সুন্দরবনের মানুষখেকো – ৩

১৯৭২ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনে বাঘকে উপদ্রব বলে গণ্য করা হত। তখন অনুমোদনপ্রাপ্ত যে কোন শিকারী বাঘ মেরে চামড়া ও মাথার খুলি বন অফিসে জমা দিলে তাঁকে অর্থ পুরস্কার দেওয়া হত। ১৯৭৩ সালে জারীকৃত বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী বনে এখন সকল প্রকার প্রাণী শিকার নিষিদ্ধ, বন দফতর থেকে ‘মানুষখেকো’ বলে কাগজেপত্রে ঘোষণা করলে তবেই কেবল সেই বাঘ মারা যায়। পচাব্দী গাজীর শিকার জীবন ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত। এর মধ্যে তিনি ৫৭ টি বাঘ মেরেছে। ফ্রান্স, জার্মানী, মধ্যপ্রাচ্য ও জাপানের পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশনে শিকারী পচাব্দী গাজীর কৃতিত্বের কাহিনী প্রচারিত হয়।

বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় সেবা প্রকাশণী থেকে ১৯৮০ সালে।  বিখ্যাত শিকারি পচাব্দী গাজীর জবানিতে বইটি লিখেছেন হুমায়ুন খান। বইয়ে ৭টি অনুচ্ছেদ আছে। ১. আঠারোবেকির বাঘ, ২. দুবলার চরের মানুষখেকো, ৩. গোলখালীর বিভীষিকা, ৪. সুন্দরবনের ভয়ঙ্কর, ৫. শিকারী জীবনের বিচ্ছিন্ন স্মৃতি, ৬. সুপতির মানুষখেকো, ৭. তালপট্টির বিভীষিকা।

এটি বইটি ধারাবাহিক প্রকাশের তৃতীয় পর্ব। প্রথম পর্বদ্বিতীয় পর্ব এখানে পড়ুন।

গোলখালীর বিভীষিকা

খুলনার পাইকগাছা থানার গোলখালী গ্রাম সুন্দরবনের একেবারে প্রান্তে অবস্থিত। বড় নদী কপোতাক্ষীর পাড়ে বড় গ্রাম গোলখালী, পুরা নাম শিঙের গোলখালী । গ্রামবাসী অধিকাংশ মানুষই গৃহস্থ, হাল-বলদ আছে, চাষাবাদ করে, মাছের অভাব নেই, কাঠেরও অভাব নেই। কিছু কিছু লোক অতি দরিদ্র, তারা বাওয়ালী ও মৌয়াল, নদীর ওপারের গভীর বনে গিয়ে কাঠ-লাকড়ি-গোলপাতা কাটে, মৌচাক কেটে মধু আহরণ করে। এই গ্রামের কেউ কেউ বনে কাজ করতে গিয়ে বাঘের এমন কি মুখামুখি হয়েও রক্ষা পেয়ে এসেছে, কিন্তু বাংলা১৩৫২ সালে একটি বাঘ যখন গোলখালী গ্রামেই গিয়ে একের পর এক মানুষ মারতে থাকে, গৃহস্থের হালের বলদ খেয়ে ফেলতে থাকে তখন অসহায় গ্রামবাসীগণের মধ্যে মহা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়ে যায়।

বাঘ প্রথমে নিয়ে যায় একটি গরু। হালের বলদ, দুপুরের পরে জঙ্গলের ধারে খুঁটিয়ে রেখেছিল এক গৃহস্থ, সন্ধ্যার আগক্ষণে গোহালে আনতে গিয়ে দেখে গরু নেই, দড়ি ছিঁড়া। এক জায়গায় রক্ত দেখে তার মনে সন্দেহ হয়। গ্রামের লোকজনসহ হৈ-চৈ করতে করতে জঙ্গলে ঢুকে আন্দাজ শ দুই হাত ভিতরে আধা-খাওয়া বলদ খুঁজে পায়। তারা বলদের সেই অর্ধেকটাই টেনে খোলা জায়গায় এনে গর্ত করে পুঁতে রাখে গোলখালীর মানুষ সেই প্রথম গ্রামে বাঘের উপস্থিতি জানতে পারে। এই ঘটনার অনেক বছর আগেও একবার গ্রামের প্রান্ত থেকে বাঘে গরু নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তখন গরু পর্যন্তই, বাঘ কোন মানুষকে আক্রমণ করেনি। এ বছর তার ব্যতিক্রম ঘটল।

উক্ত ঘটনার পরের দিন একজন লোক নিজেরই প্রয়োজনে শুকনা ডাল কাটার জন্যে গ্রামের জঙ্গলে যায়। বাঘ যেখান থেকে গরু নিয়ে গিয়েছিল সেই এলাকায় নয়, গ্রামের সামনে নদীর ধারের কতকটা খোলা জঙ্গলে, কাছে মানুষের চলাচল ছিল । মাটিতে দাঁড়িয়েই উপরের ডাল কেটে কেটে জমা করছিল সে, হঠাৎ চীৎকার করে উঠে, দূরের লোকেরা সঙ্গে সঙ্গেই বাঘের গর্জন শুনতে পায়, তারপরেই সব নীরব। দিনের বেলা, সকাল দশটা সাড়ে দশটার ঘটনা। ভয়ার্ত গ্রামবাসী কিছুক্ষণের মধ্যেই একত্র হয়, গ্রামে বন্দুক ছিল, সেটা নিয়ে একজন শিকারী এবং অন্যান্য সবাই যার যা অস্ত্র ছিল তাই নিয়ে তাকে উদ্ধার করে আনতে যায়। জঙ্গলের অনেকখানি ভিতরে তার দেহ খুঁজে পায় কিন্তু দেখে যে তার মধ্যেই ক্ষুধার্ত বাঘ পেট আর ঊরু খেয়ে ফেলেছে ৷

এর তিনদিন পরে নদী থেকে গ্রামে ফিরার পথে দুইজনের মধ্য থেকে পিছনেরজনকে বাঘে নিয়ে যায় বিকাল বেলা। তারা মাত্র চার-পাঁচ হাত তফাতে হেঁটে আসছিল, হাঁটু সমান হুদো লতার জঙ্গল, সেই হুদো বন পার হয়ে একটু খালি জায়গা, তারপরেই আবার একটা মাঝারি আকারের হুদো ঝোপ; আগেরজন ঝোপ পার হয়ে মাত্র কয়েক হাত গিয়েছে, এম হঠাৎ ‘হুঙ্ক!’ করে ভয়ঙ্কর গর্জন। ভয়ে উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে যায়, সেই অবস্থায়ই পিছনে ফিরে দেখতে পায় সঙ্গেরজনকে মুখে করে ঝোপের ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে বিশাল বড় বাঘ। সে মরার মত কিছুক্ষণ মাটিতে পড়ে থাকে, তারপর ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গ্রামে এসে সকলকে এই দুঃসংবাদ জানায় মিনিট ত্রিশ-চল্লিশেকের মধ্যেই বন্দুক হাতে গ্রামের দুইজন শিকারীসহ অন্যান্যরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হৈ-চৈ করতে করতে ঘটনাস্থলে পৌঁছায়।

শিকারীগণ মানুষখেকো বাঘের পারা দেখে চিনতে পারলেন। নদীর পাড় থেকে দুইজনকে আসতে দেখে বাঘ আগেই ঝোপের ভিতরে শুয়েছিল, কাছে আসামাত্র হুঙ্কার দিয়ে পিছনেরজনকে ধরে। গ্রামবাসীগণ হৈ-চৈ, চীৎকার করতে করতে জঙ্গলের ভিতরে অগ্রসর হয়। খুবই সাবধানে আর ভয়ে ভয়ে এগুতে হচ্ছিল বলে মাত্র শ দুই হাত যেতেই অন্ধকার হয়ে যায় । তখন তারা বাধ্য হয়ে আবার গ্রামে ফিরে আসে ।

পৃষ্ঠা ৩৬

পরদিন সকালে গ্রামবাসীরা আবার দল বেঁধে শিকারীর পিছনে পিছনে লাশ উদ্ধার করতে যায় এবং জঙ্গলের অনেক ভিতরে গিয়ে মৃতদেহ খুঁজে পায় পেট, উরু, কোমর ও বুকের প্রায় সবকিছু খেয়ে ফেলেছে। তারা হাড়গোড় এবং দেহের বাকী অংশ কাপড়ে জড়িয়ে এনে, গোসল দিয়ে জানাজা পড়ে দাফন করে এবং বাঘের মুখে পর পর দুইজন মানুষের মৃত্যুসংবাদ কপোতাক্ষী ফরেস্ট অফিস ও বুড়ী গোলালিনী ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসে জানায়। কয়েকজন শিকারী সঙ্গে সঙ্গে গোলখালী আসেন। গ্রাম এলাকা বলে শিকারীদের এখানে কতগুলো সুবিধা ছিল, যেমন গাছতলায় গরু বা ছাগল বেঁধে রেখে মাচাতে বসে রাত্রে বাঘ মারার চেষ্টা করা বা গ্রামবাসীদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতা।

এই ব্যবস্থা গ্রহণের পরেও বুড়ী গোলালিনীর বন কর্মকর্তা নিশ্চিত হতে পারলেন না, বিশেষ লোক মারফত আমাদের গ্রামের বাড়ীতে আমার বাবা, সুন্দরবনের শ্রেষ্ঠ শিকারী মেহের গাজীকে খবর পাঠালেন। বাবা চাকরী করতেন না, কিন্তু বন দফতরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে শিকার করতেন । সুন্দরবনের কোনখানে মানুষখেকো বাঘের উপদ্রব হলেই বাবাকে খবর দেওয়া হত, তিনি গিয়ে সেই বাঘ মেরে বন দফতরের ঘোষিত নগদ পুরস্কার নিতেন। ইতিপূর্বে একটি মানুষখেকো বাঘের জন্যে পুরস্কার ছিল তৎকালীন দুইশ টাকা, কিন্তু গোলখালীর বাঘ বিভীষিকা সৃষ্টি করে ফেলায়, এবং বলতে গেলে গোটা গ্রামকেই একেবারে অচল করে দেওয়াতে বন দফতর থেকে সরাসরি তিনশ টাকা ঘোষণা করা হয়।

মানুষখেকো বাঘের কথা একবার শুনলে বাবা আর ঘরে থাকতে পারতেন না। আমাদের বাড়ী সোরা গ্রামে, শ্যামনগর থানায় আর শিঙের গোলখালী পাইকগাছা থানায়। কিন্তু উভয় গ্রামই থানার সীমান্তবর্তী হওয়াতে দুই গ্রামের মধ্যে দুরত্ব আড়াই মাইলের বেশী নয়; যেতে হয় কপোতাক্ষী নদী পার হয়ে। বাবা সেই মুহূর্তেই বন্দুক আর ছরা-বারুদ বের করলেন। দোনলা গাদা বন্দুকটি তিনি কিনেছিলেন এবং সেই অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য বন্দুকটি দিয়েই তিনি জীবনের অধিকাংশ প্রায় পঞ্চাশটা—রয়াল বেঙ্গল বাঘ মেরেছিলেন। আমি আর চাচা, বাবার ছোট ভাই, তিনিও নামকরা শিকারী ছিলেন, নাম নিজামদী গাজী, তৈরী হতে হতে বাবা বন্দুকের দুই নলই ভরে ফেললেন, তারপর মাকে কোন কিছু না বলে তক্ষুণি রওনা হলেন।

বিকাল তিনটা নাগাদ আমরা কপোতাক্ষীর তীরে গিয়ে পৌছলাম নদী পার হতে হতে মাঝির কাছে শোনলাম যে, গতরাতেই গোলখালীর এক গৃহস্থের গোহাল থেকে বাঘ একটা গরু নিয়ে গেছে, গোহালের দরজা বরাবর খোলা থাকে, গতরাত্রেও খোলাই ছিল, বাঘ নিঃশব্দে ঢুকে গাভীর ঘাড় ভেঙে দড়ি ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। গোহালের প্রায় সংলগ্নই বাড়ীর লোকেরা অন্য সব গরুর ছট্‌ফটানি শুনতে পেয়েছিল, বুঝতেও পেরেছিল যে বাঘ এসেছে, কিন্তু প্রাণভয়ে কেউ বের হয়নি। সকালে বাঘের পায়ের ছাপ ও তাজা রক্ত পায়। অন্য দুইটা বলদ দড়ি ছিঁড়ে দূরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।

গোলখালীর লোক সকলেই মেহের গাজীর নাম জানত। আমরা গ্রামের একটা বাড়ীতে গিয়ে পৌঁছতেই অল্পক্ষণের মধ্যে সেখানে প্রায় জনাত্রিশেক লোক জড়ো হল। তারা গতরাতে বাঘে গরু জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে যেখানে খেয়েছে তক্ষুণি সেই জায়গাটা দেখিয়ে দিতে চাইল, এবং বাবাও সেই মুহূর্তেই যেতে তৈরী ছিলেন; পাঁচ মিনিটও বিশ্রাম না করে হন্তদন্ত অবস্থায় ভয়ঙ্কর হিংস্র মানুষখেকো বাঘ মারতে রওনা হলেন। গ্রামের মানুষের অবস্থা তখন অতি বিপজ্জনক। সন্ধ্যা হবার আগেই সব ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়, এমন কি দিনের বেলাতেও কেউ স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে সাহস পায় না, হাট-বাজার বলতে গেলে প্রায় বন্ধই; গরু ছাগল পর্যন্ত ঘরের বাইরে নেয় না।

পৃষ্ঠা ৩৭

বেলা চারটার পরে আমরা গ্রামের প্রান্তে জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে আধা-খাওয়া গরুটা দেখলাম। গরুর উপরে তখন দুই গাছে দুইজন শিকারী বসে ছিলেন, একজন বন অফিসের, একজন গ্রামবাসী। গোহাল থেকে জঙ্গলের সেইখানটা অন্ততঃ পাচশ হাত দূরে। বাবা ও চাচা দুইজনেই বাঘের পারা দেখলেন এবং আন্দাজ করলেন যে, বাঘ মরি রেখে পুব-দক্ষিণ দিকের হুদোবনে ঢুকে গেছে, রাতের মধ্যে অবশ্যই আবার আসবে, কিন্তু ধূর্ত জন্তু যদি চক্কর দিয়ে থাকে তবে হয়ত কাছেই কোথাও শুয়ে মাচার উপরে বসা দুই শিকারীকেই লক্ষ্য করছে। শিকারীগণ বাবাকে জানালেন যে, তাঁরা একেবারে সারা রাতের জন্যে তৈরী হয়ে বসেছেন।

বাবা গ্রামের সকল লোককে যার যার বাড়ীতে চলে যেতে বললেন। তারা একটু খোলা এবং মোটামুটি নিরাপদ স্থানে না যাওয়া পর্যন্ত আমরা জঙ্গলের কিনারায়ই অপেক্ষা করলাম; তারপর মরি থেকে পশ্চিমমুখী অগ্রসর হলাম। শ দুই হাত যেতে বাঘের পারা পাওয়া গেল। তাজা পারা! হুদৌ জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দক্ষিণ-পূর্বমুখী গেছে। পারা ধরে অগ্রসর হলাম। বাবা আগে, তাঁর পিছনে চাচা, তারপরে আমি, বন্দুক শুধু বাবার হাতে। হুদো সুন্দরবনের একরকম লতানো গাছ, গুচ্ছ গুচ্ছ হয়। সাধারণতঃ হাঁটু সমান উঁচু হয়, কোমর সমান খাড়াও হয়। সরু হুদোলতার ডালপালা হয় না, গোড়া থেকেই লম্বা লম্বা পাতা মেলে।

এই হুদো বন একটানা বেশ কিছুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয় আর এত ঘন হয় যে তার ভিতরে বাঘ অনায়াসে লুকিয়ে থাকতে পারে, ভিতরে চার-পাঁচ হাতের বেশী কিছুই দেখা যায় নাবিপজ্জনক জঙ্গল ভেঙে দক্ষিণ-পুবমুখী আন্দাজ পঞ্চাশ হাত গিয়ে বাবা হঠাৎ থেমে গেলেন। সেখানে একেবারেই তাজা পারা, মাত্র কয়েক মিনিট আগে বাঘ হেঁটে গেছে। বাবা ও চাচা দুইজনেই থেমে খুব ভালভাবে জায়গাটা পরীক্ষা করলেন, তারপর ইশারায় স্থির করলেন যে অনুসরণ করবেন।

আধা-খাড়া আধা-বসা অবস্থায় আমরা এগুতে লাগলাম। নিশ্চিত যে বাঘ তখন আমাদের থেকে দূরে নেই, হয়ত আমরা যে রকম বাঘের দিকে এগুচ্ছিলাম বাঘও তেমনি আমাদের ঘ্রাণ ওঁকে বা হুদোগাছের নড়াচড়া দেখে আমাদের দিকে তাক করছিল; মৃত্যুভয় বহন করে আমরা এক পা এক পা করে সামনে এগুতে লাগলাম। বাবা একটু যান, থামেন, কখনও বা এক পা পিছনে হঠে আসেন, আবার বিবেচনা করে খাড়া হুদো লতার ফাঁক দিয়ে এক পা সামনে বাড়েন।

হঠাৎ হুদোঝোপ ভেঙে তিনি বামদিকে একবারে তিন-চার হাত পিছনে সরে এলেন। চাচা আর আমি তৎক্ষণাৎ তাঁর পিছনে ছুটে গেলাম। বাঘের গর্জন ও লাফ আর বাবার বন্দুকের আওয়াজ একই সঙ্গে হল; বিজলীর মত বাঘটা ডান দিক থেকে এসে আমাদের মাত্র পাঁচ হাত সামনে পড়ল এবং বাবা দ্বিতীয় ট্রিগার টানার আগেই পূবমুখে অদৃশ্য হয়ে গেল। মাত্র এক ঝলক আমি বাঘের কোমর থেকে লেজ দেখলাম, তারপর হুদোবন ভাঙা ছাড়া আর কিছুই দেখলাম না। একটা লতা সামনে থাকলেও বন্দুকের গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যায়, আর হুদোবনের ভিতর দিয়ে ছুটে যাওয়া অদৃশ্য বাঘকে গুলি করাটা একেবারেই অর্থহীন কাজ হত।

বাবা আর গুলি করলেন না, যতদূর দেখতে পেলেন বাঘের গতি লক্ষ্য করলেন, তারপর চাচার হাতে বন্দুকটা দিয়ে দুই হাত কোমরে রেখে চিন্তা করতে লাগলেন। মানুষখেকো বাঘ ঠিকই আমাদের লক্ষ্য করছিল এবং তার কাছাকাছি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়েছিল; বাবা যদি পিছনে হঠে গুলি না করতেন তবে দ্বিতীয় লাফে অবশ্যই বাবাকে ধরত। অভিজ্ঞ শিকারী, গুলি করেছিলেন বলেই বেঁচে গেলেন, কারণ বাঘ কখনও গুলি খাওয়ার পরে আর শিকারীকে আক্রমণ করে না। সামনে এগুতেই-বাঘের রক্ত দেখলাম, হুদো গাছের গোড়ায় ও মাটিতে। অর্থাৎ গুলি লেগেছে ঠিকই কিন্তু বাঘ ঘায়েল হয়নি।

পৃষ্ঠা ৩৮

বেলা তখন আর খুব বাকী ছিল না, বাঘ যতদূর গেছে হুদোবন ঠেলে সে পর্যন্ত পৌছাতে আমাদের অন্ধকার হয়ে যাবে, তখন অসহায় অবস্থায় গুলি খাওয়া বাঘের সামনে পড়ব। বাবা ও চাচা দুইজনেই ভেবেচিন্তে সেদিনের মত বাড়ী ফিরা স্থির করলেন, গোলখালীর সকলকে রাত্রে অত্যন্ত সতর্ক থাকার কথা বলে, কপোতাক্ষী পার হয়ে আমরা বাড়ী ফিরে এলাম। ভাত খেয়ে রাত্রেই বাবা আবার বন্দুক ভরতে বসলেন, তখন মা বাধা দিলেন। দারুণ জেদী শিকারী হলেও বাবা রাত্রির মত বন্দুকটা রেখে দিলেন।

কিন্তু মার বাধাকে পরোয়া না করে খুব ভোরে তিনি বন্দুক নিয়ে বসলেন, গাদা বন্দুকের দুই নলে বারুদ-ছা ভরলেন। চাচা নিজামদী গাজীও নিজের বন্দুক ভরলেন; সকাল সাতটার মধ্যেই আবার বাবা গোলখালী রওনা হলেন। এবারও আমরা তিনজন, তবে গতকাল বন্দুক ছিল এক বাবার হাতে, আর আজ বাবা-চাচা দুইজনের হাতে দুই বন্দুক; আমি চললাম শুধু একটা লাঠি হাতে ।

গোলখালী গিয়ে বাবা প্রথমেই গ্রামবাসী সকলকে অত্যন্ত সতর্ক অবস্থায় থাকতে বললেন, কেন না গুলি খাওয়া মারাত্মক হিংস্র বাঘ নিশ্চিত গ্রামের সীমানার মধ্যে রয়েছে। বেলা তখন সাড়ে নয়টা দশটার বেশী হয়নি। গতকাল বাবা গুলি করে বাঘ মারতে না পেরে ফিরে যাওয়ার পর থেকে সকাল পর্যন্ত কোন একটি প্রাণীও বাড়ী থেকে চল্লিশ হাত দূরে যায়নি, গোহাল থেকে কেউ গরু বের করেনি। বাবার কথামত গোলখালীর জনাদশেক সাহসী যুবক একটি বন্দুক সমেত গ্রামের বাড়ী বাড়ী সবাইকে সতর্ক করে দিতে রওনা হয়ে গেল, আর বাবা, চাচা ও আমি এগিয়ে গেলাম গ্রামের বাইরে গতকালকের ঘটনাস্থলে, দুনিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক অভিযানে ঠিক যেখানে বাঘকে গুলি করেছিলেন গতকাল, সেখানে আজও গেলেন এবং বাঘের পারা ও কাত হওয়া হুদোর চারা দেখে অত্যন্ত সাবধানে, অতি সতর্কতার সঙ্গে বাবা পূবমুখে অগ্রসর হলেন। আগে বাবা, বাবার হাত পাচেক পিছনে চাচা, আর চাচার হাত আষ্টেক পিছনে আমি লাঠি হাতে, যা বাঘের আক্রমণের মুখে হয়ত অতি সামান্যই কাজে আসবে।

ঘন হুদো বনের ভিতরে সামনে বা পাশে কোনদিকেই চার-পাচ হাতের বেশী দৃষ্টিতে আসছিল না, আমরা চোখের উপরে যতটা ঘ্রাণশক্তির উপরে তার চেযে বেশী নির্ভর করে অতি ধীরে, প্রায় নিঃশব্দে এগুতে লাগলাম, একটা কাঁচা পাতা নড়ার শব্দও তখন সঠিক শুনতে পাচ্ছিলাম। বাবার কালকের গুলি, খুব কার্যকরভাবে না হলেও, বাঘের গায়ে লেগেছিল এবং অবশ্যই বাঘ আহত হয়েছে। তিনি বুকে গুলি করেছিলেন, সে গুলি নিশ্চয়ই কাঁধ বা ঘাড়ের চামড়া ভেদ করে গিয়ে থাকবে। অনুসরণ করতে করতে স্থানে স্থানেই আমরা মাটিতে আর হুদো পাতায় জমাট রক্ত দেখতে পেলাম, কিন্তু কোনখানেই খুব বেশী পরিমাণে নয়, ফোঁটা ফোঁটা। নিশ্চিত হয়ে কিছু ধারণা করার মত চিহ্ন নেই। খুব জখম হলেও দ্রুতবেগে ধাবমান বাঘের দেহ থেকে যথেষ্ট রক্তক্ষরণ না হতে পারে, আবার গুলি কেবলমাত্র চামড়া ভেদ করে গিয়ে থাকলেও এ রকম হতে পারে। তবে সম্ভবতঃ বাঘ যেখানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল আজ সেখানেই শুয়ে রয়েছে।

পৃষ্ঠা ৩৯

দুই ঘন্টায় আমরা সামান্যই এগুতে পারলাম। সামনে, ডানদিকে, খুব ভাল করে লক্ষ্য করে, বার বার রুদ্ধপ্রায় নিঃশ্বাস টেনে তারপর একটি পা সামনে এগুতে হচ্ছিল। হাত বিশেক দক্ষিণে একটা মাঝারি আকারের কেওড়া গাছ পড়ল, তার ঠিক নীচে হুদোবন কিছুটা পাতলা ছিল, বাঘ গেছে সেদিকে। যদিও গ্রাম থেকে দূরত্বহেতু ঘয়েল বাঘের পক্ষে যে কোন আড়াল-আবডালে শুয়ে থাকা সম্ভব ছিল, তবু সেই হালকা হুদোবনে গাছের পিছনেই যে বাঘ থাকবে এটা সম্ভবতঃ বাবা বা চাচা কেউ ধারণা করতে পারেননি। কেওড়া গাছটা বরাবর আরও হাত আষ্টেক গিয়েই বাবা হঠাৎ থপ করে থামলেন। পাতার একটু নড়াচড়া হল এবং তারপর একেবারে আচম্বিতে ভয়ঙ্কর গর্জন করে বাঘ ছুটে এসে বাবাকে আক্রমণ করল। বন্দুক তাক করার আগেই হা-হা করে এসে বাবার উপরে পড়ল, তিনি বন্দুক হাতে কাত হয়ে একপাশে পড়ে গেলেন, বাঘ তার মাথায় একটা থাবা মেরেই আরেক লাফে গিয়ে চাচাকে ধরল। চাচা বন্দুক নিশানা করে থাকা সত্ত্বেও বাবা সামনে থাকায় ট্রিগার টানতে পারলেন না, বাঘ আরেকটা হুঙ্কার দিয়ে চাচার হাতে কামড় দিল এবং পরমুহূর্তে হুদোবনে ঢুকে গেল।

মাত্র হাত-দশেক দূরে থেকেও আমি বাঘ দেখতে পাইনি। হুদোগাছ ঠেলে এগিয়ে যেতেই দেখলাম বাবার বিকট চেহারা; মাথার বামদিকে তালু থেকে কপাল, কান ও চোয়ালের মাংসপেশী আলগা হয়ে কাঁধের উপরে ঝুলে পড়েছে, মাড়ির দাঁত বের হয়ে আছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সেই অবস্থায়ই বন্দুক আমার দিকে এগিয়ে অবিশ্বাস্য সাহসের অধিকারী বাবা চীৎকার করে হুকুম দিলেন, ‘ধর বন্দুক! গুলি কর!’ এক হাতে আদেশমত বন্দুক এবং আরেক হাতে বাবাকে বুকে ধরে সামনে তাকিয়ে অন্ততঃ দেড়শ হাত দূরে আমি কেবল হুদোগাছ নড়তে দেখলাম। চাচার দিকে চেয়ে দেখি তিনিও ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে এক হাতেই বন্দুক নিশানা করে বাঘের বরাবর চেয়ে আছেন, আরেকটা হাত কনুই-এর উপর থেকে নীচে ঝুলে আছে, রক্তের ধারা ছুটছে। বাবা ও চাচা দুইজনকে অতিকষ্টে ধরে হুদোবন ও জঙ্গল পার করে গোলখালী গ্রামে নিয়ে এলাম ।

গ্রামবাসীরা যে যতদূর পারল সাহায্য করল, সাধ্যেরও বেশী করল। এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে সুন্দরবনের দুই বিখ্যাত শিকারী ভাই-এর শিকার জীবনে যতি নেমে এল–একজনের চিরতরে। দীর্ঘ তিনমাস চিকিৎসাধীন থাকার পরে আমার বাবা মেহের গাজী সেরে উঠলেন, এবং তারপরেও আরো পাঁচটা বাঘ মেরে শেষ পর্যন্ত সুপতির মানুষখেকো বাঘের কামড়ে মারা যান; আর চাচা নিজাম্দী গাজী এর পরে যদিও আরো আঠারো বছর জীবিত ছিলেন তবু একহাতে আর বাঘ মারতে পারেননি।

চাচাকে সেই দিনই শ্যামনগর থানার সরকারী ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সুধীর ডাক্তার অপারেশন করে কনুইর উপর থেকে তাঁর হাত কেটে বাদ দেন। বাবাকে বাড়ীতেই চিকিৎসা করেন আমাদের মুন্সীগঞ্জের এক ভদ্রলোক, তিনি বাঘের কামড়ের বনজ চিকিৎসা জানতেন। পুরা তিন মাসে তিনি ভাল হন, কিন্তু ঘা শুকিয়ে চামড়া কুঁচকানোর ফলে বাবার সুন্দর চেহারা বিকৃত হয়ে যায়। তিনি পুরা মুখ হা করে ভাতের নওলা মুখে দিতে পারতেন না, অতিকষ্টে নরম ও তরল খাবার খেতেন।

সামনের দুই পায়ের থাবায় অবিশ্বাস্য শক্তি ধরে বাঘ, চকিতের মধ্যে বাবার মাথায় একটা থাবা মারতেই খুলির অংশ, কান, চোয়ালের মাংসপেশী সব আলগা হয়ে যায়। বারো দিন পরে বাবার জীবনের আশঙ্কা দূর হয় । আমাদের শিকারী পরিবার, তাই গোলুখালীর বাঘ মারার জন্যে আমাদের দায়িত্ব চলে যায়নি। তাছাড়া সুন্দরবনের মহাবীর মেহের গাজীকে তার ভাইসহ জখম করেছে গোলখালীর বাঘ, এখন তার চূড়ান্ত মোকাবিলা না করে আমরা পারি না, কেন না পরিবারের সকলেই আমরা বন্দুক ধরতে জানি ।

পৃষ্ঠা ৪০

বারো দিনের দিন আমার ছোট দাদা, অর্থাৎ বাবার চাচা, ইসমাইল গাজী এবং আমার দুই চাচা আতাব্দী গাজী ও মাদার গাজী গোলখালী রওনা হলেন, আমিও সঙ্গে চললাম। কপোতাক্ষী পার হয়ে সেই গ্রামে গিয়ে দাদা কিছুক্ষণ গ্রামবাসীগণের সঙ্গে কথা বলে বাঘের সন্ধান নিলেন। মানুষখেকো বাঘ সেই বারো দিনে আরো একজন মানুষ ও দুইটা গরু খেয়েছে। গ্রামের কেউ মৃতদেহ বা গরু উদ্ধার করে আনতে পারেনি যদিও বন্দুকসহ দল বেঁধে গিয়ে তারা কিন্তু চেষ্টা করেছিল। এর মধ্যে একজন একদিন দুপুর বেলা বাজার থেকে ফিরার পথে দূরে হুদোবনের ভিতরে বাঘের গোঙানি শুনতে পেয়েছিল, সে প্রাণভয়ে ছুটে কোনরকমে বাড়ী ফিরে আসে ।

যতদূর ধারণা করা গেল, বাঘ তখনো গোলাখালী গ্রামেই ছিল, জখম শুকায়নি— যদি গোঙানীর আওয়াজ শোনার কথা ঠিক হয়ে থাকে। বাবা ও চাচাকে কামড়ানোর পরে গ্রামবাসীরা তো বটেই শিকারীদের মধ্যেও এমন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল যে হুদোবনে বাঘের অবস্থান জানা সত্ত্বেও কেউ আর সেই বাঘ মারার জন্যে কাছে যেতে সাহস পায়নি মৃত্যুরূপ মানুষখেকোর উপস্থিতি সত্ত্বেও এর মধ্যে গ্রামবাসীদের মধ্যে কিছু কিছু দৈনন্দিন কাজ-কাম শুরু হয়েছিল। হাট-বাজার, কৃষিকাজ ও চলাফিরা না করে কোন মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। কিন্তু আছরের ওয়াক্ত হয়ে গেলে তখন সকলেই যার যার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিত এবং প্রাণে ভয় বহন করে তারা রাত্রে ঘুমানোর চেষ্টা করত যাই হোক, গ্রামবাসী সবাইকে সতর্ক থাকতে বলে বিকাল তিনটার সময়ে দাদা আমাদের নিয়ে হুদোবনে নামলেন।

সবার আগে দাদা ইসমাইল গাজী, তাঁর হাতচারেক পিছনে প্রায় পাশাপাশি আমার দুই চাচা, অতাব্দী গাজী ও মাদার গাজী, তাঁদের তিনজনের হাতেই বন্দুক, এবং তাঁদের ঠিক পিছনে খালি হাতে ছিলাম আমি। যেখানে বাঘ বাবা ও চাচাকে আক্রমণ করেছিল, দাদা সাবধানতার সঙ্গে অগ্রসর হয়ে আগে সেই কেওড়া গাছটার তলায় গেলেন, দুই চাচা দুই দিকে বন্দুক ধরে দাঁড়ালেন, দাদা গাছের গোড়ার চারদিকে ভাল করে পরীক্ষা করতে লাগলেন । তাঁর সঙ্গে আমিও বাঘের অসংখ্য পারা দেখতে লাগলাম।

মানুষখেকো হোক আর সাধারণ হোক, বাঘমাত্রই অতি চঞ্চল জন্তু, এক জায়গায় বেশীক্ষণ শোবে না বা ঘুমাবে না, কেবল হাঁটাহাঁটি করবে। কেওড়া গাছের চারপাশে হাত দশ-বারো জায়গার মধ্যেই সম্ভবতঃ গত দুই দিনে বাঘ বার বার শুয়েছে ও হেঁটেছে, চিহ্ন থেকে তা বুঝতে পারলাম। এখনো বাঘ নিশ্চয়ই এই গাছটার পোয়া মাইল এলাকার মধ্যেই রয়েছে ।

এক পা এক পা করে এগুতে লাগলাম। আমরা চারজন আগ বাড়তে যতটুকু শব্দ হচ্ছিল চারটা পিঁপড়া হেঁটে গেলেও সম্ভবতঃ তার চেয়ে বেশী আওয়াজ হত না। ঝানু শিকারী দাদা একটি একটি করে হুদো কাত করে উদ্যত বন্দুকটা হাতে পথ করে এগুচ্ছিলেন তাঁর পরিণতির দিকে, আর পিছনে আমরা। দক্ষিণমুখে পঞ্চাশ হাতের বেশী যাইনি, হঠাৎ দাদার ডানপাশে কয়েকটা হুদোগাছ খাড়া হয়ে উঠল, দাদা বন্দুক ঘুরানোর আগেই ভয়ঙ্কর গর্জন করে বাঘ তাঁর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল। মাত্র চার হাত পিছনে চাচারা দুইজন দাঁড়িয়ে থেকেও কিছু করতে পারলেন না, দাদাকে মেরে বাঘ বিজলীর মত অদৃশ্য হয়ে গেল এত কাছে থেকেও আমি গর্জন শোনলাম, বাঘ দেখলাম না। সামনে ছুটে গিয়ে দেখি হুদো ঝোপের উপরে দাদার লাশ পড়ে আছে, মাথার একদিক কামড়ের চাপে চ্যাপ্টা হয়ে বসে গেছে, রক্ত ছুটছে। ঘাড়-মাথা জোড়া একটিমাত্র কামড়ে অন্ততঃ বিশটি বাঘ শিকারের অভিজ্ঞতা অর্জনকারী খ্যাতনামা শিকারীর জীবনাবসান হল।

পৃষ্ঠা ৪১

দাদার লাশ বহন করে, গোলখালীর লোকদের আরও বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে ফেলে রেখে আমাদের গ্রামে ফিরতে হল, বেবাক বাড়ীতে হাহাকার পড়ে গেল। দুর্বল এবং তখনো শয্যাগত বাবা আহত যোদ্ধার মত মোচড় দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, পর মুহূর্তে ইসমাইল গাজীর চূর্ণ-বিচূর্ণ মাথা বুকে ধরে শিশুর মত কাঁদতে লাগলেন। চারপাশের কয়েক মাইল এলাকার মধ্যে এমন কথাও ছড়িয়ে পড়ল যে, শিঙের গোলখালীর মানুষখেকো বাঘ মারার ক্ষমতা কোন মানুষের নেই।

অনেকে, বিশেষ করে মেয়েলোকেরা, বিশ্বাস করেই বলতে লাগল যে, এটা বাঘ নয়, বাঘের রূপ ধরে এক নরখাদক প্রেতাত্মা এসেছে, বন্দুকের গুলি তার গায়ে লাগে না। কিন্তু দীর্ঘদিনের ভয়ার্ত লোকে যাই বলুক না কেন, আমরা তো জানতাম যে সেটা বাঘ, হুদোবনের গভীর আচ্ছন্নতা ও আত্মগোপনের অবাধ সুযোগ পেয়ে এতদিন ধরে ক্রমাগত মানুষ মেরে যাচ্ছে। কোন না কোন শিকারীর গুলিতে একদিন সে মারা পড়বেই, কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে আর কে আছে যে তাকে মারতে যাবে?

দাদার মৃত্যুর পরও ষোল দিন পার হয়ে গেল। এর মধ্যে গোলখালী গ্রামের আরও একজন মানুষ মারা পড়েছে। বনে আমরা সেই খবর পাই। গরু কয়টি গেল তা জানার মত মানসিক অবস্থা আর আমাদের ছিল না। ততদিনে বাবা অনেকটা হয়ে উঠেছেন, অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে একটু একটু হাঁটতে পারেন। কিন্তু হেঁটে আর কোনখানে নয়, কেবল তাঁর চাচা ইসমাইল গাজীর কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকেন।

হঠাৎ একদিন দুপুরবেলা বাবা ডাকলেন আমাকে। কাছে যেতেই মাকে ইশারা করলেন বন্দুক বের করতে। মা দোনলা গাদা বন্দুকটি বের করে দিতেই বাবা সেটি আমার হাতে তুলে দিলেন। বললেন, ‘ধর!’ দুই হাতে বন্দুকটি নিয়ে সামনে দাঁড়ালে তিনি বললেন, ‘যাও, তুমি ছাড়া আর কেউ এই বাঘ মারতে পারবে না।’ সুন্দরবনের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঘ শিকারী, আমার বাবা মেহের গাজী তাঁর জীবনের হাতিয়ার ও অন্তরের দোয়া আমাকে দিলেন।

হাতে আন্দাজ করে বারুদ দিয়ে বললেন, ‘ভর!’ আমি বারুদ ভরলাম। পাট নিজ হাতে দলা করে দিয়ে বললেন, ‘ভর!’ পাট ভরলাম। তারপর গণে গণে ছরা দিলেন, আমি ছর্রা ভরলাম, সবশেষে আবার পাটের দলা ভরলাম, ক্যাপ পকেটে নিলাম; ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে যখন বাড়ী থেকে গোলখালীর উদ্দেশে রওনা হলাম তখন বেলা আন্দাজ দুইটার কাছাকাছি। একবার পিছনে তাকিয়ে দেখলাম ঘরের বারান্দায় মার কাঁধে ভর দিয়ে বাবা আমাদের দিকে চেয়ে রয়েছেন। আমার বয়স তখন আঠারো-ঊণিশ বছর। বাবা ও চাচার সঙ্গে গিয়ে ইতিমধ্যে আমি চারটি বাঘ মেরেছি; কিন্তু তাদের কোনটিই মানুষখেকো ছিল না, ছিল সাধারণ বাঘ। শিঙের গোলখালীর মানুষখেকো শিকার করতে বাবা ও দাদার সঙ্গে যে দুইবার গিয়েছিলাম, প্রতিবারেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছি আর এবার জেদী বাপের হুকুমে বলতে গেলে অনভিজ্ঞ আমি যাচ্ছি গোলখালীর বিভীষিকার মোকাবিলা করতে।

পৃষ্ঠা ৪২

কিন্তু তবু আমার মনে কোন ভয় ছিল না, যত ভয়ঙ্করই হোক না কেন বাঘকে ভয় করলে আমাদের চলে না। বেলা চারটায় গোলখালী পৌঁছলাম। গিয়েই শোনলাম, গতরাত্রে বাঘ এক গৃহস্থের গোহাল থেকে একটি বাছুর নিয়ে গেছে। গোহালের দরজা খোলা ছিল, বাঘ নিঃশব্দে ঢুকে বাছুর মুখে তুলে প্রায় দুই আনা মাইল দূরে হুদোবনে গিয়ে খেয়েছে। রাত্রে বাড়ীর লোকেরা বাঘের কোন গর্জন শোনেনি, কোন আওয়াজও পায়নি, সকালে গোহালে গিয়ে বাঘের পারা ও রক্ত দেখতে পেয়েছে সেদিন পোলখালীতে বন বিভাগের একজন কর্মকর্তা এবং আরো দুইজন শিকারী ছিলেন; তাঁরা গোলখালী গ্রামের আরো একজন বন্দুকধারীসমেত গিয়ে হুদোঝোপের ভিতরে আধা-খাওয়া বাছুর খুঁজে পান। তারপর আর অগ্রসর না হয়ে রাত্রে বাছুরের উপরে বসবেন স্থির করে তারা গ্রামে ফিরে আসেন।

আমি যেতে এবার মোট শিকারীর সংখ্যা হল পাঁচ, যদিও তখন পর্যন্ত সত্যিকারের শিকারী আমি হইনি। আমরা স্থির করলাম যে, বাঘের সম্ভাব্য আসার পথে এবং আধা খাওয়া বাছুরের উপরে বিভিন্ন সুবিধাজনক স্থানে আমরা বসব।

বেলা পাঁচটার সময়ে প্রায় বিশ-পঁচিশজন সাহসী গ্রামবাসীসহ আমরা হুদোবনে ঢুকলাম। যেখানে নিয়ে বাছুর খেয়েছে সেখানে হুদোঝোপ ছিল অপেক্ষাকৃত পাতলা৷ বাছুরের প্রায় চার আনা খেয়েছে, কাজেই বাঘ রাত্রে যে আবার আসবে তা একেবারে নিশ্চিতই; কোনরকম বাধা না পেলে বাঘ তার শিকারের কিছুই ফেলে না।

হুদোবন একটানা নীচু হলেও কোথাও একটি-দুইটি, কোথাও একসঙ্গে কয়েকটি, এ রকম বড় গাছ ছিল। অন্যান্য শিকারীরা কেউ একা, কেউ একজন সঙ্গী নিয়ে যার যার সুবিধামত গাছে বসলেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন বন বিভাগের কপোতাক্ষী অফিসের ডেপুটি রেঞ্জার, কপোতাক্ষীই গোলখালী থেকে নিকটবর্তী বন অফিস ৷ আমি বসলাম বাছুরটা থেকে প্রায় পনের হাত দূরে এক কেওড়া গাছে। ছোট ভাই আমার নির্দেশমত আমার মাথার হাতচারি উপরে বসে গাছের ডালের সঙ্গে তার কোমর বেঁধে নিল আর মাটি থেকে নয় হাত আন্দাজ উপরে যেখানে আমি বসলাম সেখান থেকে কয়েকটি ডাল একসঙ্গে বের হয়েছিল, যার ফলে আমি বেশ ভাল আড়াল করেই বসতে পারলাম।

পৃষ্ঠা ৪৩

আমরা শিকারীরা সবাই গাছে উঠে বসলে ডেপুটি রেঞ্জার সাহেবের নির্দেশে গ্রামবাসী লোকজন সবাই হৈ-চৈ করতে করতে যার যার বাড়ীতে চলে গেল । চারজন শিকারী নিজ নিজ পছন্দ অনুযায়ী গাছে বসেছিলেন; বাঘ আসার সম্ভাব্য দিক অনুমান করে এবং বাঘ দেখার ও গুলি করার সুবিধা বিবেচনা করে একজন থেকে আরেকজন প্রায় পঞ্চাশ-একশ হাত দূরে দূরে ছিলেন। আমি যে বাছুরটার মাত্র পনের হাত দূরে কেওড়া গাছে বসেছিলাম তা ছিল একেবারেই ঘটনাক্রমে, আমার কোন বিশেষ পছন্দ অনুযায়ী নয়; আর কোন শিকারীই সেই গাছে বসেননি।

আধা-খাওয়া বাছুরটা তখন আমার গাছ থেকে দক্ষিণে; আমার পিছনে, অর্থাৎ উত্তর দিকে, গোলখালীর শেষ বসতবাড়ী-বাছুর যার সেই গৃহস্থের বাড়ী, আমার গাছ থেকে তার ঘরের চাল দেখা যাচ্ছিল। বাছুরটা থেকে হাত তিরিশ দক্ষিণে একটি ছোট্ট খাল ছিল আর, আগেই বলেছি, সমস্ত জায়গাটা ছিল একটানা হুদোবন, হাঁটু সমান, কোথাও কোমর সমান, স্থানে স্থানে কেবল বিচ্ছিন্ন বড়-মাঝারি গাছ। শিকারীরা কে কোন্ গাছে ছিলেন তা প্রত্যেকেরই জানা ছিল। বাঘ সম্পূর্ণ সম্ভাবনায় দক্ষিণ দিক থেকে আসবে, সে আন্দাজেই সবাই গাছ বাছাই করেছিলেন। আর এই রাত্রে যদি আসে তাহলে পাঁচজনের যে কোন একজনের হাতে মারা পড়বে, অন্ততঃ আরেকটা গুলি খাবেই। অল্পক্ষণের মধ্যেই সমস্ত শিঙের গোলখালী গ্রামে ও হুদোবনে অন্ধকার নেমে এল।

পিছনে তাকিয়ে দেখলাম, গ্রামে একটি বাতিও জ্বলে না অন্ধকার ও নীরবতার মধ্য দিয়ে প্রায় একঘন্টা সময় কাটলে তখন পুব আসমানে ভরা চাঁদ উঠল, আর আলোর সঙ্গে সঙ্গে বনের মধ্য দিয়ে যেন একটা শিহরণ খেলে গেল; প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত হুদোবন লণ্ডভণ্ড করে বাতাস ছুটল। এর ফলে একটা অসুবিধা দেখা দিল যে, বাঘ কাছাকাছি এলেও আমরা তার আওয়াজ শুনতে পাব না, এক চাঁদের আলোর উপরে নির্ভর করতে হবে, কিন্তু আলো তখনো তীর্যক ছিল বলে বাছুরটার কাছে যথেষ্ট ছিল না।

প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে ধীরে ধীরে বাতাস থেমে গেল, তখন আবার পাতা নড়ার শব্দও আমি পরিষ্কার শুনতে পেলাম। আন্দাজ নয়টার সময়ে অনেক দূরে টাই! টাই! করে হরিণের ডাক শুনে সচকিত হয়ে উঠলাম, কিন্তু তার পরেই আবার নীরবতা। দশটার দিকে বন ফাটিয়ে চাঁদ এল প্রায় মাথার উপরে। সে আলো এত প্রখর ছিল যে পনের হাত দূরে অর্ধভুক্ত বাছুরটার ছাটনার হাড় পর্যন্ত আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। উজ্জ্বল আলোতে পরের দুই ঘন্টা নিস্তব্ধতার মধ্যে কাটিয়ে ক্লান্ত হয়ে আমি যখন আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম যে বাঘ আর আসবে না, ঠিক তখন রাত প্রায় বারোটার সময়ে, দক্ষিণের ছোট্ট খালে ঝপ্! ঝপ্! করে দুইবার শব্দ হল। দীর্ঘ প্রতীক্ষারত আমার কাছে সেই শব্দ কত বড় আকাঙ্ক্ষিত যে ছিল তা গভীর বনে মানুষখেকো বাঘ শিকার করেননি এমন কাউকে বুঝানো যাবে না; এক মিনিট পরে ঝক্ঝকা আলোতে আমি বাঘের পুরা শরীর দেখতে পেলাম।

মরা বাছুরটা থেকে হাত দশেকের মধ্যে এগিয়ে এসে থামল, বসল, আবার উঠে ডানদিকে বামদিকে মুখ ঘুরিয়ে, বাছুরটার একেবারে কাছে এসে দাঁড়াল। চটাৎ! করে একটি অতি ছোট্ট শব্দ হতেই বাঘ সেদিকে ফিরে চাইল, তখন আর একটুও দেরী না করে আমি বুক বরাবর ট্রিগার টানলাম। বিকট একটা গর্জন করে বাঘ পিছনে ছিটকে পড়ল এবং চক্ষের পলকে হুদোঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। পরের আধা মিনিট পর্যন্ত আমি কেবল বাঘের গোঙানী আর চার পায়ের দাবড়া-দাবড়ি শুনতে পেলাম এবং তখন, কোন শিকারী যে কাজ হয়ত কখনো করতেন না, মুহূর্তের বিবেচনায় আমি তাই করে বসলাম; শব্দ লক্ষ্য করে দ্বিতীয় গুলি করলাম।

পৃষ্ঠা ৪৪

পরের ছয় ঘন্টা আমরা সবাই গাছেই বসে রইলাম। চাঁদ ডুবে গেল, পূবের আকাশ ধলা হয়ে উঠল এবং দূরে একসঙ্গে কয়েকটি পাখী ডেকে উঠল। আমি, আমার ভাই বা শিকারীদের মধ্যে কেউই তখনো পর্যন্ত নিশ্চিত জানতে পারিনি যে বাঘ মরেছে না কি আবার হুদোবনেই অদৃশ্য হয়ে গেছে সূর্য উঠলে তখন চারজন শিকারী গাছ থেকে নেমে অতি সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে এলেন। আমিও নামলাম। সঙ্গীদের পিছনে থাকতে বলে আমরা পাঁচজন শিকারী একসঙ্গে বাঘ সন্ধান করতে অগ্রসর হলাম যদিও আমার গাদা বন্দুকে তখন আর গুলি ছিল না। মাছির ভণ্ ভণ্ কানে আসতেই বুঝলাম যে গুলি রাত্রে ঠিকই লেগেছে, এবং একটু পরে বাঘ টেনে খোলা জায়গায় আনার পরে দেখলাম যে আমার দ্বিতীয় গুলিও বাঘের পাজরেই লেগেছে সেখানেই মাপা হলঃ সাড়ে দশ ফুট লম্বা বুড়া বাঘ । যে ‘চটাৎ!’ শব্দের জন্যে আমি বাঘের বুকে গুলি করার সুযোগ পেয়েছিলাম সেটা ছিল জোংড়ার মুখ খোলার আওয়াজ । রাত্রির নীরবতায় শামুকের অত ছোট্ট শব্দও আমি পরিষ্কার শুনতে পেয়েছিলাম।

আধ ঘন্টার মধ্যে শিঙের গোলখালী গ্রাম শূন্য করে মেয়ে-পুরুষ-ছেলে-বুড়া বেবাক লোক হুদোবনে ছুটে এল, চীৎকার, গালিগালাজ, ক্রোধ প্রকাশ ও উল্লাসধ্বনি করতে করতে তারা বাঘের চার পা বেঁধে বয়ে নিয়ে এল সেই গৃহস্থের বার বাড়ীতে। দীর্ঘদিনের ত্রাস সৃষ্টিকারী ভয়ঙ্কর হিংস্র শত্রুর নিধনের আনন্দ এবং পুত্রহারা পিতামাতার হাহাকারে শিঙের গোলখালী গ্রামের বাতাস ভারী হয়ে উঠল।

শিকারী ভাইদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, গোলখালী গ্রামবাসীদের আন্তরিক সহায়তায় কপোতাক্ষী নদী পার করে বাঘ আড়াই মাইল দূরবর্তী সোরা গ্রামে আমাদের বাড়ীতে নিয়ে এলাম।

বাড়ীতে আমরা সবাই মিলে আমাদের উঠানে গোলখালীর বাঘের চামড়া ছোলাই করলাম। আগেই বলেছি যে বাঘটা ছিল বুড়া, কয়েকটা দাঁত ছিল না, বাবার গুলি বাঘের কাঁধের নীচে চামড়া ও অনেকখানি গোশ্ত ভেদ করে গিয়েছিল এবং পচন ধরেছিল, সেখানেই মাছি ভণ্ ভণ্ করছিল ।

এই আমার জীবনের প্রথম মানুষখেকো বাঘ শিকারের কাহিনী। বন দফতরে গোলখালীর বিভীষিকা এই বাঘের চামড়া জমা দিয়ে পুরস্কারের তৎকালীন ৩০০ টাকা পুরাপুরি এনে আমি বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। বাবা তখনও শয্যাগত, ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছিলেন।

বইয়ের পরবর্তী অংশ ওয়েবসাইটে আপলোড করা হবে শীঘ্রই। চোখ রাখুন Green Belt The Travelers ফেসবুক গ্রুপে।

প্রথম পর্ব: আঠারোবেকীর বাঘ – পর্ব ১
দ্বিতীয় পর্ব: দুবলার চরের মানুষখেকো – পর্ব ২

আরো পড়ুন

সুন্দরবনের মানুষখেকো – ২

১৯৭২ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনে বাঘকে উপদ্রব বলে গণ্য করা হত। তখন অনুমোদনপ্রাপ্ত যে কোন শিকারী বাঘ মেরে চামড়া ও মাথার খুলি বন অফিসে জমা দিলে তাঁকে অর্থ পুরস্কার দেওয়া হত। ১৯৭৩ সালে জারীকৃত বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী বনে এখন সকল প্রকার প্রাণী শিকার নিষিদ্ধ, বন দফতর থেকে ‘মানুষখেকো’ বলে কাগজেপত্রে ঘোষণা করলে তবেই কেবল সেই বাঘ মারা যায়। পচাব্দী গাজীর শিকার জীবন ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত। এর মধ্যে তিনি ৫৭ টি বাঘ মেরেছে। ফ্রান্স, জার্মানী, মধ্যপ্রাচ্য ও জাপানের পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশনে শিকারী পচাব্দী গাজীর কৃতিত্বের কাহিনী প্রচারিত হয়।

বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় সেবা প্রকাশণী থেকে ১৯৮০ সালে।  বিখ্যাত শিকারি পচাব্দী গাজীর জবানিতে বইটি লিখেছেন হুমায়ুন খান। বইয়ে ৭টি অনুচ্ছেদ আছে। ১. আঠারোবেকির বাঘ, ২. দুবলার চরের মানুষখেকো, ৩. গোলখালীর বিভীষিকা, ৪. সুন্দরবনের ভয়ঙ্কর, ৫. শিকারী জীবনের বিচ্ছিন্ন স্মৃতি, ৬. সুপতির মানুষখেকো, ৭. তালপট্টির বিভীষিকা।

এটি বইটি ধারাবাহিক প্রকাশের দ্বিতীয় পর্ব। প্রথম পর্ব এখানে পড়ুন।

দুবলার চরের মানুষখেকো

বাগেরহাটের শরণখোলা রেঞ্জের অধীনে দুবলা বহু মাইলব্যাপী এক বিশাল চর। সমুদ্ররেখার বরাবর সুন্দরবনের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত এই দ্বীপ। এর একদিক দিয়ে পশুর আর আরেক দিকে মরজত নদী বয়ে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। প্রত্যেক বছর কার্তিক থেকে মাঘ এই চার মাস প্রধানতঃ চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য এলাকার অন্ততঃ কয়েক হাজার হিন্দু-মুসলমান ও মগ জেলে এসে দুবলার চরে অস্থায়ী বসত গড়ে। তারা নদীর মোহনা এলাকা ধরে ও সাগরে মাছ ধরে, চরেই শুঁটকি দেয় ৷ বহু তাজা মাছ সাম্পান আর যান্ত্রিক ট্রলার বোঝাই হয়ে সরাসরি চালান যায় চট্টগ্রামে, কক্সবাজারে, সেখানে সাগরতীরে বড় এলাকাজোড়া শুঁটকি দেওয়া হয়। লটিয়া, লাক্কা, ছুরি, রূপচান্দা, ইলিশ, বাইন, জাবা, ভেটকি, দাঁতনী, ভোলা, চিংড়ি, এবং আরো নানা জাতের মাছ, মগ জেলেরা হাঙর মাছও ধরে শুঁটকি দেয়।

ফাল্গুন মাস এলে হাওয়া ঘুরে যায়, সমুদ্র আবার উত্তাল হয়ে উঠে, জেলেরা তখন জাল গুটিয়ে বড় বড় সাম্পানে শুঁটকি বোঝাই করে নিয়ে চলে যায়। তারপর থেকে একেবারে আশ্বিনের শেষাশেষি পর্যন্ত দুবলা দ্বীপ একেবারেই জনশূন্য পড়ে থাকে। পরের কার্তিকে উত্তরের হাওয়া বইতে শুরু করলে সমুদ্র আবার শান্ত হয়ে যায় এবং কয়েক হাজার জেলেও আবার দুবলার চরে এসে গোলপাতার চালাঘর বেঁধে ব্যাপকভাবে মাছ ধরার প্রস্তুতি নেয়। সুন্দরবনের এই এক বিরাট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ছোট ছোট নৌকা করে মাছ ধরছে, বড় বড় ট্রলারে করে সব নিয়ে যাচ্ছে। দেখতে বড় আকর্ষণীয় ।

সবাই বড় বড় মটকি ভরে মিঠা পানি নিয়ে আসে। শুধু জেলেরাই নয়, মাঝি, জোংড়াখুটা, বাওয়ালী ও মৌয়াল যারা সারা বছর ধরে শত শত মাইল বিস্তৃত সুন্দরবনে কাজ করে তারা সবাই খাবার পানি সঙ্গে নিয়ে আসে। কারণ সুন্দরবনের সব নদীর পানিই লোনা–পানের অযোগ্য। নিতান্ত বিপদে আপদে চর খুঁড়লে কিছু মিঠা পানি পাওয়া যায়, কিন্তু সে পানির জন্যে কেউ সময় নষ্ট করে না বা তা যথেষ্টও নয় ।

দুবলার চরের জেলেদের কাজ তদারক করার জন্যে, এবং জেলেদের কাছ থেকে নির্ধারিত কর আদায়ের জন্যে বন দফতর সেখানে চার মাসের অস্থায়ী অফিস করে। একটি বড় ভাসমান বোটের মধ্যেই সেই অফিস, সেখানে একজন কর্মকর্তা আর অন্যান্য কর্মচারীগণ থাকেন। সুন্দরবনের এই দক্ষিণের চর অঞ্চলেই ফোঁটা হরিণ সবচেয়ে বেশী দেখা যায় খুব ভোরে আর ভরসন্ধ্যায় শত শত সুন্দর হরিণ যখন একসঙ্গে জড়ো হয় তখন সে দৃশ্যের তুলনা হয় না। আবার সুন্দরবনের যে ময়াল বা অজগর সাপের কথা সবাই জানেন সেই বিশাল আকারের ময়ালও এই চর এলাকায়ই বেশী বাস করে। এক একটা এক মণ, দেড় মণ পর্যন্ত ওজনের হয় এবং ইঁদুর, খরগোশ ও ছোট আকারের শূয়োর বা হরিণ আস্ত গিলে ফেলে। সুযোগ পেলে মানুষকেও আক্রমণ করে।

নদীতে ও সাগরে বড় ভয় দুইটির, কামোট ও কুমীরের। কেউ গোসল করতে কি কোন কাজে পানিতে নেমেছে, হঠাৎ পায়ে তীক্ষ্ণ খোঁচা লাগল, সেই পায়ে আর ভর করতে পারে না। হাতে খোঁচা লাগল, সেই হাতে আর বল পায় না, কামোট বা হাঙরে নিয়ে গেছে। প্রত্যেক বছর সমগ্র সুন্দরবন এলাকায় বহু লোক কামোটের দাঁতে হাত-পা হারায়। কুমীরের পেটেও যায় পাঁচ-দশজন। কুমীর কমোটের মত হাত-পা কেটে নেয় না, পানি থেকে গোটা মানুষই ধরে নিয়ে টুকরা টুকরা করে খেয়ে ফেলে। বাঘ একজন মানুষ খায় দুই দিনে কিন্তু কুমীর পরের দিনের জন্যে কিছু রাখে না। সুন্দরবনের সব কুমীরই মানুষ খায়।

পৃষ্ঠা ২৬

কিন্তু চর এলাকার শুধু চর এলাকার নয়, সমগ্র সুন্দরবন এলাকারই-জেলেদের সবচেয়ে বড় শত্রু হল বাঘ। কারণ সাবধান সচেতন থাকলে তারা কামোট-কুমীরের মুখ থেকে বাঁচতে পারে, কিন্তু বাঘের মুখ থেকে নয় বাঘ থাকে বনে-বনের সর্বত্র তার বিচরণ, তার মুখ থেকে বাঁচার উপায় নেই। দুবলার চর এবং সুন্দরবনের অন্যান্য চরগুলো আসলে এক একটি ছোট ব-দ্বীপ সবগুলোই বনজঙ্গলে ঢাকা। জঙ্গল কোথাও গভীর একেবারে দুর্ভেদ্য ও অগম্য, আবার জায়গায় জায়গায় কিছুটা ফাঁকা। বাংলা ১৩৫৮ সালের অগ্রহায়ণের শেষাশেষি এই চরে যখন একটি মানুষখেকো বাঘের উপদ্রব হয় তখন এখানে অন্ততঃ দুই হাজার হিন্দু-মুসলমান মগ জেলে মাছ ধরছিল । বাঘের বিরুদ্ধে সেই হতভাগ্যদের আত্মরক্ষার কোন ব্যবস্থাই ছিল না বলে মানুষখেকোটি একের পর এক জেলেকে নিয়ে যেতে থাকে।

বন কর্মকর্তা ও শিকারীগণ বোট নিয়ে, নৌকা নিয়ে জেলেদের বস্তির কাছাকাছি জঙ্গলে গিয়ে বাঘ মারার চেষ্টা করেন, কিন্তু ধূর্ত বাঘের ভয়ঙ্করতা তাঁদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়, মানুষখেকো হলে তখন বাঘের ধূর্তামিও অনেক বেড়ে যায়। কিছুদূর পরে পরে জেলে বসতি, চারদিকেই জঙ্গল; অসহায় জেলেদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শিকারীগণের প্রহরা ও অনুসন্ধান সত্ত্বেও এই মানুষখেকোটি দুবলার চরে মাত্র এক মাস সময়ের মধ্যে যে তেরজন জেলেকে ধরে খেয়েছিল আমি তাদের মধ্যে দুই-তিনটির সাধারণ উল্লেখ করব।

দশ-পনের হাত দূরে দূরে চারজন জেলে দাও দিয়ে গরানের চারা কাটছিল। খটি বা চালাঘর থেকে তারা তখন মাত্র শ-খানেক হাত দূরে এবং বেলা আন্দাজ আটটা । হঠাৎ একপাশ থেকে বাঘ গর্জন করে একজনের উপরে লাফ দিয়ে পড়ে, মাথায় কামড় দিয়ে ধরে মুখে তুলে নিয়ে যেতে থাকে। সঙ্গী জেলেরা প্রথমে মাটিতে শুয়ে পড়েছিল, কিন্তু চোখের সামনে তাকে নিয়ে যাচ্ছে দেখে কিছুক্ষণের মধ্যে সাহস ফিরে পায়। তারা চীৎকার করতে থাকে, অল্পক্ষণের মধ্যে লাঠিবাড়ি নিয়ে আরো কয়েকজন আসে। সকলে মিলে হৈ-চৈ করতে করতে জঙ্গলে এগুতে থাকে। প্রায় শ দুই হাত দূরে গিয়ে এক ঝোপের পিছন থেকে তারা হতভাগ্যের লাশ উদ্ধার করে আনে। এ ছিল হিন্দু, চরেই তার মৃতদেহের সৎকার করা হয় ।

জেলেরা গরান গাছ কাটে কষের জন্যে। সরু সরু গরানের ছাল টুকরা টুকরা করে জ্বাল দিয়ে যে কষ পাওয়া যায় তা তারা জালে লাগায়, শুকালে জাল মজবুত হয়। বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গার জেলেরা গাবের কষ দেয়, সুন্দরবনে গাব গাছ নেই। চরের জেলেরা যে বাঘের মুখে যায় তাদের অনেকেই এই গরান গাছ কাটার সময়ে সেই ঘটনার ঠিক পরের দিন। গরান গাছ কেটে বিকাল বেলা দুই জনে মুগুর দিয়ে পিটিয়ে ডাল থেকে ছাল আলগা করছিল। জায়গাটা তাদের চালাঘর থেকে খুব বেশী দূরে নয়। খালের পাড়ে জঙ্গল, তারই এক প্রান্তে দুইজন সামনা সামনি এবং অপেক্ষাকৃত খোলা জায়গাতে বসা ছিল। হঠাৎ পিছন থেকে এসে বাঘ একজনকে ধরে। জেলের ঘাড়ে-মাথায় কামড় দিয়ে ধরে দুইটা ঝট্কা মারে এবং ভয়ে আধমরা দ্বিতীয় জেলের সামনেই তাকে নিয়ে জঙ্গলে চলে যায়। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দ্বিতীয় জেলে দৌড় দেয়, ঘরের ভিতরে গেলে তবে তার মুখ থেকে চীৎকার বের হয় এবং সকলকে সে মর্মন্তুদ ঘটনার কথা জানাতে সক্ষম হয়।

পৃষ্ঠা ২৭

বিশ-পঁচিশজন লোক হৈ-চৈ করতে করতে জেলেকে উদ্ধার করতে রওনা হয়। কিন্তু তখন বেলা পড়ে গেছে, জঙ্গলের ভিতরে বেশীদূর এগুনো সম্ভব হয়নি। অগত্যা তারা সেদিনের মত ফিরে আসে। সকালে প্রায় পঞ্চাশ-ষাটজন রওনা হয়। কুড়াল, দা, লাঠি, কাঠ যার যা ছিল সঙ্গে নিয়ে চলল। বাঘের পারা, রক্তের চিহ্ন ধরে জঙ্গলের ভিতরে প্রায় সিকি মাইল যেতেই হঠাৎ বাঘের গর্! গর্! চাপা গর্জন শুনতে পায়, আর তাদের পক্ষে সামনে এগুনো সম্ভব হয়নি। এই জেলের লাশ বা হাড়-গোড় আর কেউ আনতে যায়নি; এ ছিল মুসলমান।

রাত্রে ভাত খেয়ে একজন জেলে পিছনের খটিতে তার এক আত্মীয়কে দেখতে যায় ৷ এটা কোনো অস্বাভাবিক কিছু নয় । জেলেদের খটি বা চালাঘরগুলো কোন কোন এলাকাতে বেশ ঘন ঘন থাকে এবং একটি থেকে হয়ত বা পাঁচ-ছয় বিঘা জায়গা পরেই আরেকটি চালাঘর। সারাদিন তারা নদীতে ও সাগরে মাছ ধরে, শুঁটকি করে, জাল শুকায়, তখন কর্মব্যস্ততার দরুন আত্মীয়-স্বজনের ভাল-মন্দের খবর নেওয়া সম্ভব হয় না; রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পরেই কেবল তাদের জীবনে সামাজিক সম্পর্ক রক্ষার সুযোগ এই জেলের খটি থেকে মাত্র কয়েক শ হাত হালকা জঙ্গল পার হলেই অপর খটি, সেখানে তার আত্মীয় থাকে। বের হয়ে যাওয়ার পর রাত্রে সে আর ঘরে ফিরেনি। তাদের ঘরের অন্য সবার মনে সন্দেহ হয়–স্বভাবতঃই যে, মাত্র ককেদিনের মধ্যে এই চরের আটজন মানুষকে বাঘে নিয়ে গেছে। অবশ্য তারা কেউ কোন বাঘের গর্জন শুনতে পায়নি ।

সন্দেহ আর ভয়ের মধ্যে দীর্ঘ রাত পার হয়। সকাল বেলা কয়েকজন মিলে পিছনের খটিতে খবর নিতে যায়, আধা রাস্তায় যেতেই তারা বাঘের পারা আর রক্ত দেখতে পায়। চীৎকার করে ডাকাডাকিতে দুই খটির জেলেরা সকলে সেখানে জড় হয় এবং ঘটনা বুঝতে পারে। তারা স্থির করে যে শুধু নিরস্ত্র অবস্থায় জঙ্গলে না ঢুকে বন অফিসের বোটের একজন শিকারীকে সঙ্গে নিয়ে যাবে, নতুবা মৃতদেহ উদ্ধার করে আনতে যারা যাবে তাদের মধ্য থেকে আরো একজন না একজন বাঘের মুখে পড়বে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বোট থেকে দুইজন শিকারীকে গিয়ে নিয়ে আসা হয়। তাঁদের পিছনে পিছনে বেশ অনেক লোক সিকি মাইলের মত জঙ্গল পার হয়ে গিয়ে এক আঁটো জায়গাতে লাশ পায় ! অর্ধেকই খেয়ে ফেলেছে। জেলেরা সেই আধা-খাওয়া দেহ এনে জানাজা পড়ে চালাঘরের সামনেই মাটি দেয়, শিকারী দুইজন সন্ধ্যা পর্যন্ত দুবলার জঙ্গলে বাঘের ব্যর্থ সন্ধান করেন।

মাত্র এক মাসের মধ্যে দুবলার চরের তেরজন জেলে অসহায়ভাবে বাঘের মুখে গেল। বন দফতরে নিযুক্ত শিকারীগণ, বোটের ফরেস্টার, বনপ্রহরী এবং ভাড়া করে আনা শিকারী সেই সময়ের মধ্যে বাঘের কোন মোকাবিলা করতে পারলেন না। কেউ একটি গুলি করার সুযোগও পাননি। কোন কোন দেহ জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে সৎকার বা কবর দেওয়া গিয়েছিল কোনটা তাও পারা যায়নি। দুবলার জেলেদের অনেকেই যেহেতু সুদূর চট্টগ্রাম এলাকা থেকে আগত তাই কারো মৃত্যু হলে তাকে আর বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না, চরেই পোড়াতে হয় বা কবর দিতে হয় দ্বীপের অবস্থা অতি শোচনীয় পর্যায়ে গিয়ে পৌছায়। জেলেরা যে কোথাও যাবে সে উপায় নেই, আবার মানুষখেকো বাঘের কিছু যে করবে সেই শক্তিও নেই। বোটের শিকারীগণ যথাসাধ্য চেষ্টা করেও প্রাণহানি রোধ করতে পারলেন না।

পৃষ্ঠা ২৮

দুবলার অস্থায়ী বোট অফিসের দায়িত্বে তখন ছিলেন রেঞ্জার কাজী করীম সাহেব দিন দিনই অবস্থা বেশী শোচনীয় হচ্ছে এবং সকলের আয়ত্বের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে তিনি আর স্থানীয় শিকারীগণের উপরে নির্ভর করে থাকতে পারলেন না। নিজেই লঞ্চ নিয়ে দীর্ঘ নদীপথ পার হয়ে আমার গ্রামের বাড়ী সোরাতে এসে উঠলেন। দুবলা হল। সুন্দরবনের সর্বদক্ষিণ প্রান্তে সমুদ্রের কিনারায়, আর আমার বাড়ী হল বনের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে ।

হাজার হাজার জেলের অসহায় অবস্থা, ধূর্ত নরখাদকের ভয়ঙ্করতা এবং প্রাণনাশের ঘটনাগুলো কাজী সাহেবের মুখ থেকে শোনার পরে আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। তখনো আমি বন দফতরে চাকরী নিইনি, পেশাদার বাঘ শিকারীরূপে বন বিভাগের স্বীকৃতিপত্র নিয়ে বনে গিয়ে শিকার করে থাকি। কিন্তু ঘটনাগুলো শোনার পরমুহূর্তের চেতনাবোধহেতু লঞ্চের ইঞ্জিন ঠাণ্ডা হবার আগেই আবার চালু করতে হল; নিজেদের কোন একজনকে সঙ্গী হিসাবে না নিয়েই আমি তৎক্ষণাৎ লঞ্চে উঠে বসলাম। আমার স্ত্রী আপত্তি করলেন এবং বলতে পারব না কেন, আমার মা ক্ষ্যান্ত বিবি, যিনি সুন্দরবনের দুর্জয় সাহসী, স্বনামধন্য বাঘ শিকারী মেহের গাজীর সংসার করেছেন, সেই মা-ও বললেন, ‘এখন যেয়ো না’। কিন্তু তাঁদের বাধা ঠেলেই আমি দুবলা রওনা হয়ে গেলাম; এবং তারপর সেখান থেকে যে আতঙ্কজনক অভিজ্ঞতা নিয়ে আবার বাড়ীতে ফিরে এলাম তা, ঘটনার এতদিন পরে, আজও মাঝে মাঝে আমার মনে জাগে এবং আমি যেন শুধু দুঃস্বপ্ন দেখতে থাকি৷

বাড়ী থেকে সন্ধ্যার পরে পরে রওনা হয়ে পরদিন সকাল সাতটায় আমরা দুবলা গিয়ে পৌঁছলাম । চরের অস্থায়ী অফিস আমাকে সকল রকম সুযোগ-সুবিধা দিল; একটি বড় বোট, সঙ্গে মজবুত ডিঙি, তিনজন বোটম্যান বা বনমাঝি এবং আরো একজন পাহারাদার, আর সকলের জন্যে যথেষ্ট খাবার। বিপদের মোকাবিলার জন্যে সুন্দরবনের সকল বন অফিসেই বন্দুক থাকে, দুবলার চরের ভাসমান অফিসেও ছিল। যে বন্দুক তাঁরা আমকে দিয়েছিলেন তা ছিল একটি দোনলা বেলজিয়াম। আগের দিনই বন অফিসে খবর পৌঁছেছিল যে মানিকখালীতে একজন জেলেকে বাঘে নিয়ে গেছে। কাজেই দুবলার অস্থায়ী বন অফিসের বোটে একবেলার বেশী দেরী করলাম না। জেলের দেহাবশেষ উদ্ধার করার এবং একটা সম্ভাব্য সুযোগের আশায় আমরা রওনা হলাম।

বিকাল তিনটায় দুবলা থেকে বোট ছেড়ে রাত বারোটায় মানিকখালী গিয়ে পৌছলাম। বাকী রাতটা বোটেই আধা-ঘুমা আধা-জাগা অবস্থায় কাটিয়ে দিলাম এবং সকাল সাতটার মধ্যেই নাশ্তা করে একটি ডিঙি নিয়ে বের হয়ে গেলাম, দুইজন বোটম্যান ডিঙি বাইতে লাগল আর মাঝখানে বন্দুক হাতে বসলাম আমি মানিকখালীর জেলেদের জিজ্ঞেস করে সঠিক জায়গা চিনে নিলাম যে কোনখান থেকে দুইদিন আগে গরান গাছ কাটার সময়ে জেলেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। জেলেদের কাছেই শোনলাম যে, ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যে তারা সবাই তাকে উদ্ধার করে আনতে গিয়েছিল, কিন্তু জঙ্গলের ভিতরে কিছুদূর যেতেই এক ঝোপের পিছন থেকে গভীর গর্! গর্! শব্দ শুনতে পায় এবং তখন সবাই প্রাণভয়ে ফিরে আসে। পঞ্চাশ-ষাটজন লোকের হৈ-চৈকেও বাঘ ভয় করে না এবং মুখের শিকার না খেয়ে সে ছাড়বে না জেলের দেহ আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি ।

সাধারণ বাঘ মানুষকে ভয় পায়, সামনে দেখলে বিদ্যুৎবেগে ছুটে পালায়। কিন্তু মানুষখেকো হলে তখন সেই বাঘের আর ভয় থাকে না, পাঁচ-দশজনের মধ্যে একজনকে আক্রমণ করে বসে, এমন কি সাঁতার কেটে নৌকায় উঠে ঘুমন্ত জেলে মাঝিদের পর্যন্ত মুখে তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু অর্ধভুক্ত দেহ উদ্ধার করতে আসা পঞ্চাশজনের উদ্ধারকারী দলকে গর্! গর্! ডাক দিয়ে ভয় দেখিয়ে পিছিয়ে দেওয়া এমন কি মানুষখেকো বাঘের জন্যেও অস্বাভাবিক ।

পৃষ্ঠা ২৯

গত একমাসে এই বাঘ গড়ে প্রতি তিন দিনে একজন করে মানুষ খেয়েছে; দুইদিন আগে ধরা শিকার নিশ্চয়ই এর মধ্যে সে খেয়ে ফেলেছে এবং আজ অবশ্যই খাবারের অন্বেষণে বের হবে; জেলেদের মধ্যে যারা জাল নিয়ে গাঙে ও সাগরে গেছে তারা নিরাপদ, যারা চালাঘরে কাজ করছে—শুঁটকি দিচ্ছে বা খোলা যায়গাতে বসে জালে কষ লাগাচ্ছে তারাও কিছুটা নিরাপদ; কিন্তু যারা গরান গাছ কাটতে বের হয়েছে তাদেরই বেশী ভয় ৷

আমি স্থির করলাম, দুইদিন আগে গরান গাছ কাটার সময়ে যেখান থেকে জেলেকে নিয়ে গেছে আগে সেখানে যাব, মরির যদি কিছুমাত্রও থাকে তবে—যদিও সে সম্ভাবনা কম—তাহলে মরির উপরেই আগে বসব। জেলেরা আমাদেরকে যে জায়গাটা দেখিয়ে দিল সেটা আমাদের বোট থেকে আধ মাইল.হবে না, খালের উল্টাপাড়ে। পাড় সেখানে সামান্য উঁচু এবং একবারে কিনারা থেকেই গভীর বন। মিনিট বিশেকের মধ্যে আমরা ডিঙি নিয়ে সেই স্থানে পৌছলাম।

গত দুইদিন বৃষ্টি হয়নি, সুন্দরবনে শীতকালেও মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়—কাজেই রক্তের চিহ্ন নিশ্চয়ই মুছে যায়নি, বাঘের পারাও থেকে থাকবে-যদিও পঞ্চাশজন লোক সেখান দিয়ে হেঁটে গেছে—তাই উদ্ধারকারী দল যেখান দিয়ে এগিয়েছিল সেই চিহ্ন ধরতে আমার অসুবিধা হবে না। পাছার মাঝি ডিঙি ঘুরিয়ে পাড়ে লাগাল আর বন্দুকের দুই নলে টোটা ভরে আমি লাফ দিয়ে টানে উঠলাম।

জঙ্গলের কিনারায় পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঘ আমাকে আক্রমণ করল। ‘হুঙ্ক!’ গর্জন শোনার আগেই কি শক্তিবলে যে আমি দুই হাত পিছনে সরে এসেছিলাম তা বলতে পারব না, বাঘ ঠিক আমার দুই হাত সামনে পড়েই গা-গা করে পিছনের দুই পায়ের উপরে খাড়া হয়ে উঠল, হাতের আন্দাজে নিশানা করে ট্রিগার টানলাম, কিন্তু গুলি ছুটল না। তখন বিকট হা মেলে গাঁ-গা করতে করতে বাঘ আমার মাথা লক্ষ্য করল। আমি বন্দুকের নল বাঘের ব্যাদান করা মুখের বরাবর ধরে ট্রিগার টানতে লাগলাম, কিন্তু গুলি ছুটল না! গুলি ছুটল না! গুলি ছুটল না! গলা ফাটিয়ে চীৎকার করতে লাগলাম। বাঘ হঃ! হঃ! ডাক ছেড়ে আমাকে কামড়ে ধরতে এল, বাঘের মুখের লালা আমার গায়ে আর মুখে ছিটকে পড়তে লাগল। চারটি ভয়ঙ্কর দাঁত আর গোঁফ যেন আমার হাতে লাগল। বন্দুকের নল তার দাঁত-মুখ বরাবর ধরে আমি বাঘের পাল্টা হাঁক ছাড়তে লাগলাম আর লাফিয়ে লাফিয়ে পিছে হঠতে লাগলাম! লালায় আমার শরীর ভরে গেল। একদলা ফেনা নাকে আর কপালে এসে ছিটকে পড়ল, সরাতে পারলাম না। আবার হঃ! হঃ! করে বাঘ তার বিশাল শরীরটা ঝাঁকাতে লাগল। আমার মনে হল গোটা দুনিয়া যেন থর্ থর্ করে কাঁপছে, আমি জমিনের নীচে চলে যাচ্ছি, মনে হল আমার শরীরটা নেই, আত্মা যেন হাড়ের সঙ্গে লেগে আছে। বাঘ আবার হঃ! হঃ! করে উঠতেই একসঙ্গে একদলা লালা ছিটকে এল, আমি আবার নিজের শরীরটা বোধ করলাম । হাঃ! হাঃ! যাঃ! যাঃ! ডাক ছেড়ে বন্দুকের নল একেবারে মুখের হা বরাবর ঠেলে দিলাম। বাঘ তার শরীর পিছনে সঙ্কুচিত করল, আমি একপাশে সরে যেতেই খালের পানিতে পা পড়ল, লাফ দিয়ে খালে পড়ে ডুব দিলাম ।

মাথা তুলতে দেখি খালের চারভাগের তিনভাগ পার হয়ে গেছি, আরেক ডুবে পাড়ে পৌছলাম । উঠে ছুটে কয়েক হাত দূরে একটা গাছের গোড়ায় গিয়ে পিছনে তাকালাম, দেখি বাঘ লাফ দিয়ে পানিতে যে পড়েছিল এখন গোঁ গোঁ করতে করতে আবার পাড়ে উঠছে। বন্দুকের টোটা খুলে পকেট থেকে অন্য দুইটি ভিজা টোটা ভরে বাঘের বুক বরাবর নিশানা করে আবার ট্রিগার টানলাম কিন্তু তবু গুলি ছুটল না। বেলজিয়াম বন্দুক, কিন্তু সেই বন্দুকটা ভাল ছিল না। ওপারে বাঘ পানি থেকে পাড়ে উঠে কয়েকবারই আমার দিকে তাকিয়ে মুখ খিঁচাল, তারপর জঙ্গলে ঢুকে গেল। জঙ্গলাকীর্ণ একেবারে জনশূন্য চর, পিছনে দেখতে দেখতে বেহুঁশের মত ছুটলাম আর এতক্ষণে দুই চোখ ফেটে পানি এল আমার।

পৃষ্ঠা ৩০

পাড়ে বাঘের গর্জন শোনামাত্র বোটম্যান দুইজন আমাকে ফেলে ডিঙি ভাসিয়ে দিয়ে নিজেদের প্রাণ দুইটি নিয়ে তাড়াতাড়ি বোটে চলে এসেছিল। আমি বাঘের মুখ থেকে রক্ষা পেয়ে চর পার হয়ে বেহুঁশের মত ছুটে গিয়ে যখন বোটে উঠব ঠিক সেই মুহূর্তেও তারা অন্যদের কাছে বর্ণনা করছিল যে কেমন করে হঠাৎ বাঘ আমার উপরে লাফ দিয়ে পড়ে আমার মাথাটা গিলে ফেলে এবং আরপর আমার শরীরটা এক ঝটকায় পিঠে তুলে নিয়ে জঙ্গলের ভিতরে চলে যায়; তারা কোন সাহায্য করারই সুযোগ পায়নি।

আমি বন্দুক হাতে বোটের গলুইয়ে পা দিতেই বোটটা দুলে উঠল আর ভিতরে ওরা ‘বাবা গো, খেয়ে ফেলল!’ বলে আর্তনাদ করে উঠল। ভাবল, যে-সঙ্গীকে বাঘের মুখে ফেলে পালিয়ে এসেছে সেই পচাব্দী গাজীকে খেয়ে বাঘ এবার অবশ্যই তাদেরকে খাবার জন্যে লাফ দিয়ে বোটে উঠেছে। আমি পর পর পাঁচ গেলাস পানি খেলাম, কথা বলতে পারলাম না, বন্দুকটা ফেলে পাটাতনের উপরেই শুয়ে পড়লাম। সারা শরীর থর্ থর্ করে কাঁপতে লাগল ।

সেইদিনই আমি দুবলার অস্থায়ী বন অফিসে ফিরে গিয়ে অকেজো বন্দুকটি জমা দিলাম এবং বাঘ শিকার করতে অস্বীকার করলাম। বোটের রেঞ্জার কাজী সাহেবসমেত সবাই আমার অভিজ্ঞতার কাহিনী শুনে ভয়ে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। কিন্তু অবস্থা বিবেচনা করে আবার বললেন যে বন্দুক আরো রয়েছে এবং আমি চলে যাওয়ার অর্থ হবে দুবলার চরের হতভাগ্য জেলেদেরকে মানুষখেকোর মুখের খোরাক করেই রেখে যাওয়া। তাঁরা অনেক আশা করেই আমাকে বাড়ী থেকে আনিয়েছিলেন; আর বাঘ শিকার করতে এসে বিখ্যাত মেহের গাজীর ছেলে পচাব্দী গাজী বাঘের মুখে পড়েছিল, অতঃপর প্রাণভয়ে বাড়ী চলে গেছে, এই কথাটি প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে দুবলার চরের হাজার হাজার জেলের মধ্যে একেবারেই অবশ কর্মহীনতা সৃষ্টি হয়ে যাবে। কিন্তু তাঁদের কথা বিবেচনা করার মত মানসিক অবস্থা তখন আর আমার ছিল না। বললাম, ‘বাড়ী যাই, যদি বাঘ শিকার করতে হয় তবে আমার নিজের লোক সঙ্গে নিয়ে এসে করব।’

দুবলার চর থেকে একটি মাছের নৌকা করে সেই রাত্রেই আমি খুলনা গেলাম এবং সেখান থেকে লঞ্চে করে পরদিন বিকালে আমার বাড়ী শ্যামনগর থানার সোরা গ্রামে পৌছলাম । পরের বারোদিন বাড়ীতে মা, স্ত্রী-ছেলেমেয়ে ও অনেক আপনজনের মাঝে বেশ হাসিখুশীতেই কাটালাম। ততদিনে মনের আতঙ্ক ও অস্বাভাবিকতা অতিক্রম করে আবার মজবুত হয়ে উঠলাম। কিন্তু তারপরেই আবার দুবলার চরের হাজার হাজার অসহায় মানুষদের কথা মনে করে আমি কেমন যেন অস্থির হয়ে পড়লাম দিনরাত কাদের যেন ডাক, কাদের যেন আর্তনাদ, হাহাকার আমাকে অস্থির করে তুলল ।

আমরা শিকারী বংশের মানুষ, যত ছোটই হই না কেন ভয়ঙ্কর মানুষখেকোকে সামনা সামনি মোকাবিলা করে বনের জেলে-বাওয়ালীদের রক্ষা করার গৌরব আমাদের রক্তে মিশে আছে। আমার দাদার ভাই দাদা, শিকারী ইসমাইল গাজী বাঘের মুখে প্রাণ দিয়েছিলেন, আমার বিখ্যাত বাবা, শিকারী মেহের গাজী পঞ্চাশটির বেশী বাঘ মেরে বাঘের কামড়ে মারা যান, আমার চাচা নিজাম্দী গাজীর একটা হাত বাঘে নিয়ে গেছে। যত ধূর্ত, যত ভয়ঙ্করই হোক না কেন, বাঘের কাছে আমি হার মানতে পারি না। সুন্দরবনের যেখানে মানুষখেকো বাঘ সেখানেই আমাদের ঠিকানা।

পৃষ্ঠা ৩১

এবারে মা ‘না’ বললেন না, স্ত্রীও কিছু বললেন না; ছোট ভাই হাশেম আলীকে আর শ্যালককে সঙ্গে নিয়ে আমার নিজের নৌকা করে আবার দুবলার ভাসমান বন অফিসের বোটে গিয়ে হাজির হলাম। কাজী করীম সাহেবের, বন বিভাগের অন্যান্য কর্মকর্তা ও লোকজনদের খুশীর আর শেষ রইল না। তাঁরা যেন জানতেন যে আমি আবার সেখানে যাব এবং মানুষখেকোকে শেষ পর্যন্ত আমিই মারব। কয়েকটা বন্দুকই এগিয়ে দিলেন, আমার যেটা পছন্দ । আমি আরেকটা দোনলা বেলজিয়াম বন্দুকই নিলাম, দুইটি কার্তুজ ভরে এবার আগেই শূন্যে গুলি করে দেখে নিলাম।

সেই বারোদিনে আরো দুইজন বাঘের মুখে গেছে। জেলেরা এমনি সাহস হারিয়ে ফেলেছে যে অনেকে মিলে গিয়ে যে উদ্ধার করে আনবে তাও করতে পারেনি। এর মধ্যে অন্যান্য শিকারীগণও চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কেউ বাঘকে গুলি করার সুযোগ পাননি পরবর্তী তিনদিন ধরে আমরা তিনজনে ডিঙি নিয়ে সন্ধান করতে থাকলাম। সারাদিন খালে খালে, বনের ধারে, বনের ভিতরে বাঘের সন্ধান করলাম, কিন্তু বাঘ যদিও একেবারে নিশ্চিত সেই এলাকাতেই ছিল।

এর মধ্যে দুবলার চরের সকল জেলেদের বলে দেওয়া হল যে, কোনখানে কেউ বাঘ দেখলে, কি বাঘে কোথাও কাউকে আক্রমণ করলে তা যেন তৎক্ষণাৎ বন অফিসের বোটে বা আমকে জানানো হয়। দুইদিন এক রাতের মধ্যে কোনখান থেকে খবর পাওয়া গেল না বা আমরাও কোনখানে বাঘ দেখতে পেলাম না। কিন্তু আমি নিশ্চিত জানতাম যে কোনখানে কোন একজন জেলের অসাবধানতার সুযোগ এই মানুষখেকো বাঘ অবশ্যই নিবে; তাই আমাকে একটু ক্ষান্ত হলে চলবে না।

দেখলাম না, তৃতীয় দিনে বন অফিসের বোট থেকে আমরা তখন প্রায় দুই মাইল দূরে। আমার ভাই হাশেম আর শ্যালক-রাত প্রায় বারোটা পর্যন্ত সজাগ থেকে তারপর ছৈ-এর নীচে ঘুমাতে গেল। আমি অর্ধেক শরীর ছৈ-এর ভিতরে এবং অর্ধেক বাইরে হয়ে বসে সকাল পর্যন্ত একাই জেগে থাকব স্থির করলাম। তখন মাঘ মাসের শুরু, কিন্তু সমুদ্রের কাছাকাছি চর এলাকায় শীত খুব বেশী ছিল না। পুর্ণিমার তিন দিন বাকী ছিল বলে প্রায় সারা রাতই চাঁদের আলো থাকবে, সেই আলোতে অন্ততঃ চল্লিশ হাতের মধ্যেও বাঘ এলে আমি দেখতে পাব এবং আমার গুলি সম্ভবতঃ লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে না।

ফজরের ওয়াক্ত পর্যন্ত বনে শুয়োরের শব্দ পেলাম দুই-তিনবার, হরিণের ডাকও শোনলাম, কিন্তু সেগুলোর কোনটাকেই ভয়ার্ত ডাক বলে মনে হল না এবং সারা রাতের মধ্যে বাঘের কোন চিহ্নও দেখলাম না। পূবের আকাশ ফর্সা হলে তখন হাশেম আলী ও আমার শ্যালককে জাগালাম, হাশেমের হাতে বন্দুক দিয়ে নামাজ পড়লাম এবং শুধু ক্লান্তি নিয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম । সকাল আটটার সময়ে গরম ভাত খেয়ে আমরা আবার নৌকা ছাড়ব, এমন সময়ে দেখি একটি ডিঙি নৌকা খুব জোরে বেয়ে আমাদের দিকে আসছে। আমরা নৌকা কিনারায় ভিড়িয়ে একটু দেরী করলাম। ডিঙিতে তিনজন জেলে, তাদের মধ্যে একজন তরুণ যুবক, আমার সামনে খালের পাড়ে শুয়ে পড়ে হাউমাউ করে বলতে লাগল, ‘আমার ভাই ভালয়ে গেছে! আমার ভাই ভালয়ে গেছে!’ তার আর কোন কথাই বুঝা গেল না, শোকে, আঘাতে সে এমন হয়ে গেছে যে, বারবারই কেবল বলছে, ‘আমার ভাই ভালয়ে গেছে!’ তার সঙ্গী দুইজনের কাছ থেকে আমরা অতি দুঃখজনক ঘটনার বর্ণনা শোনলাম।

পৃষ্ঠা ৩২

মাত্র এক ঘন্টারও কম সময় আগে বাঘ যেখান থেকে একজন জেলেকে নিয়ে গেছে সে জায়গাটা আমাদের নৌকা থেকে আরো আধা মাইল এবং দুবলা বোট অফিস থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে। খটি থেকে কিছু দূরে তারা চারজন গরান গাছ কাটতে গিয়েছিল। অল্প কয়েকটিমাত্র চারা গাছ কাটতেই হঠাৎ একপাশ থেকে বাঘ একজনের উপরে লাফ দিয়ে পড়ে এবং তাকে মুখে নিয়ে জঙ্গলের ভিতরে চলে যায়। যে হতভাগ্য বাঘের মুখে গেছে সে এই ক্রন্দনরত যুবকের আপন বড় ভাই।

আমি বললাম, ‘বন অফিসে পরে যাবে, আগে চল ওকে নিয়ে আসি।’ দুই নৌকা করে আমরা তক্ষুণি রওনা হলাম এবং আধ ঘন্টার মধ্যেই ঘটনাস্থলে গিয়ে পৌছলাম। বাঘের হিংস্রতার এক মর্মান্তিক চিহ্ন দেখলাম। জঙ্গলের কিনারায়ই তারা গরান চারা কাটছিল। চারজন একই জায়গায় প্রায় পাশাপাশি ছিল, অর্থাৎ কেউ কারো থেকে বিচ্ছিন্ন বা দূরে নয়। দশ-পনের মিনিটমাত্র গাছ কাটতেই বাঘ একটা গর্জন করে জেলেকে ধরে এবং তার ঘাড়ে কামড় দিয়ে ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু জেলে তখনো মরেনি, গোঙাতে গোঙাতে হাত-পা আছড়াতে থাকে, একটা ছোট চারাগাছ সে আঁকড়ে ধরে। শিকার নড়াচড়া করছে দেখে হাত দশেক নিয়ে গিয়ে বাঘ তাকে মাটিতে থোয়, আবার ঘাড়ে গলায় কামড়ে ধরে দুইটা হ্যাচকা ঝাঁকুনি দিয়ে মেরে ফেলে, তারপর মুখে তুলে নিয়ে যায়। যেখানে বাঘ জেলেকে প্রথমে ধরেছিল সে জায়গায় রক্ত পড়েছিল আর হাত দশেক দূরে যেখানে নিয়ে কামড় ছেড়ে দিয়ে আবার ধরেছিল, যখন হতভাগ্যের মুখ থেকে একটা ‘ক্যাক!’ শব্দ হয়ে গোঙানি থেমে যায়, সেখানে অনেক রক্ত।

আমরা ছয়জন বাঘের পারা আর রক্ত দেখে দেখে এগুতে লাগলাম। কিছুদূর যেতেই তার কাপড় পেলাম-একটা চারা গাছের সঙ্গে আটকে আছে— তারপর আর মাত্র হাত পঞ্চাশেক যেতেই জেলেকে পেলাম, গরান বনের ভিতরে কতকটা খোলা জায়গাতেই পড়ে রয়েছে। পা দুইটি গুটানো, মাথাটা একদিকে কাত অবস্থায়, চোখ খোলা, যেন চেয়ে আছে; বাঘ কাছে ধারে আছে বলে মনে হল না। জেলের শরীর থেকে এক খাবলা গোশত খায়নি। এমন হতে পারে যে তার ভাইয়ের চীৎকারে বিরক্ত হয়ে শিকার এ পর্যন্ত এনে কাছেই কোথাও অপেক্ষা করছিল, এখন আমাদের আওয়াজ পেয়ে সরে গেছে। গত তিন দিনে বাঘ কোন মানুষ খায়নি, আজ নিশ্চয়ই খুব বেশী ক্ষুধার্ত হবে, কেবল নিরাপত্তার অভাবেই শিকার খেতে শুরু করেনি।

জেলের ভাই তক্ষুণি মৃতদেহ নিয়ে যেতে চাইল, কিন্তু আমি এবং বাকী সবাই বুঝিয়ে বলাতে সে আধাবেলার জন্যে রাখতে রাজী হল। সেই আধাবেলার মাঝেই গুলি করার একটা নিশ্চিত সুযোগ পাবে বলে আশা করলাম। বাঘ অবশ্যই বেশী দূরে কোথাও যায়নি, অতি ক্ষুধার্ত থাকাতে, একটু নিরিবিলি পেলে এই এখনিও আসতে পারে।

মরি থেকে প্রায় বিশ হাত সোজা পশ্চিমে একটা বিশাল বাইন গাছের আট-নয় হাত উপরে একটি ডাল মোটামুটি বসার উপযোগী ছিল, সেটাতেই উঠে বসলাম। আমার শ্যালক খালি হাতেই উঠে বসল গিয়ে আমার উপরের ডালে। হাশেম আলী তিনজন জেলেকে নিয়ে হাত ধরাধরি করে, জোরে কথা বলতে বলতে নৌকায় চলে গেল আমার শ্যালক প্রায় সোজা আমার মাথার উপরে আড়াল করে বসল, আর মাটি থেকে আট-নয় হাত উপরে মোটা ডালে পাতার আড়াল করে কাণ্ডের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে বসলাম আমি। আমার বন্দুকের দুই নলই ভরা। জেলের মৃতদেহ আমার গাছের গুড়ি থেকে প্রায় বিশ হাত পূবে। এখন বাঘ যেদিক থেকেই আসুক না কেন, যদি মরির কাছে আসে তাহলে আমার গুলি করতে কোন অসুবিধা হবে না। আর বাঘ যদি ইতিমধ্যেই আমাদের দুইজনকে দেখে ফেলে থাকে এবং না আসে তাহলে আমার আজকের প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হবে।

কিন্তু আসার সময়ে অতি ক্ষুধার্ত ও ক্রুদ্ধ বাঘ সম্ভবতঃ তার ফেলে যাওয়া শিকার ছাড়া আর কোন কিছুই খুব সাবধানতার সঙ্গে খেয়াল করবে না। আমরা যখন বাইন গাছে উঠে বসি তখন বেলা ছিল এগারটা-সাড়ে এগারটা। তার পর থেকে বেলা একটা পর্যন্ত আধা-অন্ধকার বনে প্রায় স্তব্ধ নীরবতা বিরাজ করতে লাগল, বাতাসে পাতা নড়া ছাড়া আর কোন শব্দও শুনতে পেলাম না। সকল সতর্কতার সঙ্গে আমি লক্ষ্য রাখতে থাকলাম। মাঝে মাঝে উপরে তাকাই, প্রতিবারেই আমার শ্যালক হাত নেড়ে বা মুখ নেড়ে ইঙ্গিত করে জানায় যে কিছু চোখে পড়েনি। স্তব্ধতার মধ্যে সময় কাটতে লাগল ।

পৃষ্ঠা ৩৩

হঠাৎ পাতার চড়ু চড়ু শব্দ শোনলাম, প্রায় একশ হাত দূরে পূব-দক্ষিণ দিকে। সারা জীবন সুন্দরবনে কাটিয়ে ওই গুরুত্বপূর্ণ ছোট্ট শব্দের সঙ্গে আমি অতি পরিচিত ছিলাম, দূরের ক্ষীণ আওয়াজ হলেও আমার মনে সন্দেহমাত্র রইল না যে, বাঘ এসেছে ৷ এর পরের পাঁচ মিনিট সময় ধরে উত্তেজনায় আমার শরীরের সব লোম খাড়া হয়ে রইল, কিন্তু মরি থেকে প্রায় ত্রিশ হাত দূরে ঝোপের ভিতর থেকে বাঘ যখন বের হয়ে এল তখন আমার আর সাহসের অভাব হল না।

এদিক সেদিক কোথাও না তাকিয়ে বাঘ দাপটের সঙ্গে মরির দিকে এগিয়ে এল, জেলের ঘাড় কামড়ে ধরে তুলে নিয়ে যাবার জন্যে মুখটা উঁচু করল, আর সেই মুহূর্তে আমি বুক বরাবর গুলি করলাম ‘হৌক্ক!’ করে ডাক ছেড়ে বাঘ লাফ দিয়ে উঠল, মুখ থেকে জেলের দেহ শূন্যে ছুটে অন্ততঃ দশ হাত দূরে গিয়ে পড়ল আর গুলির আঘাতে বিশাল বাঘটা পিছন দিকে মাটিতে পড়ে চার পা দাবড়াতে দাবড়াতে শরীরটা একদিকে ঠেলতে লাগল। হাত পাঁচ-ছয় সে রকম ঠেলে ঠেলে বাঘের মাথাটা যখন একটা ঝোপের ভিতরে চলে গেছে কিন্তু বাকী শরীর বাইরে—তখন কোমরে দ্বিতীয় গুলি লাগতেই মুখের গোঙানি আর চার পায়ের মাটি দাবড়ানি সব থেমে গেল। বিশাল বাঘটা পিছনের একটা পা শূন্যে তোলা অবস্থায় আধা-চীৎ আধা কাত হয়ে পড়ে রইল। আমি গাছ থেকে ‘আল্লা! আল্লা!’ বলে ডাক দিলাম, সঙ্গে সঙ্গে নৌকা থেকে হাশেম আলী ডাক দিল, ‘আল্লা! আল্লা! আল্লা! আল্লা! আল্লাহ!’

এক নৌকায় বাঘ আরেক নৌকায় জেলের দেহ নিয়ে বেলা আনুমানিক তিনটার সময়ে আমরা দুবলার চরের অস্থায়ী বন অফিসে বোটের কাছে পৌছলাম এবং নৌকা কিনারায় ভিড়ানোর আগে শূন্যে একটা গুলি করলাম। শোকাহত দীর্ঘদিনের আতঙ্কগ্রস্ত হাজার হাজার জেলে এই শূন্যে একটা গুলির জন্যেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ছিল, এক ঘন্টা সময়ের মধ্যে প্রায় এক হাজার জেলে এসে বাঘের চারদিকে জড় হল ।

সেদিন তারা কিছুতেই চামড়া ছোলাই করতে দিল না, তাই সারারাত বাঘ রাখতে হল বোটের সামনে চরে। চাঁদনী রাত ছিল, রাতভরই লোক আসতে লাগল। মানুষখেকো বাঘ মারা পড়েছে, এখন আর কোন ভয় নেই, দল বেঁধে এবং একজন একজন করেও চাঁদের আলোয় দুবলার চরের চারদিক থেকে জেলেরা কেবল আসতে লাগল। মাঘ মাসের সারারাত ধরে এমন চলল ৷ পরদিন সকালে সব লোকের উপস্থিতিতে বাঘের চামড়া ছাড়ানো হয়। সাড়ে দশ ফুট লম্বা বাঘের সামনের চারটা দাঁত ছিল না, অর্থাৎ মানুষখেকো ছিল বুড়া বাঘ।

হারানো আত্মীয়-স্বজন ও সঙ্গীর শোকে অনেক জেলেই তখন কান্নাকাটি করছিল। দুবলার চরের মানুষখোকোর ষোল নম্বর এবং শেষ শিকার ছিল যে জেলে, তার ভাই বারবারই শুধু বলছিল, ‘আমার ভাইকে মারলি, তুইও মরলি!’

বইয়ের পরবর্তী অংশ ওয়েবসাইটে আপলোড করা হবে শীঘ্রই। চোখ রাখুন Green Belt The Travelers ফেসবুক গ্রুপে।

প্রথম পর্ব: আঠারোবেকীর বাঘ – পর্ব ১
তৃতীয় পর্ব: গোলখালীর বিভীষিকা – পর্ব ৩

আরো পড়ুন

সুন্দরবনের মানুষখেকো – পর্ব ১

সুন্দরবনের কোন এলাকায় মানুষখেকো বাঘের উপদ্রব হলে প্রথমে বন অফিসের লোকেরাই সেই বাঘ মারতে চেষ্টা করেন। বন-কর্মকর্তাগণের মধ্যে, এমন কি বনপ্রহরী, বনমাঝিদের মধ্যেও অনেকে আছেন যারা ভাল শিকারী। কিন্তু মারাত্মক মানুষখেকোর ক্ষেত্রে তখন আর এঁদের উপরে নির্ভর করা যায় না, পেশাদার এবং শক্ত স্নায়ুর অধিকারী সুকৌশলী শিকারীর প্রয়োজন হয় । সুন্দরবনের প্রান্তবর্তী গ্রামসমূহে কিছুসংখ্যক শিকারী পরিবার আছে, তাঁদের মধ্যে বন দফতরের অনুমোদনপ্রাপ্ত শিকারীগণ রয়েছেন, বন দফতর মানুষখেকো বাঘের উপর পুরস্কার ঘোষণা করে সেই শিকারীগণকে খবর দেয়, তখন তাঁরা গিয়ে বাঘ মারেন। পচাব্দী গাজী তেমনি এক নামকরা শিকারী বংশের সন্তান এবং আজ পর্যন্ত সুন্দরবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে গৌরবময় কৃতিত্বের অধিকারী শিকারী । তিনি জীবনে সাতান্নটা রয়াল বেঙ্গল বাঘ মেরেছেন, সেগুলোর মধ্যে একুশটাই ছিল ভয়ঙ্কর মানুষখোকো।

১৯৭২ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনে বাঘকে উপদ্রব বলে গণ্য করা হত। তখন অনুমোদনপ্রাপ্ত যে কোন শিকারী বাঘ মেরে চামড়া ও মাথার খুলি বন অফিসে জমা দিলে তাঁকে অর্থ পুরস্কার দেওয়া হত। ১৯৭৩ সালে জারীকৃত বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী বনে এখন সকল প্রকার প্রাণী শিকার নিষিদ্ধ, বন দফতর থেকে ‘মানুষখেকো’ বলে কাগজেপত্রে ঘোষণা করলে তবেই কেবল সেই বাঘ মারা যায়। পচাব্দী গাজীর শিকার জীবন ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত, যদিও আশির দশকের শেষভাগে তিনি আরো একটি বিখ্যাত মানুষখেকো বাঘ মেরেছেন। তিনি প্রথমে চাকরী করতেন না, পিতার মত স্বাধীনভাবে শিকার করতেন, পরে বিখ্যাত বন কর্মকর্তা জনাব আবদুল আলীম তাঁকে বন বিভাগের চাকরীতে নিয়ে আসেন। ফ্রান্স, জার্মানী, মধ্যপ্রাচ্য ও জাপানের পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশনে শিকারী পচাব্দী গাজীর কৃতিত্বের কাহিনী প্রচারিত হয়।

বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় সেবা প্রকাশণী থেকে ১৯৮০ সালে।  বিখ্যাত শিকারি পচাব্দী গাজীর জবানিতে বইটি লিখেছেন হুমায়ুন খান। বইয়ে ৭টি অনুচ্ছেদ আছে। ১. আঠারোবেকির বাঘ, ২. দুবলার চরের মানুষখেকো, ৩. গোলখালীর বিভীষিকা, ৪. সুন্দরবনের ভয়ঙ্কর, ৫. শিকারী জীবনের বিচ্ছিন্ন স্মৃতি, ৬. সুপতির মানুষখেকো, ৭. তালপট্টির বিভীষিকা।

আঠারবেকীর বাঘ

তেইশজন মানুষ খাওয়ার পরে এই ভয়ঙ্কর বাঘটা আমার হাতে মারা পরে। এটার কথা আমি সবার আগে বলব সাতক্ষীরা জিলার শ্যামনগর থানার অধিকাংশ এলাকাই সুন্দরবনের অন্তর্ভুক্ত। রায়মঙ্গল ও যমুনা নদী দুইটি শ্যামনগরের ভিতর দিয়ে বয়ে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে; দুই নদীর মাঝখানের মৌজাটির নাম আঠারবেকী। প্রায় বিশ মাইল লম্বা মৌজা, পুরাটাই বন আর বন। সুন্দরবন। অত্যন্ত ঘন গজানো গরান আর গেওয়া বন, তার সঙ্গে সুন্দরী, কাঁকড়া, কেওড়া, বাইন ও অন্যান্য গাছ। মাঝে মাঝে হুদো লতার জঙ্গল, আবার অতি দুর্ভেদ্য হেতাল ঝোপ-বাঘের প্রধান আস্তানা।

নদী থেকে বের হওয়া অসংখ্য ছোটবড় খালে মৌজাটি প্রায় জালের মত ছাওয়া। চব্বিশ ঘন্টায় দুইবার জোয়ার, দুইবার ভাটা হয়। জোয়ারকে আমরা সুন্দরবনের লোকেরা বলি ‘গোণ লেগেছে’, অর্থাৎ গ্রহণ লেগেছে। সে সময়ে খালগুলো কানায় কানায় ভরে যায়, পাড় ডুবে বনের ভিতরেও হাঁটু পানি হয়। আবার ভাটার টানে সেই পানি সব নেমে যায়, তখন ঝিঝিরা পানিতে পড়ে থাকে অসংখ্য ছোট-বড় লোনাপানির মাছ। সুন্দরবনের সব নদী ও খালের পানিই লোনা।

এক আঠারবেকী মৌজার মধ্যেই এ রকম অসংখ্য খাল রয়েছে-নদীতে পড়েছে, নদী থেকে উঠেছে। এগুলোর ধারে ধারে, নদীর কিনারে সুন্দরবনের বিখ্যাত গোলপাতার গাছ হয়। পাতা গোল নয়, হুবহু নারিকেল পাতার মত, আবার নারিকেল গাছের মত কাণ্ড হয় না, একেবারে গোড়া থেকেই পাতা গজায়। গোলপাতা দিয়ে ঘরের ছাউনি হয়, বেড়া হয়, নৌকার ছৈ হয় সাবেক খুলনা, যশোর, বরিশাল, পটুয়াখালী ও নোয়াখালী জিলার নীচু অঞ্চলের অধিকাংশ নিম্নবিত্ত মানুষের ঘরই গোলপাতা দিয়ে ছাওয়া। অনেক অবস্থাপন্ন গৃহস্থের ঘরেও এই ছাউনি থাকে, একেক ছাউনিতে সাত-আট বছর চলে যায়। সুন্দরবনের নদী খালের কিনারা থেকে যারা এই গোলপাতা কেটে আনে, দুর্গম বন এলাকা থেকে যারা কাঠের গুড়ি আর লাকড়ি কেটে আনে তাদেরকেই বলা হয় ‘বাওয়ালী । এরা নেহায়েত দরিদ্র শ্রমিক, পেটের দায়ে বনে গিয়ে কাজ করে কোনরকমে সংসার চালায়।

ইংরাজী ১৯৬৬ সালের ঘটনা। সকাল সাতটা-আটটার সময়ে ছয়জন বাওয়ালী দুই ডিঙি নৌকা করে আঠারবেকীতে গোলপাতা কাটতে যায়। খালের কিনারা জুড়ে একটানা বিস্তৃত গোলগাছের কাছে ডিঙি বেঁধে কিনারায় আধা কাদা আধা-মাটিতে নেমে গোলপাতা কাটছিল, কেউ কারো থেকে বেশী দূরে নয়। একজন বাওয়ালী দুইখানা ডগা কেটে মাটিতে রেখে তৃতীয়টির গোড়ায় দায়ের কোপ দিয়েছে, সেই মুহূর্তে বাম পাশ থেকে হুঙ্কার দিয়ে বাঘ তার উপরে পড়ে। ঘাড় কামড়ে ধরে বিড়াল যে রকম সহজে ইঁদুর নিয়ে যায় ঠিক তেমনি বাওয়ালীকে নিয়ে পিছনের জঙ্গলে চলে যায় ।

বাঘের ‘হুঙ্ক!’ গর্জন শুনেই পাঁচজন বাওয়ালীর আত্মা কেঁপে উঠে, দুইজন গোলগাছের উপড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। পুরা হুঁশ হলে পাচজনই উঠে সঙ্গী যেখানে পাতা কাটছিল সেই গাছটার কাছে যায়। তাকে বাঘে নিয়ে গেছে চোখেই দেখেছে, তবু বিশ্বাস হতে চায় না। তার দা গোলগাছের গোড়ায় পড়ে রয়েছে, তীরের মত রক্ত ছুটে গাছের পাতায় আর কাদাতে লেগেছে, গোলপাতার ধার বেয়ে নীচে পড়ছে । সংখ্যায় পাঁচজন ছিল বলে আর সকালবেলা বলে বাওয়ালীরা সাহস সম্পূর্ণ হারায়নি। দা-কাঠ-লাঠি নিয়ে চীৎকার করতে করতে তারা সঙ্গীকে উদ্ধার করতে রওনা হয়। ভিজা মাটিতে বাঘের পারা ও তাজা রক্ত দেখে এগুতে থাকে। হাত বিশেক যেতেই তার নীল-রঙা লুঙ্গি পায়, এক কোনা গাছের ডালের সঙ্গে আটকা, একজনে ছিঁড়া লুঙ্গিটা হাতে তুলে নেয়।

পৃষ্ঠা ১৩

পাঁচজনে আবার এগুতে থাকে। আরও আন্দাজ দুইশ হাত জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে তারা লাশ পায়। বাওয়ালীর উলঙ্গ শরীরটা কুঁচকানো, মাথা একদিকে কাত হয়ে আছে। পিঠ আর বাম হাতে বাঘ যে থাবা মেরেছে গোশত আলগা হয়ে গেছে, ঘাড় গলা মারাত্মক দাঁতের কামড়ে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেছে, প্রচুর রক্ত পড়েছে এবং তখনো পড়ছে।

 বাওয়ালীরা হৈ-চৈ চীৎকার করতে করতে লাশ নৌকায় নিয়ে আসে। আঠারবেকীর মানুষখেকো বাঘ তার প্রথম শিকার খেতে পারেনি। দ্বিতীয়টি পেরেছিল। সেই দিনই রাত্রে এই ঘটনাস্থল থেকে মাত্র পোয়া মাইল দূরে ফুলখালীর খালের গোলপাতা বোঝাই নৌকায় ঘুমাচ্ছিল চারজন বাওয়ালী। এটা সুন্দরবনের খুব সাধারণ দৃশ্য এবং চিরাচরিত রীতি। খুব সকাল থেকে একেবারে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত বাওয়ালীরা বনে কাঠ, লাকড়ি বা গোলপাতা কাটে। রাত হলে কাঠ-কাটা বাওয়ালীরা নদীর কিনারায় মাটি থেকে সাত-আট হাত উঁচুতে তৈরী টোঙ বা অস্থায়ী ছোট্ট ঘরে গিয়ে ঢালা বিছানাতে ঘুমায়। কিন্তু পাতা-কাটা বাওয়ালীরা পাড় থেকে পনেরো-বিশ হাত বাইরে নৌকা গেড়ে সেখানে ঘুমায়। জোয়ারের সময়ে অনেকে খালেও রাত কাটায়। ভাটার সময়ে খালে পানি কম থাকলে তখন নৌকা নদীতে নিয়ে গিয়ে সে রকমই কিনারা থেকে পনের, বিশ কি তিরিশ হাত দূরে গেড়ে ঘুমায় নৌকা বড় হলে মজবুত ছৈ-এর তলে তারা নিরাপদেই থাকে, কিন্তু মাঝারি নৌকা হলে সাধারণ একটা ছৈ-মাত্র তাদের রাত কাটাবার আশ্রয় হয় ।

ফুলখালীর খাল বেশ বড়, চল্লিশ হাতের কম প্রশস্ত নয়। চারজন বাওয়ালী ছিল মাঝারি আকারের নৌকাতে। সামান্য ছৈ-এর তলায় সকলের জায়গা হয় না, বাকী নৌকাতে গোলপাতা বোঝাই, উপরভাগ সমান। সেই পাতার উপরেও বিছানা করা হয়েছিল। ভাত খেয়ে, হুঁকা খেয়ে, চারজন রাতের মত শুয়ে পড়ে। দুইজনের পুরা শরীরই ছৈ-এর ভিতরে থাকলেও পা ছিল বাইরে।

সকালবেলা মাত্র পোয়া মাইল দূরের একজন গোলপাতা কাটা বাওয়ালীকে যে বাঘে খেয়েছে সে কথা এই চারজন বাওয়ালী শুনেছিল, যদিও লাশ তারা দেখতে যায়নি। তা সত্ত্বেও মাত্র আধ মাইলখানেক দূরের নদীতে না গিয়ে তারা যে খালেই ঘুমানো স্থির করেছিল সেটা অবশ্য ছিল তাদের দুঃসাহস এবং বোকামী, কিন্তু সে ধরনের বোকামী সুন্দরবনে আদৌ কোন বিরল ঘটনা নয়। আগের দিন বিকালে যেখান থেকে হয়ত বাঘে মানুষ ধরে নিয়ে গেছে, পরদিন সকালেই তার আশেপাশে বাওয়ালীরা আবার কাজ করছে, এটা বনে অহরহ ঘটে থাকে ।

এদের নৌকা গোলপাতায় ভরেনি, আরো পাঁচ-সাত মন আন্দাজ খালি ছিল। ভেবেছিল যে, পরদিন সকালে আরো ঘন্টা দুই ঘন্টা পাতা কেটে বোঝাই পুরা করে তখন নৌকা ছাড়বে । তাছাড়া তাদের পানির হিসাবও মোটামুটি ঠিক ছিল। রাত্রে যখন তারা ঘুমায় তখন খালে ছিল জোয়ার ভাটার টানে পানি কমতে শুরু করলেও ভোর রাতের আগে ভাটা শেষ হবে না, তখন তারা ঘুম থেকে উঠে নামাজ-কালাম পড়বে। ফুলখালীর খালে ভাটার সময়েও কিছু পানি থাকে এবং মাঝখালে নৌকা রাখা চলে ।

পৃষ্ঠা ১৪

কিন্তু আঠারবেকীর মানুষখেকো ছিল সুন্দরবনের ইতিহাসে এক অতি ভয়ঙ্কর বাঘ । সম্পূর্ণ অচিন্তিত উপায়ে সে একজন হতভাগা মানুষকে ধরে নিয়ে যায়। রাত আন্দাজ বারোটার কাছাকাছি সময়ে বাঘ নিঃশব্দে সাঁতার কেটে কিনারা থেকে দূরে নৌকাতে গিয়ে উঠে। বাঘের ভরে নৌকা একদিকে কাত হয়ে ডুবে যাওয়ার মত হয়। তখন ডিঙিতে আধা শরীর তুলে ছৈ-এর বাইরে শোওয়া যে বাওয়ালীর ঘাড় কামড়ে ধরে, সে কেবল ‘ক্ক্যাক!’ করে একটা শব্দমাত্র উচ্চারণ করতে পেরেছিল। তিনজন বাওয়ালীর ভয়ার্ত ‘বাঘ! বাঘ! যাঃ! যাঃ!’ চীৎকারে কিছুমাত্র না দমে, লোকটিকে মুখে তুলে বিশাল বড় বাঘ খাল পার হয়ে বনের ভিতরে অদৃশ্য হয়ে যায়।

ভয়াবহ স্তব্ধতার মাঝে তিন বাওয়ালীর বাকী রাত কাটে। সকালে সূর্য উঠলে তখন নৌকা খুলে তারা গিয়ে আরো দশ-বারোজন বাওয়ালী ভাইকে ডেকে আনে। সকলে মিলে দা-কাঠ-কুড়াল নিয়ে হৈ-চৈ করতে করতে জঙ্গলে ঢোকে। বাঘের পারা দেখে দেখে প্রায় সিকি মাইল ভিতরে গিয়ে একটা আঁটো যায়গায় লাশ পায়। রাতের মধ্যে বাঘ বাওয়ালীর পেট, নাড়িভুরি, কোমর ও উরু সব খেয়ে ফেলেছে। সেই আধা-খাওয়া লাশ এনে তারা বন বিভাগের অস্থায়ী অফিসে এই মৃত্যুর খবর রেকর্ড করায় এবং তারপরে জানাজা পড়ে নদীর চরেই দাফন করে। এর পরে তিনদিন পর্যন্ত বাঘ যদিও আর কাউকে আক্রমণ করেনি তবু সমস্ত আঠারবেকী এলাকায় মারাত্মক ভীতি ছড়িয়ে পড়ে।

বন বিভাগের কর্মকর্তাগণ মানুষখেকো বাঘ সম্বন্ধে সতর্ক হয়ে উঠেন। অবিলম্বেই বন দফতরের কয়েকজন শিকা বন্দুক ও রাইফেল নিয়ে বের হয়ে যান। কর্মকর্তাদের মধ্যে শিকারী আছেন, অন্যান্য বন কর্মচারীগণের মধ্যেও কেউ কেউ আছেন যে শিকার করতে জানেন—যদিও তাঁরা ঠিক পেশাদার শিকারী নন। কোনখানে মানুষখেকো বাঘের উপদ্রব হলে সঙ্গে সঙ্গে এই শিকারীগণ সেখানে গিয়ে বাঘের মোকাবিলা করতে চেষ্টা করেন এবং বাওয়ালীরা যাতে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারে সে রকম নিরাপত্তার বিধান করেন। যখন এই ব্যবস্থা যথেষ্ট না হয় তখন বন বিভাগ থেকে মানুষখেকো বাঘের জন্যে পুরস্কার ঘোষণা করা হয় এবং পেশাদার শিকারীগণকে জরুরী সংবাদ পাঠানো হয় ।

ঠিক তিন দিন পরে বাঘ আরেকজন বাওয়ালীকে ধরে নিয়ে যায়। ফুলখালী থেকে কাঁচিকাটা খালের দূরত্ব আধ মাইলের বেশী নয়। দুইটি ডিঙি নৌকা করে ছয় বাওয়ালী গোলপাতা কাটছিল খালে। ফুলখালীর বাওয়ালীকে বাঘে খাওয়ার পর থেকে আঠারবেকীর আর সব বাওয়ালীই যতদূর সম্ভব সাবধানতার সঙ্গে পাতা কাটতে থাকে দল থেকে দূরে একাকী না থেকে পরস্পর কাছাকাছি থাকলে বাঘের আক্রমণের সম্ভাবনা কম থাকে। এই বাওয়ালীরাও খুব সতর্কতার সঙ্গেই কাজ করছিল

সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নির্বিঘ্নে পাতা কেটে, গোসল করে, বাওয়ালীরা নৌকায় বসে ভাত খায়। তারপর খানিক বিশ্রাম করে, হুঁকা টেনে, আবার গিয়ে পাতা কাটায় লাগে। কেউই একজন আরেকজন থেকে পাঁচ-সাত হাতের বেশী দূরে ছিল না। হঠাৎ ‘হুঙ্ক!’ করে এক ভয়ঙ্কর গর্জনের সঙ্গে বাঘ আড়াল থেকে একজন বাওয়ালীর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে। আক্রমণের ধাক্কায় আর বাঘের বিশাল দেহের ভারে বাওয়ালী তলে পড়ে যায়।

এই কাহিনী যিনি পড়বেন তিনি সঙ্গী বাওয়ালীদের সাবাসী না দিয়ে পারবেন না। হয়ত কতকটা মানসিক প্রস্তুতি তাদের ছিল, হয়ত বা একেবারে গায়ের কাছেই ঘটনাটি ঘটায় তারা মহা সাহসের সঙ্গে এক অবিশ্বাস্য কাজ করে ফেলে। পাঁচজন একসঙ্গে বনের কাটা ডাল দিয়ে বাঘকে পিটাতে থাকে আর চীৎকার করতে থাকে। তখন বাঘ শিকার ছেড়ে দিয়ে জঙ্গলের ভিতরে চলে যায়।

পৃষ্ঠা ১৫

হতভাগ্য বাওয়ালীর নিঃসাড় দেহ পড়ে থাকে সেখানে। মরা। ঘাড় থেকে মাথা থেকে তখন স্রোতের মত রক্ত ছুটছে। ঘাড়-মাথা জুড়ে একটা কামড় দিয়ে ধরেছিল, তাতে তার মাথা চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। বাওয়ালীরা কাশিমারী গ্রামের বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে তাকে দাফন করে।

কয়েকদিন পরেই এই বাওয়ালী দলটি আবার গোলপাতা কাটতে এলে তখন আমি গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করি এবং ঘটনার বিস্তারিত জানতে চাই। তখন একজন আমাকে বলে যে, ‘বিশাল বড় বাঘ, আমার মাথার উপর দিয়ে লাফ দিয়ে গিয়ে ওকে ধরল!’ আর আরেকজন বলে, ‘এই লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরে বাঘকে খেদিয়েছি!’

বর্ণনা দুইটি যত রোমাঞ্চকর তার চেয়ে অনেক বেশী দুঃসাহসিক। সঙ্গের সঙ্গীকে নিয়ে যাচ্ছে বাঘে, আর তাকে বাঁচানোর জন্যে মহা শক্তিমান ও হিংস্র জন্তুটিকে লাঠির বাড়ি দিয়ে তাড়ানোর চেষ্টা করাতে যে কি পরিমাণ সাহসের দরকার হতে পারে তা সার্কাসের বা চিড়িয়াখানার বাঘ দেখে ধারণা করা যাবে না। অন্তহীন, জনবসতিহীন গভীর বনে এমন কি দূরেও একটা সাধারণ বাঘ দেখলে প্রাণে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়ে যায়; আর বিশাল আকারের মানুষখেকোর মুখের সামনে অসহায় মানুষের পক্ষে নিজের জীবন বিপন্ন করে সঙ্গীকে বাঁচানোর চেষ্টা করাতে অবিশ্বাস্য বীরত্বেরই দরকার হয়। একটিমাত্র থাবায় তার মৃত্যু হতে পারে, আর থাবা মারতে বাঘের এক সেকেণ্ড সময়ও লাগে না। সুন্দরবনের দরিদ্র, অশিক্ষিত বাওয়ালীদের মধ্যে মনুষ্যত্বের এই যে পরিচয় এর কোন তুলনা নেই।

পচাব্দী গাজী

পর পর কয়েকজন বাওয়ালী বাঘের মুখে যাওয়ায় সমস্ত বন বিভাগে এক মহা শঙ্কা ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়ে যায়। বন কর্মকর্তা ও বনরক্ষীদের মধ্যে যারা শিকারী ছিলেন তাঁরা ইতিমধ্যেই বোট নিয়ে নৌকা নিয়ে আঠারবেকীতে বাঘের অনুসন্ধানে ছিলেন । কেউ যদিও এই বাঘকে একটি গুলি করার সুযোগ পাননি, তবু তাঁরা সকাল-সন্ধ্যা আপ্রাণ চেষ্টা করেই যাচ্ছিলেন। এই সময়ে বন বিভাগ থেকে সুন্দরবনের পেশাদার শিকারী পরিবারগুলোর কাছে এই বাঘ শিকারের জন্যে সংবাদ পাঠানো হয়। আমি অবিলম্বে রওনা হয়ে যাই এবং আঠারবেকীর অস্থায়ী বন অফিসে গিয়ে অন্যান্য শিকারীগণের সঙ্গে যোগ দিই।

বন বিভাগ থেকে শিকারীগণকে সকল রকম সুযোগ সুবিধা দেওয়া হল। আমাকে নেওয়া হয় এক বোটে, সঙ্গে একটি ডিঙি নৌকা এবং কয়েকজন বনপ্রহরী ও বনমাঝিকে সাহায্যের জন্য দেওয়া হয়। বড় বোট নদীতে রেখে ডিঙি করে সকাল সন্ধ্যা এক খাল থেকে আরেক খালে, পাড়ে উঠে কিনারে, এবং যেখানে যতদূর সম্ভব বনের ভিতরে গিয়ে আমি বাঘের খোঁজ করতে লাগলাম। সুন্দরবনে এভাবে ছাড়া খোজার বা চলাচলের আর কোন উপায় নেই। বিশাল বনের কোনখানে রাস্তাঘাট বলে কিছু নেই, কোন রাস্তার চিহ্নও নেই। একটানা বনের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার একমাত্র উপায় নৌকা। আমি সকলের সঙ্গে অব্যাহতভাবে মানুষখেকো বাঘের সন্ধান করতে লাগলাম।

এর মধ্যে আঠারবেকী এলাকায় কর্মরত সকল বাওয়ালী ও জেলেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, কোনখানে বাঘে কাউকে নিয়ে গেলে বা আক্রমণ করলে বা বাঘ দেখলেও যেন অস্থায়ী বন অফিসে বা কোন না কোন বোটে সঙ্গে সঙ্গে খবর দেওয়া হয়। তারপর কয়েকদিন ধরে চলল আমাদের সবার প্রাণান্তকর চেষ্টা আর সন্ধান। সেই সব চেষ্টাই ব্যর্থ হল, কোনখানে একবার বাঘ দেখতে পেলাম না। নৈরাশ্যের মধ্যে হঠাৎ একদিন অত্যন্ত দুঃখজনক আরেকটি মৃত্যুসংবাদ এল-আঠারবেকী মৌজা থেকেই। পাড় আঁটুনির খালে এক হিন্দু জেলে তার ছেলেকে নিয়ে মাছ ধরছিল। এই বৃদ্ধ সারা জীবন মাছ ধরেছে সুন্দরবনের খালে আর গাঙে। ছেলেকে যে সঙ্গে নিয়েছে তাও আজ অনেক বছর । বাঘ সে হয়ত দেখেছে বহুবার, চোখের সামনে দিয়ে গাঙ পার হয়ে যেতেও হয়ত দেখেছে বহুবার, কিন্তু মানুষখেকোর নজরে পড়তে হয়নি কোনদিন; একবার নজরে পড়ল, সেই সেবারেই মৃত্যু ঘটল।

পৃষ্ঠা ১৬

আগের দিন সন্ধ্যায় বাপ-ছেলে পাড়-আঁটুনির ভরা খালে জাল পেতে রেখে গিয়েছিল, সেদিন সকালে ভাটার টানে পানি নেমে গেলে তখন ঝিঝিরা পানিতে আটকে থাকা মাছ ধরতে আসে তারা। এই জেলেরা দুইদিন, তিনদিন, চার-পাঁচ-, এমন কি সাতদিন পর্যন্ত থাকে নৌকায়; ডিঙিতে খায়, ডিঙিতেই রাত কাটায়। মাছ ধরে ধরে নৌকায় দুইপাশে বাঁধা চাই-এর মধ্যে জিইয়ে রাখে, সেগুলো ভরে গেলে তখন নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে।

একটানা কয়েক ঘন্টা খালের কাদাতে অনেক দূরে পর্যন্ত হেঁটে হেঁটে বাপ আর ছেলে মাছ ধরল। বড় ছোট নানারকম লোনা পানির মাছ। বেলা দুপুর হলে তখন রান্নার ব্যবস্থা করতে হয়, বুড়া বাপ কিনারায় উঠল লাকড়ির জন্যে। বৃদ্ধ পাড়ে উঠল শুকনা ডাল কেটে আনতে, আর ছেলে মাছ ধরতে থাকল। হঠাৎ ছেলে একটা ‘হুঙ্ক!’ গর্জন শুনল, তারপর গোঙানি, কাঠ কাটার আওয়াজ থেমে গেল। বিভ্রান্ত ছেলে ‘বাবা! বাবা!’ বলে চীৎকার করতে করতে দ্রুত পাড়ে উঠল। কিন্তু বুড়া বাবার কাছ থেকে কোন জবাব এল না। সে কাণ্ডজ্ঞানহীনের মত বনের ভিতরে ঢুকে পড়ল। হঠাৎ মাত্র কয়েক হাত সামনেই ‘হাম!’ করে বাঘের গভীর ডাক শুনে তার জ্ঞান ফিরে এল । সে ডিঙিতে ফিরে দ্রুত গিয়ে কয়েকজন বাওয়ালীকে জোগাড় করে আনল।

সুন্দরবনের এ আরেক আশ্চর্য সহমর্মিতা। কারো বাবাকে, ভাইকে কি সঙ্গীকে বাঘে নিয়ে গেছে শুনলে কাছে-ধারের আর সবাই সেখানে আসে, বিপদ উপেক্ষা করে যতদূর সাধ্য সাহায্য করে। সকলে মিলে হৈ-চৈ করতে করতে বাঘের পায়ের চিহ্ন আর রক্তের দাগ দেখে বনের ভিতরে এগুতে থাকল। কিছুদূর যেতেই জেলের পরনের কাপড় পেল। বাপের দা আর রক্তমাখা কাপড় হাতে নিয়ে ছেলে ছুটতে লাগল পাগলের মত । সেই উদভ্রান্ত মুহূর্তে তার যেন বিশ্বাস ছিল যে, তাড়াতাড়ি যেতে পারলে বাবাকে সে জীবিতই উদ্ধার করে আনতে পারবে। কিন্তু বেলা ইতিমধ্যে পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটা হয়ে যাওয়াতে বাওয়ালীরা বাধ্য হয়ে অনুসন্ধান স্থগিত করে এবং ছেলেকে জোর করে নৌকায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে। বনে অন্ধকার দ্রুত ঘন হয়ে আসছিল, তাই আর অগ্রসর হওয়া তাদের পক্ষে মোটেই নিরাপদ ছিল না। এই জেলের দেহের অবশিষ্ট আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

আঠারবেকী মৌজা সীমানার মধ্যেই এই বাঘ একের পরে এক অসহায় জেলে ও বাওয়ালীকে খেতে থাকে। সমস্ত এলাকায় মারাত্মক ত্রাসের সৃষ্টি হয়ে যায়, বহু খালে বাওয়ালীরা প্রাণভয়ে লাকড়ি ও পাতা কাটা বন্ধ করে দেয়, জেলেরাও মাছ ধরা বন্ধ করে দেয়—যদিও এটাই তাদের রুজি রোজগারের উপায়। কয়েকজন বন কর্মকর্তা, অন্যান্য শিকারী ও আমি বহু চেষ্টা করেও তখন পর্যন্ত একবার মানুষখেকো বাঘ দেখতে পাইনি। আমি কেবল পায়ের পারার দাগ পেয়েছিলাম। কয়েকদিনের বাসি চিহ্ন হলেও বুঝতে পেরেছিলাম যে সেটা বিশাল এবং অস্বাভাবিক বড় এক বাঘের পারা; তত বড় আমি আগে আর কোনদিন দেখিনি।

পচাব্দী গাজী (ছবিতে ডানে)

এর মধ্যে একটি জার্মান টেলিভিশন দল সুন্দরবনে আসে ছবি তুলতে। সামগ্রিকভাবে পৃথিবীবিখ্যাত সুন্দরবনের এবং বিশেষ করে রয়াল বেঙ্গল টাইগারের চলচ্চিত্র তুলে নিয়ে যাবেন তাঁরা। রাজা, রাষ্ট্রপ্রধান, কোন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব বা বিদেশীগণ সুন্দরবনে এলে বন দফতর থেকে সাধারণতঃ আমাকেই তাঁদের গাইড নিযুক্ত করা হয়। জার্মান দলের গাইডও আমাকেই নিযুক্ত করা হল।

পৃষ্ঠা ১৭

যথাশীঘ্র সম্ভব খুলনা শহরে যাবার জন্যে আমার প্রতি জরুরী নির্দেশ এল যে বাঘের মাত্র কয়েকটি ভয়াবহতার আমি উল্লেখ করেছি, যে বাঘ কয়েক সপ্তাহ যাবত আমাদের সকল শিকারীর আপ্রাণ চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে এক বর্ণনাতীত ত্রাসের সৃষ্টি করে ফেলেছে তাকে জীবিত রেখে খুলনা শহরে যাবার কথা আমি চিন্তাও করতে পারিনি। কিন্তু বাধ্য হয়েই আমাকে আঠারবেকী ছেড়ে যেতে হল এই দলের কয়েকজনই ছিলেন নামকরা শিকারী। একজন মেম ছিলেন, তাঁরও শিকারে আগ্রহ কিছু কম ছিল না, কিন্তু দুনিয়ার অন্যান্য জায়গায় বনভূমিতে সাধারণ বাঘ শিকার করলেও সুন্দরবনে মানুষখেকো রয়াল বেঙ্গল শিকারের পূর্ব অভিজ্ঞতা তাঁদের কারো ছিল না।

আঠারবেকীতে এক মানুষখেকোর উপর্যুপরি আক্রমণে সেই এলাকায় জেলে বাওয়ালীদের সকল কাজ বন্ধ হবার অবস্থা হয়েছে শুনে তাঁরা সেখানেই যাবেন বলে স্থির করলেন। টেলিভিশনের ছবি তুলতে এসেছেন, দুঃসাহস যতটা আছে এখানকার ভয়াবহতার ধারণা ততটা নেই। তাঁদেরকে আঠারবেকীতে নিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে উচিত ছিল না, কিন্তু হতভাগ্য জেলে-বাওয়ালীদেরকে ধূর্ত মানুষখেকোর খোরাক করে রেখে বনের অন্য কোন নিরাপদ জায়গায় গেলেও আমি বোধ হয় শাস্তি পেতাম না। মনের এক দিকের অনিচ্ছার উপরে আরেক দিকের ইচ্ছাই জয়ী হল এবং সম্ভাব্য বিপদের কথা সবই উল্লেখ করার পরে জার্মান দলকে শেষ পর্যন্ত আমি আঠারবেকীতে নিয়ে গেলাম।

এই সময়ের মধ্যে বাঘ আরো মানুষ খেয়েছে, বাওয়ালী-জেলেরা প্রতিদিন বন ত্যাগ করছে। বন অফিসের এবং পেশাদার শিকারীগণও আপ্রাণ চেষ্টা করেও কেউ এই মানুষখেকোটিকে একটি গুলি করার সুযোগ পাননি, যদিও তাঁরা বৃঘের পায়ের চিহ্ন দেখে সন্ধান করেছেন, রাত জেগেছেন এবং অনেক বিপদেরও ঝুঁকি নিয়েছেন।

সব বাঘ মানুষখেকো হয় না, যেটা হয় বুড়া হলে হয়। শরীরের শক্তি কমে গেলে যখন আর দ্রুতগামী হরিণ ধরতে পারে না, শুয়োর ধরতে পারে না, তখনি বাঘ মানুষ ধরে খায়, কারণ মানুষ অসহায় প্রাণী। আর, একবার মানুষখেকো হলে তখন বাঘ কেবল মানুষই খায়, অন্য কোন প্রাণী ধরতে যায় না। আঠারবেকীর মানুষখেকো বাঘ বিশজন জেলে ও বাওয়ালীকে মেরে আতঙ্কজনক রেকর্ড করে ফেলে এবং তা মাত্র মাস দেড়-দুই সময়ের মধ্যে সুন্দরবনের ইতিহাসে সে রকম ব্যাপক ভীতি আর অচল অবস্থা আর কখনো সৃষ্টি হয়নি। জার্মান টেলিভিশন দলকে নিয়ে আঠারবেকীতে পৌছেই আমরা যে জোড়া ঘটনার খবর পেলাম তার বর্ণনা না করে পারছি না।

একজন হিন্দু নমশুদ্র, সবার কাছে গুণীন বলে পরিচিত ছিল। গুণীন এজন্যে যে, তিনি বনের হিংস্র জীবজন্তু বশীভূত করার মন্ত্র জানতেন। অনেক বাওয়ালী ও জেলে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে বা তাঁর কাছ থেকে মন্ত্রপূতঃ লাল কাপড়ের টুকরা নিয়ে বনে কাজ করতে যেত এবং কাজের স্থানে কাপড়টি নিশানের মত করে গেড়ে রাখত। এতকাল পর্যন্ত কোনদিন তাঁর মন্ত্রের কার্যকারিতা মিথ্যা প্রমাণিত হয়নি বলে এই গুণীন বাওয়ালী এবং জেলেদের কাছে বিশেষ শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি ছিলেন যে তিনি একবার মন্ত্র পড়ে দিলে তাতে বনের দেবী বনবিবি বশীভূত হন; বাঘের সাধ্য নেই যে আর কাছে আসে। বনের বিশালত্ব, অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ, জনমানবহীনতা, হিংস্র মানুষখেকো বাঘ, অজগর, কুমীর ও হাঙরের যত্রতত্র উপস্থিতির জন্যে মানুষের মনে যে অসহায়ত্ববোধ জাগে, গুণীনগণের যাদুটোনা সেখানে স্বভাবত কিঞ্চিত নিরাপত্তাবোধ আনে এবং মানুষকে বনে কাজ করার শক্তি জোগায়। কিন্তু এই খ্যাতনামা গুণীনের মন্ত্রবল শেষ পর্যন্ত তাঁর নিজের জীবনেই অসার বলে প্রমাণিত হয় এবং তা এই আঠারবেকীতে।

পৃষ্ঠা ১৮

গুণীনরা বাওয়ালীদের সঙ্গে লাকড়ি, গোলপাতা কাটার যায়গাতে যান। এই গুণীনও বাওয়ালী দল নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু বন অফিস এবার তাঁকে টিকিট দিতে অস্বীকার করে। কর্মকর্তা গুণীনকে দোলনপীরের খাল ছাড়া অন্য কোন খালের টিকিট নিতে বললেন, কেন না গত মাস দেড়েকের মধ্যে দোলনপীরে বেশীরকম মানুষ মারা পড়েছে। কিন্তু গুণীন দোলনপীরেরই টিকিট চান, সেখানে গোলপাতা বেশী আছে এবং মন্ত্র দিয়ে তিনি এলাকা আটক করে নিবেন, বাঘের আর কোন শক্তি থাকবে না। তখন নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেই বন কর্মকর্তা সেই বাওয়ালী দলকে পাঁচটি নৌকা নিয়ে পাতা কাটার পারমিট দেন।

চার ডিঙি এবং একটি বড়, মোট পাঁচ নৌকায় পনেরজন বাওয়ালী রাত্রিবেলা দোলনপীরের খালে গিয়ে নৌকা গাড়ে। রাত্রেই গুণীন মন্ত্র দিয়ে সেই এলাকা ‘আটক’ করে ফেলেন এবং সকাল সাতটার সময়ে বাওয়ালীরা খালের পাড় থেকে পাতা কাটতে শুরু করে। দুপুর পর্যন্ত নির্বিঘ্নে কাজ করে তারা বড় নৌকাতে এসে ভাত খায়। পান তামাক খেয়ে পড়ন্ত বেলায় আবার কাজে লাগে এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রচুর পাতা কাটে— গোলপাতা সেখানে যথেষ্টই ছিল। রাতে মন্ত্রের উপরে আস্থাশীল পনেরজন লোকই বড় নৌকায় নির্বিঘ্নে ঘুমায়।

সকালে কারো মনেই আর তেমন কোন ভয় নেই, সেদিন তারা আরো কিছুটা উজানে পাতা কাটতে যাবে। সবার আগে গুণীনের নৌকা, বৈঠা হাতে গলুই-পাছায় দুইজন বাওয়ালী এবং মাঝখানে তিনি বসা। তখন ভাটার সময় বলে কিছুদূর গিয়েই নৌকা খালে আটকে যায়। পাছার বাওয়ালী একটা বিড়ি ধরায় তিনজনেই টানবে বলে, হঠাৎ পাড় থেকে বাঘ লাফ দিয়ে গুণীনকে ধরে। আক্রমণের চোটে নৌকা কাত হয়ে যায় আর শিকারসহ বাঘ খালের পানিতে গিয়ে পড়ে। মৃত্যুরূপ মহাবিপদ যখন একেবারে সামনে এসে পড়ে মানুষ কখনো তখন অবিশ্বাস্যরকমের সাহসী হয়ে উঠে। পাছার বাওয়ালী চীৎকার করতে করতে হাতের বৈঠা দিয়ে বাঘের মাথায় পিটাতে শুরু করে।

মুহূর্তের মধ্যে বাঘ গুণীনকে ছেড়ে দিয়ে পিছনের দুই পায়ে খাড়া হয়ে উঠে এবং বাওয়ালীর মাথা কামড়ে ধরে পাড়ে উঠে অদৃশ্য হয়ে যায়। সমস্ত ঘটনাটি মাত্র মিনিটখানেক সময়ের মধ্যে ঘটে। চৌদ্দজন বাওয়ালী গুণীনকে নিয়ে দুই মাইল দূরে আঠারবেকীতে ছোট কৃপ অফিসে আসে। কিন্তু গুণীন পথেই মারা যান, একটা কথাও বলতে পারেননি। পানি থেকে নৌকায় তোলার পরে অল্পক্ষণ কেবল একটা অস্পষ্ট গোঙানি ছিল।

খবর পেয়ে, গুণীনের লাশ দেখে, আর এক মুহূর্ত দেরী না করে অন্ততঃ ত্রিশজন বাওয়ালীকে সঙ্গে নিয়ে আমি রওনা হয়ে গেলাম। বন অফিসের আরও ছয়জন রওয়ানা হলেন আমার সঙ্গে বন্দুক নিয়ে। আগেই বলেছি যে, সুন্দরবনে চলাচলের একমাত্র উপায় হচ্ছে নৌকা। রাস্তাঘাট বলতে কিছু নেই কোনখানে। দুর্গম বনে কোথাও বাঘে মানুষ খেলে তার খবর পেতে এবং তার অকুস্থলে গিয়ে পৌছতে যে সময় অবধারিতভাবে পার হয়ে যায় তারপরে প্রায়ই বাঘ আর সেখানে থাকে না; শিকার খেয়ে কেবল হাড়গোড়গুলো ফেলে রেখে যায়। সেদিন বাওয়ালীরা গুণীনের লাশ আঠারবেকীর ছোট অফিসে নিয়ে এসেছিল বেলা দুইটায়, জোর ডিঙি বেয়ে গেলে আমরা এক ঘন্টার মধ্যে দোলনপীরের খালের উজানে পৌছতে পারব এবং ভয়ঙ্কর মানুষখেকোকে সামনাসামনি দেখার, এমন কি কিসমতে থাকলে হয়ত বা গুলি করারও সুযোগ পাব বলে আশা করলাম।

পৃষ্ঠা ১৯

ভাটি খাল বেয়েই আমাদের ডিঙিগুলো সেদিন বিজলীর মত ছুটল এবং বেলা আন্দাজ তিনটার মধ্যেই ঘটনার স্থানে গিয়ে পৌছলাম। নরম মাটিতে তখন বাঘের একেবারে তাজা পারা, দেখামাত্র আমি চিনতে পারলাম যে, এ সেই একই মানুষখেকো বাঘ। উপস্থিত সকলেই বলল যে, এত বড় পারা তারা জীবনে কোনদিন দেখেনি। গুণীনের নৌকার যে একমাত্র ভাগ্যবান বাওয়ালী প্রাণে বেঁচে গেছে সে ভয়ে তখন এমন বিমূঢ় হয়ে গেছে যে ‘বিশাল বড় বাঘ!’ এর বেশী আর কিছুই বর্ণনা করতে পারল না। সে রকম মনের অবস্থাই তার ছিল না।

আমরা পঁয়ত্রিশজন মানুষ হাঁক-ডাক হৈ-চৈ করে বনের ভিতরে এগিয়ে চললাম। কাদার মধ্যে বাঘের পায়ের চিহ্ন পরিষ্কার পড়ে ছিল। মানুষখেকো বাঘ সাধারণত দাপটের সঙ্গে হাঁটে, সাধারণ বাঘ তা করে না। এ বাঘও যাওয়ালীকে মুখে নিয়ে অতি দাপটের সঙ্গে মাটিতে আঁচড়ে আঁচড়ে হেঁটে গেছে। ফলে নরম মাটিতে ও কাদাতে সেই স্পষ্ট পারা অনুসরণ করা আমাদের সহজ হল। তাছাড়া মাটিতে, গাছের পাতায় ও গুড়িতে যথেষ্ট তাজা রক্তও লেগে ছিল। বাওয়ালীর পায়ের আঙুল কোথাও কোথাও কাদাতে হাঁচড়ে গিয়েছিল, সেই চিহ্নও ছিল আমি রইলাম সকলের সামনে আর, যদিই বা বাঘ কাউকে আক্রমণ করে তবে সম্পূর্ণ সম্ভাবনায় পিছনেরজনকে ধরবে, এজন্যে সকলের পিছনে বন্দুক হাতে রইলেন বন অফিসের দুইজন শিকারী।

গভীর বনের মধ্য দিয়ে প্রায় সিকি মাইল যাওয়ার পরে আমরা বাওয়ালীর লাশ পেলাম। নৌকা থেকে এখান পর্যন্ত বাঘ এক হাঁটায় এসেছে, পথে কোনখানে থামেনি বা একবারের জন্যে মুখের শিকার মাটিতে রাখেনি। এ থেকেও বাঘের বিপুল শক্তি এবং আকারের বিশালত্বের একটা আন্দাজ করতে পারলাম । অর্থাৎ একেবারে অভ্রান্তভাবে এ সেই একই মানুষখেকো বাঘ।

বাওয়ালীর লাশ দুই পা গুটানো অবস্থায় পড়ে ছিল, কোমর ও পেট থেকে কয়েক খাবলায় তিন-চার সেরমত গোশত খেয়ে ফেলেছে, মাথা কামড়ে ধরে যে এনেছে তা একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।

 চারপাশে ছোট ও মাঝারি গরান গাছই বেশী ছিল, তাই বন গভীর হওয়া সত্ত্বেও বসার বা মাচা বাঁধার কোন সুবিধা হল না। বেশ দূরে একটা কেওড়া গাছ ছিল, অনেক উঁচু এবং মাটি থেকে তের-চৌদ্দ হাত উপরে গাছটার তে-ডালায় বিনা মাচায়ও বসার সুবিধা ছিল আমি সেখানে বসেই রাত্রে বাঘের অপেক্ষা করব বলে স্থির করলাম। বাঘ অবশ্যই বাওয়ালীর দেহের বাদবাকী অংশ খেতে আসবে। দীর্ঘদিন পরিশ্রম ও কষ্টের পরে অবশেষে আজ সুযোগ পাওয়া গেল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, হয়ে গেল ভিন্ন এবং অপ্রত্যাশিত এক সমস্যা। কোন একজন শিকারী বা বাওয়ালী রাত্রে আমার সঙ্গে থাকতে রাজী হল না। আর একজন কাউকে সঙ্গে না নিয়ে সম্পূর্ণ একাকী শিকার করতে বসা আমার বংশের রীতি নয়, কোন একজন মানুষ সঙ্গী হিসাবে থাকতেই হবে।

পৃষ্ঠা ২০

বহু অনুরোধ করলাম, বাঘ মারার নিশ্চিত সম্ভাবনার কথা বুঝিয়ে বললাম, আমার বন্দুক, তাজা এল. জি. কার্তুজ দেখালাম, গাছের উঁচু ডালের সঙ্গে কোমর বেঁধে নিরাপদে বসে থাকতে বললাম, কিন্তু সবই বৃথা হল। এই মানুষখেকো অগুনতি মানুষ খেয়ে যে মারাত্মক ভয়ের সৃষ্টি করে ফেলেছে সে কারণেই কাউকে, এমন কি কোন একজন শিকারীকেও, রাজী করাতে পারলাম না। একেবারে নিতান্ত বাধ্য হয়েই সুন্দরবনের শ্রেষ্ঠ শিকারীবংশের লোক হয়েও ভয়াবহ মানুষখেকো বাঘ মারার নিশ্চত সুযোগ আমাকে ছেড়ে দিতে হল এজন্যে যে কোন দোষারোপ আমি মাথা পেতে নিতে রাজী আছি। সুন্দরবন জনমানবহীন ও পথঘাটহীন মহা অরণ্য, এখানকার শিকারের রীতি ভিন্ন। আর সেজন্যেই অন্ততঃ একজন কাউকে সঙ্গী না নিয়ে বাঘ শিকার করার রেওয়াজ আমাদের বংশে নেই। বাধ্য হয়েই সন্ধ্যার আগে বাওয়ালীর লাশ নিয়ে আমরা আঠারবেকী কূপ অফিসে ফিরে এলাম ।

জার্মান টেলিভিশন দল প্রচুর ছবি তুলল। আঠারবেকীর যত গভীর, গহন জায়গা ছিল সব কিছুরই ছবি তুলল। হরিণ, বানর, সাপ, কুমীর ও পাখীর ছবি। আমার ছবিও তুলল । কিন্তু দুঃখের বিষয় বাঘ দেখাতে পারলাম না। তাঁদের সাহসের তারিফ না করে পারা যায় না। এই এলাকায় একটি মানুষখেকো বাঘ মাত্র দেড়-দুই মাসে অসংখ্য মানুষ খেয়ে ফেলেছে শুনে দলের শিকারীগন সেই বাঘ মারার জন্যে আন্তরিকভাবে আগ্রহী হয়ে উঠেন। সকল বিপদ উপেক্ষা করে সম্ভাব্য কয়েকটি স্থানে তাঁরা বাঘের মোকাবিলা করতেও চেষ্টা করেন। কিন্তু সুন্দরবনে মানুষখেকো বাঘ শিকারের রীতি ভিন্ন। একদিন এক অতি বিপজ্জনক স্থানে কয়েক ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করে অবশেষে অনেক দূরে রেঞ্জের বাইরে—একটি বাঘ তাঁদের দেখাতে পেরেছিলাম; কিন্তু সেটি ছিল এক ছোট বাঘ, বছর তিনেক বয়সের।

অবশেষে জার্মান দল তাদের কাজ শেষ করে খুলনা রওনা হয়ে গেল। যাবার সময়ে মেম সাহেব, মিসেস লেচেনপার্গ, আমাকে একটি টাইপ করা প্রশংসাপত্র দিয়ে গেলেন, আমি সেটি যত্নের সঙ্গে রেখে দিয়েছি।

তাঁরা চলে যাওয়ার ঠিক পরের দিনই আঠারবেকী খালের ধারে বাঘ একজনকে নিয়ে যায়। সকাল আটটার দিকে কয়েকজন বাওয়ালী খালের পাড়ে গোলপাতা কাটছিল, বাঘ মাত্র পাঁচ-ছয় হাত দূর থেকে লাফ দিয়ে এসে বাওয়ালীর ঘাড়ে পড়ে এবং সবার চোখের সামনে থেকে ইতভাগ্যকে নিয়ে যায়। সঙ্গের বাওয়ালীরা বনে ঢুকতে সাহস না পেয়ে এক মাইল দূরে আমাদের সরকারী বোটে এসে খবর দেয়।

এক মুহূর্ত দেরী না করে আমি বারোজন বাওয়ালীসহ ডিঙি করে রওনা হলাম। দোনলা বন্দুক আর কয়েকটি এল.জি. কার্তুজ নিলাম এবং আধঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে সেই খালের ধারে গিয়ে পৌছলাম। ত্রিশ-বত্রিশ বছরের যুবক বাওয়ালী পাতা কাটছিল ডান হাতে, বাঘ মাত্র ছয় হাত দূরে তার বাম পাশের একটা ঝোপের ভিতরে ওঁত পেতে বসেছিল, সেখান থেকে এক লাফে তাকে ধরে। যেখান থেকে লাফ দিয়েছিল, পায়ের ভয়ানক দাপটে কাদামাটি লেখানে গর্ত হয়ে গেছে। তার গোলকাটা দা তখনো গাছের গোড়াতেই পড়ে ছিল, সেখানে প্রচুর রক্ত।

পৃষ্ঠা ২১

একেবারে বরাবর সোজা পুবে গেছে। জঙ্গল ভেঙে হাত দশেক এগুতেই প্রথমে মাটিতে পড়ে থাকা লুঙ্গিটা পেলাম-রক্তে ভিজা। নরম কাদা ও মাটিতে একেবারে পরিষ্কার বাঘের পারা, আমি দশ হাত দূর থেকে এই চিহ্ন দেখলেও বলতে পারতাম যে, এটা সেই বিশালাকার মানুষখেকোর পারা যে আঠারবেকীতে এই নিয়ে তেইশজন জেলে আর বাওয়ালীকে খেয়েছে এতদিনের মধ্যে আমি বা আমরা কোন একজন শিকারী এই বাঘ চোখে দেখতে পাইনি। পায়ের চিহ্ন দেখে আর বাওয়ালীদের মুখের বর্ণনা থেকেই কেবল জেনেছি যে আঠারবেকীর এই মানুষখেকো হচ্ছে বাঘা।

সবার আগে আমি অতি সাবধানে এগুতে লাগলাম। গোল গাছ থেকে গেওয়া, গরান বন পার হয়ে একটানা এক হেতাল ঝোপ পড়ল, কতকটা সরু সরু খেজুর গাছের কাঁটাওয়ালা এই গাছ অত্যন্ত ঘন হয়ে জন্মায় । বহু কষ্টে সেই দুর্ভেদ্য হেতাল পার হতেই পড়ল আবার বিস্তৃত হুদো বন, তার ভিতর দিয়ে নিয়ে গেছে। হুদো পার হতেই একটা ছোট্ট নালা পড়ল, সেটাও পার হয়ে আরো কিছুদূর জঙ্গলের ভিতরে একটা আঁটো জায়গাতে গিয়ে লাশ পেলাম। দেখলাম হতভাগ্য বাওয়ালীর দেহ হাঁটু গুটানো, ঘাড় কাত করা অবস্থায় পড়ে রয়েছে, পেট আর উরুর গোশত সবই খেয়ে ফেলেছে। মানুষ মেরে বাঘ প্রায় সব সময়েই প্রথমে উরু আর পেটের গোশত খায়।

বাঘ এখান থেকে গেছে পূব দিকে, কিন্তু এটা নিশ্চতই বুঝতে পারলাম যে, পোয়া মাইলের ভিতরে—হয়ত বা আরো কাছেই-কোনখানে ঘাপটি মেরে রয়েছে। আমি মৃত বাওয়ালীর আত্মীয়-স্বজনদের কাছে অনুরোধ করে সন্ধ্যা পর্যন্ত লাশ সেখানেই রাখার সম্মতি আদায় করলাম। আর এতজনের মধ্যে মাত্র একজন সাহসী বাওয়ালীকে আমার সঙ্গে থাকতে রাজী করাতে পারলাম; আমারও একজনই সঙ্গী দরকার ছিল। তখন বেলা তিনটা, সুন্দরবনে আরো আড়াই ঘন্টা আলো থাকবে এবং সেই সময়ের মধ্যে বাঘকে গুলি করার একটা সুযোগ নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে বলে আশা করতে পারলাম। তা না হলে আত্মীয়-স্বজনেরা ফিরে এসে লাশ নিয়ে যাবেই এবং আরো কোন একজন হতভাগ্য বাওয়ালী বাঘের মুখে না যাওয়া পর্যন্ত আমি দ্বিতীয় একটি সুযোগ পাব না।

বাওয়ালীর দেহ আঁটো জায়গায় থাকলেও ষাট-সত্তর হাতের মধ্যে কোন সুবিধাজনক গাছ ছিল না যে শরীর লুকিয়ে ডালে বসা যায়। একটা বড় বাইন গাছ কাছাকাছি জায়গায় থাকলেও বসার কোন সুবিধা হল না। এ ছাড়া চতুর্দিকেই শুধু গরান, গেওয়া, ধুন্দুল ও সরু সরু সুন্দরী গাছ। এক উপায় ছিল যে কোন একটি গাছে পিঠ ঠেকিয়ে মাটিতে বসা; কিন্তু তাতে আমি দেখার আগে বাঘ আমাকে দেখে ফেলবে এবং হয় আমি মারাত্মকরকম বিপদে পড়ব আর না হয় তো অনর্থকই সময় নষ্ট করা হবে, বাঘ আসবে না। আরেক উপায় ছিল যদি বাওয়ালীর লাশ যেখানে ছিল সেখান থেকে সরিয়ে কোন সুবিধাজনক জায়গায় রেখে আমি ঝাঁকড়া গাছে উঠে বসি, কিন্তু মানুষখেকো বাঘ এমনি সতর্ক ও সচেতন হয় যে তার শিকার পাঁচ হাত দূরে সরানো দেখলেও সন্দেহ করবে এবং চলে যাবে। কাজেই লাশ বাঘ যেখানে ফেলে গেছে ঠিক সেখানেই রাখতে হবে।

বসার আর একটিমাত্র স্থানই ছিল—যদিও খুবই বিপজ্জনক স্থান—তা হল নালার ঢাল; পাড় থেকে নীচের ঢালুতে শুয়ে পাড়ের উপরে শুধু মাথা জাগিয়ে বাঘের জন্যে অপেক্ষা করা। বেশী সময় ছিল না, তাই তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে সব বাওয়ালীদেরকে আমি জোরে হৈ-চৈ করতে করতে নৌকায় চলে যেতে বললাম, যেন বাঘ বুঝতে পারে যে মানুষ যারা এসেছিল তারা দলেবলে চলে গেছে। তারা জোরে জোরে কথা বলতে বলতে, ডাকাডাকি করতে করতে নালা পার হয়ে ডিঙিতে চলে গেল। গুলির আওয়াজ শুনলে তারা আসবে, আর নয়ত একেবারে সন্ধ্যায় এসে লাশ নিয়ে যাবে।

পৃষ্ঠা ২২

নালার পাড়ে একটা ছোট ঝোপের ভিতরে শুয়ে পড়লাম। আমার বুক থেকে মাথা পর্যন্ত কেবল পাড়ের উপরে প্রায় পাড়ের সমান সমান হয়ে রইল—বাকী শরীর বিছিয়ে দিলাম নালার ঢালে। ঝোপের ভিতর দিয়ে কেবল বন্দুকের নলের আগা খোলাতে রইল যদি ইতিমধ্যেই না দেখে ফেলে থাকে তাহলে বাঘ খুব লক্ষ্য না করলে ঝোপের ভিতরে ও খালের ঢালে আমাদের দুইজনকে বা আমার বন্দুক দেখতে পাবে না। বাওয়ালীকে আমার বাম পাশে চুপ করে শুয়ে পড়তে বললাম। সে সামনে, বাম দিকে এবং মাঝে মাঝে পিছনের নালার দিকে লক্ষ্য রাখবে। বাঘ দেখলে বা কোন নড়াচড়া দেখলেই,

কথা বলবে না, ফিফিস্ত্ত করবে না, কেবল আঙুল টিপে আমাকে দেখাবে। বাওয়ালীর অর্ধভুক্ত দেহ এখন আমাদের থেকে পনের-ষোল হাত দূরে সোজা পূবে । বাঘ আমাদের আসার আওয়াজ শুনে মরি ফেলে গেছে যে সে-ও একেবারে সোজা পূর্ব দিকে যে পথে গেছে এখন যদি সেই পথেই আবার আসে তাহলে আমাকে বন্দুক একটুও ঘুরাতে হবে না; নল, মরি আর বাঘ এক সরল রেখায় থাকবে। আর যদি বাঘ ডান বা বামদিক থেকে ঘুরা পথে আসে তাহলেই কেবল আমাকে বন্দুকের নল ঘুরাতে হবে।

ধূর্ত নরখাদক এরমধ্যে আমাদের অবস্থান দেখে থাকলে একটা খুব দূর-সম্ভাবনা ছিল যে চক্কর দিবে, অর্থাৎ দূর দিয়ে নালা পার হয়ে পিছন থেকে এসে আমাদের উপরে পড়বে। কিন্তু বিশাল বড় বাঘ হলেও এক লাফে সেই নালা পার হতে পারবে না, দুই লাফ দিতে হবে এবং সে ক্ষেত্রে ভাটা নালার কাদাতে বা এই পাড়ের অংশে ঝপ্ শব্দ শুনে ঘুরে দাঁড়ানোর একটা সুযোগ আমি পাবই। অবশ্য সেটা ছিল খুবই দূর সম্ভাবনা। প্রায় এক ঘন্টা, সোয়া ঘন্টার মধ্যে আমার দুই চোখের পাতা বোধ হয় একবারও পড়েনি। বনের মধ্যে কোন দিকে একটি শব্দও উঠেনি, কেবল বাতাসে পাতা কাঁপার আওয়াজ ছিল। নালার উল্টা পাড়ে, তা-ও প্রায় সিকি মাইল দূরে হবে, একবার একটা মোরগের ডাক শোনলাম, কিন্তু সেটাকে কোন ভয়ার্ত ডাক বলে মনে হয়নি।

আমার মনে বরাবরই কেন জানি একটা ধারণা ছিল যে, বাঘ পূব দিকে যে গেছে আবার সেই পূব দিক থেকেই আসবে। ঠিক সেদিক থেকেই এল । প্রায় দুইশ হাত সোজা পূবে গাছের ডালে এক বানর খক! খক! করে ডেকে উঠল, ভয়ার্ত ডাক শোনামাত্র আমি বুঝতে পারলাম যে বাঘ আসছে। প্রতিটি মুহূর্তের প্রত্যাশায় রুদ্ধ নিঃশ্বাসে বন্দুকের কুন্দা কাঁধে ঠেকিয়ে মরিসোজা চোখ রেখে চেয়ে রইলাম। দশ মিনিট পরে বাঘ দেখলাম, পূব দিক থেকে সোজা আসছে। মরি থেকে হাত দশেকের মধ্যে এসে থমকে দাঁড়াল, বাওয়ালীর দেহটা দেখল, একবার ডানে একবার বামে মুখ ঘুরাল এবং তারপর আরো প্রায় ছয় হাত এগিয়ে এল ।

কট্-কট্ করে একটা বনমোরগ ডেকে উঠল ডান পাশে, তৎক্ষণাৎ থমকে দাঁড়িয়ে বাঘ সেদিকে মুখ ঘুরাল। সোজা ঘাড়ে গুলি করলাম। দোনলা বেলজিয়াম বন্দুকের এল.জি-র গুলি, বাঘ যেখনে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই পড়ে গেল। গর্! গর! করে একটা গোঙানি শোনলাম মিনিটখানেক, তারপর বিশাল আকারের মানুষখেকো বাঘটা নিথর হয়ে পড়ে রইল।

পৃষ্ঠা ২৩

উঠে খালের পাড়ে দাঁড়ালাম এবং দ্বিতীয় নলের গুলি বুকে মারলাম, বাঘ আর একটা পা-ও নাড়ল না। দুই নলে আবার কার্তুজ ভরে তখনো শুয়ে থাকা বাওয়ালীকে টেনে তোললাম এবং বাঘের শরীর বরাবর বন্দুক ধরে দুইজনে অতি সাবধানে কাছে এগুলাম। ভলক দিয়ে রক্ত ছুটছে আর চোখ বুজে পড়ে আছে মরা বাঘ। বন্দুকটা মাটিতে রেখে দুই হাতের তালু গোলাকার করে মুখে ধরে পাঁচবার ডাক দিলাম, ‘আল্লা আল্লা-আল্লা-আল্লা-আল্লাহ্!’ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অনেক পিছন থেকে বাওয়ালীদের ‘আল্লা আল্লা!’ ডাক শোনলাম। তখন বেলা সোয়া চারটা।

তেইশজন জেলে-বাওয়ালীকে খেয়েছে সেই মানুষখোকোটিকে আমি এই প্রথম দেখতে পেলাম। বুড়া বাঘা। সামনের কয়েকটা দাঁত নেই। শরীরের কয়েক জায়গায় ছাল উঠে গেছে, মানুষ ধরতে গিয়ে লাফ দিয়ে যে পড়েছে, গাছের শূলার বা চোখা ডালের খোঁচা লেগে লেগে ছাল চলে গেছে। বাওয়ালীরা “আল্লা-আল্লা!” ডাক দিতে দিতে সুন্দরবন ভেঙে এসে হাজির হল। বাঘ দেখে প্রথমে কিছুক্ষণ তারা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর হঠাৎ উল্লাসে ফেটে পড়ল। মরা বাওয়ালীর আত্মীয়েরা কাঁদতে লাগল ।

জানাজা পড়ে হতভাগ্য বাওয়ালীর লাশ আমরা খালের পাড়েই একটা পরিষ্কার জায়গায় দাফন করলাম। আর বাঘের চার পা লতা দিয়ে বেঁধে, পায়ের ফাঁকে খুব শক্ত একটা মোটা ডাল দিয়ে ছয়জন বলিষ্ঠ বাওয়ালী বাঘকে বহন করে নিয়ে এল নৌকায় । রাত্রেই আমরা পৌছলাম বুড়ী গোয়ালিনী বন অফিসে এবং তৎক্ষণাৎ ওয়ারলেস করে খবর পৌছানো হল খুলনা বিভাগীয় বন অফিসে। ফিতা দিয়ে মেপে দেখা গেল পৌনে বারো ফুট লম্বা; এত বিশাল আকারের বাঘ কমই চোখে পড়েছে আমার।

পরদিন সকালে শত শত লোকের সামনে এই বাঘ ছোলাই করা হল সেই দিনই বহু লোকের সামনে অনেক ঘটা করে বন দফতর থেকে আমাকে তখনকার নগদ ৫০০ টাকা পুরস্কার দেওয়া হল, আমার ফটোও তোলা হল। মহা ত্রাস দূর হয়ে গেলে অতঃপর সুন্দরবনের আঠারবেকী মৌজায় জেলে-বাওয়ালীরা আবার নিশ্চিন্তমনে তাদের রুজি-রোজগার করতে শুরু করল ।

এরপরে খবরের কাগজের কয়েকজন ভাই আমার মুখ থেকে এই বাঘ শিকারের কাহিনী সংগ্রহ করে ঢাকার পত্রিকায় ছাপান। সে সব খবরের কোন কোনটি আমি কেটে রেখে দিয়েছিলাম । ইত্তেফাকের একটি সংবাদের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে আমি এই কাহিনী সমাপ্ত করব। 

“সুন্দরবনের দুর্ধর্ষ শিকারী। রোমাঞ্চকর কাহিনীর নায়ক পচাব্দী (নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরীত) খুলনা, ২৪শে। পচাব্দী নামটি সুন্দরবনের গল্পকথায় পরিণত হইয়াছে। বস্তুতঃ এই নামটি সুন্দরবনের রয়াল বেঙ্গল টাইগারের নিকটও আতঙ্কের কারণ। পচাব্দী গাজী সম্প্রতি সুন্দরবনের বুড়ী গোয়ালিনী রেঞ্জে একটি বার ফুট দীর্ঘ বাঘ মারিয়াছেন। খুলনা বিভাগীয় বন অফিসার জনাব এ. আলীম বলেন যে, সুন্দরবনের ইতিহাসে এ পর্যন্ত যতগুলো বাঘ মারা হইয়াছে ইহা তার মধ্যে দীর্ঘতম। তিনি আরও বলেন যে, ইহা বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ বাঘ। গত দুই মাস ধরিয়া এই মানুষখেকো বাঘটি সুন্দরবন এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করিয়া রাখিয়াছিল এবং এ পর্যন্ত বাঘটি ২১ (২৩) জনের প্রাণনাশ করিয়াছে।”

দ্বিতীয় পর্ব: সুন্দরবনের মানুষখেকো – পর্ব ২
তৃতীয় পর্ব: গোলখালীর বিভীষিকা – পর্ব ৩

বইয়ের পরবর্তী অংশ ওয়েবসাইটে আপলোড করা হবে শীঘ্রই। চোখ রাখুন ভ্রমণ গ্রুপ Green Belt The Travelers ফেসবুক গ্রুপে।

আরো পড়ুন

error: Content is protected !!
Exit mobile version