে রুমাবাজার পৌঁছাতে হয়। রুমা বাজার থেকে বগালেকের রাস্তা ভাঙাচোরা হওয়ায় যাতায়াত ব্যবস্থার অসুবিধা হয়। এটা পুরোটাই হাঁটতে হয়। তাই নিতান্তই এডভেঞ্চারপ্রেমী না হলে শীতকালেই বগালেক যাওয়াকে সাজেস্ট করেন ভ্রমনকারীরা। অর্থাৎ বলা চলে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বগালেক ভ্রমণের উপযুক্ত সময়।

কিভাবে বগালেক যাবেন

বগালেক যেতে হলে প্রথমে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে আপনাকে বান্দরবান আসতে হবে। ঢাকা থেকে এসি – নন এসি সব ধরণের বাসই বান্দরবান যায়। নন এসির মধ্যে শ্যামলী, সৌদিয়া, ইউনিক, ডলফিন, সেন্টমার্টিন, এস আলম ইত্যাদি পরিবহনের বাস পাবেন। বাস ছাড়ে কলাবাগান, ফকিরাপুল ও সায়েদাবাদ থেকে। রাত এগারোটার মধ্যে লাস্ট বাস ছেড়ে যায়। ভাড়া ৫৮০ থেকে ৬২০ টাকা। এসি বাসের ভাড়া ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে।

ট্রেনে যেতে চাইলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী যেকোনো ট্রেনে উঠতে হবে। সোনার বাংলা এক্সপ্রেস, সূবর্ণ এক্সপ্রেস, তূর্ণা নিশীথা, মহানগর প্রভাতী ও গোধুলী সহ অনেকগুলো ট্রেইন ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ট্রেন ও আসন ভেদে ভাড়া ২০০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে।

চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবান যেতে হলে প্রথমে বহদ্দারহাট যেতে হবে। ওখান থেকে ৩০ মিনিট পরপর ‘পূর্বাণী’ ও ‘পূরবী’ নামে দুটি পরিবহনের বাস ছাড়ে। ভাড়া ২২০ টাকা।

বান্দরবান থেকে রুমা বাজার

বান্দরবান থেকে বগালেক যেতে হলে প্রথমে রুমা বাজার যেতে হবে। রুমা বান্দরবানের একটি উপজেলা। এটি জেলা শহর থেকে ৫০ কিঃমিঃ দূরে। বাসে বা জিপে করে আপনি রুমা বাজার যেতে পারবেন। বান্দরবান সদরের রুমা বাস স্ট্যান্ড থেকে ১ ঘন্টা পরপর রুমার বাস ছাড়ে। ভাড়া ১২০ টাকা। যেতে সময় লাগবে ৩ ঘন্টার মতো। বিকাল ৩টার মধ্যে লাস্ট বাস ছেড়ে যায়।

জিপে করে রুমা যেতে চাইলে রিজার্ভ নিতে হবে। ভাড়া পড়বে সিজন ভেদে ২৫০০ থেকে ৪০০০ টাকার মধ্যে। এক জিপে ১২/১৩ জন বসা যায়। যেতে সময় লাগবে ২ ঘন্টার মতো। শীতের সিজনে এই রুটে লোকাল জিপ পাওয়া যায়। জনপ্রতি ৮০ থেকে ১২০ টাকা ভাড়া নেয়।

রুমা বাজার থেকে বগালেক

রুমা বাজার পৌঁছে আপনার প্রথম কাজ হবে বগালেক যাওয়ার জন্য গাইড ও জিপ ঠিক করা। গাইড সমিতির অফিস থেকে রেজিস্টার্ড গাইড কাউকে নিতে হবে। রেজিস্টার্ড গাইড ছাড়া আপনি বগালেকে যাওয়ার অনুমতি পাবেন না। এরপর রুমা বাজার আর্মি ক্যাম্পে আপনাকে রিপোর্ট করতে হবে। সবার নাম ফোন নাম্বার সহ বিস্তারিত লিখে জমা দিতে হবে ক্যাম্পে। আপনার হয়ে গাইডই এই কাজগুলো করে দিবে। গাইড ফি প্রতিদিনের জন্য ৬০০ টাকা। এটা আর্মি দ্বারা নির্ধারিত। তবে গাইডের থাকা খাওয়ার সকল খরচ আপনাকেই বহন করতে হবে। বগালেকের কয়েকজন রেজিস্টার্ড গাইডের নাম্বার-

সুফল বড়ুয়া 01843-229547, ইসমাইল 01869-364977
প্রকাশ 01887-659360, হারুন 01828-872894
বাবুল 01552-432937, রঞ্জন 01827-713975
তাপস বড়ুয়া01884756482

রুমা বাজার থেকে বগালেক পর্যন্ত জিপ ভাড়া ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকা। এক জিপে ১২/১৩ জন যাওয়া যায়। আপনার টিমে সদস্য সংখ্যা কম হলে অন্য কারো সাথে জিপ শেয়ার করতে পারবেন। এছাড়া ১ ঘন্টা পরপর লোকাল জিপ ছাড়ে। ওগুলোতেও যেতে পারবেন। ভাড়া ১০০ টাকা। বিকাল ৪টার পর রুমা যেতে বগালেকের উদ্দেশ্যে কোনো গাড়ি যেতে দেয় না আর্মি। তাইল আপনাকে সকল কাজ ৪টার আগেই শেষ করতে হবে। রুমা থেকে বগালেকের দূরত্ব ১৭ কিঃমিঃ। যেতে ১ ঘন্টার মতো সময় লাগে।

বগালেকে কোথায় থাকবেন

বগালেকে থাকার জন্য উন্নতমানের কটেজ বা রিসোর্ট নেই। স্থানীয় আদিবাসীদের ছোট ছোট কিছু কটেজ আছে। ওগুলোতেই রাত্রি যাপন করতে হবে। এতে জনপ্রতি খরচ হবে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। এক রুমে ৫/৬ জন করে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। ফিমেইলদের জন্য আলাদা থাকার ব্যবস্থা। আর কাপল হলে আলাদা কাপল কটেজ পাওয়া যায়। সবকিছু আগে থেকে গাইডকে বলে রাখলে সে ব্যবস্থা করে রাখবে। অথবা আপনি চাইলে ওখানে গিয়েও ঠিক করতে পারবেন। ঢাকা থেকে কটেজ ঠিক করতে চাইলে বুুকিংয়ের জন্য ফোন দিতে পারেন লারাম বম- 01552376551, বা সিয়াম দিদির 01840721590 নাম্বারে।

খাওয়ার ব্যবস্থা আছে আদিবাসী ঘর ও কটেজগুলোতে। জনপ্রতি খাওয়ার খরচ পড়বে প্রতিবেলা ৮০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে। খাবার হয় প্যাকেজ সিস্টেমে। মেনু হিসেবে ভাত, ডাল, ভর্তা, ডিম মুরগী ইত্যাদি পাওয়া যায়। খাবার কতজন খাবেন, কী দিয়ে খাবেন ইত্যাদি আগে থেকে অর্ডার করতে হয়। গাইডকে বললেই হবে, সে অর্ডার করে দিবে। অথবা চাইলে আপনি নিজেও কথা বলে অর্ডার করতে পারেন। কটেজগুলোতে নিজস্ব বারবিকিউর ব্যবস্থা আছে। রাতে বগালেক পাড়ে মনোরম পরিবেশে বারবিকিউ পার্টি করে নিজেদের মধ্যে আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারেন চাইলে।

বগালেক ভ্রমণ টিপস

  • বগালেকে বিদ্যুত নেই। সোলার প্যানেলে পাওয়ার সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা আছে। তবে সাথে করে পাওয়ার ব্যাংক নিয়ে গেলে ভালো।
  • রবি ও টেলিটক বাদে অন্য ফোনের নেটওয়ার্ক নেই বগালেকে। তাই এই সিমগুলো সাথে রাখুন।
  • বগালেকে গোসল করতে চাইলে সাবধানে করবেন। সবসময় সতর্ক থাকা ভালো। সাঁতার দিতে গিয়ে অতীতে একাধিক মৃত্যু দেখেছে বগালেক।
  • সাথে এনআইডি কার্ড রাখুন। এটা বাধ্যতামূলক নয়। যেকোনো ফটো আইডি সাথে থাকা জরুরি।
  • যাত্রাপথে জিপের ছাদে উঠবেন না। এটি করতে আর্মির পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা আছে। তাছাড়া পাহাড়ি পথে জিপের ছাদে উঠা বিপদজনক।
  • আদিবাসীদের ছবি তোলার ক্ষেত্রে অনুমতি নিতে ভুলবেন না। এটা সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান। আপনার কাণ্ডজ্ঞান আপনার ব্যাক্তিত্বকে রিপ্রেজেন্ট করে।
  • পাহাড়িদের কালচারের প্রতি সম্মান দেখান। এমন কিছু বলবেন না, যেটি অন্যকেউ আপনাকে বললে আপনারও খারাপ লাগতো।
  • যেখানে সেখানে ময়লা না ফেলা আপনার ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক। সেটি শুধু পাহাড়ে নয়, এমনকি শহরেও।

আশেপাশে কী কী দেখার আছে

হাতে সময় থাকলে বগালেকের আশেপাশে আরো কিছু স্পট ঘুরে দেখতে পারেন। এরমধ্যে অন্যতম কেওক্রাডং। বগালেক থেকে কেওক্রাডং যেতে চাইলে ১ দিন বাড়তি সময় লাগবে। কেওক্রাডংয়ে থাকার ব্যবস্থা আছে। যাওয়ার পথে দেখতে পারবেন চিংড়ি ঝর্ণা। এছাড়া বান্দরবানের অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে নীলগিরি। এটি সর্বাধিক জনপ্রিয় পর্যটন স্থান। এছাড়া থানচিতে আছে নাফাখুম জলপ্রপাত এবং রোয়াংছড়িতে আছে দেবতাখুম নামে একটি গিরিখাদ উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশের অন্যন্য লেক