টাঙ্গুয়ার হাওর

টাঙ্গুয়ার হাওর

টাঙ্গুয়ার হাওর (Tanguar Haor) সুনামগঞ্জ জেলার প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এরিয়া জুড়ে বিস্তৃত। যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। তার মাঝে ডুবে আছে অসংখ্য গ্রাম। বর্ষায় সেখানে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যাতায়াতের বাহন নৌকা। হাওরের একপ্রান্তে মেঘালয়ের পাহাড়, সেখান থেকে নেমে আসা ছোটবড় ৩০টি ঝর্ণাধারা আর দিগন্তজোড়া নীল আকাশ। সাত হাজার একরের এই টাঙ্গুয়ার হাওর এর আয়তন বর্ষায় বেড়ে তিনগুন হয়।

বাংলাদেশে যত দর্শনীয় স্থান আছে একই রকমের জায়গা দক্ষিণ এশিয়ায় অন্য কোথাও না কোথাও আছে। কিন্তু টাঙ্গুয়া হাওর এর মতো বৈচিত্রময় স্থান আর কোথাও নেই। তাই একজন বিদেশী পর্যটক বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থানের নাম জানতে চাইলে তাকে টাঙ্গুয়ার হাওরের নাম সাজেস্ট করার কথা জানান ট্রাভেল এক্সপার্টরা।

টাঙ্গুয়া হাওর ভ্রমণের উপযুক্ত সময়

বর্ষাকাল টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। মেঘালয় থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে পুরো হাওর তখন কানায় কানায় ভরে উঠে। পাশাপাশি দুই বাড়িতে বিয়েও হয় নৌকায়! এক কথায় বলা চলে জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত টাঙ্গুয়া হাওর ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। তবে পাখি প্রেমীরা শীতকালেও টাঙ্গুয়া হাওর ভ্রমণ করেন।

টাঙ্গুয়ার হাওর এর দর্শনীয় স্থান গুলো

প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে পুরো হাওরটাই দর্শনীয়। তবে নির্দিষ্ট করে বললে- হাওরে রয়েছে অনেকগুলো ছোট ছোট সোয়াম্প ফরেস্ট। এছাড়া নীলাদ্রি লেক (শহীদ সিরাজ লেক), লাকমাছড়া, বারিক্কা টিলা, শিমুল বাগান, ওয়াচ টাওয়ার, যাদুকাটা নদী উল্লেখযোগ্য। হাওরের সূর্যাস্ত আপনার স্মৃতিতে অনেকদিন থাকবে। চাঁদনী রাতে গেলে মাতাল জোছনা আর বাউলা বাতাস আপনাকে মাতাল করে দিবে!

কিভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ: ঢাকার সায়েদাবাদ, মহাখালী ও ফকিরাপুল থেকে প্রতিদিন মামুন পরিবহন, এনা পরিবহন ও শ্যামলী পরিবহনের বাস সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। বাস ভাড়া জনপ্রতি ৫৫০ টাকা। যেতে সময় লাগে প্রায় ৬ ঘন্টা।

সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ: যারা সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ যেতে চান, তারা সিলেটের কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ড থেকে সুনামগঞ্জ যেতে পারবেন। সিলেট থেকে সুনামগঞ্জের বাস ভাড়া ১০০ টাকা। যেতে সময় লাগে ২ ঘন্টার মতো।

সুনামগঞ্জ থেকে টাংগুয়া: সুনামগঞ্জ নেমে সুরমা ব্রিজের উপর থেকে টাংগুয়া যাওয়ার সিএনজি, লেগুনা এবং বাইক পাবেন। যেতে সময় লাগবে দেড় ঘন্টার মতো। তাহিরপুর নেমে ঘাট থেকে নৌকা পেয়ে যাবেন। ট্যুরের সদস্য সংখ্যা অনুযায়ী ছোট বড় নৌকা ভাড়া করেতে পারবেন বাজেটের মধ্যে। তবে সবচেয়ে ভালো নৌকা গুলো পেতে আগে থেকে ফোন করে বুকিং করাই ভালো।

রাতে কোথায় থাকবেন

রাতে থাকার জন্য টাঙ্গুয়া হাওরে ভালো হোটেলের ব্যাবস্থা নেই। হাওর বিলাস নামে একটি কটেজ রয়েছে হাওরের মাঝখানে, এছাড়া টেকেরঘাটে একটি বোর্ডিং আছে। সাধারণত হাওর ভ্রমণ এ রাতে সবাই নৌকাতেই ঘুমায়। যারা রাতে ঘুমানোর সময় প্রাইভেসি পছন্দ করেন তারা মাঝিকে বলে হোটেলের ব্যাবস্থা করতে পারবেন।

টাঙ্গুয়ার হাওর এর নৌকা ভাড়া

টাংগুয়া হাওড়ের নৌকা ভাড়া আসলে বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যেমন নৌকার ধারণ ক্ষমতা, নৌকার সুযোগ সুবিধা, কতদিনের জন্য ভাড়া নিচ্ছেন ইত্যাদি। সাধারণত মাঝারি আকারের একটা নৌকা ভাড়া ৫০০০ থেকে ৭০০০ টাকা। এসব নৌকায় ১৫/২০ জন বসতে পারে, ৭/৮ জন রাতে ঘুমাতে পারে। বড় নৌকার ভাড়া ৭০০০ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়। বড় নৌকাতে বসতে পারে ৩০/৩৫ জন, রাতে ঘুমাতে পারে ১০/১২ জন। নৌকা নেওয়ার সময় সোলার আছে কিনা, টয়লেটের অবস্থা কেমন ইত্যাদি দেখে নিতে হবে।

এছাড়া টাংগুয়া হাওরে আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন দুই তিনটি বোট আছে। এগুলোতে জেনারেটর থেকে শুরু করে হাই কমোড, লাইট ফ্যান, গ্যাসের চুলা ইত্যাদি রয়েছে। এসব নৌকায় প্রায় ৪০ জন বসতে পারে। রাতে ঘুমাতে পারে ১৪ থেকে ১৮ জন। দুইদিনের জন্য এসব নৌকার ভাড়া পড়ে ১২ থেকে ১৮ হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে সব ধরণের নৌকা ভাড়া শুক্র শনিবারে কিছুটা বেশি ও অন্যান্য দিন কিছুটা কম থাকে।

টাঙ্গুয়ার হাওরের সবয়েচে প্রিমিয়াম হাউজবোট চন্দ্রাবতীর ফোন নাম্বার সহ বিস্তারিত তথ্য দেখুন  এখানে।

খাবার ব্যাবস্থা

টাঙ্গুয়ার হাওড় এর তাহিরপুর ও টেকেরঘাটে কয়েকটা খাবারের দোকান আছে। এসব দোকানে হাওরের নানান সুস্বাদু মাছ, হাঁস, ভর্তা ইত্যাদি দিয়ে দুপুর ও রাতের খাবার খেতে পারবেন। আর নিজেরা রান্না করতে চাইলে তাহিরপুর বাজার থেকে জিনিসপত্র কিনে নিয়ে উঠতে হবে। লোকজন বেশি হলে মাঝিকে বলে একজন বাবুর্চি নিতে পারবেন বোটে। দুই দিনের জন্য বাবুর্চিকে দিতে হবে ১৫০০ টাকা।

নীলাদ্রী লেক
নীলাদ্রি লেক | ছবি: গ্রিন বেল্ট

টাঙ্গুয়ার হাওর ট্যুর প্ল্যান ২ দিন ১ রাত

হাওড়ে যেতে হলে রাতের বাসে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে প্রথমে সুনামগঞ্জ চলে আসতে হবে। ভোরের মধ্যে সুনামগঞ্জ পৌঁছে যাবেন। এরপর সুনামগঞ্জের সুরমা ব্রিজ থেকে সিএনজি লেগুনা বা বাইকে করে রওনা করে দিন তাহিরপুরের উদ্দেশ্যে। সুনামগঞ্জ থেকে তাহিরপুর যেতে ঘন্টা দেড়েক সময় লাগবে। তাহিরপুর পৌঁছে প্রথমে নৌকা ঠিক করে এরপর প্রয়োজনীয় বাজার করে নিন। সব কাজ শেষে নৌকা নিয়ে প্রথমেই চলে আসুন ওয়াচ টাওয়ার।

ওয়াচ টাওয়ার এলাকায় রয়েছে ছোট ছোট অনেক জলাবন। এখানে আপনি গোসল সেরে নিতে পারেন। সাঁতার না জানলে লাইফ জ্যাকেট ছাড়া হাওরে নামবেন না। এর মধ্যেই দুপুরের খাবারের আয়োজন করে ফেলুন। গোসল শেষে মাঝ হাওর দিয়ে চলে যান টেকেরঘাট। টেকেরঘাট পৌঁছাতে বিকেল হবে। সেদিনের জন্য নৌকা ওখানেই বাধা থাকবে। টেকেরঘাট হচ্ছে সীমান্তঘেঁষা গ্রাম। নৌকা থেকে নেমে পায়ে হেঁটে ঘুরে আসুন লাকমাছড়া। ঘাট থেকে লাকমাছড়া হেঁটে যেতে বিশ মিনিটের মতো সময় লাগবে। স্থানীয় যে কাউকে বললে পথ দেখিয়ে দিবে। আর সন্ধ্যেটা কাটিয়ে দিন চুনাপাথরের লেক নীলাদ্রি এর মনোরম পরিবেশে।

পরদিন সকালের খাবারের পর চলে যাবেন যাদুকাটা নদী, বারিক্কা টিলা ও শিমুল বাগানের উদ্দেশ্যে। এই তিনটা স্পটে আপনি লোকাল বাইক ভাড়া নিয়ে যেতে পারেন। ১৫০ টাকা নিবে জনপ্রতি। আর নৌকায় যেতে চাইলে নৌকা ভাড়া নেওয়ার সময়ই মাঝিকে বলতে হবে। নইলে পরে বাড়তি ভাড়া দাবি করতে পারে। এই স্থানগুলো ঘুরতে ঘুরতে বিকেল হয়ে যাবে। এরপর তাহিরপুর হয়ে বা টেকেরঘাট থেকে সরাসরি সুনামগঞ্জ চলে আসুন। তারপর রাতের বাসে গন্তব্যে ফিরে যান।

টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ খরচ

ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জের বাস ভাড়া আসা যাওয়া ১১০০ টাকা। সুনামগঞ্জ থেকে তাহিরপুর সিএনজি বা বাইক ভাড়া আসা যাওয়া ২০০ থেকে ৪০০ টাকা জনপ্রতি। নৌকা ভাড়া ৫০০০ থেকে ১৫০০০ টাকা, এটা আপনার দলের সদস্যদের মধ্যে ভাগ হবে। খাবার খরচ প্রতি বেলা গড়ে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পড়বে। দলে কম মানুষ হলে নিজেরা রান্না করে খেলে একটু বেশি খরচ হবে। এগুলোই মূল খরচ। এর বাইরে টুকটাক ১০০ টাকা জনপ্রতি খরচ হতে পারে।

টাংগুয়া হাওড় ভ্রমণ টিপস ও সতর্কতা

*টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণে লাইফ জ্যাকেট সাথে নিন। তাহিরপুরে ৫০থেকে ১০০ টাকা ভাড়ায় লাইফ জ্যাকেট পাবেন। এছাড়া প্রিমিয়াম বোট গুলোর নিজস্ব লাইফজ্যাকেট থাকে। সাঁতার না জানলে লাইফ জ্যাকেট ছাড়া অল্প পানিতেও নামবেন না।

* ভ্রমণের সময় টিম সাইজ যত বড় হবে খরচ তত কম হবে। দলে সদস্য সংখ্যা একেবারে কম হলে কোনো ট্যুর গ্রুপ এর সাথে ভ্রমণ করতে পারেন। এতে ভ্রমণ খরচ কমে আসবে। নিরাপত্তাও বাড়বে।

*জাদুকাটা নদীতে অল্প পানিতে কিছুদূর হাঁটার পর হঠাৎ খাড়া গভীর! নদীর তলদেশে তীব্র স্রোত আছে। যা উপর থেকে দেখে বোঝা যায়না। তাই জাদুকাটা নদীতে লাইফ জ্যাকেট ছাড়া নামবেন না।

* টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণে বজ্রবৃষ্টি বা ভারী বৃষ্টি হলে নৌকার ছাদ থেকে নেমে ভিতরে অবস্থান নিন।

* হাওরে কোনো ভাবেই মাইক এমনকি স্পীকারও ব্যাবহার করে গান বাজাবেন না। এতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। স্থানীয়রাও বিরক্ত হয়।

*ভ্রমণের সময় ছাতা নিন সাথে। রোদ বৃষ্টি যেকোনো সময় কাজে দিবে। মাঝি ও স্থানীয়দের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার করুন।

*কোনো ধরণের অপচনশীল দ্রব্য হাওরে ফেলবেন না। পরিবেশ সংরক্ষণে মনযোগ  দিন। শুধু টাঙ্গুয়ার হাওড় এ গিয়ে নয়, আপনার দৈনন্দিন জীবনেও যেখানে সেখানে ময়লা না ফেলা আপনার ব্যাক্তিত্বের পরিচায়ক।

অনেকে ঝামেলা এড়াতে ট্যুর এজেন্সির মাধ্যমে ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন তারা দেশের সবচেয়ে ফিমেইল ফ্রেন্ডলি ট্যুর অর্গানাইজার গ্রিন বেল্ট এর টাঙ্গুয়া হাওর ট্যুর প্যাকেজটি দেখতে পারেন। ভ্রমণ সম্পর্কিত আপডেট পেতে জয়েন করতে পারেন আমাদের নিয়মিত ট্রাভেল আড্ডার গ্রুপ Green Belt The Travelers এ। আপনার স্বপ্নগুলো স্মৃতি হোক।

আরো পড়ুন

Exit mobile version