আন্দিজ পর্বতমালা ১২

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৫

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ১
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ২
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৩
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৪

আবারও অনিশ্চয়তা! কুফা যেন পিছু ছাড়ছে না কিছুতেই। একদিনে এত ঝামেলা সহ্য করার জন্যে চাই বায়োনিক শরীর! মাছে ভাতে বাঙ্গালীর শরীর এমন বিরামহীন হাঙ্গামার জন্যে মোটেও তৈরি নয়, এ সহজ সত্যটা আগেই বোধহয় বুঝা উচিৎ ছিল। অস্থিরতা ধীরে ধীরে হতাশায় পরিণত হল। হাতের লাগেজটা মাটিতে বিছিয়ে জিন্দা-লাশ হয়ে বসে পরলাম খোলা আকাশের নীচে। সূর্যটা বিদায় নিয়েছে অনেকক্ষণ হল। একদিকে হায়েনার মত আন্দিজের বিশাল চূড়া, বিপরীত দিকে লাখ লাখ নিয়ন বাতির রহস্যময় লা পাস নগরী। এ যেন কল্পরাজ্যের স্বপ্ন-পূরীর মত, চোখে দেখা যায় কিন্তু কাছে যাওয়ার উপায় নেই! যমজ বাসটাকে দেখা গেল বেশ কিছুক্ষণ পর। ক’জন যাত্রী উঠিয়ে ওটাও চলে গেল একই কথা বলে। মহিলাদের প্রাধান্যের কারণে আমার জায়গা হলোনা এ যাত্রায়। তীর্থের কাকের মত বসে রইলাম পরবর্তী বাসের আশায়। প্রায় ৪০ মিনিট পর থামল দ্বিতীয় বাসটা। এবার মিস হলে হয়ত সাড়াটা রাত এখানেই কাটাতে হতে পারে, তাই পরি মরি করে উঠে পরলাম। বসার জায়গা নেই, গাদাগাদি করে কোন রকমে দাড়িয়ে রইলাম লাগেজটা হাতে নিয়ে। যে সমস্যার কথা ভেবে এতক্ষণ উৎকণ্ঠিত ছিলাম এসে গেল সেই মহেন্দ্রক্ষণ! বাস কন্ডাক্টর জানতে চাইল, কোথায় যাচ্ছি আমরা? একজন আরেকজনের দিকে তাকাই, কিন্তু কারও মুখে কোন উত্তর পাওয়া গেলনা। সাহস করে আমিই বললাম, সানফ্রানসিসকো প্লাজা! ট্যুর গাইডের মুখে উচ্চারিত নামটা মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। সময় মত মনে করতে পারায় সহযাত্রীরা প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে। ভাড়া পরিশোধ করতে হল ডলারে। এক ডলার সমান কত বলিভিয়ানো আর কতই বা গন্তব্য-স্থলের ভাড়া তার কোন ধারণা না থাকায় ৫ ডলার নোটের সবটাই রেখে দিল ভাংতির অজুহাতে। এ সব নিয়ে চিন্তিত হওয়ার মত মানসিক অবস্থা ছিলনা কারও। শুধু তজ্‌বী গোনার মত বেহুশ হয়ে গুনছিলাম অন্তিম মুহূর্তের। এবং শেষ পর্যন্ত এলো সেই মুহূর্ত। বাস কন্ডাকটরদের কেউ একজন প্রায় গলাধাক্কা দিয়ে ছুড়ে ফেলল বাস হতে। লাগেজটাও ছিটকে পরল হাত হতে।

ব্যাগটা কুড়িয়ে সোজা হয়ে চারদিক চোখ ফেরাতে সহযাত্রীদের কাউকে খুঁজে পেলামনা কাছাকাছি। ওরা কেউ নামেনি। মনটা দমে গেল নতুন আশংকায়। সানফ্রানসিসকো প্লাজা! প্লাজার বিশাল ঘড়িটায় ঢং ঢং করে রাত ৯টা বাজার সময় সংকেত বেজে উঠল। ৪ ঘণ্টার পথ ১৫ ঘণ্টায় পাড়ি দিয়ে শেষ পর্যন্ত দাড়িয়ে আছি লা পাস শহরের কেন্দ্রস্থলে; ক্লান্ত, শ্রান্ত, অবসন্ন, বিষণ্ণ এবং বিধ্বস্ত! ধাতস্থ হতে ৫টা মিনিট কেটে গেল। এ ধরনের অমানুষিক অভিজ্ঞতা জীবনে এই প্রথম নয়। জার্মানির বার্লিন শহর তখনও এক হয়নি। ঐতিহাসিক বার্লিন দেয়াল পার হয়ে পশ্চিম বার্লিনের জুওলঝিশিয়া গার্টেন ষ্টেশনে হাজির হয়েছি নেদারল্যান্ডের হোক-ভ্যান-হল্যান্ড গামী ট্রেন ধরব বলে। শেষ গন্তব্য হারউইচ হয়ে লন্ডনের লিভারপুল ষ্টেশন। পূর্ব বার্লিনে অযথা ঘুরাঘুরির কারণে শেষ ট্রেনটা মিস হয়ে যায়। হোটেল ভাড়ার যথেষ্ট টাকা নেই হাতে, তাই ষ্টেশনে রাত কাটাবার সিদ্ধান্ত নেই বাধ্য হয়ে। সেপ্টেম্বরের শুরু, কনকনে শীত আর পুলিশের অত্যাচারে সাড়াটা রাত দৌড়ের উপর কাটাতে হয়। সকালের প্রথম ট্রেনটা ধরতে বেলা বেজে যায় ১১টা।

ভেঙ্গে পরলে চলবে না। এখনও অনেক পথ পাড়ি দেয়া বাকি। নিজকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলাম! প্লাজায় ঠায় দাড়িয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। কোনদিকে গেলে হোটেল মিলবে তার কোন হদিস করতে পারলাম না। হরেক রকম মানুষের ভীরে গিজগিজ করছে চারদিক। সাহস করে একজনকে জিজ্ঞাস করতে বাধ্য হলাম, ‘দন্ডে এস্তা এলো হোতেল?‘। অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী সন্দেহ নেই, কিন্তু এই অল্পতাই অনেক সময় বিশাল কাজে আসে, বিশেষ করে অজানা অচেনা ভাষার দেশে। কাজ হল এ যাত্রায়! আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখানোর চেষ্টা বুঝতে অসুবিধা হলোনা আমার। হাটতে শুরু করলাম হোটেলের সন্ধানে। কয়েক গজ যেতেই রাস্তাটা ৪৫ ডিগ্রী কোণ হয়ে উপরে উঠতে শুরু করল। জ্বিহ্‌বাকে জায়গা মত ধরে রাখায় অসুবিধা দেখা দিল। ম্যারাথন দৌড়ের গতিকে পাল্লা দিয়ে হার্ট-বীটও বাড়তে থাকল। মুখের থুথুতে এই প্রথম লবণের অস্তিত্ব অনুভব করলাম। প্রথম হোটেলটা চোখে পরল কাইয়ে পতোসির উপর, ’হোটেল প্রেসিদেন্তে’। ভাগ্য এ যাত্রায় বিমুখ করল আমায়, সীট নেই একটাও। দূরে অন্য একটা হোটেলের সাইন দেখে আশান্বিত হয়ে রওয়ানা দিলাম সে দিকে। আরও অনেক উপরে উঠতে হবে। শরীরের শেষ শক্তি ব্যয় করে হোটেল দরজায় হাজির হতেই দেখি দরজা বন্ধ! প্রচণ্ড শব্দে নক করে ইয়া নফ্‌সি ইয়া নফ্‌সি ঝপতে থাকলাম। কেউ এগিয়ে এলো মা। ঘুসি মারতে বাধ্য হলাম। রাজ্যের ক্ষুধা মগজের চিন্তা শক্তিকে গ্রাস করে নিয়েছে ইতিমধ্যে। খুট করে ছোট বুথের মত জানালা খুলে উঁকি দিল কেউ একজন। ’সিনিওরা, উস্তেদ হাবলা ইংলেজ?’। অন্য একজন মাথা বের করে জানাল ’পকি্‌ত‘, অর্থাৎ অল্প স্বল্প। সীট পাওয়া গেল ৬ তলায়, আলাদা বাথরুম। এটা আসলে একটা হোস্টেল, ভাড়া মাত্র ৭ ডলার। হঠাৎ মনে হল পৃথিবীটা আসলে অতটা খারাপ নয় যতটা আমি ভাবছি!

’হোস্তাল নাইরা’, আসলেই নাইড়্যা (ন্যাড়া), ভেতরের সবকিছুতে অযত্ন, অবহেলা আর দারিদ্রের ছাপ। এলিভেটর নেই, তাই সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে হল ৬ তলায়। চাবি ঘুরিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করতে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরল, খুলছে না দরজা! নীচে নামা এ মুহূর্তে অসম্ভব আমার পক্ষে! বসে পরলাম দরোজার সামনে। আধা ঘণ্টা পর রুম সার্ভিসের একজনকে দেখা গেল নতুন গ্রাহকের সাথে উপরে উঠতে। হাউমাউ করে বুঝাতে চাইলাম আমার অবস্থা। সুন্দর একটা হাসি দিয়ে অপেক্ষা করতে বলল। আরও প্রায় ১৫ মিনিট পর প্রায় ৮০ বছরের এক বৃদ্ধাকে দেখা গেল সিঁড়ি ভাঙ্গছে। পাগলের মত হাঁপাচ্ছে সে। শেষ পর্যন্ত অন্য একটা রুমে ঠাঁই নিতে হল। ধবধবে সাদা বিছানা, রঙ্গিন টিভি আর বড় মত আয়নাটা দেখে চোখে পানি আসার মত অবস্থা। হঠাৎ মনে হল আমার বিশ্বজয়ের এখানেই বোধহয় সমাপ্তি! এবার বিশ্রামের পালা!!
আন্দিজ ৩
শরীরে শুটকির গন্ধ, পরনের কাপড়ে দশ ইঞ্চি ধূলা, জুতা জোড়া বলছে এইমাত্র হালচাষ শেষে ঘরে ফিরেছি, এমন একটা অবস্থায় বিছানায় গেলে সহসাই ঘুম ভাঙ্গবেনা। তাই সাদা শুভ্র বিছানাটায় ঝাঁপিয়ে পরার লোভ সামলাতে হল জোড় করে। প্রথমত গোসল করতে হবে যে কোন মূল্যে। পেট শান্ত করাও জরুরী হয়ে পরেছে। প্রায়োরিটি সেট করে প্রথমে গোসলখানায় ঢুকে পরলাম। আধা ঘণ্টা মরার মত দাড়িয়ে রইলাম ঝরনাটার নীচে। গরম পানির উষ্ণ ছোঁয়ায় দিনের ক্লান্তি অনেকটাই কেটে গেছে মনে হল। পোশাক বদলে রাতের খাবারের সন্ধানে বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সিঁড়ি ভাঙ্গা এখন আর ততটা কঠিন মনে হলোনা। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল হোটেল ফটকে! বন্ধ হয়ে গেছে রাতের জন্যে। অল্প ইংরেজি জানা মহিলার দেখা পাওয়া গেল লবিতে। সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি জানতে পেরে তার চোখে মুখে মমতা ঝড়ে পরল। আমাকে সাথে নিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া ক্যান্টিনটায় ঢুকে পরল। দশ মিনিটের ভেতর গরম সুপ, সিদ্ধ আলু এবং সাথে মুরগীর ফ্রাই নিয়ে হাজির হতেই হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পরলাম প্লেটে। খাওয়া শেষ হতে মনে হল হাত-পা কাঁপছে আমার। চক্কর দিয়ে মাথাটাও ঘুরছে। এক কাপ কফি নিয়ে মহিলা কখন পাশে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। ’খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে, উপরে যাও এবং ভাল করে ঘুমিয়ে নাও, সব ঠিক হয়ে যাবে’, মা’র মমতা নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল মহিলা। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো আমার। এবার ঘুমের পালা।

সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে গেল ওয়েক-আপ কল ছাড়াই। হাত ঘড়িটা বলছে স্থানীয় সময় সকাল ৬টা। খুব একটা বেশী সময় ঘুমিয়েছি বলে মনে হলোনা। গতকালের ঘটনাগুলো এ মুহূর্তে দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই ভাবতে ইচ্ছে করলোনা। এতদিন জেনেছি এক জায়গায় দু’বার বজ্রপাত হয়না, আজ বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল আমারও পরপর দুটো দিন খারাপ যেতে পারেনা। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম ঘটনাবহুল আরও একটা দিনের প্রস্তুতি নিতে। মনে মনে দিনটার একটা ছক একে নিলাম; প্রথমে নিশ্চিত করতে হবে সময় মত পেরুর রাজধানী লিমা ফিরে যাওয়া; দ্বিতীয়ত, শহরটা দেখতে হবে যে কোন মূল্যে।

এধরনের সস্তা হোটেলে থাকার এ একটা ভাল দিক, বিনামূল্যে ব্রেকফাস্ট! যদিও তা আহামরি কিছু নয়, কিন্তু সময় মত হাতের কাছে পাওয়াটাই অনেককিছু, বিশেষকরে ডলার পাউন্ডের দেশে। ফ্রেশ হয়ে নীচে নামতে নামতে ৭টা বেজে গেল। টোষ্টেড রুটির উপর মাখন, সাথে ডিমের অমলেট… সবশেষে এক কাপ ধূমায়িত কফি। মন্দ না ফ্রি নাস্তার জন্যে। পকেটে পাসপোর্টটা আরও একবার পরীক্ষা করে বেরিয়ে পরলাম রাস্তায়। রোববার সকাল। উত্তর আমেরিকার হিসাব মত সময়টা হওয়া চাই একেবারেই জনশূন্য। কিন্তু এখানে দেখলাম ঠিক তার উল্টো। চারদিক লোকে লোকারণ্য। হাটতে হাটতে হাজির হলাম রাতে যেখানটায় আমাকে বাস হতে ছুড়ে ফেলা হয়েছিল। ঢালু রাস্তা, হাটতে গেলে মনে হবে কেউ যেন পিছন হতে ধাক্কা মারছে। গড় গড় করে নেমে গেলাম উচ্চতা হতে। সান ফ্রান্‌সিসকো প্লাজায় দৃশ্যটা দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল। হরেক রকম পোশাক পরে একদল বৃদ্ব-বৃদ্ধা নাচছে। বলিভিয়ানরা দৈর্ঘ্যে প্রায় সবাই ছোট, কিন্তু প্রস্থে বেশ নাদুস নুদুস। বাদ্যযন্ত্র প্রায় সবার হাতে। ৩-৪ জন মিহি-সুরে গান গাইছে। এ রকম প্রায় ৩/৪ গ্রুপে আলাদা হয়ে গোটা ৫০ মানুষ উপভোগ করছে রোববারের অলস সকাল। একজনকে জিজ্ঞাস করে জানা গেল একটু পর এরা সবাই চার্চে যাবে। ঈশ্বরকে আগাম ধন্যবাদ জানাতে এই আয়োজন। বিভিন্ন এঙ্গেল হতে বেশ ক’টা ছবি তুললাম। আমার মত বেশ ক’জন টুরিস্টকেও দেখলাম প্রাণভরে উপভোগ করছে সকালের এই আয়োজন। ৮টা বাজতেই হুস হল। ফিরে যাওয়ার টিকেট কেনা হয়নি এখনো।

মাথা ঠাণ্ডা রেখে প্ল্যান শুরু করলাম কোথা হতে শুরু করা যায়। কিছুদূর না যেতেই দেখা মিলল স্থানীয় পুলিশ ষ্টেশনটার। দৈব জিনিষে বিশ্বাস ছিলনা কোন কালেই, কিন্তু এ যাত্রায় মনে হলে দিনটা ভাল যাওয়ার এ যেন ঐশ্বরিক ইংগিত। সাত পাঁচ না ভেবে ঢুকে পরলাম। ‘উস্তেদ হাবলা ইংলেজ?‘ দাঁড়াও বলে ভেতরে গিয়ে নিয়ে আসল ইংরেজি জানা এক মহিলা পুলিশকে। খুলে বললাম আমার কাহিনী। উত্তরে ভদ্রমহিলা যা বলল তাতে আশান্বিত হওয়ার কোন কারণ খুঁজে পেলামনা। আজ রোববার, খাবার দোকান ছাড়া লা পাস শহরের সবকিছু বন্ধ! গতকালের মত সবকিছুতেই আতংকিত না হয়ে জানতে চাইলাম কোথা গেলে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সাহায্য মিলতে পারে। ফাইভ স্টার হোটেল হতে পারে পারফেক্ট স্পট, এমনটাই ধারণা পাওয়া গেল পুলিশ ষ্টেশনে। তথাস্তু! সব দ্বিধা দন্ধ আছড়ে ফেলে লম্বা একটা ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে পরলাম ফাইভ স্টার হোটেলের খোঁজে। আন্দিজের মৃদু মন্দ বাতাসে হাটতে মন্দ লাগছিলোনা। এক ধরনের কাব্যিক আনন্দ পেলাম সুমুদ্রপৃষ্ট হতে এতটা উচ্চতায় ঘুরে বেড়াতে। না, কোন কিছুতেই আজ মন খারাপ হচ্ছেনা। দূর হতে পড়তে অসুবিধা হলোনা দালানটার মাথায় সাইনবোর্ডটা, র‌্যাডিশন। ভেতরে ঢুকতেই ফাইভ স্টার আরামের গন্ধ পাওয়া গেল চারদিকে। হোটেলটার নিজস্ব ট্রাভেল এজেন্সিটাতে বড় একটা তালা ঝুলতে দেখে মনটা বেশ দমে গেল। ফ্রন্ট ডেস্কে আলাপ করে জানা গেল সোমবার সকাল ছাড়া কাজ হবেনা। নিজের কাহিনী সবটা খুলে বলতে ডেস্কে বসা ল্যাটিন সুন্দরীর মন গলাতে পেরেছি মনে হল। মুহূর্তের মধ্যে গোটা দশেক ফোন করে গাই গুই করে স্প্যানিশ ভাষায় কি বললো কিছুই বুঝা গেলনা। কিন্তু কাজের কাজ হল শেষ পর্যন্ত। ’লান চিলি’ নামের এয়ার লাইনের টিকেট পাওয়া গেল। দাম নিয়মিত দামের প্রায় ৩ গুন। আলহামদুল্লিলাহ্‌ বলে জবাই হওয়ার স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য হলাম। সকাল ৭ টার ফ্লাইট, এয়ারপোর্ট থাকতে হবে ৬টার ভেতর। সুন্দরী জানাল সোমবার সকালে নতুন করে শুরু হতে যাচ্ছে অনির্দিষ্ট কালের ধর্মঘট। মন মনে বললাম, লা ক্যুম দ্বিনুকুম ওলয়্যাদিন …। আমাকে আর পাচ্ছোনা তোমরা! টিকেটের ঝামেলা শেষ হতেই মনে হল গোটা আন্দিজ পাহাড় নেমে গেছে মাথা হতে। এবার যে উদ্দেশ্যে এখানে আসা তা পূর্ণ করার পালা। এ ব্যাপারে সাহায্য চাইলাম ফ্রন্ট ডেস্কের কাছেই। তোতা পাখীর মত একগাদা ট্যুরের আমলনামা ধরিয়ে দিল হাতে। ধারণাটা হঠাৎ করেই মাথায় খেলল, প্রথমবার সিংগাপুর গিয়েও এর সাহায্য নিয়েছিলাম। সারাদিনের জন্যে বিশ্বাসযোগ্য একজন ক্যাব ড্রাইভার দরকার আমার! জানাতেই বত্রিশ পাটি দাঁত উদাম করে হেসে উঠল উদ্ধার দেবী। হোটেলের নিজস্ব ড্রাইভার কার্লোস বসে আছে ৭ দিন ধরে। হাঙ্গামার কারণে টুরিস্টদের দেখা নেই, আমই চাইলেই নিতে পারি। ৬০ ডলারে ফয়সালা হয়ে গেল। সেকেন্ডের ভেতর মাটি ফুড়ে হাজির হলেন আমার সারাদিনের কেনা গোলাম কার্লোস হেরনান্‌ডেস।

বিয়েন বেনিদছ্‌ আ লা পাস’, হাত বাড়িয়ে লা পাস’এ আমাকে স্বাগত জানাল কার্লোস। ’গ্রাসিয়াস সিনওর’, ধন্যবাদ জানিয়ে আমিও হাত বাড়িয়ে দিলাম। স্প্যানিশ ভাষায় জানতে চাইলাম তার নাম, এবং তাতেই সে ধরে নিলো এ আমার ন্যাচারাল ভাষা। দক্ষিণ আমেরিকা আসব বলে প্রয়োজনীয় ক’টা বাক্য রপ্ত করেছিলাম সেই নিউ ইয়র্ক বসেই। কিন্তু কার্লোসের বকবকানির উত্তর দিতে গিয়ে সহসাই আবিষ্কার করলাম আমার স্প্যানিশের ভাণ্ডার একেবারেই ঠুনকো। কিছুদূর এগুতেই জানিয়ে দিলাম, নো স্প্যানিশ por favor(প্লীজ)। বেচারা তাতে মোটেও দমে গেল বলে মনে হলোনা, বরং বকর বকর আরও বাড়িয়ে কান ঝালাপালা করে ফেলল। উপায় না দেখে আমিও কথা বলার ষ্ট্রাটেজি বদলে ফেললাম, মিঃ হেরনান্‌ডেজের সাথে এখন হতে বাংলায় কথা বলব আমি! আমার সূদীর্ঘ ভ্রমন জীবনে অনেকবারই ব্যবহার করেছি এ কৌশল। মৌখিক যোগাযোগে ভাষার গ্যাপ থাকলে নির্জলা বাংলা ব্যবহার এক ধরনের ঐশ্বরিক তৃপ্তি দেয়!

হাতের কাছেই সান ফ্রানসিস্কো প্লাজা। আমার ড্রাইভার-কাম-ট্যুর গাইড এখান হতেই শুরু করতে চাইল শহর ভ্রমন। খাঁটি বাংলায় বললাম, ’মিয়াভাই, ঘন্টাখানেক আগে ঘুরে গেছি এই স্কয়ার, যাওয়ার আর দরকার নাই‘। আগা মাথা কিছু না বুঝে গাড়ির দরজা খুলে আহ্বান জানাল সান ফ্রানসিস্কো কলোনিয়াল চার্চটা ঘুরে আসার জন্যে। না গেলে হয়ত ভুলই করতাম। দেখার মত জিনিষ। পরবর্তী ঠিকানা প্লাজা মুরিয়েয়ো। এই প্লাজার চারদিক ঘিরে আছে অনেকগুলো সরকারী ভবন, তারমধ্যে জাতীয় কংগ্রেস ভবন এবং প্রেসিডেন্ট ভবন অন্যতম। লন্ডনের ট্রাফলগয়ার স্কয়ারের মত শত শত কবুতর উড়ে বেড়াচ্ছে যত্র তত্র। খাবার দিলে ওরা হাতে, শরীরে বসে পর্যটকদের আনন্দ যোগায়। টুরিস্টদের ভীরে গিজ গিজ করছে স্কয়ারটা। বেশ ক’টা ছবি তুলে বিদায় নিলাম জায়েন ষ্ট্রীটের উদ্দেশ্যে। পথেই দেখলাম এভিনিউর নামটা, বুশ এভিনিউ। এবার আর বাংলা নয়, ভাঙ্গা স্প্যানিশেই কার্লোসকে জিজ্ঞেস করলাম, ’তে গুস্তা বুশ মুচঅ?’ অর্থাৎ, বুশকে কি তোমাদের খুব পছন্দ? পাহাড়ি খাদ বেয়ে উপরের দিকে উঠছিলাম আমরা, কায়দা করে গাড়িটাকে এক জায়গায় থামিয়ে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল সে আমার দিকে, বিশ্রী একটা গালি দিল প্রেসিডেন্ট বুশকে, আমাকে সাবধান করে দিল লা পাসে এ ধরনের মন্তব্য করা হতে বিরত থাকতে। ভুলেই গিয়েছিলাম বলিভিয়া ভেনিজুয়েলান প্রেসিডেন্ট হুগো সাভেজের সমাজতান্ত্রিক জ্বরে আক্রান্ত এবং এই নতুন কাস্ত্রোর লোকাল এজেন্ট এবো মরালেসের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। মাথা ঠাণ্ডা হতেই কার্লোস জানাল বুশ এভিনিউর নাম করণ করা হয়েছে আসলে তাদেরই এক জেনারেলের নামে, যার পুরো নাম খেরমান বুশ। দক্ষিণ আমেরিকার রাজনীতি নিয়ে কথা বলার সময় এবং জায়গা এটা নয়, তাই চুপ করে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। তিওয়ানাকো কালচারের ওপেন-এয়ার মিউজিয়াম আমাদের পরবর্তী ঠিকানা। তারপর মেনুতে ছিল ওব্রাখেস, কালাকোতা এবং লা ফ্লোরিডা আবাসিক এলাকা ভ্রমন। মুন ভ্যালির মাটির ধ্বস দেখার মধ্য দিয়ে আমাদের ট্যুর শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু কার্লোস এখানেই থামল না, আঁকাবাঁকা পথ ধরে পাহাড়ে ভাঙ্গতে শুরু করল প্রচণ্ড গতিতে। প্রথমেই থামল এমন একটা উচ্চতায় যেখান হতে পুরো লা লাজ শহরের প্যানোরমা দেখা যায় ফ্রেমে বাধানো ছবির মত। গাড়ি থামিয়ে সেও এগিয়ে এলো আমার সাথে। নির্দিষ্ট একটা জায়গায় আঙ্গুল দেখিয়ে তাকাতে বলল আমায়। বিন্দুর মত দেখাল দূরের স্টেডিয়ামটাকে। এক ধরনের গর্ব খেলে গেল কার্লোসের চোখে মুখে। এই সেই বিখ্যাত স্টেডিয়াম যেখানে অনুষ্ঠিত হয় বলিভিয়ার ন্যাশনাল ফুটবল স্পেক্টাকেল। প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম আমি ফুটবল পাগল দক্ষিণ আমেরিকার কোন একটা দেশে এখন। সমুদ্র পৃষ্ট হতে পৃথিবীর যে কোন স্টেডিয়ামের চাইতে সবচেয়ে বেশী উচ্চতায় অবস্থিত এই স্টেডিয়াম। নাম শুনেছি অনেক, রাশিয়ায় থাকতে টিভিতে সরাসরি খেলাও দেখেছি অনেকবার। কার্লোসকে ধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে গেলাম গাড়ির দিকে। তাকে খুব একটা খুশী মনে হলোনা ফুটবল নিয়ে আমার এই ভাবলেশহীন অভিব্যক্তিতে।

আমরা এগিয়ে গেলাম ট্যুরের শেষ গন্তব্যস্থল পরিদর্শনে। সান পেড্রো পাহাড়ের উপর কোচাবাম্বা এলাকায় ’ক্রেষ্টো দ্যা লা কনকরডিয়া’ স্ট্যাচু শহর হতে বেশ কিছুটা দূরে। যিশু খ্রিষ্টের এই মূর্তি ব্রাজিলের রিও দ্যা জেনেরোর ’ক্রাইস্ট দ্যা রিডিমারের’ চাইতেও কয়েক ফুট লম্বা। প্রায় ৪১ মিটার লম্বা এটাই বিশ্বের সর্ব বৃহৎ যীশুর স্ট্যাচু। উচ্চতায় পৌঁছে গাড়ি থামতেই চোখ জুড়িয়ে গেল দৃশ্যটা দেখে। খণ্ড খণ্ড মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে চারদিক। ইচ্ছে করলেই হাত দিয়ে ছোঁয়া যায় এক খণ্ড মেঘ। বিশাল উচ্চতা হতে নীচে লোকালয়ের দিকে তাকালে রক্ত হিম হয়ে আসে। এত উঁচুতেও আলপাকা এবং জামাদের দেখা গেল এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করতে। ছবি তুললাম মন ভরে। হঠাৎ করেই বিশাল এক খণ্ড মেঘ ঢেকে দিল মাথার উপরটা, চারদিকে নেমে এলো এক ধরনের বোবা অন্ধকার। ভয়টা ভূতের মত চেপে বসল মাথায়! আমার হাতে দু’টা ভিডিও ক্যমেরা, একটা ডিজিটাল ষ্টীল ক্যমেরা এবং পকেটে অনেকগুলো টাকা। কি হবে যদি এই অজানা অচেনা ড্রাইভারের মাথায় লোভ চেপে বসে? হাল্কা একটা ধাক্কা দিলেই যথেষ্ট, ইতিহাস হয়ে যাব আমি আন্দিজের বিপদজনক বাঁকে। বলিভিয়া পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র এবং চরিত্রহীন দেশ, এখানে কাউকে বিশ্বাস করাটা হবে বোকামির শামিল। উঠে দাঁড়ালাম মূর্তিটার বিশাল পাদদেশ হতে। ড্রাইভার বললাম, ‘বামুস‘ (চল)। কোন অঘটন ছাড়াই পৌঁছে গেলাম হোটেলে। বিদায়ের আগে কার্লোসই জানতে চাইল সকালে এয়ারপোর্ট যাওয়ার যানবাহন ঠিক করা আছে কিনা। ভাল কথা মনে করিয়ে দিল সে, ধন্যবাদ জানিয়ে তাকেই আসতে বললাম সকাল ৪টার ভেতর।

সন্ধ্যাটা এলোমেলো ঘুরে বেড়ালাম ডাউন টাউনে। মূল রাস্তায় এক মহিলা মুচির ছবি তুলতে গেলে তেড়ে এলো মারতে, দৌড়ে আশ্রয় নিলাম পার্শ্ববর্তী হোটেলে। তবে এখানেই সমাপ্তি টানলাম না ভাল একটা দিনের। সন্ধ্যা নামার সাথে আবারও আন্দিজ হতে নেমে এলো ঘন কালো কুয়াশা, ভোজবাজির মত কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেল চারদিকের সবকিছু। অনেক সন্ধান অনুসন্ধানের পর একটা চীনা রেস্তোরা খুঁজে পাওয়া গেল বেশ কিছুটা দূরে। অস্ট্রেলিয়ান এক দম্পতিকে সাথে নিয়ে অনেকদিন পর রাতের আহারে ভূরি ভোজ করলাম মনের আনন্দে। ৯টা বাজতেই চারদিকে বেজে উঠল হরতাল দামামা, তৈরি হচ্ছে লা পাস কালকের জন্যে। আর কোন রিস্ক না নিয়ে ঘরে ফিরে গেলাম বিনা এডভেঞ্চারে। ১০টার ভেতর শুয়ে পরলাম খুব সকালে উঠতে হবে বলে।

ভোরে ঘুম ভাঙ্গল ওয়েক-আপ কলে, নীচে ক্যাব নিয়ে অপেক্ষা করছে কার্লোস। হোটেল ভাড়া পরিশোধ করে যথেষ্ট সময় হাতে নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্য। লা পাস এয়ারপোর্টের চারদিকের বিস্ময়কর সৌন্দর্য বেশীক্ষণ উপভোগ করার সময় পাওয়া গেলনা, চারদিকে হরতাল শুরুর চাপা উত্তেজনা। ইমিগ্রেশন পার হয়ে ভেতরে ঢুকে পরলাম নিরাপত্তার কথা ভেবে। যাত্রী সহ ’লান চিলির’ ফ্লাইট আকাশে উঠতেই হাফ-ছেড়ে বাঁচলাম, কিন্তু মনটাও কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেল সাথে। বিমানের জানালা ধরে তাকিয়ে থাকতে সেলুলয়েডের ফিতার মত রি-ক্যাপ হতে শুরু করল ফেলা আসা ২/৩ দিনের স্মৃতি। দেসাগুয়াদেরর অজানা আশংকা, আন্দিজের অচেনা বাঁকে জীবন বাঁচানোর ম্যারাথন দৌড়, বিকট শব্দে বাসের চাকা পাংচার, খাদ্য এবং পানি ছাড়া আন্দিজের বাকে বিপদজনক বিকেল সহ টুকরো টুকরো অনেক ঘটনা। সবচেয়ে বেশী মনে পরল হারিয়ে যাওয়া রহস্যময়ী ভিক্টোরিয়ার কথা। স্মৃতির অলিগলি হাতড়াতে কোনদিন কি ফিরে আসা হবে পৃথিবীর এ প্রান্তে?

লা পাস ‘এলো আলতো’ এয়ারপোর্ট হতে লিমা ’হোরহে চাভেজ‘ এয়ারপোর্ট ২ ঘণ্টার পথ। দেশ দু’টোর মধ্যে রয়েছে ১ ঘণ্টা সময় ব্যবধান। সাধারণ মানের এক প্যাকেট পটেটো চিপস, সাথে মিনি গ্লাসে এক গ্লাস ইনকা কোলা, আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে এ ধরনের দায়সারা গোছের আপ্যায়নে বেশ হতাশ হলাম। এতগুলো ডলার খসে গেল মাত্র দুই ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে হবে, ভেতরের এই অসন্তুষ্টিটা কাটা গায়ে নুন ছেটানোর মত যন্ত্রণা দিচ্ছিল বার বার। দৃশ্যটা প্রথমবারও লক্ষ্য করেছি, লিমা এয়ারপোর্টকে ঘিরে থাকা আন্দিজের চূড়াগুলো ঘন মেঘের স্তর ভেদ করে আকাশে উঠে গেছে। হঠাৎ করে দেখলে দৈত্য দানবের মত মনে হবে। প্রাক ধারণা না থাকলে চূড়াগুলি ভয় ধরিয়ে দেয় ফ্লাইট সেফটির আশংকায়। সীট নিয়ে ভাল করে বসার আগেই মন হল হল ল্যান্ড করছি আমরা।

৯টার ভেতর ঝামেলা চুকিয়ে বেরিয়ে এলাম এয়ারপোর্ট হতে। নিউ ইয়র্কের ফ্লাইট রাত ১২টায়; মাঝখানের ১৫ ঘণ্টা কোথা যাব, কি করব ভেবে চিন্তিত হয়ে পরলাম। ইচ্ছা ছিল এয়ারপোর্ট লাউঞ্জেই কাটিয়ে দেব সময়টা, কিন্তু এত লম্বা সময়ের কথা মনে হতেই দ্বিধায় পরে গেলাম। রাতে ভাল ঘুম হয়নি, তা ছাড়া সামনে পরে আছে আরও ৭ ঘণ্টার ফ্লাইট। এত ধকল শরীরে সইবার নয়, তাই হিসাব শেষে হোটেলে উঠার সিদ্ধান্ত নিলাম। টুরিস্ট ব্যুরোর ডেস্কে গিয়ে সন্ধান চাইলাম কাছাকাছি সস্তা হোটেলের। আগের বার বোকার মত ৭৫ ডলার দিয়ে লিমার সবচেয়ে অভিজাত এলাকা মিরাফ্লোরেসে হোটেল বুক করেছিলাম। ডেস্কের লাস্যময়ী তরুণী এক সপ্তাহের ভেতর দ্বিতীয় বার স্বাগত জানিয়ে আগের হোটেলে যেতে চাই কিনা জিজ্ঞেস করল। ৩৫ ডলারে এয়ারপোর্টের সবচেয়ে কাছের হোটেলটায় বুকিং দিয়ে ক্যাব নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেলাম।
আন্দিজ পর্বতমালা ১৩
রাজধানী লিমা ইতিমধ্যে জেগে উঠেছে। অগুনিত যানবাহন, গিজ গিজ করা মানুষের ভিড়। এয়ারপোর্টের কাছাকাছি রাস্তাগুলো হঠাৎ করে দেখলে ঢাকার কোন রাস্তা বলে ভুল হতে পারে। এলোমেলো ট্রাফিক, শ্রীহীন ইমারত, যত্রতত্র নির্বাচনী চিকা, লক্কড় ঝক্কড় মিনিবাস এবং রাস্তায় পরিকল্পনাহীন দোকান পাট, নির্ঘাত ঢাকার ছবি! শুধু পার্থক্য এর চতুর্দিকের প্যনোরমা। আন্দিজের বিশাল বিশাল চূড়ায় নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে সকালের সূর্য। এক ধরনের ঘন কুয়াশা রাজত্ব করছে শহর জুড়ে। একটু এগিয়ে হাইওয়ে ধরতেই পার্থক্যটা প্রকট হয়ে উঠল, ঢাকায় এ ধরনের নিয়ন্ত্রিত ট্রাফিক চলাচল অকল্পনীয়। পনের মিনিটের ভেতর হাজির হলাম হোটেলটার সামনে। হোটেল ’ম্যানহাটন’, নির্জন পরিবেশে বেশ খোলামেলা জায়গায় হোটেলটাকে দেখে পছন্দ হয়ে গেল।

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই ৩২ দাঁত বের করে স্বাগত জানাল অবিকল বাঙ্গালী চেহারার এক তরুণী।

আমার ভ্রমণ কাহিনীর এখানেই বোধহয় সমাপ্তি টানা যায়, কারণ এর পরের ১৫ঘন্টায় যা ঘটবে তার সাথে ভ্রমণের কোন সম্পর্ক নেই। লম্বা একটা ঘুম সেরে নীচে নামতেই আলাপ হবে সকালের সেই মেয়েটার সাথে। সে আলাপ চলবে টানা ৩ ঘণ্টা। এবং এই ৩ ঘণ্টায় বীজ বপিত হবে নতুন এক কাহিনীর। এ কাহিনীর ট্রেইল ধরে আমাকে আবারও ফিরে আসতে হবে লিমায়। স্মৃতির অলিগলি হাতড়াতে আবারও যেতে হবে কুসকো, মাচা পিচু, পদানত হবে আন্দিজের নতুন নতুন চূড়া। পাড়ি দিতে হবে কলার দেশ ইকুয়েডর, ড্রাগের স্বর্গভূমি কলম্বিয়া সহ আন্দিজের আরও অনেক বাঁক। এ নিয়ে হয়ত লেখা যেতে পারে বিশাল ক্যানভাসের আরও একটা কাহিনী, যা ভ্রমণের পাশাপাশি ছুঁয়ে যাবে প্রেম, ভালবাসার মত নাটকীয় বিষয়গুলি।

– সমাপ্তি

লেখাটা শেষ করে গিন্নীকে আনতে যেতে হবে। সে এখন কাজে। এবং আমার গিন্নীই সেই জন যার সাথে দেখা হয়েছিল লিমার সেই হোটেলটায়।

Published by

greenbelt

We started organizing travel events to contribute in the expansion of education in Hill tracks. Later on Green Belt becomes a Brand in this arena. And becomes a tour planner company. Now a days, Green Belt regularly organizes tour both inbound & outbound. Ph-01869649817

Exit mobile version