সীতাকুন্ড ইকোপার্ক ও গুলিয়াখালী বিচে একদিন

একটা ব্যাগ কাঁধে চেপে সন্ধায় আমি বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। চারিদিকে সন্ধার আঁধার নামা শুরু করলেও আমার মধ্যে তখন ভোরের আলোর মতো উচ্ছ্বাস কাজ করছে। বেশ উচ্ছ্বসিত মনে বাইক নিয়ে সোজা চলে গেলাম মিরপুর। সেখান থেকে টিমমেটকে নিয়ে শাহবাগ এসে দেখলাম দু’টো হাইএস দাঁড়িয়ে আছে, বেশকিছু মানুষও আছে। ও হ্যা, আমার এই ভ্রমণটি হয়েছিল একটি ভ্রমণ দলের সাথে। সবাইকে যার যার মতো সিট দেয়া হল। একজন মানুষ বেশি হওয়াতে সিট সংকটে পড়তে হল। কি আর করা! শেষে এই পাতলা, ছোটখাটো গড়নের মানুষটির জায়গা হল ড্রাইভারের সাথে থাকা এক্সট্রা সিটে। এটাই হুটহাট ভ্রমণের মজা। যেখানে যেমন সেখানে তেমন মানিয়ে নেয়া। রাত ১১ টায় আমাদের গাড়ি চলতে শুরু করলো চট্রগ্রামের উদ্দেশ্যে।

সবাই বেশ অল্প সময়ের মধ্যেই পরিচিত হয়ে গেলো। গল্পগাছা, হাসি তামাশা, গান আড্ডা হল। সময়ের সাথে সাথে প্লে-লিস্ট পরিবর্তন হতে লাগলো। ফোক থেকে সফট মেলোডি। অল্প অল্প করে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। ড্রাইভার খুব দক্ষতার সাাথে গাাড়ি চালাচ্ছেন। আমার পাশের জন ম্যাপ দেখছে। এক এক করে টিমের সবাই ঘুমিয়ে পড়লো। কেবল আমরা তিনজনই সফট মেলোডির সাথে রাস্তা আর বৃষ্টি দেখছি। আহা সে কি দারুণ অনুভূতি! কোন একটা সময় আমারও চোখ লেগে এলো। রাত তিনটার দিকে টিমমেটের ডাকে আমার ঘুম ভাঙলো। আমরা একটা জায়গায় থেমেছি কিছুক্ষণের জন্য। কেউ চা খাচ্ছে, কেউ কফি খাচ্ছে। লোকজনদের থেকে খানিক আলাদা হয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। রাতেই এই সময়টাতেই সারাদিনের হিসাব নিকাশ নিরিবিলি করা যায়। ব্রেক শেষে আবার রওনা হলাম।

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আমরা সীতাকুণ্ড স্থানীয় বাজারে নামলাম নাশতা করতে। নাশতা রেডি হতে হতে সবাই ফ্রেশ হয়ে খানিক হাটাহাটি করতে করতে ভোর দেখছে, সাথে ভোরের শুভ্র বাতাস। এখন ধূসর আলো কেটে হালকা হলুদ আলো চারিদিকে। নাশতা করে আমরা আবার গাড়িতে উঠে চলে গেলাম সীতাকুন্ড ইকোপার্ক‘এ। চট্রগ্রাম শহর থেকে ৩৫ কি.মি. উত্তরে ঢাকা- চট্রগ্রাম মহাসড়কের পূর্ব পাশে সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক অবস্থিত। আমরা যাচ্ছি সহস্রধারা-সুপ্তধারা ঝর্ণা দেখতে৷ ইকোপার্কের মূল গেট থেকে সহস্রধারার দূরত্ব ৫ কিলোমিটার। আমরা প্রায় চলে আসাতে সবার ভেতরই বেশ উত্তেজনা কাজ করছে। এবার গাড়ি থেকে নেমে হাটার পালা।

সহস্রধারা ঝর্ণা
ছবি: সহস্রধারা ঝর্ণা

ওপর থেকে সহস্রধারা ঝর্ণায় নামতে সিড়ি ৪৮৭ টি৷ সোজা একটানা সিড়ি, ঝিরিপথ নেই। এই সিড়ি নামতে যতোটা না কষ্ট তার চেয়ে বেশি কষ্ট উঠতে। তার ওপর ঝর্ণায় জোকের ভয়। নামার আগে কেউ কেউ পায়ে তেল লাগাচ্ছে, কেউ লবণ পানি ঢালছে। সবার এতো আয়োজন দেখে আমি একটু ঘাবড়েই গেলাম! মনে হচ্ছিল না যেন কত জোক সেখানে! সবার প্রস্তুতি শেষ হলে সিড়ি ধরে হাটা শুরু করলাম। পথে একটা জবা ফুল পেলাম। খোপায় গেথে গুণগুণ করে গান গাইছি আর নামছি। বেশ আনন্দ লাগছে। একটা সময় দূর থেকে জলের শব্দ পাচ্ছি। তখন সবাই খুব উচ্ছ্বসিত। মাথার ওপর খটখটা রোদ তবুও সবাই খুব দ্রুত নামছে৷ ভীষণ গরমে জল তৃষ্ণার মতো ঝর্ণার কাছে আসতেই কয়েকজন পানিতে লাফিয়ে পড়লো! আমি ঝর্ণার ওপরে তাকালাম। সূর্যের রশ্নি জলের সাথে পাল্লা দিয়ে লুকোচুরি খেলছে। আশানুরূপ জল না পেলেও জলগুলোকে স্বর্ণের দানার মতো লাগছে।

আমাদের টিম লিডার আমাকে ঝর্ণায় নামতে দিলো না। বাকীরা জলে লুটোপুটি খাচ্ছে। তাঁর ওপর আমার ভীষণ রাগ হচ্ছে। আমি তাঁর পাশে বসে রাগে দাঁতে দাঁত চেপে খিটমিট করছি। সে বলল যারা এখানে বেশি এনার্জি লস করছে তারা আরেকটা ঝর্ণায় যেতে পারবে না। ভেজা কাপড়ে উপরে উঠতে উঠতেই হাঁপিয়ে যাবে। সুপ্তধারা ঝর্ণাটা আরও সুন্দর। সেটাতে নেমো৷ এই ভ্রমণে সবচেয়ে বিরক্তির বিষয় ছিল কয়েকজন ভ্রমণের শুরু থেকে অনবরত ছবি তুলে যাচ্ছিলো, যার কারণে বাকী সকলকে জায়গায় জায়গায় থামতে হচ্ছিলো। এরা উপভোগে যতটা না আগ্রহী তারচেয়ে বেশি আগ্রহী উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে ছবি তুলতে। ঘন্টা খানেক থাকার পর আমরা আবার সিড়ি ধরে উপরে উঠছি। এটা বেশ কষ্টকর। আমি একটানাই উঠছি। কোথাও থামছি না। থামলেই ক্লান্তি উপভোগ করতে হয়। একটানা উঠতে থাকায় সবার আগে উপরে উঠে আসলাম।

এক ঝর্ণাতে নেমেই একেক জনের অবস্থা কাহিল। সবাই বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। ঘন্টা খানেক পর আমরা আরেক ঝর্ণার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। কথার সাথে মিল পেয়ে গেলাম। কিছু মানুষ ক্লান্ত হওয়ায় আমাদের গাড়িতে রয়ে গেলো। সহস্রধারা এবং সুপ্তধারা ঝর্ণার মধ্যে দূরত্ব ২ কিলোমিটার। সহস্রধারা ঝর্ণাটি সুপ্তধারা ঝর্ণার জল থেকেই সৃষ্ট। দ্বিতীয় দফায় সবাই জোকের ভয়ে তেল লাগানো। আমরা সুপ্তধারার সিড়ি ধরে নামা শুরু করলাম। সুপ্তধারার সিড়ি ৪২২ টি। এবারও আগে আগে নেমে গেলাম। এরপর ঝিরিপথ। এরমাঝেই বৃষ্টি নামায় পানি বেড়ে গেলো৷ এই জায়গাটুকু পার হওয়া কঠিনই ছিল। লিডারের হাত ধরে ধরে পার হলাম। সবকিছুর শুরু অর্থাৎ এক্সপেরিমেন্ট আমাকে দিয়েই করা হচ্ছে! এরমাঝেই আরেকদল মেয়ে ঝিরিপথে স্রোত বাড়ায় চিৎকার শুরু করলো। আমাদের থেকে কয়েকজন তাদের সাহায্য করলো পার হতে।

সীতাকুন্ড ইকো পার্ক আনিকা
ঝর্ণার মায়া

আমরা হাটতে হাটতে চলে এসেছি কাঙ্ক্ষিত সুপ্তধারায়। বিশাল হুংকার দিয়ে পাহাড়ের বুক চিরে জল গড়িয়ে পড়ছে। অপূর্ব তার রূপ! এবার আর আমাকে আটকালো না। আমরা শীতল জলে ভিজলাম। এতোক্ষণে মনে হচ্ছিলো সারাদিনের কষ্ট সার্থক হল। বেশ কিছুক্ষণ ভেজার পর দেখলাম আকাশ মেঘলা হয়ে আসছে। জল ঘোলাটে হয়ে আসছে। ঝড় নামলে ঝর্ণাতে যেকোন দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। আমরা সেখান থেকে রওনা হবার সিদ্ধান্ত নিলাম। এবার ফিরতি ঝিরি পথ পাড়ি দিয়ে সিড়ি দিয়ে উঠতে আমারও ক্লান্ত লাগছে৷ তবুও উঠছি। পাশেই আরেক দল আমার সাথে সাথে উঠছে। শেষমেশ আমরা উপরে উঠে এলাম। উপরে এসে দেখলাম যে আপু পায়ে সবচেয়ে বেশী তেল মেখেছিলেন সে আপুকেই সবচেয়ে বেশী জোক ধরেছে। সেসব ছাড়িয়ে আমরা ইকোপার্কের মূল গেটে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করলাম। দুপুরে স্থানীয় হোটেলে খেয়ে আমরা গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত এর উদ্দেশ্যে রওনা হব।

আমরা বেশ ক’জন শাড়ি পড়লাম। সমুদ্র বিলাসে শাড়ি না পড়লে কি চলে নাকি! আমি অবশ্য প্রায়ই শাড়ি পড়ি। পাবলিক ওয়াশরুমে শাড়ি পড়ার এক অসাধারণ ক্ষমতা অর্জন করেছি। সীতাকুণ্ড বাজার থেকে গুলিয়াখালি সি বীচের দূরত্ব মাত্র ৫ কিলোমিটার। স্থানীয়দের কাছে ‘মুরাদপুর বীচ’ নামেও পরিচিত। গুলিয়াখালী সী বিচের একদিকে দিগন্তজোড়া সাগর জলরাশি আর অন্য দিকে কেওড়া বন। এখানে ম্যানগ্রোভ ও সোয়াম ফরেস্টের মতো পরিবেশ পাওয়া যায়। আমরা গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতে যাবার জন্য গাড়ি পার্ক করে একটা ট্রলার ভাড়া করলাম। এখানে জোয়ার ভাটার হিসেব আছে। মাঝি বলে দিল দু এক ঘন্টা পর ভাটা শুরু হবে তখন আর ট্রলার চলবে না কাদাপানিতে হেটে যেতে হবে। ট্রলার থেকে নামার পর দেখলাম সবুজ ঘাসের গালিচা যেন বিছানো! তার পরেই ঢেউ আছড়ে পড়ছে তীরে। এই প্রথম আমার সমুদ্র দেখা! বড় তৃপ্তিময় ছিল সে সময়! কিন্তু সময় যেন খুব দ্রুত কেটে গেলো! সন্ধা নামবে নামবে করছে। এদিকে ভাটাও শুরু হল। দু তিনজন প্রায় ঠেলে ট্রলার নিয়ে আসলো। আমরা রাতে খেয়ে আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।

ভ্রমণ গাইডলাইন পড়ুন
Exit mobile version