বলিভিয়া

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৩

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – পর্ব ১
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – পর্ব ২

অনিশ্চয়তার বেড়াজালে আটকে গেল ঘুমের পৃথিবী। এপাশ ওপাশ করেই কাটিয়ে দিলাম বাকি রাতটা। শেষ রাতের দিকে তন্দ্রা মত আসতেই ঘড় ঘড় শব্দে বেজে উঠল এলার্ম ঘড়িটা। মিনিট খানেকের ভেতর রিসিপশন ডেস্ক হতে কেউ একজন ওয়েক-আপ কল দিয়ে জানিয়ে দিল এবার উঠতে হবে। রাজ্যের আলসেমি এসে ভর করলো শরীরের উপর। সাথে মাথাটাও ঘুরছে পাগলা ষাঁড়ের মত। উঠে পরলাম অনিচ্ছা সত্ত্বেও। বাথটাবে গরম পানি ছেড়ে শরীরটাকে ডুবিয়ে রাখলাম অনেকক্ষণ। এত সকালে হোটেল ক্যান্টিন খোলা থাকবে কিনা সন্দেহ হল। ব্রেকফাস্ট নিয়ে বেশ একটু চিন্তায় পরে গেলাম।

রুমের বিশাল পর্দাটা সড়াতেই আন্দিজের চূড়ায় ঘুমন্ত সূর্যটার দেখা মিলল। ঘন কুয়াশা এবং খণ্ড খণ্ড মেঘের কোল ঘেঁষে শুয়ে থাকা লাল আভাটা উঠি উঠি করছে কেবল। হঠাৎ মনে হল সূর্যোদয়ের এমন একটা মায়াবী দৃশ্য দেখেই বোধহয় বাকি দিনটা কাটিয়ে দেয়া যাবে, দরকার কি বলিভিয়া যাওয়ার! আবারও ফোন পেলাম রিসিপশন হতে, ক্যান্টিন খোলা হয়েছে, চাইলে নাস্তা করতে পারি। এলোমেলো চিন্তা সরিয়ে বাস্তবে ফিরে এলাম। নাস্তা মিস করা যাবেনা। শুকনো দু’টুকরো রুটি, সাথে মাখন আর গরম এক কাপ কফি, এই ছিল হোটেলের ফ্রি ব্রেকফাস্ট। নাস্তা সেরে রুমে ফিরে আসতেই বেশ তরতাজা মনে হল নিজকে। রাতেই লাগেজ গুছিয়ে রেখেছি, তাই এ নিয়ে মাথা ঘামাতে হলোনা। সূর্য উঠার পর্বটা মিস করতে চাইলাম না এ যাত্রায়। সাথে একটা দূরবীন ছিল, ওটা নিয়ে দাড়িয়ে গেলাম জানালার পাশে। সবকিছু কেমন যেন গোলমেলে মনে হল; কুয়াশা সাথে লড়ছে সূর্যটা, মাঝে মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে খণ্ড খণ্ড কালো মেঘ। পাহাড়ের কোলে চাইলেই দেখা যাচ্ছে সেই সব মেঘদের ছায়া। কোটি কোটি সূর্য রশ্মি বাধ ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে চাইছে মেঘ রাজ্যের মায়াবী বন্ধন হতে। ফাকে ফাকে উকি দিচ্ছে লাভার মত জ্বলন্ত সূর্যটা। বেশীক্ষণ স্থায়ী হলোনা এ অসম লড়াই। সূর্যের তীব্রতার কাছে ভেসে গেল মেঘমালার হাল্কা প্রতিরোধ। পাহাড়ের চূড়াগুলো বেরিয়ে এলো কুয়াশার বুক চিড়ে। ধীরে ধীরে সকাল হয়ে গেল আন্দিজের এ অংশটায়। রাতের পুনোকে চেনা গেলনা দিনের আলোতে।

যতই বেলা বাড়ছে সাথে বাড়ছে আমার টেনশন। দোভাষীনির দেখা নেই। কথা ছিল ৮টার ভেতর বাস ষ্টেশন থাকব আমি। ঠিক ৮টা ১০’এ হাঁপাতে হাঁপাতে হাজির হলেন জনাবা। কথা না বলে শুধু ইশারা দিল, দৌড়াও। পরি মরি করে ছুটলাম। অনেকটা হিন্দি সিনেমার থ্রিলিং সিকোয়েন্সের মত মনে হল দু’জনের এ দৌড়। লাগেজ নিয়ে দৌড়ানো খুব একটা সহজ মনে হলনা। বিশেষ করে সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে এত উঁচুতে দৌড়াতে গেলে শ্বাস ছোট হয়ে আসে। নাক মুখ হতে রক্ত বেরিয়ে আসে বিনা নোটিশে। কুলিয়ে উঠলাম না, তাই দৌড়ে হার মানতে হল দোভাষিনীর কাছে। বাসটা প্রায় ছেড়ে যাচ্ছে… অন্তিম মুহূর্তে পড়িমরি করে কোনরকমে উঠে পরলাম। ততক্ষণে মুখ বেয়ে লালা পরতে শুরু করেছে, চাইলেও জ্বিহবাকে সঠিক জায়গায় ধরে রাখা যাচ্ছিলোনা। হঠাৎ করে মারত্মক পিপাসা পেল। কিন্তু তৃষ্ণা মেটাবার কোন কিছু সাথে আনা হয়নি, তাই নিজকে সান্ত্বনা দিলাম অবুঝ শিশুর মত। যেমনটা চেয়েছিলাম জানালার পাশেই আমার সীট। একটু গুছিয়ে বসতেই চোখ গেল পাশের সহযাত্রীর দিকে। অত্যন্ত ধারালো এক সুন্দরী। বাঁশের মত লিকলিকে শরীর, টাইট জিনস এবং কোমরের অনেক উঁচু পর্যন্ত একটা হাল্কা টি-শার্ট। মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম আমার ট্যুর গাইডকে।

আমার অবস্থা যাচাই করে হাই হ্যালো বলার আগেই ঠাণ্ডা এক বোতল কোমল পানীয় এগিয়ে দিল। লৌকিকতা করার মত অবস্থা ছিলনা, তাই কোন মতে হাল্কা একটা ধন্যবাদ জানিয়ে ঘট ঘট করে গিলতে শুরু করে দিলাম পানীয়। ‘তুমি আন্দিজের এ দিকটায় কি এই প্রথম?’, চোস্ত মার্কিন উচ্চারণের ইংরেজিতে জানতে চাইল তরুণী। ‘হ্যাঁ, এই প্রথম, কিন্তু তুমি জানলে কেমন করে? জিজ্ঞেস করলাম আমি। উত্তরে যা বলল তা শুনে মাথা আমার চড়কগাছ। এ অঞ্চলে ভ্রমণ করতে গেলে সাথে থাকা চাই যথেষ্ট শুকনো খাবার এবং পানীয়। অথচ আমার সাথে আছে কেবল ৪টা আপেল, তাও আবার কুসকো হতে কেনা। ’আমার নাম ভিক্টোরিয়া’, হাত বাড়িয়ে নিজের পরিচয় নিশ্চিত করল এই রহস্যময়ী। পেশায় একজন আইনজীবী, লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের বেটেন-রুজ শহরে বাস। অবাক হয়ে গেলাম একজন আইনজীবীর এ ধরনের পোশাক দেখে। সেও বুঝতে পারল বোধহয় আমার কনফিউশন। বত্রিশ দাঁত বের করে উত্তর দিল, ‘আমি ছ’মাস আইন প্র্যাকটিস করি আর ছ’মাস ঘুরে বেড়াই মুক্ত বিহঙ্গের মত’, বেশ ঘটা করে নিজকে প্রকাশ করল আমার সহযাত্রী। নড়েচড়ে বসলাম আমি। জার্নিটা মনে হল বেশ লোভনীয় হতে যাচ্ছে।

প্রাথমিক ধাক্কা সামলে ঠিকঠাক হয়ে বসতেই ড্রাইভার জানাল দুঃসংবাদটা, আমরা কোপাকাবানা হয়ে লা পাস যাচ্ছিনা। ও পথ নাকি ধর্মঘটকারীদের দখলে চলে গেছে। রক্তারক্তির খবরও নাকি বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। অজানা আশংকায় মনটা অস্থির হয়ে উঠল। এমন একটা ঘোলাটে পরিবেশে বলিভিয়া যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে কিনা বুঝতে পারলাম না! কোপাকাবানা নামটার সাথে অনেক দিনের পরিচয়। বেশ ক’টা বিখ্যাত স্থাপনা আছে দেখার মত। ১৬০০ শতাব্দীর স্প্যানিশদের তৈরি Basilica of Our Lady of Copacabana পর্যটকদের কাছে খুবই পরিচিত নাম। গির্জাটা দেখতে মৌমাছির মত ভিড় জমায় পৃথিবীর এ কোনায়। তা ছাড়া লেক টিটিকাকার তীরে এটাই বলিভিয়ার মূল শহর। শহরটার সৌন্দর্য নিয়ে ভ্রমণ দুনিয়ায় অনেক উপকথা চালু আছে। লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দূর করলাম কোপাকাবানা না দেখার দুঃখ। খুব একটা লম্বা হলোনা জার্নিটা। ৩০ মিনিটের ভেতর পেরু-বলিভিয়ার সীমান্ত শহর দেসাগুয়াদে্‌র পৌঁছে গেলাম। নড়বড়ে একটা কাঠের সেতুর সামনে এসে বাসটা থেমে গেল। এখানেই পেরুর শেষ। সেতুর ওপারে বলিভিয়া। অন্য একটা বাস ধরতে হবে সীমান্তের ওপার হতে। বলিভিয়ান বাস।

’তুমি কি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক’, প্রশ্ন করল আমার সহযাত্রী ভিক্টোরিয়া।

’না, আমি অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্টে ভ্রমণ করছি, অবশ্য নিউ ইয়র্ক ফিরে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বের শপথ নিতে যাচ্ছি’ উত্তর দিয়ে কারণ জানতে চাইলাম এমন প্রশ্নের।

ভিক্টোরিয়া জানাল, পৃথিবীর এ অঞ্চলে মার্কিন পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণ খুব একটা নিরাপদ নয়। বলিভিয়ান আন্দিজের অনেক বিপদজনক বাঁক আছে, যেখানে ওৎ পেতে থাকে অপহরণকারীর দল। অপহরণ ব্যবসায় মার্কিন নাগরিকদের চাহিদা নাকি সবার শীর্ষে। আমার জ্যাকেটে যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা সম্বলিত একটা পিন দেখে ভিক্টোরিয়া অনুরোধ করল খুলে ফেলার জন্যে। এসব শুনে একেবারেই হতাশ হয়ে পরলাম। এলাম নতুন কিছু দেখব বলে অথচ পদে পদে দেখছি ভয়ঙ্কর সব বাধা। হা হা করে হেসে উঠল মেয়েটা/ বোধহয় বুঝতে পেরেছে আমার মনের অবস্থা।

’ভয় পেওনা, এ গুলোই কিন্তু আন্দিজ দেখার আনন্দ, তাছাড়া তোমার চেহারা অনেকটাই বলিভিয়ানদের মত, বিপদ আসলে মিশে যেও ওদের ভিড়ে’, বলতে গিয়ে হাসিতে ফেটে পরল।

এমন বিপদজনক সুন্দরী যদি ৬ মাস আন্দিজের বাঁকে বিচরণের পরও জীবিত থাকে, তা হলে আমার কেন বিপদ হবে, এমন একটা সমীকরণের ফলাফল বের করে নিজেই নিজকে আস্বস্ত করলাম।

বাস হতে বেরুতেই আন্দিজের ঠাণ্ডা বাতাস শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল। ইতিমধ্যে জেগে উঠেছে সীমান্ত এলাকার জনপদ। চারদিক গিজগিজ করছে মানুষের ভিড়ে। ভ্যান গাড়ি, সাইকেল, অটো রিক্সা, বাস, ট্রাক, হরেক রকম যানবাহন আর পায়ে হেটে হাজার হাজার মানুষ অতিক্রম করছে দুই দেশের সীমান্ত। চারদিকে মনে হল ধূলিঝড় বইছে যেন। মাঝ খানে কয়েক শ ফুট নো ম্যানস্‌ ল্যান্ড। শ্রীহীন ছোট্ট একটা ছাপরা ঘরে ঢুকতে হল পাসপোর্টে পেরুর একজিট সিল নেয়ার জন্যে। অভিব্যক্তিহীন চাউনিতে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল ইমিগ্রেশন অফিসার। ধপাস শব্দে বসিয়ে দিল সীলটা। ’আডিওস‘, যান্ত্রিক পুতুলের মত উচ্চারন করল বিদায় বানী।

নো ম্যানস্‌ ল্যান্ডে দাড়াতেই শিরদাঁড়া বেয়ে অন্যরকম একটা অনুভূতি নেমে গেল। আমি এখন কোন দেশে? চোখের সামনে বলিভিয়া আগমনের শুভেচ্ছা। পিছন ফিরে তাকালেই দেখা যাচ্ছে পেরু ভ্রমণের ধন্যবাদ বানী। এই মুহূর্তে আমার কোন দেশ নেই! ভাবতেই মনে হল এ কয়েক শ ফুটের আমিই অলিখিত বাদশাহ্‌। এখানে নেই কোন ইমিগ্রেশন, নেই পুলিশের বাঁকা চাউনি। প্রফুল্ল মনে দূরত্বটুকু পার হলাম।

বলিভিয়া! অফিসিয়াল নাম প্লুরিন্যাশনাল ষ্ট্যেইট অব বলিভিয়া। কোন সমুদ্র বন্দর ছাড়াই মধ্য দক্ষিণ আমেরিকার একটি দেশ। দেশটার পূব এবং উত্তর দিকে ব্রাজিল, দক্ষিণে প্যরাগুয়ে এবং আর্জেন্টিনা, পশ্চিম দিকে চিলি এবং পেরু। ১৬ শতাব্দীতে স্প্যানিশরা দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশের মত এ দেশটিতেও নিজদের প্রভুত্ব কায়েম করে। ১৬ বছর এক নাগাড়ে যুদ্ধের পর ১৮০৯ সালে নিজদের স্বাধীন বলে ঘোষণা দেয় বলিভিয়ানরা। কবর রচিত হয় উপনিবেশবাদের। সাইমন বলিভারের নামে দেশটার নাম রাখা হয় বলিভিয়া। উপনিবেশবাদের বিদায় হলেও তাদের স্প্যানিশ ভাষাকে বিদায় জানাতে পারেনি এ দেশের মানুষ। যদিও শত বাধা বিপত্তি নিয়ে এখনো টিকে আছে এদের আঞ্চলিক ভাষা আয়মারা এবং কোয়েচুয়া। জনসংখ্যা মাত্র ৯০ লাখ।

কালো পোশাক এবং হাতে কালাশনিকভ রাইফেল নিয়ে অল্প ক’জন পুলিশ পাহারা দিচ্ছে সীমান্ত এলাকা। নিজদের মধ্যেই গল্পে নিয়ে ব্যস্ত ওরা, সীমান্ত পেরিয়ে কে এলো আর কে গেল তার দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। আমাদের দেশে টোল আদায়ের ঘরগুলোর মত ছোট্ট একটা বুথে ঢুকতে হল বলিভিয়ার ভিসা নিতে। ইমিগ্রেশনের সাথে একটা শব্দও বিনিময় হলোনা। ৩ মাসের ভিসা দিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হল দেশটায়। দাঁত বের করা হাসিতে গ্রাসিয়াস জানিয়ে পা রাখলাম আরও একটা নতুন দেশে, বলিভিয়া। কয়েক শ ফুট দূরেই দক্ষিণ আমেরিকার অন্য একটা দেশ পেরু, অথচ পার্থক্য চোখে পরার মত। চারদিকে অনিয়ম আর দৈণ্যতার রাজত্ব এখানে। ঠেলা রিক্সা, ভ্যান গাড়ি আর স্কুটারগুলো রাস্তা আটকে অপেক্ষা করছে যাত্রীর। একে অপরকে গালাগালি দিচ্ছে চড়া গলায়। আমাদের আরিচা ঘাটের মত ট্রাক আর বাসের কাফেলা দাড়িয়ে আছে সাড়িবদ্বভাবে। কিন্তু ড্রাইভারদের আশপাশ কোথাও দেখা গেলনা। আবারও অজানা আশংকায় মনটা কেপে উঠল। পুনো হতে ছেড়ে আসা বাস যাত্রীদের একটা জায়গায় জমা হতে দেখে ওদিকেই পা বাড়ালাম। সহযাত্রী ভিক্টোরিয়া আমাকে দেখে বত্রিশ দাঁত বের করে হাসল। তার পরনের কাপড় আরও বিপদজনক ভাবে কমে গেছে ইতিমধ্যে। অবাক হওয়ার মত কাণ্ড, এ সবের সময় পেল কখন মেয়েটা! অপেক্ষার যেন শেষ নেই। বাস আসার কোন লক্ষন দেখা গেলনা। চিন্তার রেখা ফুটে উঠল লা-পাসগামী যাত্রীদের কপালে। ঘন্টাখানেক পর ট্যুর কোম্পানির একজন এসে জানাল রাস্তায় প্রচণ্ড হাংগামা চলছে, এক সপ্তাহ হল এ লাইনে বাস চলাচল বন্ধ। বাধা পেরিয়ে দু’একটা বাস নাকি  চেষ্টা করেছিল লা-পাস পৌছার, কিন্তু হরতালকারীদের তাড়া খেয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে। সরকার এবং দেশের ট্রেড ইউনিয়নগুলোর মধ্যে বেশ কিছু ইস্যু নিয়ে টানাপোড়ন চলছে, তাই অনির্দিষ্ট কালের এই হরতাল। । পিন পতনের নীরবতা নেমে এলো যাত্রীদের মাঝে। আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল একটাই চিন্তা, আজ শনিবার এবং আমাকে সোমবার মধ্যরাতে লিমা হতে নিউ ইয়র্কের ফিরতি ফ্লাইট ধরতে হবে। ভিক্টোরিয়ার অট্ট হাসিতে চিন্তায় ছেদ পরল।

‘এতটা হতাশ হওয়ার কোন কারণ নেই, উপায় একটা নিশ্চয় বেরিয়ে আসবে’, ফুড় ফুড়ে মেজাজে বলল সে।

খুব কাছে এসে ফিস ফিস করে বলল, অতিরিক্ত কিছু পয়সা ঢালতে হবে আমাদের, তবেই নাকি হারামির বাচ্চারা নড়তে শুরু করবে।

মেয়েটার এমন আজব তথ্যে অবাক হলাম আমি, এ যে দেখছি বাংলাদেশের কার্বন কপি! ১০ ডলার করে চাঁদা উঠানো হল যাত্রীদের কাছ থেকে। সবাই বিদেশী, এ নিয়ে কেউ বেশী উচ্চবাচ্য করল না। মনে মনে ট্যুর কোম্পানির ১৪ গুষ্টি উদ্ধারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল যাত্রীদের ক্ষোভ। যাত্রী ড্রাইভারের মধ্যে গোপন শলা-পরামর্শ এবং লেনা-দেনা শেষ হওয়ার ১৫ মিনিটের মধ্যে ছোট আকারের দু’টা বাসকে দেখা গেল দিগন্ত রেখায়। একই কোম্পানির বাস। একেবারে যমজ ভাইয়ের মত। কিছু খাবার আর পানের জন্য দু বোতল পানি কিনে উঠে পরলাম একটা বাসে। ভিক্টোরিয়া আগেই উঠে গেছে এবং জানালার পাশের একটা সীট দখল নিয়ে অপেক্ষা করছে আমার। ধন্যবাদ জানিয়ে বসে পরলাম।

‘তোমাকে জানাইনি আতংকিত হবে বলে, রাস্তার অবস্থা কিন্তু আসলেই খারাপ, সব কিছুর জন্যে তৈরি থেক।’, বাসটা ছাড়তেই দুঃসংবাদটা দিল ভিক্টোরিয়া।

উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তার অবসান ঘটিয়ে ১৮ জন যাত্রী নিয়ে বাসটা নড়তে শুরু করল শেষ পর্যন্ত। স্বস্তির পাশাপাশি এক ধরনের নীরবতা গ্রাস করে নিলো বাসের পরিবেশ। কারও মুখে কোন কথা নেই। সবাই ক্লান্ত এবং সামনে কি অপেক্ষা করছে এ নিয়ে চিন্তিত। প্রায় ৫ ঘণ্টার জার্নি। কথা-ছিল সকাল ৮টায় পুনো হতে রওয়ানা হয়ে দুপুরের খাবার খাব লা-পাস’এ। হাত ঘড়িটার দিকে তাকালাম, সকাল ১১টা। সবকিছু ঠিক ঠাক চললে বিকাল ৪টার ভেতর লা-পাস পৌছার কথা। মনে মনে হিসাব কষলাম, একটু দেরী হলেও গন্তব্যে পৌঁছেই লাঞ্চ করব। সাথে ক’টা আপেল, কলা এবং দু’বোতল পানি আছে, চলে যাবে আপাতত। বাসে হিটার চালু আছে, পরনের গরম কাপড় খুলে হল্কা হয়ে বসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দৃষ্টি হতে মিলিয়ে গেল সীমান্ত শহরটা। যানবাহন আর মানুষের এলোমেলো চলাফেরা বদলে দিল আন্দিজের সুশৃঙ্খল চূড়াগুলো। পাহাড় আর পাহাড়! কোল ঘেঁষে বয়ে যাচ্ছে খরস্রোতা নদী। মাঝে মধ্যে ভূতের মত উদয় হচ্ছে দু’একজন আন্ডিয়ান তরুণ-তরুণী, হাতে চাষাবাদের যন্ত্রপাতি। কৃষিকাজ হচ্ছে হয়ত কোথাও। কিন্তু যতদূর চোখ যায় লোকালয়ের কোন চিহ্ন দেখা গেলনা।

আকাশটাকে আজ একটু বেশী রকম নীল মন হল। ভার্টিকেল এঙ্গেলে চোখ ঘুরালে শূন্যে উড়ে যাওয়া চিলগুলোকে মনে হবে স্থির হয়ে উড়ছে। দু’একটা চিল মাঝে মধ্যে গোত্তা মেরে নীচে নামছে শিকারের ধান্ধায়। রাস্তার সমান্তরালে বয়ে যাওয়া নদীটার দু’পাশে হঠাৎ করে আবাদি জমির উদয় হল। আলু, পেয়াজ আর ভুট্টার খণ্ড খণ্ড জমি। গাছের খোল ব্যবহার করে নদী হতে পানি উঠানোর ব্যবস্থা মনে করিয়ে দেয় জীবন এখানে বয়ে যাওয়া নদীর মত অত সহজ নয়। প্রতি খণ্ড চাষাবাদের পেছনে নিশ্চয় লুকিয়ে আছে পাহাড়ি মানুষের খেটে খাওয়া জীবনের দীর্ঘশ্বাস। নেশা ধরে আসে প্রকৃতির এই অন্তহীন ক্যানভাস একাধারে গিলতে গেলে। বাসের একটানা যান্ত্রিক শব্দে তন্দ্রা-মত এসে গেল। সকালে ঘটে যাওয়া উটকো ঝামেলাগুলো এই ফাকে মাথা হতে নেমে গেল। পাশে বসা বিপদজনক সুন্দরীকেও আন্দিজের বিশালতার কাছে খুব ছোট মনে হল। গাঁটের পয়সা খরচ করে এতদূর এসেছি আন্দিজের সানিন্ধ্য পেতে, স্থানীয় মানুষ এবং তাদের জীবনের সাথে পরিচিত হতে। সে দিকে মনোনিবেশ করে ভুলে গেলাম উটকো এক সুন্দরীর উপস্থিতি।

আন্দিজ! শব্দটার ভেতর লুকিয়ে আছে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা, অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার স্বপ্নিল হাতছানি। পাহাড় পর্বত ঘুরে বেড়ানো যাদের নেশা তাদের ধমনীতে এই নামটা এক ধরনের কম্পন তৈরি করে। যার উৎপত্তি প্রকৃতির প্রতি অকৃপণ ভালবাসা হতে। এন্ডিসের উপর একাধিক বই পড়েছি, ডকুমেন্টারি দেখেছি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করেছি এর কাব্যিক কল্পনায়। কিন্তু চোখে দেখার কাছে এগুলো এ মুহূর্তে অর্থহীন মনে হল। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে যাওয়া রাস্তাটার বর্ণনাও মনে হল বই, আর্টিকেল অথবা ডকুমেন্টারিতে জীবন্ত করতে পারেনি। বাইরের স্তব্ধতাকে মনে হল অতি যত্নের সাথে কেউ লালন করছে হাজার বছর ধরে। পাহাড়ের চূড়াগুলোকে মনে হবে নীরব সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে কোটি বছর উপর। কোন একটা চূড়ায় উঠে চীৎকার দিলে হয়ত শত শত প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসবে সে চীৎকার। ভাঙবে সহস্রাব্দীর ভৌতিক নীরবতা। আমাদের বাসটা উঁচু নিচু এবং আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে ছুটে চলল প্রচণ্ড গতিতে।

’তুমি কি একটা জিনিষ লক্ষ্য করেছ?’ ভিক্টোরিয়ার প্রশ্নে ছুটে গেল তন্দ্রা। নতুন কোন সমস্যার প্রসঙ্গ টানতে যাচ্ছে সে। গন্ধ পেলাম গলার সতর্ক সূরে। ’পাহাড় ছাড়া এ মুহূর্তে অন্যকিছু লক্ষ্য করছিনা আমি’, অনেকটা তিরিক্ষে মেজাজে উত্তর দিলাম। উত্তরে সে যা বলল তা সত্যি ভাবিয়ে তুলল। দু’লেনের রাস্তা, অথচ যানবাহন চলছে শুধু এক লেনে। অর্থাৎ বিপরীত দিক হতে কোন গাড়ি আসছে না। ভিক্টোরিয়ার ইংগিতটা বুঝতে অসুবিধা হলোনা। বাংলাদেশের মানুষ আমি, কিছুদিন আগে হাসিনার লাগাতার পর্ব ’উপভোগ’ করে এসেছি মাত্র। পূর্বাভিজ্ঞতা হতে বলতে পারি, সামনে সমস্যা। আকাশের পাখীগুলোকেও দেখলাম শুধু একদিকে উড়ে যাচ্ছে। ভিক্টোরিয়ার অভিজ্ঞতা বলছে, খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে। অন্য যাত্রীদেরও দেখলাম নড়েচড়ে বসতে, কৌতূহলী হয়ে উঠছে সবাই। দূর হয়ে যাওয়া উৎকণ্ঠা গুলো বিদ্যুৎ গতিতে ফিরে এলো নতুন করে।

ছোট দু’একটা পাথর দিয়ে শুরু। কিছুদূর যেতেই বাড়তে থাকল পাথরের সংখ্যা এবং এর আকৃতি। নিবিড়ভাবে বিছানো আছে সমস্ত পথজুড়ে। যেন বিশাল আয়তনের শিলাবৃষ্টি হয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। কিন্তু তাতে বাসের চাকা বিশেষ কোন বাধা পেলোনা। এগুতে থাকলাম আমরা। বিশাল একটা বাক পেরুতেই দৃশ্যটা ভেসে উঠল দিগন্ত রেখায়… শত শত গাড়ি। যতদূর চোখ যায় শুধু গাড়ি আর গাড়ি। থেমে আছে লাইন ধরে। মাইলের পর মাইল। ছোটখাটো পাথর নয়, বিশাল আকারের বোল্‌ডার দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে পথ। এক কদম এগোবার কোন উপায় নেই। আমাদের যমজ বাসটা  ঠিক পেছনে এসে হুমড়ি খেয়ে থেমে গেল। সোজা কথায় আটকে গেছি আমরা। আন্দিজের এই গহীন রাজ্যে জিম্মি হয়ে গেছি গরীব দেশের গরীবিপনার কাছে। আকাশ ভেঙ্গে পড়ল সবার মাথায়। আবারও আমার মাথা জুড়ে পুরানো চিন্তাটা ঘুরপাক খেতে শুরু করল, আজ শনিবার এবং সোমবার মধ্যরাতে লীমা হতে নিউ ইয়র্কের ফিরতি ফ্লাইট ধরতে হবে। ভিক্টোরিয়াকে দেখে মনে হল বেশ উপভোগ করছে সে নতুন বাস্তবতা। ‘আমি জানতাম এমনটা হবে, এ জন্যেই এদিকে আসা’, উৎফুল্ল হয়ে জানাল সে। কথা বলে জানা গেল ওকালতির পাশাপাশি দক্ষিণ আমেরিকার রাজনীতি নিয়ে বই লিখছে সে। এ অঞ্চলে ভেনিজুয়েলান নেতা হুগো সাভেজের প্রভাব তার আগ্রহ। বলিভিয়ায় এবো মরালেস নামের নতুন এক নেতার উত্থান হয়েছে, যে আদর্শ হিসাবে বেছে নিয়েছে হুগো সাভেজের কথিত সমাজতান্ত্রিক পথ। তার উত্থানকে কাছ হতে দেখার জন্যেই এই জার্নি। উদ্ভট পোশাক দেখে মেয়েটা সম্পর্কে আজেবাজে ধারণা করায় নিজকে অপরাধী মনে হল এ মুহূর্তে। ’চল সামনে গিয়ে দেখে আসি’, আহ্বান জানাল মেয়েটা। বাসের ট্যুর গাইড ইতিমধ্যে সাবধান করে দিয়েছে এ ধরনের এডভেঞ্চার হতে দূরে থাকতে।

’চল, ঘুরে আসি’, সায় দিয়ে নেমে পরলাম। সাথে যোগ দিল আরও গোটা তিনেক সহযাত্রী। চারদিক চোখ বুলাতেই কেন জানি ঢাকার কথা মনে হয়ে গেল। রাজনীতির গ্যারাকলে আটকে একদিন ৫ ঘণ্টা দাড়িয়ে থাকতে হয়েছিল কাঁচপুর ব্রিজের উপর। সামনে শেখ হাসিনার সমর্থনে মিছিল, কিছুক্ষণ পর শুরু হল ধাওয়া আর পালটা ধাওয়া, সাথে নির্বিচার ভাংচুর। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো অজান্তেই। আন্দিজের শো শো বাতাস আর চোখে মুখে শীতের কনকনে ঝাঁপটা ফিরিয়ে আনল কঠিন বাস্তবতায়। হঠাৎ করে কেন জানি গান গাইতে ইচ্ছা করল আমার, প্রিয় সেই গানটা; ’নাই টেলিফোন নাইরে পিওন নাইরে টেলিগ্রাম…। ভিক্টোরিয়া ফিস ফিস করে বলল, ‘মন খারাপ করে লাভ নেই, বরং উপভোগ কর যা দেখছ, এমন অভিজ্ঞতার সুযোগ জীবনে দ্বিতীয়টা নাও আসতে পারে‘।

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৪
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৫

Published by

greenbelt

We started organizing travel events to contribute in the expansion of education in Hill tracks. Later on Green Belt becomes a Brand in this arena. And becomes a tour planner company. Now a days, Green Belt regularly organizes tour both inbound & outbound. Ph-01869649817

Exit mobile version