আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ১
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ২
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৩
মাইল খানেক হাটার পর জটলাটা চোখে পরল। ড্রাইভার এবং ট্যুর গাইডদের সাথে পাহাড়ি এলাকার মাম্বো জাম্বো টাইপের ক’জন কি নিয়ে যেন দরকষাকষি করছে। দু’পক্ষকেই বেশ উত্তেজিত মনে হল। বন্দী দশা সইতে না পেরে অনেক যাত্রীও নেমে এসেছে খোলা বাতাসে। অধৈর্য এবং উৎকণ্ঠার ছাপ সবার চোখে মুখে। ৭ দিন ধরেই চলছে অবরোধ নামের ক্যাট & মাউস গেইম। আজ শনিবার, অনেকেই ভেবেছিল অন্তত ছুটির দিনটায় রেহাই পাওয়া যাবে ধর্মঘটীদের টাগ অব ওয়্যার হতে। দেশের ট্রেড ইউনিয়নগুলো চাইছে বলিভিয়ান সরকার গ্যাস কোম্পানিগুলো জাতীয়করণ করুক। তাদের অভিযোগ, বিদেশীরা যুগ যুগ ধরে এ দেশের গ্যাস সম্পদ দুর্নীতিবাজ সরকারগুলোর সহযোগিতায় বিদেশে পাচার করে নিজদের পকেট ভারী করছে। পয়েন্ট অব নো রিটার্নে চলে গেছে আদিবাসীদের বেচে থাকা। মূলত তাদের স্বার্থেই এ ধর্মঘট। চারদিক তাকালে মনে হবে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কোন এক আশ্চর্য্যতম গলিতে বন্দী হয়ে গেছি আমারা। একদিকে আন্দিজের বিশালতা, পাশাপাশি মাইলের পর মাইল খোলা মাঠ, সমান্তরালে বয়ে যাচ্ছে খরস্রোতা নদী। এখানে আধূনিক প্রযুক্তি নির্বাসিত, নেই মুঠো ফোনের রাজত্ব। বহুদূরে ক’টা জংলী মহিষ এবং আলপাকাদের অলস চলাফেরা মনে করিয়ে দেয় সৌরজগতের অন্যকোন গ্রহ নক্ষত্র নয়, এ আমাদেরই প্রিয় পৃথিবীর কোথাও না কোথাও।
আন্দিজের যে বাকটাতে আমরা আটকে আছি তার শেষ প্রান্তটা বেশ অদ্ভুত দেখাল দূর হতে। রাস্তার দু’পাশের পাহাড়গুলো হঠাৎ করে যেন এক বিন্দুতে মিলে গেছে। গুহার মত দেখায় নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া পাকা রাস্তা হতে দেখলে। মোক্ষম জায়গা ট্রাফিক আটকানোর! হঠাৎ করে সামনের জটলায় সবাইকে কেমন উত্তেজিত মনে হল। মিনিট পাঁচেক না যেতেই এক দল অন্য দলকে ধাওয়া শুরু করে দিল। চারদিকে বন্য চীৎকারে খানখান হয়ে গেল আন্দিজের নির্জনতা। আঙ্গুল উঁচিয়ে পাহাড়ের দিক কি যেন দেখাতে চাইছে অনেকে। ও দিকে চোখ ফেরাতেই হিম হয়ে গেল সমস্ত শরীর। কিং কং কায়দায় হাতে পাথরের বড় বড় টুকরা এবং তীর ধনুক নিয়ে আদিবাসীরা ঘেরাও করে ফেলেছে আমাদের। ভেতরের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় একসাথে বলে উঠল পালাতে হবে আমাকে। শুধু আমি নই যতদূর চোখ যায় সবাই দেখলাম দৌড়াচ্ছে। পালাচ্ছে যুদ্ধের মাঠে পরাজিত সৈনিকদের মত। পেছনে ধেয়ে আসছে সাক্ষাৎ আজরাইল। কেউ একজন খোলা আকাশের নীচে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছিল, পরনের কাপড় ফেলে দৌড়াতে শুরু করল সে। লিউ টলষ্টয়ের কালজয়ী উপন্যাস ’ওয়্যার এন্ড পিস’ অবলম্বনে তৈরি ছায়াছবির পুনরাবৃত্তি হচ্ছে যেন এখানে। পরনের ভারী জ্যাকেট নিয়ে দৌড়াতে বেশ অসুবিধা দেখা দিল। ভাবলাম ছুড়ে ফেলি। কিন্তু তখনই দেখলাম ভয়াবহ দৃশ্যটা! পাহাড়ের উঁচু হতে ধেয়ে আসছে অসংখ্য পাথর। সাথে ধনুক হতে ছোড়া শত শত তীর। জ্যাকেট ফেলে দেয়ার চিন্তাটা বাদ দিলাম নিরাপত্তার কথা ভেবে। পাগলের মত বেশ কিছুটা পথ দৌড়ানোর পর বুঝতে পারলাম তীর ধনুকের বলয় হতে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। ওগুলো টার্গেট মিস করে লুটিয়ে পরছে পাথরের উপর। সাথে সৃষ্টি করছে এক ধরনের বন্য আওয়াজ। দৌড় থামানো গেলনা কারণ সামনে পেছনে সবাই এ কাজটা করছে জীবন বাজি রেখে। হঠাৎ মনে হল দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। থামতে বাধ্য হলাম। নাক হতে রক্তের ফোয়ারা বইতে শুরু করেছে ততক্ষণে। সমুদ্র পৃষ্ট হতে অনেক উঁচুতে আমরা, এমন একটা উচ্চতায় কেনীয়ান দৌড়বিদরাও দু’বার চিন্তা করবে ম্যারাথন দৌড়ে শামিল হতে। প্রায় জ্ঞান হারানোর মত অবস্থা। এক পা এগুনোর শক্তি অবিশিষ্ট নেই শরীরে। শুয়ে পরলাম বাধ্য হয়ে। জ্যাকেটটা টেনেটুনে মরার মত পরে রইলাম কিছুক্ষণ। দূরের চিলগুলোকে মনে হল আমার দিকেই তাকাচ্ছে যেন। চিল নয়, বড় বড় শকুন কোত্থেকে এসে হাজির। অনবরত চক্কর দিচ্ছে মাথার উপর। অনেক গল্প উপন্যাসে পড়েছি ক্ষুধার্ত শকুনের দল রক্তের গন্ধ পেলেই ছুটে আসে। খুবলে খায় খুঁজে পাওয়া শিকার। পাখীর শিকার হয়ে আন্দিজের এ অঞ্চলে কংকাল হওয়ার ইচ্ছা হলোনা, তাই জোর করে দাড়াতে হল। আমার মত বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত এবং প্রায় অর্ধমৃত অনেককেই দেখলাম টেনেটুনে হাঁটছে। সবাই কম বেশী আহত। অনেকের নাক দিয়েই রক্ত ঝরছে। বেশ কিছুটা হেটে প্রথম বাঁকটা পার হতেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। যতদূর চোখ যায় শুধু মাঠ আর মাঠ। কোন এক দৈব মন্ত্রবলে হাওয়া হয়ে গেছে অপেক্ষমাণ বাসগুলো।
শুরু হল আসল চিন্তা। সাথে মানিব্যাগ ছাড়া অন্যকিছু নেই। পাসপোর্টটাও রেখে এসেছি বাসে। চিন্তার সব দুয়ার একসাথে বন্ধ হয়ে গেল যেন। কোথা হতে শুরু করব বুঝতে পারছিলামনা। মানিব্যাগ থাকলেও নগদ বলতে শ’খানেক ডলার, সাথে দু’টা ক্রেডিট কার্ড আর বলিভিয়ার কিছু বলিভিয়ানো। কিন্তু এসব কাজে লাগিয়ে কি করে লোকালয় পর্যন্ত পৌঁছবো তার কোন কাঠামো দাড় করাতে পারলাম না। এক কথায় আমি হারিয়ে গেছি আন্দিজ পর্বতমালার বাকে। মরে কংকাল হয়ে গেলেও কেউ আমার খোজ পাবেনা। মাথায় কোন কিছুই ঢুকতে চাইছে না। বসে পরলাম ধপাস করে। নাকের রক্তটা থামানো যাচ্ছেনা কিছুতেই। ভিক্টোরিয়ার কথা মনে হল হঠাৎ করে। সে সাথে থাকলে একটা কিছু বেরিয়ে আসত। কিন্তু মাইল-খানেকের ভেতর মেয়ে মানুষের কোন ছায়া দেখা গেলনা। কেন জানি মনে হল সে নিশ্চয় মিশে গেছে আদিবাসীদের সাথে। হয়ত তার মিশনটাই ছিল এখানে আসার এবং এই আউলা চক্কর কাছ হতে দেখার। মিনিট দশেক বিশ্রাম নিয়ে আবারও হাটতে শুরু করলাম। সামনে আরও একটা বাঁক। দেখতে হবে কি আছে ঐ বাঁকটার পর। গায়ের জোড় আর শরীরের জোর একসাথে করে কচ্ছপ গতিতে এগিয়ে চললাম।
বাঁকটা পার হতেই চোখে পরল দৃশ্যটা। মাইল দু’এক দূরে সাদা সাদা বিন্দুর মত দেখাচ্ছে অপেক্ষমাণ বাসগুলোকে। হঠাৎ মনে হল স্বপ্ন দেখছি! যেন অমল ধবল মেঘরাজ্যে উড়ছি আমি। সাথে বসন্তের পাগলা হাওয়া। জ্যাকেটটা খুলে মাথার উপর ঘুরাতে শুরু করলাম। দূর হতে কেউনা কেউ দেখে থাকবে নিশ্চয়ই। দু’মাইলের পথ, ইচ্ছে হল দু’মিনিটে পাড়ি দেই। আমার বিশ্রাম দরকার, সারা জীবনের বিশ্রাম। কিন্তু বাতাসের শো শো আওয়াজ আর হাড্ডি কাঁপানো কনকনে শীত বাধা হয়ে দাঁড়াল বাস ও বিশ্রামের মাঝে। মাথার উপর সূর্যটাকেও কেমন ক্লান্ত দেখাল। কিন্তু এ মুহূর্তে আমার ক্লান্ত হওয়া চলবে না… আজ শনিবার এবং সোমবার মধ্যরাতে লিমা হতে নিউ ইয়র্কের ফিরতি ফ্লাইট ধরতে হবে।
দূর হতে দু’মাইলের পথ মনে হলেও দূরত্ব বোধহয় এক মাইলের বেশী ছিলনা। ক্লান্ত, শ্রান্ত এবং বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে বাসটার কাছাকাছি আসতেই স্বাগত জানাল পটকা মাছের মত ফুলে উঠা কতগুলো মুখ। ডায়নামাইটের মত বিস্ফোরিত হল ট্যুর গাইড, সাথে গলা মেলাল ড্রাইভার এবং তার হেল্পর। দু’একজন যাত্রীও ইনিয়ে বিনিয়ে কি যেন বলতে চাইল। এতকিছু শোনার মত শরীর ছিলনা। বসে পরলাম ধপাস করে এবং ভুলে যেতে চাইলাম গত কয়েক ঘণ্টায় ঘটে যাওয়া অলৌকিক ঘটনাগুলো। পাসপোর্টের কথা মনে হতেই হুস ফেরলো। লাগেজ খুলে জায়গা-মত হাত দিতেই অনুভব করলাম মূল্যবান ডকুমেন্টটার উপস্থিতি। সব আগের মতই আছে শুধু জীবন হতে খসে ৩টা ঘণ্টার মত সময়। হেল্পার পানি এগিয়ে দিল নাক-মুখের রক্ত পরিষ্কার করার জন্যে। অনিচ্ছা স্বত্বেও নামতে হল বাস হতে।
পরিষ্কার হয়ে বাসে ফিরতেই হাজারো প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল সহযাত্রীরা। মূল প্রশ্ন, মেয়েটা কোথায়? ট্যুর গাইড সবার হয়ে অফিসিয়ালি করল প্রশ্নটা। আমি সাফ জানিয়ে দিলাম ভিক্টোরিয়া ছিল আমার সহযাত্রী মাত্র। বাসে পরিচয় এবং তার সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। আমার বক্তব্যের পক্ষে সমর্থন পাওয়া গেল দু’এক জন যাত্রীর। বাস ড্রাইভার জানাল আর মিনিট দশেক অপেক্ষা করবে, মেয়েটা না ফিরলে সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া তাদের গত্যন্তর নেই। ব্যাপারটা ভাবতেই আমি শিউরে উঠলাম, কি হত বাসটা যদি এই জনশূন্য এলাকায় আমাকে ফেলে চলে যেত! এবার আমার প্রশ্ন করার পালা, ভেতরের সব রাগ দলা করে ছুড়ে দিলাম ট্যুর গাইডের মুখে, কঠিন গলায় জানতে চাইলাম, আমাদের ফেলে বাসটা কেন পালিয়েছিল? এই প্রথম জানলাম একটা বাসের মূল্য আমার জীবনের চেয়ে অনেক বেশী। এমন একটা তথ্য দিতে ট্যুর গাইডের গলাটা সামান্য একটু কাঁপলোনা। হজম করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলনা। এ ধরনের কথাবার্তা তৃতীয় বিশ্বের অনৈতিক এবং মানসিকভাবে পঙ্গু মানুষগুলোর পক্ষেই বলা সম্ভব, এমনটা ভেবে নিজকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলাম।
আরও আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করল বাসটা। কিন্তু ভিক্টোরিয়ার হদিস পাওয়া গেলনা। আমাদের যমজ বাসটা ইতিমধ্যে রওয়ানা হয়ে গেছে। ট্যুর গাইড জানাল মূল রাস্তা হতে বের হয়ে মাইল খানেক গেলে নতুন একটা ট্রেইল পাওয়া যাবে। এবং সে পথটা ধরতে পারলে আরও স্বল্প সময়ে আমরা লা-পাস পৌঁছতে পারব । আমার কাছে এসব কথা রূপকথার মত মনে হল। এখান হতে জাহান্নামের দিকে রওয়ানা দিলেও আমার কিছু আসে যায়না, লা-পাস পৌঁছার আগে বাস হতে আমি নামছি না। অপেক্ষা শেষে বাসটা রওয়ানা দিল উলটো পথে। যতক্ষণ সম্ভব জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলাম ফেলে আসা পথটার দিকে। রহস্যময়ী ভিক্টোরিয়ার হাজারো রহস্যের জন্ম দিয়ে হারিয়ে গেল আন্দিজের বাঁকে।
সামনের নড়বড়ে সেতুটা দেখে অন্তরাত্মা কেপে উঠল আমার। দৈত্যের তাণ্ডবে বয়ে যাওয়া খরস্রোতা নদীটা পার হতে গেলে সেতুটা অতিক্রম ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই। ড্রাইভারের তাগাদায় নামতে হল প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে। দূর হতে যতটা দুর্বল মনে হয়েছিল, বাস্তবে ততটা দুর্বল মনে হলোনা। কোন দৈব ঘটনা ছাড়াই পারাপার পর্ব শেষ হল। টেনেটুনে শরীরটাকে কোন রকমে বাসে ঠেলে বসে পরলাম আগের সীটটায়। শুরু হল আমাদের যাত্রা।
চোখ বুজে মৃতের মত পরে রইলাম অনেকক্ষণ। রাজ্যের ঘুম এসে ভর করল শরীরের উপর। পেটের ক্ষুধাও জানান দিচ্ছে নিজের অস্তিত্ব। ভয়, বিস্ময় আর অনিশ্চয়তা গ্রাস করে নিলো ষষ্ঠইন্দ্রীয়। চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে অনেক আগেই। এবার শরীরের পালা। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি টের পাইনি। চোখ খুলে জানালার বাইরে তাকাতে যে দৃশ্য চোখে পরল তা দেখে দূর হয়ে গেল সব ক্লান্তি। শুধু মাঠ আর মাঠ। সবুজের বুক-চিড়ে চলে গেছে সূক্ষ্ম একটা ট্রেইল। একদিকে বরফ আচ্ছাদিত আন্দিজের চূড়া। নৈসর্গিক প্যানোরমার অন্যপাশেই অঘটনে ভরা পাকা হাইওয়ে। খোলা মাঠে এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছে ভেড়া এবং আলপাকার দল। মাঝে মধ্যে দু’একজন রাখাল অবাক হয়ে লক্ষ্য করছে আন্দিজের দুর্গম অঞ্চলে আমাদের অনিশ্চিত যাত্রা। নদীটাকে দেখা গেলনা কাছাকাছি কোথাও। খণ্ড খণ্ড জমিতে ভুট্টার চাষাবাদ দেখে আন্দাজ করা যায় খুব কাছ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে হয়ত। বন্য পশুর লাশ নিয়ে টানাটানি করছে শকুন, চিল আর কয়োটির দল। এমন দৃশ্য চোখে পরছে কিছুক্ষণ পর পর। দিগন্ত জুড়ে রাজত্ব করা সূর্যটাকে আগ্নেয়গিরি হতে বেরিয়ে আসা লাভার মত দেখালো। বাইরে কি আসলেই এত গরম? জানালাটা সামান্য খুলতেই আন্দিজের শো শো হাওয়া আর তীব্র শীত এসে ভরিয়ে দিল বাসের ভেতরটা। সামনের সীটে বসা অস্ট্রেলিয়ান স্বামী-স্ত্রী বিনীত অনুরোধ করল জানালাটা বন্ধ করতে। ভিক্টোরিয়ার কথা মনে হতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে থাকলে বিরামহীন ধারাবর্ণনায় মাতিয়ে রাখত বাসের নীরবতা। বিন্দু হতে বৃত্তের মত দিগন্তরেখায় ফুটে উঠলো সাদা ধবধবে বাসটার চেহারা। আমাদের যমজ বাস। ট্রেইলটাকে আড়াআড়িভাবে আটকে রেখে ঠায় দাড়িয়ে আছে মাঝ পথে। অভিজ্ঞ মন বলছে সামনে বিপদ!
আসলেই বিপদ… সামনের চাকা ফুটো হয়ে বাসটা প্রায় ছিটকে পরেছে ট্রেইল হতে। কাছাকাছি এসে নিথর হয়ে গেল আমাদেরটাও। যাত্রীরা নেমে গেল বিনা বাক্য ব্যয়ে। আমি বসে রইলাম অনাগত আশংকা নিয়ে। কিছুক্ষণ পর ট্যুর গাইড এসে জানালো চাইলে নীচে নামতে পারি। দুঃসংবাদ যে আসবে তা আমার আগেই জানা ছিল। চাকা বদলানো ঝগটা ভেঙ্গে গেছে ইতিমধ্যে! নেমে পরলাম ঘোর নেশাগ্রস্থের মত। নিজকেই দায়ী করলাম এমন গোলক ধাঁধায় আটকে যাওয়ার জন্যে। তবে ভাল সংবাদ বলতে যা বুঝায় তার একটা হল, রাস্তার ঠিক পাশেই ছোট একটা লোকালয় দেখা যাচ্ছে এবং হাত পাওয়ালা দু’একজন আদমকে দেখা যাচ্ছে ঘুরা ফেরা করতে। ইতিমধ্যে স্থানীয় একজন বাইসাইকেল নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেছে কোন এক রহস্যপুরী হতে নতুন একটা ঝগ আনবে বলে।
সময় বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সেই রাজপুত্রের আর দেখা নেই। ততক্ষণে ক্ষুধা বাবাজি পেটে ঢোল বাজাতে শুরু করে দিয়েছে। শক্ত কোন খাবার পেটে যায়নি অনেকক্ষণ। আমার হাতে মাত্র দু’টা আপেল। পানির শেষ খালি বোতলটা এখনো ডাস্টবিনে ফেলা হয়নি। চমৎকার একটা দৃশ্য দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল। দু’টা বাসের সব যাত্রীদের ষ্টকের খাবার এক জায়গায় করা হচ্ছে। দু’টা আপেল দিয়ে আমিও যোগ দিলাম অসময়ে গড়ে উঠা আন্তর্জাতিক সংহতিতে। আমি ছাড়া বাকি সবাইকে মনে হল আপদ-কালীন সময়ের প্রস্তুতি হয়েই যেন ভ্রমণে বের হয়েছে। সবাই পেট পূরে খেয়ে বেরিয়ে পরল পাশের লোকালয় দেখবে বলে। পরনের জ্যাকেটটা বিছিয়ে মাটিতে শুয়ে পরলাম একটু ঘুমবো বলে। ১৩ই অক্টোবর, ১৯৭২ সালে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটা মনে করার চেষ্টা করলাম। ৪৫ জন যাত্রী নিয়ে চিলি-গামী উরুগুয়ের একটা বিমান বিধ্বস্ত হয়েছিল আন্দিজের চূড়ায়। ১২ জন সাথে সাথে মারা যায়। বাকিরা মাইনাস ৩০ ডিগ্রী সেঃ তাপমাত্রার সাথে পাল্লা দিয়ে শুরু করে বাচার লড়াই। খাবার হিসাবে মৃত সহযাত্রীদের মাংস ভক্ষণ করতে বাধ্য হয় অনেকেই। এভাবে একটানা ৭২ দিন লড়াই করে শেষ পর্যন্ত ১৬ জন জীবন্ত ফিরে আসে মূল ভূখণ্ডে। পৃথিবী চমকে উঠে এমন একটা লোমহর্ষক জার্নির খবর পেয়ে। আমাদের ভাগ্য কি শেষ পর্যন্ত এমনটাই হতে যাচ্ছে? আবোল তাবোল ভাবনায় মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। প্রথমত আমরা আন্দিজের চূড়ায় নই, দ্বিতীয়ত পাশেই আছে লোকালয়, মূল রাস্তাটাও বেশী দূর নয়, তাছাড়া এটা ২০০৪ সাল, – এমন কতগুলি যুক্তি দাড় করিয়ে নিজেই নিজের কাছে প্রমাণ করলাম আমাদের ভাগ্য অতটা অনিশ্চিত নয়। বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে যোগ দিলাম বাকি যাত্রীদের কাফেলায়। এই প্রথম ক্যামেরাটা বের করলাম ছবি তুলব বলে।
শীতের দাপট মানুষগুলোর শরীর ঝলসে দিয়েছে বাদামী কাবাবের মত। প্রায় সবারই অনেকগুলো দাঁত নেই। নাক দিয়ে বেরুচ্ছে হরেক রকম তরল পদার্থ। দারিদ্র্যতার সাথে রুক্ষ্ন প্রকৃতি যোগ হলে মানুষের জীবন কতটা দুর্বিষহ হতে পারে আন্দিজের এ অঞ্চলটায় না এলে বোধহয় বুঝা যাবেনা। শত বছর বয়সী এক বৃদ্ধার বেশ কটা ছবি তুললাম। সেশন শেষ না হতেই হাত বাড়িয়ে দিল কিছু পয়সার জন্যে। সাথে কিছু স্থানীয় মুদ্রা ছিল, দশ বলিভিয়ানো দিয়ে বেরিয়ে আসলাম বৃদ্ধার আঙ্গিনা হতে। পানির কুয়া পাওয়া গেল একটা জায়গায়। সবার মত আমিও ভরে নিলাম আমার খালি বোতলটা। মনে হল উত্তর মেরুর বরফ গলিয়ে কেউ জমা করেছে কুয়াটায়, নিথর হিম শীতল পানি! সময়টা মন্দ কাটলোনা এমন অনিশ্চয়তার মাঝেও। এ ফাকে সহযাত্রী অনেকের সাথে নতুন করে পরিচয় হল। এক অপরের সাথে ছবি তুলল বিরল মুহূর্তগুলো ধরে রাখবে বলে।
বাতাসের শো শো আওয়াজ আর ধোয়াটে আবহাওয়ার ফাঁক গলে হলিউডের নায়কের মত বেরিয়ে এলো স্বপ্নের সেই রাজপুত্র। হাতে বিশাল একটা ঝগ। এ যেন শত বর্ষ অপেক্ষার পর এক পশলা বৃষ্টির আগমন। খুশীর ফোয়ারা বয়ে গেল যাত্রীদের মাঝে।
বেলা পরে আসছে। রওয়ানা হওয়ার উৎকণ্ঠা সবার চোখে মুখে। সূর্যাস্তের পর আন্দিজের এ এলাকাটা মোটেও নাকি নিরাপদ নয়। বন্য হায়েনা আর অপহরণকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয় অরক্ষিত মাঠ ঘাট । বলিভিয়া পৃথিবীর অন্যতম গরীব দেশ। দুর্নীতির হিংস্র থাবায় ক্ষতবিক্ষত এর রাজনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামো। সামরিক শাসনে দেশটির রয়েছে বিশ্ব রেকর্ড। এতগুলো বিদেশী পর্যটক এমন একটা অরক্ষিত এলাকায় আটকে থাকা মানে অপহরণকারীদের মুখে খাবার তুলে দেয়ার মত। ব্যাপারটা ভাল করেই জানা ছিল ট্যুর গাইডদের। চাকা বদল এবং ঠেলেঠুলে বাসটা রাস্তায় তুলতে প্রায় ঘণ্টা খানেক পেরিয়ে গেল। ড্রাইভার জানাল বেলা অনেক গড়িয়েছে, যে পথ ধরে যাচ্ছি সে পথটা সামনে মোটেও নিরাপদ নয়। ফিরে যেতে হবে আসল পথে। রাস্তার অবরোধের তীব্রতাও নাকি কমে এসেছে ইতিমধ্যে। সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত রওয়ানা হলাম আমরা। তবে এ যাত্রায় পিছনমূখী। আমার কেন জানি মনে হল এ কাহিনীর কোন শেষ নেই… সামনে পেছনে করে অনন্তকাল ধরে চলবে আমাদের যাত্রা! নিয়তির কাছে নিজকে সপে দিয়ে বোবার মত গিলতে শুরু করলাম আন্দিজের নৈসর্গিক স্তব্ধতা।
আবারও সেই বিভীষিকা! সেই লোমহর্ষক জায়গা!!! তবে গাড়ির সংখ্যা দেখে পরিস্থিতি সকালের মত ততটা জটিল মনে হলোনা। গাইড এসে জানাল ভয়ের কিছু নেই, কিছু লেনদেন করতে হবে শুধু। তৃতীয় বিশ্বের বিপ্লবী আন্দোলন! সবকিছুর শেষ মনে হয় একটা জায়গায়, পকেট! চোখের সামনে নতুন এক বাংলাদেশকে আবিষ্কার করলাম। বিছানো পাথরগুলো রাস্তা হতে সরিয়ে নেয়া হয়েছে ইতিমধ্যে। যদিও বাঁশ জাতীয় কিছু একটা দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে গোটা হাইওয়ে। হাতে লাঠি আর মাথায় লাল পটকার ’বিপ্লবী’রা সিংহের মত গর্জন করে বেড়াচ্ছে। ইশারা পেলে ঝাঁপিয়ে পরতে মিনিট খানেক সময় নেবে বলে মনে হলোনা। ডান হাতের ব্যাপারটা খুব দ্রুতই সম্পন্ন হয়ে গেল। গাইড জানাল দেসাগুয়াদে্রতে যাত্রী প্রতি ১০ ডলার উঠানো হয়েছিল এমন একটা আশংকার কারণে। এ মুহূর্তে কাউকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলোনা আমার। সবাইকে মনে হল একই চক্রের সদস্য, পর্যটকদের পকেট খসানোর সংঘবদ্ধ নীল নক্সা।
দৈত্য-দানব আর রাক্ষস-খোক্কসদের তাণ্ডব হতে মুক্তি পেলাম শেষ পর্যন্ত। সামনে নতুন কোন ঝামেলা নেই, এমনটা বলে ট্যুর গাইড আস্বস্ত করল আমাদের। সারাদিনের মধ্যে এই প্রথম বুক ভরে নিশ্বাস নিলাম! চোখ বুজে কল্পনা করলাম নিউ ইয়র্কের ছোট রুমটার কথা। আরও প্রায় ২ ঘণ্টার পথ। পেছনের ঝামেলা মাথা হতে নামিয়ে যাত্রীদের অনেকেই ব্যস্ত হয়ে পরল জানালার বাইরে রূপকথার আন্দিজের নিয়ে। আমি ভেজা মুরগীর মত ঝিমুতে শুরু করলাম। রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভিড় করল শরীরে। পাশের সীটটা খালি, দু’পা উঠিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পরলাম।
পাক্কা এক ঘণ্টা পর ঘুম ভাঙল। সূর্যটা নেতিয়ে পরেছে ততক্ষণে। চারদিকে শুনশান নীরবতা। আন্দিজের চূড়াগুলো ডুবে গেছে হাল্কা কুয়াশার কোলে। সূর্যের রক্তিম আভায় কুয়াশাগুলোকে আগ্নেয়গিরির রাক্ষুসে লাভার মত দেখাল। মাঝে মধ্যে দু’একটা বাড়ি ঘরের চিহ্ন দেখা গেল পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। যতই এগুচ্ছি বাড়তে থাকল জনবসতির ঘনত্ব। সামনের সহযাত্রী জানাল ’বিপ্লবীরা’ মাঝ পথে আরও একবার বাসটা থামিয়েছি। কি একটা কাগজ দেখাতে ছেড়ে দিয়েছে বিনা বাধায়। সহযাত্রীদের জানার কথা নয়, কিন্তু এই বাংলাদেশীর ভাল করেই জানা ছিল ঐ কাগজটার অর্থ এবং মূল্য। রাশিয়ায় পড়াশুনা শেষে ব্যবহারের জিনিষপত্র এবং একগাদা বই পাঠিয়ে ছিলাম জাহাজে করে। চট্টগ্রাম বন্দরের ঐতিহাসিক কালো অধ্যায় সমাপ্তি শেষে ট্রাকে করে ফিরছি ঢাকায়। বন্দর হতে বেরুতে না বেরুতে পুলিশ বাহিনী আটকে দিল আমাদের যাত্রা। ড্রাইভার জানাল টাকা দিতে হবে। গাই গুই করে কাজ হলোনা, পরিশোধ করতে হল পুলিশের ’পাওনা’। সব শেষ হতে একটা ক্লিয়ারেনস্ সার্টিফিকেট ধরিয়ে দিল ড্রাইভারের হাতে। এটাই নাকি সেই যাদু-মন্ত্র যার বলে পার হওয়া যাবে সামনের সাত সমুদ্র তের নদী। ঘটনাটা মনে হতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। উত্তর আর দক্ষিণ আমেরিকা, কাছের প্রতিবেশী দুই মহাদেশ, অথচ একেবারে উলটো তাদের জীবন যাত্রার মান!
ট্রাফিকের সংখ্যা দেখেই ধারণা করা যায়, আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি। পাহাড়ের বিপদজনক শেষ বাকটা পার হতেই চোখে পরল শহরটা, লা পাস। পাহাড়ি উপত্যকার খাদ ঘেঁষে থরে থরে সাজানো বাড়ি ঘর আর উঁচু দালান নিয়ে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে শহরটা। প্রায় ৮ লাখ লোকের বাস সমুদ্র পৃষ্ট হতে ৩৬৬০ মিটার উচ্চতার এই শহরে। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতম শহরের ভিত্তি স্থাপন করেছিল স্প্যানিশ দখলদাররা। সময়টা ছিল ১৫৪৮ সাল। এর আগে ইনকাদের কাছে এলাকার পরিচিতি ছিল চকেয়াপো হিসাবে। গ্রামটার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া চকেয়াপো নদীতেই প্রথম সোনা খুঁজে পায় উপনিবেশবাদীরা। ১৮৯৮ সালে লা পাস’কে বলিভিয়ার এডমিনিষ্ট্রেটিভ রাজধানী হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৪ সাল হতে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত মার্কিনীদের সহায়তায় একটা পর একটা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটতে থাকে দেশটায়। সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের উচ্চাভিলাষ ব্যাহত করে বলিভিয়ার গণতান্ত্রিক যাত্রা। সোনা, তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পদের মালিক হয়েও দেশটার সাধারণ মানুষ কখনোই দারিদ্র সীমা হতে বেরিয়ে আসতে পারেনি।
সূর্যটা ডুবু ডুবু করছে প্রায়। সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দেয়ার মত কণ্টকাকীর্ণ বিশাল এক পথ পাড়ি দিয়ে শহরের প্রবেশ মুখে ঢুকতেই পরিচিত দৃশ্যটা দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। খোলা আকাশের নীচে আবর্জনা ফেলার বিশাল আয়োজন। সব বয়সের শিশু, নারী এবং পুরুষের দল পিঠে ঝোলা চাপিয়ে হুমড়ি খেয়ে হাতড়াচ্ছে আবর্জনার স্তূপ। উচ্ছিষ্ট নিয়ে শকুন, কুকুর আর মানুষের কামড়া কামড়িতে বিষাক্ত হয়ে উঠছে চারদিকের পরিবেশ। দারিদ্রের এমন কুৎসিত চেহারা দেখা হয়নি অনেকদিন। এক সময় ঢাকার প্রবেশ মুখ যাত্রাবাড়ীতে দেখা যেত দারিদ্রের একই রূঢ় ছবি। পশ্চিম দুনিয়ার পর্যটকের দল হুমড়ি খেয়ে পরল ছবি তোলার জন্যে। আমি দু’চোখ বন্ধ করে ফিরে গেলাম জন্মভূমিতে। বোমা বিস্ফোরণের মত ভয়াবহ শব্দে কেপে উঠল আমাদের বাসটা। অনেকের হাত হতে ছিটকে পরল ক্যামেরা। কিছু বুঝার আগেই ড্রাইভার জানাল পেছনের চাকা পাংচার। চাকা বদলানোর কোন আয়োজন নেই বাসটায়, অথচ মূল শহর এখনো মাইল খানেকের পথ। ’এবার তোমাদের নামতে হবে এবং নিজ খরচে স্থানীয় যানবাহন ধরে পৌছতে হবে শহরের কেন্দ্রবিন্দু সানফ্রানসিসকো প্লাজায়’, ট্যুর গাইড মৃত্যু ঘোষণার মত সংবাদটা প্রকাশ করে হারিয়ে গেল জনারণ্যে।