আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ১

কুস্কো এয়ারপোর্টে নামতেই আমার নামের সাইন নিয়ে মধ্য বয়সী এক মহিলাকে এদিক ওদিক তাকাতে দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। হাত তুলে ইশারা করতে এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দিল, দোভাষী এবং ট্যুর গাইড। লিমার ট্রাভেল এজেন্টকে আগা-গোঁড়া বিশ্বাস করতে পারিনি বলে নিজকে ধিক্কার দিলাম, ট্যুরের পুরু টাকাটা আগাম তুলে দিতেও কেন জানি মন সায় দিচ্ছিলনা। তবু দিতে হল কারণ এ ছাড়া দ্বিতীয় কোন পছন্দ আমার সামনে খোলা ছিলনা। পৃথিবীর এ প্রান্তের মানুষগুলোর সাথে নিউ ইয়র্কে পরিচয় থাকলেও স্বদেশে তাদের পরিচয় কতটা বান্ধবসূলভ হবে তার কোন ধারণা ছিলনা। সবকিছু কথামত কাজ করায় বিদেশ বিভূঁইয়ে সাহসটা বোধহয় একটু বেড়েই গেল। দক্ষিণ আমেরিকার পেরু নামের দেশটার মানুষগুলোর আচরণে প্রথম হতেই বেশ মুগ্ধ হতে বাধ্য হলাম।

১৯৯০ মডেলের নড়বড়ে টয়োটা সিডানে নড়ে-চড়ে বসতেই অবাক হয়ে খেয়াল করলাম এ যে দেখছি পুরোপুরি গ্রীষ্মকাল! অথচ ঘণ্টা দুয়েক আগে ফেলে আসা রাজধানী লিমায় তখন ছিল কনকনে শীত। ভাঙা ইংরেজিতে পরিচয় পর্ব সেরে প্রথমেই জানতে চাইলাম আমার ট্যুর আইটেনের‌্যারী। যেহেতু সপ্তাহান্তে আমাকে নিউ ইয়র্কের রিটার্ন ফ্লাইট ধরতে হবে তাই আশ্বস্ত হতে চাইলাম কোথাও কোন ত্রুটি নেই। আসলেই কোন ফাঁক ফোকর খুঁজে পেলামনা, ঠাণ্ডা হয়ে গাড়ির বাইরে চোখ ফেরাতেই মনটা হাল্কা হয়ে গেল। থরে থরে সাজানো আন্দিজের চূড়া, তার পদতলে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে ইন্‌কা সভ্যতার ঐতিহাসিক সাক্ষী কুস্‌কো নগরী, পেরুর দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ৩৫০০ মিটার উচ্চতায় উরুবাম্বা ভ্যালির পাদদেশ জুড়ে প্রাচীন সভ্যতা এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি দেখতে পৃথিবীর এ অঞ্চলটায় ভ্রমণকারীদের ভিড় লেগে থাকে বছর জুড়ে।

১০ মিনিটের ভেতর পৌঁছে গেলাম হোটেলে। ’হোটেল রয়্যাল ইন্‌কা-২’, অতিরিক্ত কোন জৌলুষ ছাড়াই হোটেলটার আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলাম। রুমের সুবিশাল কাচের জানালাটা খুলে দিতেই চোখের সামনে লুটিয়ে পরল পাহাড় আর মেঘ রাজ্যের মিলন মেলা, দিগন্ত রেখায় ঈগল পাখীদের উদ্দেশ্যহীন বিচরণ পরিবেশটায় এক ধরনের ভৌতিকতা এনে দিল। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম অনেকক্ষণ, আন্দিজের আগ্রাসী চূড়া আর সুবিশাল আকাশ ফুড়ে কেন জানি মেঘনা পাড়ের গ্রামের সেই ছোট্ট বাড়িটায় ফিরে যেতে মন চাইছিল। এ এক ধরনের নস্টালজিয়া বোধহয় সব বাংলাদেশীকেই কম বেশী তাড়িয়ে বেড়ায়। সূর্য মধ্য গগনে উঠার আগেই সাক্সাই ওয়্যামান (পেরুভিয়ানরা ঠাট্টা করে বলে থাকে সেক্সি ওম্যান!) নামের একটা ঐতিহাসিক ভ্যালি দেখতে চলে গেলাম ।

সন্ধ্যা নামতেই প্রচণ্ড শীতে গ্রাস করে নিল লোকালয়, আন্দিজের চূড়াগুলো ঢেকে গেল কুয়াশার চাদরে। শহরের আলো আধারী নিয়ন বাতিগুলোকেও গ্রাস করে নিল ঘন কাল কুয়াশা। দুপুরের ভ্যাপসা গরমের কুস্‌কো শহর রাত হতেই ভোজবাজির মত মিলিয়ে গেল প্রকৃতির কোলে। আমার শুধু অবাক হওয়ার পালা, কোনটা রেখে কোনটা দেখব! হোটেলের লোকজন জানাল শহরের প্রধান চত্বরে আজ রাতে ইন্‌কাদের বিশেষ অনুষ্ঠান হচ্ছে, বাহারি পোশাক এবং আঞ্চলিক গানের তালে তালে ইন্‌কাদের দেখতে চাইলে আজকের রাতটাই বিশেষ রাত। কিন্তু উপায় ছিলনা, আমাকে সকাল সকাল বিছানায় যেতে হবে। হোটেলে পা রাখতেই দেখা পেলাম সকালের ট্যুর গাইডের। এক কাপ বিদঘুটে রঙের চা বাড়িয়ে দিল, কোঁকা টি। হাই আলটিট্যুডে কোঁকা টি এক ধরনের এন্টডোট হিসাবে কাজ করে। চুমুক দিতেই বিস্বাদে তিতিয়ে গেল মুখ, কিন্তু ইসাবেলার (গাইড) হুশিয়ারিতে পুরো কাপটাই শেষ করতে হল।
ভোর ৭টায় উঠতে হবে তাই রাতের খাবার খেয়ে সকাল সকাল ঘুমিয়ে পরলাম। পরবর্তী ঠিকানা মাচা পিচু।

মধ্যরাতে প্রচণ্ড মাথা ব্যথায় ঘুম ভেঙে গেল, দম বন্ধ হয়ে আসছিল যেন। কি করবো বুঝতে পারছিলামনা। এ শরীর নিয়ে ভোরের ট্রেন জার্নিটা অসম্ভব বলেই মনে হল। এমন একটা পরিস্থিতি যে হতে পারে তা একেবারে অজানা ছিলনা। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে এত উঁচুতে শ্বাস নেয়া কষ্টকর আগেই জানতাম কিন্তু এতটা হবে ভাবতে পারিনি। কোকা টি’র রহস্যটা বুঝতে একটু বোধহয় দেরীই হয়ে গেল। খুবই হাই ডোজের দুটো ’এডভিল’ খেয়ে লাশ হয়ে পড়ে রইলাম দক্ষিণ আমেরিকার কোন এক অজানা-অচেনা হোটেলে।

ওয়্যক-আপ কলে ঘুম ভাঙতেই বেশ হাল্কা মনে হল নিজকে। মধ্যরাতের অভিজ্ঞতাটা দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই ভাবতে চাইলাম-না। এক কাপ চা ঝটপট চুমুক দিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে ধাবিত হলাম রেল ষ্টেশনের দিকে। ট্রেন মিস করা চলবেনা কিছুতেই। কাক-ডাকা ভোরের মায়াবী পরিবেশ ভেদ করে পেরু রেলের ঝকঝকে ট্রেনটাকে প্লাটফরমে দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল প্রশান্তিতে, মাচা পিচু দেখা হচ্ছে তাহলে এ যাত্রায়। মাচা পিচু – অথবা দ্যা লস্ট সিটি অব ইন্‌কাস। কুস্‌কো হতে ৭০ মাইল উত্তর-পূবে সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে প্রায় ২,৫ কিলোমিটার উচ্চতায় আশ্চর্য এক আর্কিওলজিক্যাল আবিষ্কার। স্প্যানিশ উপনিবেশবাদের ধ্বংস যজ্ঞ হতে রক্ষা পেতে ইন্‌কারা পাহাড়ের বিশাল উচ্চতায় এমন একটা নিশ্ছিদ্র আশ্রয় কি করে তৈরি করেছিল তা আবিষ্কারকদের জন্যে আজও এক বিশাল বিস্ময়। ১৯১১ সালে মার্কিন ইতিহাসবিদ হিরাম বিংগহাম ইনকাদের ট্রেইল খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কারের করেন পৃথিবীর অন্যতম এই আশ্চর্য সৃষ্টি। এর আর্কিওলজিক্যাল গুরুত্ব এবং স্থাপনার কারিগরি দিক নিয়ে এখনো চলছে আলোচনা, গবেষণা এবং বিতর্ক।

ঘন কুয়াশার বুক চিড়ে সকালের আলো ইতিউতি করছিল দিগন্ত রেখায়। ঘুম ভাঙছে পাহাড়ি মানুষের। উপত্যকার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা বাড়ি ঘরে মিট মিট করছে বিদ্যুৎ বাতি। ট্রেনটা অদ্ভুত কায়দায় পাহাড়ের উচ্চতা অতিক্রম করছে, একবার সামনে আবার পিছনে, হেলে দুলে এগিয়ে চলছে সাপের মত। একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় উঠে স্বাভাবিক যাত্রা শুরু হল। আন্দিজ পর্বতমালার বুক চিড়ে এগিয়ে চলল আমাদের ট্রেন।

খুব ছোট হতেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে অনেক প্রশ্ন করেছি, সৌরজগতের সৃষ্টি নিয়ে বহু তত্ত্বে হাবু ডুবু খেয়েছি। ঠিক ঐ মুহূর্তে কেন জানি কোন কিছুতে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিল। প্রকৃতির এ মোহনীয় সৌন্দর্য আপনা হতে সৃষ্টি হতে পারে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল। ট্রেনের পাশাপাশি কল কল করে বয়ে চলছে পাহাড়ি খরস্রোতা ওর‌্যোবাম্বা নদী। এবং সে নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট লোকালয়। অদ্ভুত কায়দায় সন্তানকে এক টুকরো কাপড়ে বেধে পিঠে করে পাহাড় বেয়ে যাচ্ছে মা, হাতে কুড়ানো লাকড়ি। সমস্ত মুখে কঠিন লড়াইয়ের ছাপ। নেশা ধরে যায় এসব দেখতে।

হোস্টেজ এসে সকালের নাস্তা অফার করলো। প্রকৃতির নৈসর্গিক মিলন মেলায় জাগতিক খাওয়া দাওয়া কেমন যেন বেখাপ্পা মনে হল, মনে হল কেউ যেন ঘুমাচ্ছে আর আমরা তার ঘুম ভাঙ্গাচ্ছি অনাকাঙ্ক্ষিত আগ্রাসনে। হা হয়ে থেমে গেল আমার খাওয়া, সাদা ধবধবে বরফে ঢাকা পাহাড়ের চূড়া হতে সূর্যের আলোর বিকিরণ হচ্ছে, মনে হচ্ছে আয়না দিয়ে কেউ বোকা বানাচ্ছে আমাদের। মাথার উপর আকাশ মাঝে মধ্যে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের আগ্রাসনে, সবুজের মেঘমালায় থরে থরে সাজানো বিভিন্ন চূড়া। হাল্কা ’এল কন্ডের পাসা’ গানের সূরটা ঐশ্বরিক এক আবহ সৃষ্টি করলো ট্রেনের কামরায়, ১০-১৫ জন যাত্রীর মুখের ভাষা কোন এক জাদু মন্ত্রে আটকে গেল। সারা জীবন রোমাঞ্চিত হয়েছি মেঘের বিশালতা নিয়ে, কিন্তু পাহাড়ের বিশালতার কাছে মেঘের এমন বাধাহীন সমর্পণ দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। রাশি রাশি মেঘ অসহায়ের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে পাহাড়ের গলা সমান উচ্চতায়।

কোন কারণ ছাড়াই থেমে গেল ট্রেনটা, বেশ কিছুক্ষণ আটকে রইলাম একটা জায়গায়। ভয় থাকলেও নেমে পড়লাম ট্রেন হতে। কুস্‌কো হোটেলের সবাই আমাকে সাবধান করে দিয়েছিল এ ধরনের এডভেঞ্চার হতে বিরত থাকার জন্যে। নিকট অতীতে মাওবাদী আবিমেইল গুজমান এবং তার সাইনিংপাথ গেরিলাদের চোরা হামলার এটাই না-কি ছিল মোক্ষম পথ। কে শোনে কার কথা, হুরমুর করে নেমে পড়লো সবাই। একদিকে পাহাড়ি নদীর কল কল শব্দ, অন্যদিকে বন্য পাখীদের কিচিরমিচির গান, আর চারদিকে ভৌতিক নিঃশব্দতায় আন্দিজ পর্বতের বিশালতা। এগুলো বর্ণনার ভাষা আমার মত কাঁচা লেখকদের কলম যথেষ্ট নয়। এসব দেখা যায়, অনুভব করা যায় কিন্তু ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। হাল্কা একটা হুইসিল দিয়ে আমাদের কামরায় ফিরে যাওয়ার নোটিশ দিল ট্রেন চালক। হোস্টেজ এসে জানালো সামনে ওইয়াটাইটামবো নামের বড় একটা ষ্টেশনে থামবে ট্রেনটা এবং এর জন্যে আমাদের খাড়া হয়ে অনেক নীচে নামতে হবে। রেললাইনে কাজ হচ্ছে, তাই এ অপ্রত্যাশিত বিরতি।

সীটে বসে সান্‌রুফ দিয়ে আকাশ দেখতে শুরু করলাম। মড়মড় শব্দে নড়ে উঠলো রেললাইনের কাঠগুলো, নীচে নামছি আমরা। কিছুদূর যেতেই চোখে পড়লো ষ্টেশনটা। বাহারি পোশাকে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে অপেক্ষা করছে এক গাদা এন্ডিয়ান তরুণী। নামতে হবে আমাকে, ভেতর থেকে তাগাদা অনুভব করলাম ছবি তোলার এটাই মহেন্দ্রক্ষণ।

ওইয়াটাইটাম্বো ষ্টেশনে ট্রেনটা থামতেই দু’দিক হতে ঝাঁপিয়ে পড়লো ফেরিওয়ালাদের কাফেলা। ৪/৫ বছরের ছোট বাচ্চা হতে ৮০ বছরের বৃদ্ধা। হাতে হরেক রকমের সওদা; কম্বল, স্কার্ফ, আলপাকা পশুর লোম দিয়ে তৈরি বাহারি শীতকালীন পোশাক। অনেকের পিঠে ঝোলানো ছোট ছোট বাচ্চা। কুস্‌কো হতে যারা বাসে করে মাচু পিচু যাচ্ছে তারা এ ষ্টেশনে ট্রেন ধরছে। চারদিকে হৈ হোল্লর, চেঁচামেচি। যে পাহাড়ি নদী এতক্ষণ ডান-বা করে সাপের মত আমাদের অনুসরণ করছিলো খুব কাছ হতে তাকে দেখলাম। ষ্টেশনটার বুক চিড়ে উন্মাদের মত নামে যাচ্ছে যেন। পানির এত রাক্ষুসে শক্তি থাকতে পারে পাহাড়ি নদীর তাণ্ডব না দেখলে ধারণা করা অসম্ভব। এলোমেলো হাটা হাটি করলাম কিছুক্ষণ প্লাটফরমের বাইরে, দু’টো চাবির রিং কিনলাম নিউ ইয়র্কের বন্ধুদের জন্যে। পাহাড় পাহাড় আর পাহাড়, এ যেন পাহাড়ের সমুদ্র। আন্দিজের এ অংশটার সাথে পেরুর অন্য এলাকার, ইকুইডোর এবং বলিভিয়ার আন্দিজের ব্যাপক তফাৎ; এখানে পাহাড়ের শরীর সবটা ঢেকে আছে সবুজের আচ্ছাদনে, আর বাকি আন্দিজ শুধুই তামাটে, গাছপালা বিহীন উলঙ্গ এক দৈত্য যেন। একটা জিনিষ দেখে চমকিত হলাম, প্রেসিডেন্ট প্রার্থী আলেহান্দ্রো তলেদোকে ভোট দেয়ার জন্যে দেয়ালে দেয়ালে চিকা। বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো, নির্বাচনে আমাদের বাড়ির দেয়ালটার করুন চেহারাটা চাইলেও ভুলা সম্ভব ছিলনা।

মিনিট বিশেক পরে হিস হিস করে এগিয়ে চলল আমাদের ট্রেনটা। আমার ট্যুর গাইড আকাশ ফুরে কোত্থেকে উদয় হল যেন, কুসকো ষ্টেশনে তার সাথে শেষ দেখা এবং কথা ছিল মাচু পিচু ষ্টেশনে আমাকে খুঁজে বের করবে। বিদেশে বিভুয়ে হারিয়ে যাওয়ার ভয় অনেক আগেই কেটে গেছে। পকেটে দু’একটা ক্রেডিট কার্ড আর চলনসই ইংরেজি জানা থাকলে হারানোটা কোন সমস্যাই না, বরঞ্চ এ এক ধরনের এডভেঞ্চার। ব্রীফ করলো আমার ট্যুরের পরবর্তী অংশটুকু। বেশ ক’টা টিকেট ধরিয়ে দিল কাজে লাগবে বলে। এক ধরনের অস্থিরতা পেয়ে বসলো আমায়। তর সইছে না যেন। ট্রেনের জানালায় মাথা গলিয়ে উৎসুক হয়ে কি যেন খুঁজছে সবাই। একই প্রশ্ন সবার চোখে মুখে, আর কতদূর? দূর হতে ষ্টেশনটা দেখে মনটা একটু দমে গেল। এ যে দেখছি একেবারেই সাধারণ। অসংখ্য মানুষের মিছিল, ফেরিওয়ালাদের ভিড় আর থরে থরে সাজানো দোকান পাটের মিছিলে স্বপ্নের মাচু পিচুকে খুঁজে পেলামনা। প্লাটফরমে পা রাখতেই ঠাণ্ডা একটা পাহাড়ি বাতাস সমস্ত শরীরকে ঝাঁকি দিয়ে গেল। পেরুর জাতীয় পোশাক আর বাদ্যযন্ত্র নিয়ে অপেক্ষা করছে একটা গ্রুপ। ঝন ঝন করে উঠলো তাদের বাদ্যযন্ত্র। পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এলো সে সূরের মূর্ছনা। চমকে উঠলাম আমি, আরে তাইতো, ঠিক এরকম একটা দৃশ্যইতো দেখেছিলাম অস্ট্রেলিয়ার এসবিএস টিভিতে যা পৃথিবীর এ প্রান্তে আসতে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। আকাশের দিকে চাইলাম। ছেড়া ছেড়া মেঘ ছাড়াও বিন্দু রেখার মত ছোট একটা বাসের চলাচল চোখে পড়লো। নিথর হয়ে আসলো হাত-পা, আমাকে উঠতে হবে ঐ উচ্চতায়। তারপরই কেবল দেখা মেলবে হারানো ইনকা রাজ্যের।

হরেক রকমের ভাষা আর মানুষের কোলাহলে মুখরিত হয়ে উঠলো রেল ষ্টেশন। খালি পা আর অর্ধ উলঙ্গ পশ্চিমা দুনিয়ার বাহারি ভ্রমণকারীদের নিয়ে স্থানীয়দের তেমন কোন মাতামাতি লক্ষ্য করলাম না। হয়ত সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে মেনে নিয়েছে সবকিছু। আবাসিক হোটেল গুলোর অবস্থা অনেকটা ঢাকার মগবাজার মোড়ের হোটেল গুলোর মতই শ্রীহীন, বয়সের ভারে নূয্য। পাশাপাশি ঝকঝকে বিশ্বমানের হোটেল গুলো বেশ ফাকা মনে হল। একটা জিনিষ ভ্রমণ করলে শেখা যায়, যারা নিয়মিত পৃথিবীর অলি গলি চষে বেড়ায় তাদের কাছে হোটেলটা শুধু রাতটা কাটানোর একটা আশ্রয় মাত্র, এর কোয়ালিটি নিয়ে ব্যক প্যাকার্সরা খুব একটা মাথা ঘামায় না। এমনটা যেমন কোলকাতার সদর ষ্ট্রীটে দেখেছি এখানেও এর কোন ব্যতিক্রম চোখে পরলনা।

আমার ট্যুর গাইড এসে মাচু পিচুর উপর প্রফেশনাল এক গাইডের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল, স্থানীয় এ্যক্সেন্টের ইংরেজি বুঝতে খুব যে একটা সুবিধা হবেনা তা নিয়ে একটু চিন্তায় পরে গেলাম। মিনিট দশেক পায়ে হেটে বাসে চড়ে বসলাম। হিসাব করে দেখলাম ড্রাইভারের পাশের সীটটা হচ্ছে মোক্ষম জায়গা, প্রায় গায়ের জোড়ে দখল করে নিলাম কাঙ্ক্ষিত সীটটা। শুরু হল যাত্রা। ভার্টিক্যাল জার্নি বলে কোন টার্ম আছে কিনা জানিনা, বাসের সামনের চাকা আর পিছনের চাকার ভেতর ৪৫ ডিগ্রী তফাৎ নিয়ে এ যাত্রাকে অন্যকোন নামে আখ্যায়িত করার ভাষা খুঁজে পেলামনা।

রোম শিউড়ে উঠার মত যাত্রা। সরু এবং আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ। উলটো পথে কোন যানবাহন আসলে পিলে চমকে উঠে, এই বুঝি গড়িয়ে পরলাম পাহাড়ের মৃত্যু ফাঁদে! মাটি এবং ধূলার রাস্তা মাঝে মধ্যে বিপদজনক বাক। সামনের সীটে বসে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া ট্রেন ষ্টেশনটাকে মনে হল এক খণ্ড কাপড়। শ্বাস বন্ধ করে শুধুই ডানে বায়ে চোখ ফেরালাম, কোথায় সে মাচু পিচু!

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ২
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৩
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৪
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৫

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ২

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – পর্ব ১

এ অন্য এক পৃথিবী; ঘন মেঘমালা আকাশ আর মাটির ভালবাসায় সেতুবন্ধন হয়ে জড়িয়ে আছে দিগন্ত জুড়ে। পাহাড়ের চূড়ায় চুড়ায় মেঘ-দৈত্যদের অলস পদচারণ প্রকৃতির নৈসর্গিক স্তব্ধতাকে স্বপ্নিল ফ্রেমে বন্দী করে তৈরি করেছে বিস্ময়কর প্যানোরমা। প্রথম ক’টা মিনিট মুখে কথা ফুটে না। এ যেন সূরা আর সাকির অনাদিকালের মিলন-মেলা। মাচু পিচু – ইনকাদের হারিয়ে যাওয়া শহর। স্প্যনিস দখলদারদের হিংস্রতা হতে বাচতে গিয়ে নিজেদের অজান্তেই তৈরি করে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম আশ্চর্য এক স্থাপনা।

চারদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। চূড়াগুলো বাহু-লগ্না হয়ে ডুবে আছে মেঘ সমুদ্রে। ইচ্ছে করলেই এক খণ্ড মেঘ হাতে বাড়িয়ে কাছে টানা যায়। আদর করা যায়। গলার সূর উঁচু করে হাঁক দিলে সে হাঁক পাহাড়ে পাহাড়ে আছড়ে পরে। ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে তীর ভাঙ্গা তরঙ্গের মত। চারদিকে এক ধরনের ভৌতিক নীরবতা। সাথে প্রকৃতি এবং মানুষের নীরব বুঝাপড়ার বিশাল এক ক্যানভাস। ইনকা সাম্রাজ্যের বিশালতার কাছে গিজ গিজ করা পর্যটকদের ফিসফাস হাজার রজনীর আরব্য উপন্যাসের কথাই মনে করিয়ে দেয়। নিপুণ কারিগরের নিশ্ছিদ্র পরিকল্পনায় হাতেগড়া পাথরের প্রাসাদগুলো সময়ের স্তব্ধ সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে দিগন্ত জুড়ে। প্রথম যে ধাক্কাটা এসে মগজে আঘাত হানে তাহলো, কি করে এত উচ্চতায় এই বিশাল পাথরগুলোকে উঠানো হল! প্রযুক্তি বলে জাগতিক পৃথিবীতে কিছু থাকতে পারে এমন ধারণা ঐ নিষিদ্ধ অরণ্য পর্যন্ত পৌঁছানোর কথা নয়। হাত এবং মগজের চাতুর্যপূর্ণ নৈপুণ্যে পাথরগুলোকে উঠানো হয়েছে একটার উপর আরেকটা। শক্ত কাদামাটি দিয়ে আটকানো হয়েছে হাজার বছরের বন্ধনে।

একদিকে রাজপ্রাসাদ, অন্যদিকে সাধারণ ইনকাদের বসতি এবং পাশাপাশি বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উন্নয়নে গবেষণাগার সবকিছু মিলে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ সাম্রাজ্যের কথাই মনে করিয়ে দেয়। বলা হয়ে থাকে পেরুর মাটিতে স্প্যানিশ উপনিবেশবাদের আগমনের একশত বছর আগেই এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়, কারও মতে দখলদার বাহিনীর নৃশংসতা হতে বাচার জন্যে ইনকারা পালিয়ে আশ্রয় নেয় মাচু পিচুতে। পরবর্তীতে বসন্তের মত মহামারিতে বিলীন হয়ে যায় জনসংখ্যা। পরিত্যক্ত হয়ে গাছপালা আর পাহাড়ের আড়ালে চাপা পরে যায় ইনকাদের আশ্চর্য স্থাপনা মাচা পিচু। ১৯১১ সালে মার্কিন ইতিহাসবিদ হিরাম বিংগ্নহাম ইনকা সভ্যতার উপর গবেষণা চালাতে গিয়ে বেশ ক’বার এলাকাটিতে জরিপ চালান। এমনই এক আর্কিওলজিক্যাল জরিপে স্থানীয় কুয়্যেচোয়া গোত্রের ১১ বছর বয়সী বালক পাবলিত আলভারেজ হিরামকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় মাচা পিচুর ট্রেইলে। আধুনিক সভ্যতা বিস্ময় এবং হতবাক হয়ে স্বাগত জানায় হিরামের এই আবিষ্কারকে।

চারদিকে হরেক রকম ভাষা আর ক্যামেরার ক্লিক শব্দে নেশা ধরে আসে নিজের অজান্তেই। সরু এবং সংকীর্ণ পথ বেয়ে অনেকে পাহাড়ের চূড়ার দিকে হাঁটছে ইনকা ট্রেইল জয়ের লক্ষ্যে। এমনই এক মিশনে গেল সপ্তাহে দু’জন ইংরেজ পর্বতারোহী পা পিছলে হারিয়ে গেছে পাহাড়ের মৃত্যু খাদে। কোন কিছুই মানুষের অজানাকে জানার আর অচেনাকে চেনার অদম্য বাসনা আটকাতে পারেনা, মৃত্যুভয় জেনেও কিশোর হতে শুরু করে বুড়োর দলও নিজকে সাক্ষী করতে চাইছে সভ্যতার এই মহা-বিস্ময়ের সাথে।

বেলা গড়াতে ঘন মেঘ কুন্ডুলী ক্লান্ত বলাকাদের মত উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে। পাহাড়ের চূড়াগুলো সহসাই মুক্তি পেল মেঘের আগ্রাসন হতে। সাথে সাথে সূর্যের আলো ভাসিয়ে নিলো লোকালয়। কেউ যেন ছবি তোলার প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিল ক্ষণিকের জন্যে। ক্যামেরা ক্লিক ক্লিক শব্দ আর ফ্ল্যাশ লাইটের ঝলকানো আলোতে মায়াবী পরিবেশে হতে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আমাদের নিয়ে এলো জাগতিক পৃথিবীতে। কিছুক্ষণ আগের কনকনে শীত ছাপিয়ে এবার ঝাঁকিয়ে বসলো ভ্যাপসা গরম। ট্যুর গাইডের বিরামহীন বর্ণনা একসময় রাজ্যের বিরক্তির নিয়ে এলো। ভাল লাগছিল না ভাঙ্গা ইংরেজিতে ইনকাদের ইতিহাস। মনে হল যাবার আগে প্রকৃতিকে নিজের মত করে কাছে না পেলে এ যাত্রা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ছিটকে পরলাম গ্রুপ হতে। এবার উঁচুতে উঠার পালা। একটার পর একটা বিপদজনক সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে শেষপর্যন্ত সূর্যঘড়ির চূড়ায় এসে হাঁপিয়ে পরলাম। এটাই ছিল জনবসতির সর্বোচ্চ চূড়া। সামনে, পিছনে, ডানে এবং বায়ে শুধুই মৃত্যুফাঁদ, ভারসাম্যের সামান্য হেরফের হলেই আমার আমিত্বে নামবে অমেঘো পরিণতি, ডেথ উদআউট ট্রেইস!

চোখ চোখ দু’টো বন্ধ করে নিজকে হাল্কা করে নিলাম। পাখীর ডানার মত হাত দু’টো ছড়িয়ে জোড়ে চীৎকার দিতেই সে চীৎকার লক্ষ প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এলো নিজের কাছে। কেন জানি মনে হল আমি এবং আমার ঈশ্বর এখন খুব কাছাকাছি এবং আমার চীৎকার ঈশ্বরের দরবারে পৌছাতে কোন অসুবিধা হচ্ছেনা।

বেলা পরে আসছিল, তাই ফেরার আয়োজন করতে হল। প্রধান ফটক পার হয়ে বাইরে বেরুতেই দেখলাম ২০ডলারের একটা বাফে। ক্ষুধায় পেট উঁচু স্বরে কথা বলতে শুরু করে দিল। খুব রসিক মেজাজে ভূড়িভোজের পর উল্টো পথ ধরলাম। পাহাড় হতে নামতে হবে বাসে চড়ে, তারপর ট্রেন। কুস্‌কো পৌছতে রাত হয়ে যাবে তাতে কোন সন্দেহ রইল না। ট্রেনে বসে হঠাৎ করেই মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। চারদিকের শুনশান নীরবতা দেখতে ভাল লাগছিল না। নিজকে বুঝাতে পারলাম না কেন এই বিষণ্ণতা! তবে কি এতদিনের লালিত স্বপ্ন আর কোনদিন দেখবোনা বলেই এই ভাবাবেগ? পৃথিবীর এই অঞ্চলগুলোতে আর কোনদিন পা ফেলবোনা বলেই হয়ত এ সাময়িক আচ্ছন্নতা। কিন্তু কে জানত দু’বছর পরেই আবার আমাকে আসতে হবে এখানে। মাচু পিচুর পাহাড় এবং মেঘেদের লুকোচুরির কোন এক বাঁকে আমার ভালবাসার মানুষকে আংটি পরিয়ে নিবেদন করব বিয়ে প্রস্তাব! সে অন্য এক কাহিনী, অন্য এক অধ্যায় যার সাথে এ লেখার কোন সম্পর্ক নেই। সময় সুযোগ পেলে তা নিয়েও হয়ত লেখা যাবে।

হোটেলে ফিরতে রাত দশটা বেজে গেল। রাতের খাবার শেষে সকাল সকাল শুয়ে পরার সিদ্ধান্ত নিলাম। খুব সকালে বাস ধরতে হবে। পরবর্তী ঠিকানা লেক টিটিকাকা, পেরুর সীমান্ত শহর পুনো।

নক্ষত্র মেলায় ডুবে যাওয়া দূরের আকাশটাকে মনে হচ্ছিলো রহস্যময় নারীর তুলতুলে শরীরের মত। জ্বল জ্বল করা তারা গুলো মুচকি হেসে আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল অবৈধ অভিসারে। সেপ্টেম্বরের বসন্তের রাত পৃথিবীর এ অংশটায়। কনকনে শীতের রেশ এখনো প্রকৃতি জুড়ে। আরও একটা কম্বল নিতে হল সূই’এর মত হুল ফোটানো শীত হতে বাচার জন্যে। লেক টিটিকাকায় ছোট্ট একটা ইঞ্জিন বোটের ডেকে শুয়ে দূরের আকাশটা দেখতে দেখতে নিজের ভেতর একধরনের ভোতা অনুভূতির জন্ম নিচ্ছিল। চারদিকের ভৌতিক নীরবতা আর মধ্য গগনের তারাগুলো দারুণ এক কাব্যিক পরিবেশ সৃষ্টি করছিল যদিও। না চাইলেও তার চেহারাটা ঘুরে ফিরে মগজের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল ঝাঁপিত জীবন। ক্লান্ত মনে হল নিজকে।

সূর্য উঠার আগেই ঝটপট নাস্তা সেরে বাস ষ্টেশনে দৌড়াতে হয়েছে পুনো গামী শেষ বাসটা ধরার জন্যে। ১০ ঘণ্টার লম্বা জার্নি। বলিভিয়ার পথে পেরুর শেষ শহর। মাচু পিচু হতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। কুসকোর ঘন কুয়াশায় জার্নির শেষটা ছিল বেশ ভীতিকর। সময় ছিল আমার এক নাম্বার শত্রু। এত অল্প সময়ে এত বড় আয়োজন শরীরে উপর বয়ে দিচ্ছিল কাল বৈশাখী।

সহসাই দিগন্ত রেখায় মিলিয়ে গেল লোকালয়। জানালার ওপাশটায় পাহাড়ের রাজ্য এসে গ্রাস করে নিলো আমাদের চলা। থরে থরে সাজানো আন্দিজের চূড়া গুলো চলন্ত ছবির মত হারিয়ে যাচ্ছিল জানালার ওপাশ দিয়ে। নেশা ধরা প্যানোরমা। আমি যেন শুধু গিলছি আর আন্দিজকে বুকের ভেতর আঁকড়ে ধরছি শক্ত করে। রাজ্যের তন্দ্রা এসে ভর করলো। বাসের কর্কশ ব্রেকে তন্দ্রা টুটে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। দুপুরের খাবার খেতে হবে। ছোট্ট একটা লোকালয়ে আমাদের যাত্রা বিরতি। বাহারি পোশাকের ক’জন এন্ডিয়ান মহিলা গান গেয়ে আমন্ত্রণ জানালো খাবার টেবিলে। হরেক রকম খাবারে ভরা বাফে। জিবে পানি এগে গেল মেনুতে চোখ বুলিয়ে। ক্ষুধার্ত শেয়ালের মত ঝাঁপিয়ে পরলাম প্লেটের উপর। শেষ কবে ভাল খাবার মুখে উঠেছে মনে করতে পারলাম না। টেবিলের আশে পাশে ঘোরাফেরা করছিল একদল আলপাকা, জিরাফের মত উঁচু গলার একধরনের ভেড়া। পর্যটকদের মনোরঞ্জনের খুঁটিনাটি দেখে মুগ্ধ হতে হল। শ্রদ্ধায় মাথা নত করতে ইচ্ছে হল পেরুর মানুষের কাছে। বাস যখন ছাড়বে অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল…দন্ত-বিহীন এবং শীতে তামাটে হয়ে যাওয়া একদল শিশু বিরল প্রজাতির পাহাড়ি ফুল ধরিয়ে দিয়ে বিদায় জানালো আমাদের। আবারও গেয়ে উঠলো এন্ডিয়ান মেয়েগুলো। ধীরে ধীরে বিন্দুর মত ছোট হয়ে পাহাড় রাজ্যে মিলিয়ে গেল জীবনের এই সুন্দর মুহূর্তগুলো। আবারও পথ চলা।

সূর্যের তেজ ধীরে ধীরে পড়ে আসছিল। এনাকন্ডা সাপের মত ঘন কুয়াশা এসে গ্রাস করে নিলো আমাদের বাসটাকে। হঠাৎ করে মনে হল চারদিকে শুধু ঘন অন্ধকার। থেমে গেল আমাদের চলা। ভয় পেয়ে গেলাম। এ লোকালয়ে ডাকাতদের উৎপাতের কথা অনেক উপন্যাসে পড়েছি, ছবিতে দেখেছি। বাসের অন্য যাত্রীদের চোখেও দেখলাম একই ভীতি। হঠাৎ করে আসা সাপটা আবার হঠাৎ করেই আন্দিজের চোরা পথে হারিয়ে গেল। আলো দেখতে পেলাম বিপদজনক বাকে। বাসটা গতি বাড়িয়ে দ্রুত পৌঁছে গেল একটা চূড়ায়। সূর্যাস্ত দেখবো আমারা। বোবা হয়ে গেলাম অবিস্মরণীয় দৃশ্য দেখে। বরফে আচ্ছাদিত চূড়াগুলোর কোলে অসহায়ের মত ঘুমিয়ে পড়ছে শেষ বিকেলের সূর্যটা। রক্তিম আভায় ভেসে যাচ্ছে সাদা পালকের মত বরফগুলো। যুদ্ধে পর্যুদস্ত সৈনিকের মত আত্নসমর্পন করলো এতক্ষণ ধরে রাজত্ব করা পাহাড়ি সূর্যটা। হাল্কা অন্ধকার এসে চাদরের মত ঢেকে দিল চূড়াগুলো। দূরে ভেসে উঠলো টিটিকাকার হ্রদের সমুদ্র সমান চেহারাটা। দৃশ্যপটে টিমটিম করে জ্বলে উঠলো পুনো শহরের নিয়ন বাতিগুলো। এতক্ষণ পর লোকালয়ের গন্ধ পেয়ে মনটা ঝলমল করে উঠলো।

লেক টিটিকাকা, সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ১২,৫০০ ফিট (৩৮০০ মি) উচ্চতায় পৃথিবীর সবচেয়ে চলাচল যোগ্য লেক। বৃষ্টি আর আন্দিজের বরফ গলা পানির ফসল হচ্ছে প্রকৃতির এই নয়নাভিরাম দৃশ্যপট। লেকের অন্য ধারে বলিভিয়া। অনেক পর্যটক এ লেক দিয়ে পাড়ি জমায় আরও উঁচুতে অবস্থিত লা-পাস’এ।

আমার নামের ছোট একটা সাইন নিয়ে মধ্য বয়সী এক মহিলাকে এদিক ওদিক তাকাতে দেখলাম। হাত বাড়িয়ে ইশারা দিতেই নিজের পরিচয় দিল, গাইড। হোটেল বুক করা ছিল লিমা হতেই। ডকুমেন্টের ঝামেলা সেরে রুমে ঢুকতেই রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করলো। বিধ্বস্ত মনে হল নিজকে। এবার বিশ্রামের পালা।

দরজায় নক করে রুমে ঢুকল আমার গাইড। স্তম্ভিত হয়ে গেলাম দুঃসংবাদটা পেয়ে… বলিভিয়ায় সাধারণ ধর্মঘট চলছে গত ৭দিন ধরে। কবে ভাঙ্গবে কেউ জানেনা। আর তাই পুনো হতে ছেড়ে যাওয়া বাস গুলো বসে আছে হাত-পা গুটিয়ে। অংক কষার চেষ্টা করলাম নিউ ইয়র্ক ফিরে যাওয়ার। মেলাতে পারলাম না কোন কিছু। বন্দী হয়ে গেলাম আন্দিজের পাহাড়ি  অনিশ্চয়তার কাছে।

বলিভিয়ায় ৭ দিন ধরে সাধারণ ধর্মঘট চলছে খবরটা নিশ্চয় কুসকো এবং লিমার ট্রাভেল এজেন্টদের জানা ছিল, অথচ টিকেট বিক্রির সময় প্রসঙ্গটা নিয়ে কেউ কথা বলেনি। মনটা খারাপ হয়ে গেল অনিশ্চয়তার গ্যড়াকলে আটকে গিয়ে। হোটেল কাউন্টারে খোজ নিয়ে ধর্মঘটের বিস্তারিত জানার চেষ্টা করলাম। বেশ ক’দিন ধরেই ধর্মঘট চলছে। বলিভিয়া শুধু দক্ষিণ আমেরিকারই নয় বরং পৃথিবীর অন্যতম গরীব দেশ। ক্ষমতা নিয়ে দুটি রাজনৈতিক দল এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে কাড়াকাড়ির ফলে এ দেশটি ইতিমধ্যে সামরিক অভ্যুত্থানে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মর্যাদা লাভ করেছে। দারিদ্র এবং দুর্নীতির ভীত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে কতটা শক্ত মাটির উপর দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের পাশাপাশি বলিভিয়াও তার বাস্তব প্রমাণ। ৯ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশে প্রাকৃতিক সম্পদের কোন কমতি নেই, অথচ দুর্নীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রার মান একেবারেই অমানুষিক। ট্রেড ইউনিয়ন গুলো এ যাত্রায় দু’টো দাবি নিয়ে হরতাল করছে; এক, তেলের দাম কমাতে হবে, দুই, প্রাকৃতিক গ্যাসকে জাতীয়করণ করতে হবে। এ নিয়ে সরকার এবং শ্রমিক সংগঠনগুলো একে অপরের মুখোমুখি দাড়িয়ে, কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজী নয়। দেশটার সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট যাচাই না করে ভ্রমণ করার পরিকল্পনার জন্যে নিজকে ছাড়া অন্য কাউকে দায়ী করতে পারলামনা। হোটেল ম্যানেজার জানাল যেহেতু কাল শনিবার হয়ত ধর্মঘট কিছুটা শিথিল হতে পারে, এবং এমনটা হলে তারা যেভাবেই হোক আমাকে একটা বাসে উঠিয়ে দেবে। কিছুটা আশান্বিত হয়ে রাতের খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে গেলাম।

চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সাথে শক্ত তামাটে পাথরের রাস্তাগুলো হাল্কা নিয়ন আলোতে এক ধরনের রহস্য সৃষ্টি করছে যা হলিউডের ভৌতিক ছায়াছবির কথাই মনে করিয়ে দেয়। প্রচণ্ড শীত। পথচারীদের সবার মুখ বিভিন্ন কারুকার্যের চাদরে ঢাকা। দু’কান ছড়িয়ে দু’দিকের ল্যাজ সহ মাথার টুপি ছোটবেলায় দেখা দক্ষিণ আমেরিকার ছায়াছবির যেন বাস্তব প্রতিফলন। সবকিছু ছাপিয়ে চেহারার যতটুকুই বেরিয়ে আসছে তাতে প্রকৃতির সাথে লড়াই করে বেচে থাকার কঠিন ছাপ। এক টুকরো কাপড়ে সন্তানদের পিঠে ঝুলিয়ে মহিলাদের পথচলা অবচেতন মনে কল্পনা করলে ভ্যান গগের কোন অসমাপ্ত ছবির দৃশ্যপট মনে করিয়ে দেবে। শহরের রাস্তাগুলো সাগরের ঢেউয়ের মত উঁচু নিচু, সাপের মত আঁকাবাঁকা। কিছুদূর হাঁটলেই বুকের বা পাশে দাপাদাপি শুরু হয়। পা জড়িয়ে আসে। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে এত উঁচুতে আছি চাইলেও তা ভুলে যাবার নয়।

দু’তিন ব্লক হাটতেই ’পইয়্যো লা ব্রাসা’ নামের হোটেলটা চোখে পরল। পয়্যো লা ব্রাসা, অর্থাৎ ফ্রাইড চিকেন। দক্ষিণ আমেরিকার দেশে দেশে ফ্রাইড চিকেনের এত কদর চোখে না দেখলে তা বিশ্বাস করা মুস্কিল। সুইং দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই অন্য এক পুনোর চেহারা ফুটে উঠল। গিজ গিজ করছে খদ্দেরের ভিড়ে। ধোয়া এবং ভাজা মুরগীর গন্ধে চারদিক মৌ মৌ করছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই এক তরুণী এগিয়ে এলো। হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাল। সাধারণ মানের হোটেল। চেয়ার-টেবিলে দৈন্যতার ছোঁয়া। কিন্তু চারপাশের মানুষগুলোর খাওয়ার ভেতর কোন ফাঁক ফোকর খুঁজে পেলামনা। ওরা খাচ্ছে আর জীবনকে উপভোগ করছে নিজের মত করে। জোড়া জোড়া তরুণ তরুণী টেবিলে খাবার ভুলে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে একে অপরের দিকে। মা-বাবা সন্তানাদি নিয়ে উপভোগ করছে রাতের খাবার। চারদিকে চ্যাচাম্যাচি হৈ চৈ।

অর্ডার নিতে আগের সে তরুণী এগিয়ে আসতেই দমে গেলাম… কি ভাবে অর্ডার করবো! নিশ্চয় সে ইংরেজি জানেনা আর আমারও স্প্যানিশের দখল যথেষ্ট নয়। সমস্যা হল, পেরুভিয়ানদের অনেকের চেহারাই আমাদের মত, এবং আমাকে তাদেরই একজন ভেবে তরুণী গলগল করে স্প্যানিশ বলে গেল। মুচকি হেসে জবাব দিলাম, ‘ইয়ো ন হাবলা স্প্যনিয়ল‘। চোখ বড় করে হো হো করে হেসে উঠল। আমি স্প্যানিশ জানিনা এমনটা সে মোটেও আশা করেনি। বাঁকা একটা হাসি দিয়ে হারিয়ে গেল খদ্দেরের ভিড়ে। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো ততোধিক সুন্দরী এক তরুণী সাথে নিয়ে। ’ম্যা আই হেল্প ইউ সিনয়্যর?’ হাতে চাঁদ পেলাম যেন। কোয়ার্টার চিকেন, পটেটো ফ্রাই এবং ইন্‌কা কোলার অর্ডার দিয়ে আলাপ শুরু করলাম তরুণীর সাথে। আমি নিউ ইয়র্ক হতে এ অঞ্চলে এসেছি জেনে বিস্ময় প্রকাশ করল, আমার অবস্থা খুলে বলতেই সান্ত্বনা দিতে চাইল। তৈলাক্ত খাবার, বেশী খাওয়া গেলনা। সবশেষে এককাপ ধূমায়িত কফি নিয়ে অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলাম পৃথিবীর এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জীবন। আমাদের জীবন হতে খুব কি একটা তারতম্য? মনে হলনা!
আশাতীত টিপস পেয়ে তরুণীর সাদা চেহারা একেবারে লাল হয়ে গেল। মুচকি হেসে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল… ‘পরের বার আসলে ওয়েন্ডিকে খোজ কর। শুভরাত্রি জানিয়ে আবারও হারিয়ে গেলাম আলো আধারে ভরা ভূতুরে শহরে।

কুয়াশার চাদরে ঢাকা আন্দিজের চূড়াগুলো দিগন্তরেখায় খুঁজে পেতে কষ্ট হল। নিকষ কালো অন্ধকার গ্রাস করে নিয়েছে সবকিছু। রাস্তায় মানুষের সংখ্যাও বিপদজনক ভাবে কমে গেছে। উদ্দেশ্যবিহীন আরও কিছুটা পথ হাটাহাটি করার সিদ্ধান্ত নিলাম। এ ফাকে মনটাও বেশ হাল্কা হয়ে এলো। ক্ষতি কি আগামীকাল যদি বলিভিয়া যাওয়া না হয়! আর সময়মত নিউ ইয়র্ক ফিরে না গেলে চাকরীটা চলে যাবে এইতো! তাতে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে ভেবে পেলামনা। চাকরী আরেকটা খুঁজতে হবে এই যা। মনে মনে ছক আকা শুরু করলাম আগামীকালের। নৌকায় করে লেক টিটিকাকা দিয়ে লা পাস যাওয়ার চিন্তাও মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করল। সত্যি বলতে কি এমন একটা অনিশ্চয়তা হঠাৎ করেই ভাল লাগতে শুরু করল।

শহরে বিদ্যুতের আসা যাওয়া এই প্রথম খেয়াল করলাম। রাস্তার বাতিগুলো নিভে গেল বিনা নোটিশে। ভুতের বিশ্বাস থাকলে হয়ত সামনে যাওয়া হতনা। হঠাৎ করে বাইসাইকেলের আওয়াজে পিলে চমকে উঠল। সামনে একটা কাঁচা বাজারে আলোর দেখা পেয়ে ঢুকে গেলাম। বিক্রেতার দল সাড়ি সাড়ি পণ্য সাজিয়ে বসে আছে শেষ খদ্দেরের আশায়। টিমটিম করে কেরোসিনের কুপি জ্বলছে প্রতিটি দোকানে। বয়সের ভারে নূয্য দোকানীর দল একই সাথে মসলার পাশাপাশি গিনিপিগ এবং শুয়োরের মাংস বিক্রি করছে। উদভ্রান্তের মত হাটাহাটি করলাম কিছুক্ষণ। এমন একটা বাজারের সাথে কেন জানিনা ’৭১’এ দাদাবাড়িতে দেখা কাচা বাজারের মিল খুঁজে পেলাম। দু’টো প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও কোথা যেন যোগসূত্র ছিল। রাত বাড়ছিল দ্রুত, এবার হোটেলে ফিরে যাওয়ার পালা।

লেক টিটিকাকার পাড় ঘিরে হাটাহাটি শেষে হোটেলে ফিরতেই খবরটা পেলাম। খুব ভোরে দু’টো বাস যাচ্ছে লা পাস। আমিও একটা বাসের যাত্রী হতে যাচ্ছি। ভ্রমণটা হবে খুবই রিস্কি। শেষ পর্যন্ত গন্তব্যে পৌছাতে পারব কিনা তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। আমাকে সকাল ৫টার ভেতর তৈরি থাকতে হবে। খবরটা শুনে কেন জানি মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। এতক্ষণ ধরে আকা কল্পনাগুলো শুধু কল্পনা হয়েই থাকবে হয়ত এ জন্যে। এক কাপ ককো টি কোন রকমে গিলে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পরলাম। এবারের যাত্রা কোপাকাবানা হয়ে বলিভিয়ার রাজধানী লা পাস।

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৩
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৪
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৫

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৩

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – পর্ব ১
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – পর্ব ২

অনিশ্চয়তার বেড়াজালে আটকে গেল ঘুমের পৃথিবী। এপাশ ওপাশ করেই কাটিয়ে দিলাম বাকি রাতটা। শেষ রাতের দিকে তন্দ্রা মত আসতেই ঘড় ঘড় শব্দে বেজে উঠল এলার্ম ঘড়িটা। মিনিট খানেকের ভেতর রিসিপশন ডেস্ক হতে কেউ একজন ওয়েক-আপ কল দিয়ে জানিয়ে দিল এবার উঠতে হবে। রাজ্যের আলসেমি এসে ভর করলো শরীরের উপর। সাথে মাথাটাও ঘুরছে পাগলা ষাঁড়ের মত। উঠে পরলাম অনিচ্ছা সত্ত্বেও। বাথটাবে গরম পানি ছেড়ে শরীরটাকে ডুবিয়ে রাখলাম অনেকক্ষণ। এত সকালে হোটেল ক্যান্টিন খোলা থাকবে কিনা সন্দেহ হল। ব্রেকফাস্ট নিয়ে বেশ একটু চিন্তায় পরে গেলাম।

রুমের বিশাল পর্দাটা সড়াতেই আন্দিজের চূড়ায় ঘুমন্ত সূর্যটার দেখা মিলল। ঘন কুয়াশা এবং খণ্ড খণ্ড মেঘের কোল ঘেঁষে শুয়ে থাকা লাল আভাটা উঠি উঠি করছে কেবল। হঠাৎ মনে হল সূর্যোদয়ের এমন একটা মায়াবী দৃশ্য দেখেই বোধহয় বাকি দিনটা কাটিয়ে দেয়া যাবে, দরকার কি বলিভিয়া যাওয়ার! আবারও ফোন পেলাম রিসিপশন হতে, ক্যান্টিন খোলা হয়েছে, চাইলে নাস্তা করতে পারি। এলোমেলো চিন্তা সরিয়ে বাস্তবে ফিরে এলাম। নাস্তা মিস করা যাবেনা। শুকনো দু’টুকরো রুটি, সাথে মাখন আর গরম এক কাপ কফি, এই ছিল হোটেলের ফ্রি ব্রেকফাস্ট। নাস্তা সেরে রুমে ফিরে আসতেই বেশ তরতাজা মনে হল নিজকে। রাতেই লাগেজ গুছিয়ে রেখেছি, তাই এ নিয়ে মাথা ঘামাতে হলোনা। সূর্য উঠার পর্বটা মিস করতে চাইলাম না এ যাত্রায়। সাথে একটা দূরবীন ছিল, ওটা নিয়ে দাড়িয়ে গেলাম জানালার পাশে। সবকিছু কেমন যেন গোলমেলে মনে হল; কুয়াশা সাথে লড়ছে সূর্যটা, মাঝে মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে খণ্ড খণ্ড কালো মেঘ। পাহাড়ের কোলে চাইলেই দেখা যাচ্ছে সেই সব মেঘদের ছায়া। কোটি কোটি সূর্য রশ্মি বাধ ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে চাইছে মেঘ রাজ্যের মায়াবী বন্ধন হতে। ফাকে ফাকে উকি দিচ্ছে লাভার মত জ্বলন্ত সূর্যটা। বেশীক্ষণ স্থায়ী হলোনা এ অসম লড়াই। সূর্যের তীব্রতার কাছে ভেসে গেল মেঘমালার হাল্কা প্রতিরোধ। পাহাড়ের চূড়াগুলো বেরিয়ে এলো কুয়াশার বুক চিড়ে। ধীরে ধীরে সকাল হয়ে গেল আন্দিজের এ অংশটায়। রাতের পুনোকে চেনা গেলনা দিনের আলোতে।

যতই বেলা বাড়ছে সাথে বাড়ছে আমার টেনশন। দোভাষীনির দেখা নেই। কথা ছিল ৮টার ভেতর বাস ষ্টেশন থাকব আমি। ঠিক ৮টা ১০’এ হাঁপাতে হাঁপাতে হাজির হলেন জনাবা। কথা না বলে শুধু ইশারা দিল, দৌড়াও। পরি মরি করে ছুটলাম। অনেকটা হিন্দি সিনেমার থ্রিলিং সিকোয়েন্সের মত মনে হল দু’জনের এ দৌড়। লাগেজ নিয়ে দৌড়ানো খুব একটা সহজ মনে হলনা। বিশেষ করে সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে এত উঁচুতে দৌড়াতে গেলে শ্বাস ছোট হয়ে আসে। নাক মুখ হতে রক্ত বেরিয়ে আসে বিনা নোটিশে। কুলিয়ে উঠলাম না, তাই দৌড়ে হার মানতে হল দোভাষিনীর কাছে। বাসটা প্রায় ছেড়ে যাচ্ছে… অন্তিম মুহূর্তে পড়িমরি করে কোনরকমে উঠে পরলাম। ততক্ষণে মুখ বেয়ে লালা পরতে শুরু করেছে, চাইলেও জ্বিহবাকে সঠিক জায়গায় ধরে রাখা যাচ্ছিলোনা। হঠাৎ করে মারত্মক পিপাসা পেল। কিন্তু তৃষ্ণা মেটাবার কোন কিছু সাথে আনা হয়নি, তাই নিজকে সান্ত্বনা দিলাম অবুঝ শিশুর মত। যেমনটা চেয়েছিলাম জানালার পাশেই আমার সীট। একটু গুছিয়ে বসতেই চোখ গেল পাশের সহযাত্রীর দিকে। অত্যন্ত ধারালো এক সুন্দরী। বাঁশের মত লিকলিকে শরীর, টাইট জিনস এবং কোমরের অনেক উঁচু পর্যন্ত একটা হাল্কা টি-শার্ট। মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম আমার ট্যুর গাইডকে।

আমার অবস্থা যাচাই করে হাই হ্যালো বলার আগেই ঠাণ্ডা এক বোতল কোমল পানীয় এগিয়ে দিল। লৌকিকতা করার মত অবস্থা ছিলনা, তাই কোন মতে হাল্কা একটা ধন্যবাদ জানিয়ে ঘট ঘট করে গিলতে শুরু করে দিলাম পানীয়। ‘তুমি আন্দিজের এ দিকটায় কি এই প্রথম?’, চোস্ত মার্কিন উচ্চারণের ইংরেজিতে জানতে চাইল তরুণী। ‘হ্যাঁ, এই প্রথম, কিন্তু তুমি জানলে কেমন করে? জিজ্ঞেস করলাম আমি। উত্তরে যা বলল তা শুনে মাথা আমার চড়কগাছ। এ অঞ্চলে ভ্রমণ করতে গেলে সাথে থাকা চাই যথেষ্ট শুকনো খাবার এবং পানীয়। অথচ আমার সাথে আছে কেবল ৪টা আপেল, তাও আবার কুসকো হতে কেনা। ’আমার নাম ভিক্টোরিয়া’, হাত বাড়িয়ে নিজের পরিচয় নিশ্চিত করল এই রহস্যময়ী। পেশায় একজন আইনজীবী, লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের বেটেন-রুজ শহরে বাস। অবাক হয়ে গেলাম একজন আইনজীবীর এ ধরনের পোশাক দেখে। সেও বুঝতে পারল বোধহয় আমার কনফিউশন। বত্রিশ দাঁত বের করে উত্তর দিল, ‘আমি ছ’মাস আইন প্র্যাকটিস করি আর ছ’মাস ঘুরে বেড়াই মুক্ত বিহঙ্গের মত’, বেশ ঘটা করে নিজকে প্রকাশ করল আমার সহযাত্রী। নড়েচড়ে বসলাম আমি। জার্নিটা মনে হল বেশ লোভনীয় হতে যাচ্ছে।

প্রাথমিক ধাক্কা সামলে ঠিকঠাক হয়ে বসতেই ড্রাইভার জানাল দুঃসংবাদটা, আমরা কোপাকাবানা হয়ে লা পাস যাচ্ছিনা। ও পথ নাকি ধর্মঘটকারীদের দখলে চলে গেছে। রক্তারক্তির খবরও নাকি বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। অজানা আশংকায় মনটা অস্থির হয়ে উঠল। এমন একটা ঘোলাটে পরিবেশে বলিভিয়া যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে কিনা বুঝতে পারলাম না! কোপাকাবানা নামটার সাথে অনেক দিনের পরিচয়। বেশ ক’টা বিখ্যাত স্থাপনা আছে দেখার মত। ১৬০০ শতাব্দীর স্প্যানিশদের তৈরি Basilica of Our Lady of Copacabana পর্যটকদের কাছে খুবই পরিচিত নাম। গির্জাটা দেখতে মৌমাছির মত ভিড় জমায় পৃথিবীর এ কোনায়। তা ছাড়া লেক টিটিকাকার তীরে এটাই বলিভিয়ার মূল শহর। শহরটার সৌন্দর্য নিয়ে ভ্রমণ দুনিয়ায় অনেক উপকথা চালু আছে। লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দূর করলাম কোপাকাবানা না দেখার দুঃখ। খুব একটা লম্বা হলোনা জার্নিটা। ৩০ মিনিটের ভেতর পেরু-বলিভিয়ার সীমান্ত শহর দেসাগুয়াদে্‌র পৌঁছে গেলাম। নড়বড়ে একটা কাঠের সেতুর সামনে এসে বাসটা থেমে গেল। এখানেই পেরুর শেষ। সেতুর ওপারে বলিভিয়া। অন্য একটা বাস ধরতে হবে সীমান্তের ওপার হতে। বলিভিয়ান বাস।

’তুমি কি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক’, প্রশ্ন করল আমার সহযাত্রী ভিক্টোরিয়া।

’না, আমি অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্টে ভ্রমণ করছি, অবশ্য নিউ ইয়র্ক ফিরে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বের শপথ নিতে যাচ্ছি’ উত্তর দিয়ে কারণ জানতে চাইলাম এমন প্রশ্নের।

ভিক্টোরিয়া জানাল, পৃথিবীর এ অঞ্চলে মার্কিন পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণ খুব একটা নিরাপদ নয়। বলিভিয়ান আন্দিজের অনেক বিপদজনক বাঁক আছে, যেখানে ওৎ পেতে থাকে অপহরণকারীর দল। অপহরণ ব্যবসায় মার্কিন নাগরিকদের চাহিদা নাকি সবার শীর্ষে। আমার জ্যাকেটে যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা সম্বলিত একটা পিন দেখে ভিক্টোরিয়া অনুরোধ করল খুলে ফেলার জন্যে। এসব শুনে একেবারেই হতাশ হয়ে পরলাম। এলাম নতুন কিছু দেখব বলে অথচ পদে পদে দেখছি ভয়ঙ্কর সব বাধা। হা হা করে হেসে উঠল মেয়েটা/ বোধহয় বুঝতে পেরেছে আমার মনের অবস্থা।

’ভয় পেওনা, এ গুলোই কিন্তু আন্দিজ দেখার আনন্দ, তাছাড়া তোমার চেহারা অনেকটাই বলিভিয়ানদের মত, বিপদ আসলে মিশে যেও ওদের ভিড়ে’, বলতে গিয়ে হাসিতে ফেটে পরল।

এমন বিপদজনক সুন্দরী যদি ৬ মাস আন্দিজের বাঁকে বিচরণের পরও জীবিত থাকে, তা হলে আমার কেন বিপদ হবে, এমন একটা সমীকরণের ফলাফল বের করে নিজেই নিজকে আস্বস্ত করলাম।

বাস হতে বেরুতেই আন্দিজের ঠাণ্ডা বাতাস শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল। ইতিমধ্যে জেগে উঠেছে সীমান্ত এলাকার জনপদ। চারদিক গিজগিজ করছে মানুষের ভিড়ে। ভ্যান গাড়ি, সাইকেল, অটো রিক্সা, বাস, ট্রাক, হরেক রকম যানবাহন আর পায়ে হেটে হাজার হাজার মানুষ অতিক্রম করছে দুই দেশের সীমান্ত। চারদিকে মনে হল ধূলিঝড় বইছে যেন। মাঝ খানে কয়েক শ ফুট নো ম্যানস্‌ ল্যান্ড। শ্রীহীন ছোট্ট একটা ছাপরা ঘরে ঢুকতে হল পাসপোর্টে পেরুর একজিট সিল নেয়ার জন্যে। অভিব্যক্তিহীন চাউনিতে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল ইমিগ্রেশন অফিসার। ধপাস শব্দে বসিয়ে দিল সীলটা। ’আডিওস‘, যান্ত্রিক পুতুলের মত উচ্চারন করল বিদায় বানী।

নো ম্যানস্‌ ল্যান্ডে দাড়াতেই শিরদাঁড়া বেয়ে অন্যরকম একটা অনুভূতি নেমে গেল। আমি এখন কোন দেশে? চোখের সামনে বলিভিয়া আগমনের শুভেচ্ছা। পিছন ফিরে তাকালেই দেখা যাচ্ছে পেরু ভ্রমণের ধন্যবাদ বানী। এই মুহূর্তে আমার কোন দেশ নেই! ভাবতেই মনে হল এ কয়েক শ ফুটের আমিই অলিখিত বাদশাহ্‌। এখানে নেই কোন ইমিগ্রেশন, নেই পুলিশের বাঁকা চাউনি। প্রফুল্ল মনে দূরত্বটুকু পার হলাম।

বলিভিয়া! অফিসিয়াল নাম প্লুরিন্যাশনাল ষ্ট্যেইট অব বলিভিয়া। কোন সমুদ্র বন্দর ছাড়াই মধ্য দক্ষিণ আমেরিকার একটি দেশ। দেশটার পূব এবং উত্তর দিকে ব্রাজিল, দক্ষিণে প্যরাগুয়ে এবং আর্জেন্টিনা, পশ্চিম দিকে চিলি এবং পেরু। ১৬ শতাব্দীতে স্প্যানিশরা দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশের মত এ দেশটিতেও নিজদের প্রভুত্ব কায়েম করে। ১৬ বছর এক নাগাড়ে যুদ্ধের পর ১৮০৯ সালে নিজদের স্বাধীন বলে ঘোষণা দেয় বলিভিয়ানরা। কবর রচিত হয় উপনিবেশবাদের। সাইমন বলিভারের নামে দেশটার নাম রাখা হয় বলিভিয়া। উপনিবেশবাদের বিদায় হলেও তাদের স্প্যানিশ ভাষাকে বিদায় জানাতে পারেনি এ দেশের মানুষ। যদিও শত বাধা বিপত্তি নিয়ে এখনো টিকে আছে এদের আঞ্চলিক ভাষা আয়মারা এবং কোয়েচুয়া। জনসংখ্যা মাত্র ৯০ লাখ।

কালো পোশাক এবং হাতে কালাশনিকভ রাইফেল নিয়ে অল্প ক’জন পুলিশ পাহারা দিচ্ছে সীমান্ত এলাকা। নিজদের মধ্যেই গল্পে নিয়ে ব্যস্ত ওরা, সীমান্ত পেরিয়ে কে এলো আর কে গেল তার দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। আমাদের দেশে টোল আদায়ের ঘরগুলোর মত ছোট্ট একটা বুথে ঢুকতে হল বলিভিয়ার ভিসা নিতে। ইমিগ্রেশনের সাথে একটা শব্দও বিনিময় হলোনা। ৩ মাসের ভিসা দিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হল দেশটায়। দাঁত বের করা হাসিতে গ্রাসিয়াস জানিয়ে পা রাখলাম আরও একটা নতুন দেশে, বলিভিয়া। কয়েক শ ফুট দূরেই দক্ষিণ আমেরিকার অন্য একটা দেশ পেরু, অথচ পার্থক্য চোখে পরার মত। চারদিকে অনিয়ম আর দৈণ্যতার রাজত্ব এখানে। ঠেলা রিক্সা, ভ্যান গাড়ি আর স্কুটারগুলো রাস্তা আটকে অপেক্ষা করছে যাত্রীর। একে অপরকে গালাগালি দিচ্ছে চড়া গলায়। আমাদের আরিচা ঘাটের মত ট্রাক আর বাসের কাফেলা দাড়িয়ে আছে সাড়িবদ্বভাবে। কিন্তু ড্রাইভারদের আশপাশ কোথাও দেখা গেলনা। আবারও অজানা আশংকায় মনটা কেপে উঠল। পুনো হতে ছেড়ে আসা বাস যাত্রীদের একটা জায়গায় জমা হতে দেখে ওদিকেই পা বাড়ালাম। সহযাত্রী ভিক্টোরিয়া আমাকে দেখে বত্রিশ দাঁত বের করে হাসল। তার পরনের কাপড় আরও বিপদজনক ভাবে কমে গেছে ইতিমধ্যে। অবাক হওয়ার মত কাণ্ড, এ সবের সময় পেল কখন মেয়েটা! অপেক্ষার যেন শেষ নেই। বাস আসার কোন লক্ষন দেখা গেলনা। চিন্তার রেখা ফুটে উঠল লা-পাসগামী যাত্রীদের কপালে। ঘন্টাখানেক পর ট্যুর কোম্পানির একজন এসে জানাল রাস্তায় প্রচণ্ড হাংগামা চলছে, এক সপ্তাহ হল এ লাইনে বাস চলাচল বন্ধ। বাধা পেরিয়ে দু’একটা বাস নাকি  চেষ্টা করেছিল লা-পাস পৌছার, কিন্তু হরতালকারীদের তাড়া খেয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে। সরকার এবং দেশের ট্রেড ইউনিয়নগুলোর মধ্যে বেশ কিছু ইস্যু নিয়ে টানাপোড়ন চলছে, তাই অনির্দিষ্ট কালের এই হরতাল। । পিন পতনের নীরবতা নেমে এলো যাত্রীদের মাঝে। আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল একটাই চিন্তা, আজ শনিবার এবং আমাকে সোমবার মধ্যরাতে লিমা হতে নিউ ইয়র্কের ফিরতি ফ্লাইট ধরতে হবে। ভিক্টোরিয়ার অট্ট হাসিতে চিন্তায় ছেদ পরল।

‘এতটা হতাশ হওয়ার কোন কারণ নেই, উপায় একটা নিশ্চয় বেরিয়ে আসবে’, ফুড় ফুড়ে মেজাজে বলল সে।

খুব কাছে এসে ফিস ফিস করে বলল, অতিরিক্ত কিছু পয়সা ঢালতে হবে আমাদের, তবেই নাকি হারামির বাচ্চারা নড়তে শুরু করবে।

মেয়েটার এমন আজব তথ্যে অবাক হলাম আমি, এ যে দেখছি বাংলাদেশের কার্বন কপি! ১০ ডলার করে চাঁদা উঠানো হল যাত্রীদের কাছ থেকে। সবাই বিদেশী, এ নিয়ে কেউ বেশী উচ্চবাচ্য করল না। মনে মনে ট্যুর কোম্পানির ১৪ গুষ্টি উদ্ধারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল যাত্রীদের ক্ষোভ। যাত্রী ড্রাইভারের মধ্যে গোপন শলা-পরামর্শ এবং লেনা-দেনা শেষ হওয়ার ১৫ মিনিটের মধ্যে ছোট আকারের দু’টা বাসকে দেখা গেল দিগন্ত রেখায়। একই কোম্পানির বাস। একেবারে যমজ ভাইয়ের মত। কিছু খাবার আর পানের জন্য দু বোতল পানি কিনে উঠে পরলাম একটা বাসে। ভিক্টোরিয়া আগেই উঠে গেছে এবং জানালার পাশের একটা সীট দখল নিয়ে অপেক্ষা করছে আমার। ধন্যবাদ জানিয়ে বসে পরলাম।

‘তোমাকে জানাইনি আতংকিত হবে বলে, রাস্তার অবস্থা কিন্তু আসলেই খারাপ, সব কিছুর জন্যে তৈরি থেক।’, বাসটা ছাড়তেই দুঃসংবাদটা দিল ভিক্টোরিয়া।

উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তার অবসান ঘটিয়ে ১৮ জন যাত্রী নিয়ে বাসটা নড়তে শুরু করল শেষ পর্যন্ত। স্বস্তির পাশাপাশি এক ধরনের নীরবতা গ্রাস করে নিলো বাসের পরিবেশ। কারও মুখে কোন কথা নেই। সবাই ক্লান্ত এবং সামনে কি অপেক্ষা করছে এ নিয়ে চিন্তিত। প্রায় ৫ ঘণ্টার জার্নি। কথা-ছিল সকাল ৮টায় পুনো হতে রওয়ানা হয়ে দুপুরের খাবার খাব লা-পাস’এ। হাত ঘড়িটার দিকে তাকালাম, সকাল ১১টা। সবকিছু ঠিক ঠাক চললে বিকাল ৪টার ভেতর লা-পাস পৌছার কথা। মনে মনে হিসাব কষলাম, একটু দেরী হলেও গন্তব্যে পৌঁছেই লাঞ্চ করব। সাথে ক’টা আপেল, কলা এবং দু’বোতল পানি আছে, চলে যাবে আপাতত। বাসে হিটার চালু আছে, পরনের গরম কাপড় খুলে হল্কা হয়ে বসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দৃষ্টি হতে মিলিয়ে গেল সীমান্ত শহরটা। যানবাহন আর মানুষের এলোমেলো চলাফেরা বদলে দিল আন্দিজের সুশৃঙ্খল চূড়াগুলো। পাহাড় আর পাহাড়! কোল ঘেঁষে বয়ে যাচ্ছে খরস্রোতা নদী। মাঝে মধ্যে ভূতের মত উদয় হচ্ছে দু’একজন আন্ডিয়ান তরুণ-তরুণী, হাতে চাষাবাদের যন্ত্রপাতি। কৃষিকাজ হচ্ছে হয়ত কোথাও। কিন্তু যতদূর চোখ যায় লোকালয়ের কোন চিহ্ন দেখা গেলনা।

আকাশটাকে আজ একটু বেশী রকম নীল মন হল। ভার্টিকেল এঙ্গেলে চোখ ঘুরালে শূন্যে উড়ে যাওয়া চিলগুলোকে মনে হবে স্থির হয়ে উড়ছে। দু’একটা চিল মাঝে মধ্যে গোত্তা মেরে নীচে নামছে শিকারের ধান্ধায়। রাস্তার সমান্তরালে বয়ে যাওয়া নদীটার দু’পাশে হঠাৎ করে আবাদি জমির উদয় হল। আলু, পেয়াজ আর ভুট্টার খণ্ড খণ্ড জমি। গাছের খোল ব্যবহার করে নদী হতে পানি উঠানোর ব্যবস্থা মনে করিয়ে দেয় জীবন এখানে বয়ে যাওয়া নদীর মত অত সহজ নয়। প্রতি খণ্ড চাষাবাদের পেছনে নিশ্চয় লুকিয়ে আছে পাহাড়ি মানুষের খেটে খাওয়া জীবনের দীর্ঘশ্বাস। নেশা ধরে আসে প্রকৃতির এই অন্তহীন ক্যানভাস একাধারে গিলতে গেলে। বাসের একটানা যান্ত্রিক শব্দে তন্দ্রা-মত এসে গেল। সকালে ঘটে যাওয়া উটকো ঝামেলাগুলো এই ফাকে মাথা হতে নেমে গেল। পাশে বসা বিপদজনক সুন্দরীকেও আন্দিজের বিশালতার কাছে খুব ছোট মনে হল। গাঁটের পয়সা খরচ করে এতদূর এসেছি আন্দিজের সানিন্ধ্য পেতে, স্থানীয় মানুষ এবং তাদের জীবনের সাথে পরিচিত হতে। সে দিকে মনোনিবেশ করে ভুলে গেলাম উটকো এক সুন্দরীর উপস্থিতি।

আন্দিজ! শব্দটার ভেতর লুকিয়ে আছে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা, অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার স্বপ্নিল হাতছানি। পাহাড় পর্বত ঘুরে বেড়ানো যাদের নেশা তাদের ধমনীতে এই নামটা এক ধরনের কম্পন তৈরি করে। যার উৎপত্তি প্রকৃতির প্রতি অকৃপণ ভালবাসা হতে। এন্ডিসের উপর একাধিক বই পড়েছি, ডকুমেন্টারি দেখেছি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করেছি এর কাব্যিক কল্পনায়। কিন্তু চোখে দেখার কাছে এগুলো এ মুহূর্তে অর্থহীন মনে হল। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে যাওয়া রাস্তাটার বর্ণনাও মনে হল বই, আর্টিকেল অথবা ডকুমেন্টারিতে জীবন্ত করতে পারেনি। বাইরের স্তব্ধতাকে মনে হল অতি যত্নের সাথে কেউ লালন করছে হাজার বছর ধরে। পাহাড়ের চূড়াগুলোকে মনে হবে নীরব সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে কোটি বছর উপর। কোন একটা চূড়ায় উঠে চীৎকার দিলে হয়ত শত শত প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসবে সে চীৎকার। ভাঙবে সহস্রাব্দীর ভৌতিক নীরবতা। আমাদের বাসটা উঁচু নিচু এবং আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে ছুটে চলল প্রচণ্ড গতিতে।

’তুমি কি একটা জিনিষ লক্ষ্য করেছ?’ ভিক্টোরিয়ার প্রশ্নে ছুটে গেল তন্দ্রা। নতুন কোন সমস্যার প্রসঙ্গ টানতে যাচ্ছে সে। গন্ধ পেলাম গলার সতর্ক সূরে। ’পাহাড় ছাড়া এ মুহূর্তে অন্যকিছু লক্ষ্য করছিনা আমি’, অনেকটা তিরিক্ষে মেজাজে উত্তর দিলাম। উত্তরে সে যা বলল তা সত্যি ভাবিয়ে তুলল। দু’লেনের রাস্তা, অথচ যানবাহন চলছে শুধু এক লেনে। অর্থাৎ বিপরীত দিক হতে কোন গাড়ি আসছে না। ভিক্টোরিয়ার ইংগিতটা বুঝতে অসুবিধা হলোনা। বাংলাদেশের মানুষ আমি, কিছুদিন আগে হাসিনার লাগাতার পর্ব ’উপভোগ’ করে এসেছি মাত্র। পূর্বাভিজ্ঞতা হতে বলতে পারি, সামনে সমস্যা। আকাশের পাখীগুলোকেও দেখলাম শুধু একদিকে উড়ে যাচ্ছে। ভিক্টোরিয়ার অভিজ্ঞতা বলছে, খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে। অন্য যাত্রীদেরও দেখলাম নড়েচড়ে বসতে, কৌতূহলী হয়ে উঠছে সবাই। দূর হয়ে যাওয়া উৎকণ্ঠা গুলো বিদ্যুৎ গতিতে ফিরে এলো নতুন করে।

ছোট দু’একটা পাথর দিয়ে শুরু। কিছুদূর যেতেই বাড়তে থাকল পাথরের সংখ্যা এবং এর আকৃতি। নিবিড়ভাবে বিছানো আছে সমস্ত পথজুড়ে। যেন বিশাল আয়তনের শিলাবৃষ্টি হয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। কিন্তু তাতে বাসের চাকা বিশেষ কোন বাধা পেলোনা। এগুতে থাকলাম আমরা। বিশাল একটা বাক পেরুতেই দৃশ্যটা ভেসে উঠল দিগন্ত রেখায়… শত শত গাড়ি। যতদূর চোখ যায় শুধু গাড়ি আর গাড়ি। থেমে আছে লাইন ধরে। মাইলের পর মাইল। ছোটখাটো পাথর নয়, বিশাল আকারের বোল্‌ডার দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে পথ। এক কদম এগোবার কোন উপায় নেই। আমাদের যমজ বাসটা  ঠিক পেছনে এসে হুমড়ি খেয়ে থেমে গেল। সোজা কথায় আটকে গেছি আমরা। আন্দিজের এই গহীন রাজ্যে জিম্মি হয়ে গেছি গরীব দেশের গরীবিপনার কাছে। আকাশ ভেঙ্গে পড়ল সবার মাথায়। আবারও আমার মাথা জুড়ে পুরানো চিন্তাটা ঘুরপাক খেতে শুরু করল, আজ শনিবার এবং সোমবার মধ্যরাতে লীমা হতে নিউ ইয়র্কের ফিরতি ফ্লাইট ধরতে হবে। ভিক্টোরিয়াকে দেখে মনে হল বেশ উপভোগ করছে সে নতুন বাস্তবতা। ‘আমি জানতাম এমনটা হবে, এ জন্যেই এদিকে আসা’, উৎফুল্ল হয়ে জানাল সে। কথা বলে জানা গেল ওকালতির পাশাপাশি দক্ষিণ আমেরিকার রাজনীতি নিয়ে বই লিখছে সে। এ অঞ্চলে ভেনিজুয়েলান নেতা হুগো সাভেজের প্রভাব তার আগ্রহ। বলিভিয়ায় এবো মরালেস নামের নতুন এক নেতার উত্থান হয়েছে, যে আদর্শ হিসাবে বেছে নিয়েছে হুগো সাভেজের কথিত সমাজতান্ত্রিক পথ। তার উত্থানকে কাছ হতে দেখার জন্যেই এই জার্নি। উদ্ভট পোশাক দেখে মেয়েটা সম্পর্কে আজেবাজে ধারণা করায় নিজকে অপরাধী মনে হল এ মুহূর্তে। ’চল সামনে গিয়ে দেখে আসি’, আহ্বান জানাল মেয়েটা। বাসের ট্যুর গাইড ইতিমধ্যে সাবধান করে দিয়েছে এ ধরনের এডভেঞ্চার হতে দূরে থাকতে।

’চল, ঘুরে আসি’, সায় দিয়ে নেমে পরলাম। সাথে যোগ দিল আরও গোটা তিনেক সহযাত্রী। চারদিক চোখ বুলাতেই কেন জানি ঢাকার কথা মনে হয়ে গেল। রাজনীতির গ্যারাকলে আটকে একদিন ৫ ঘণ্টা দাড়িয়ে থাকতে হয়েছিল কাঁচপুর ব্রিজের উপর। সামনে শেখ হাসিনার সমর্থনে মিছিল, কিছুক্ষণ পর শুরু হল ধাওয়া আর পালটা ধাওয়া, সাথে নির্বিচার ভাংচুর। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো অজান্তেই। আন্দিজের শো শো বাতাস আর চোখে মুখে শীতের কনকনে ঝাঁপটা ফিরিয়ে আনল কঠিন বাস্তবতায়। হঠাৎ করে কেন জানি গান গাইতে ইচ্ছা করল আমার, প্রিয় সেই গানটা; ’নাই টেলিফোন নাইরে পিওন নাইরে টেলিগ্রাম…। ভিক্টোরিয়া ফিস ফিস করে বলল, ‘মন খারাপ করে লাভ নেই, বরং উপভোগ কর যা দেখছ, এমন অভিজ্ঞতার সুযোগ জীবনে দ্বিতীয়টা নাও আসতে পারে‘।

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৪
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৫

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৪

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ১
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ২
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৩

মাইল খানেক হাটার পর জটলাটা চোখে পরল। ড্রাইভার এবং ট্যুর গাইডদের সাথে পাহাড়ি এলাকার মাম্বো জাম্বো টাইপের ক’জন কি নিয়ে যেন দরকষাকষি করছে। দু’পক্ষকেই বেশ উত্তেজিত মনে হল। বন্দী দশা সইতে না পেরে অনেক যাত্রীও নেমে এসেছে খোলা বাতাসে। অধৈর্য এবং উৎকণ্ঠার ছাপ সবার চোখে মুখে। ৭ দিন ধরেই চলছে অবরোধ নামের ক্যাট & মাউস গেইম। আজ শনিবার, অনেকেই ভেবেছিল অন্তত ছুটির দিনটায় রেহাই পাওয়া যাবে ধর্মঘটীদের টাগ অব ওয়্যার হতে। দেশের ট্রেড ইউনিয়নগুলো চাইছে বলিভিয়ান সরকার গ্যাস কোম্পানিগুলো জাতীয়করণ করুক। তাদের অভিযোগ, বিদেশীরা যুগ যুগ ধরে এ দেশের গ্যাস সম্পদ দুর্নীতিবাজ সরকারগুলোর সহযোগিতায় বিদেশে পাচার করে নিজদের পকেট ভারী করছে। পয়েন্ট অব নো রিটার্নে চলে গেছে আদিবাসীদের বেচে থাকা। মূলত তাদের স্বার্থেই এ ধর্মঘট। চারদিক তাকালে মনে হবে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কোন এক আশ্চর্য্যতম গলিতে বন্দী হয়ে গেছি আমারা। একদিকে আন্দিজের বিশালতা, পাশাপাশি মাইলের পর মাইল খোলা মাঠ, সমান্তরালে বয়ে যাচ্ছে খরস্রোতা নদী। এখানে আধূনিক প্রযুক্তি নির্বাসিত, নেই মুঠো ফোনের রাজত্ব। বহুদূরে ক’টা জংলী মহিষ এবং আলপাকাদের অলস চলাফেরা মনে করিয়ে দেয় সৌরজগতের অন্যকোন গ্রহ নক্ষত্র নয়, এ আমাদেরই প্রিয় পৃথিবীর কোথাও না কোথাও।

আন্দিজের যে বাকটাতে আমরা আটকে আছি তার শেষ প্রান্তটা বেশ অদ্ভুত দেখাল দূর হতে। রাস্তার দু’পাশের পাহাড়গুলো হঠাৎ করে যেন এক বিন্দুতে মিলে গেছে। গুহার মত দেখায় নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া পাকা রাস্তা হতে দেখলে। মোক্ষম জায়গা ট্রাফিক আটকানোর! হঠাৎ করে সামনের জটলায় সবাইকে কেমন উত্তেজিত মনে হল। মিনিট পাঁচেক না যেতেই এক দল অন্য দলকে ধাওয়া শুরু করে দিল। চারদিকে বন্য চীৎকারে খানখান হয়ে গেল আন্দিজের নির্জনতা। আঙ্গুল উঁচিয়ে পাহাড়ের দিক কি যেন দেখাতে চাইছে অনেকে। ও দিকে চোখ ফেরাতেই হিম হয়ে গেল সমস্ত শরীর। কিং কং কায়দায় হাতে পাথরের বড় বড় টুকরা এবং তীর ধনুক নিয়ে আদিবাসীরা ঘেরাও করে ফেলেছে আমাদের। ভেতরের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় একসাথে বলে উঠল পালাতে হবে আমাকে। শুধু আমি নই যতদূর চোখ যায় সবাই দেখলাম দৌড়াচ্ছে। পালাচ্ছে যুদ্ধের মাঠে পরাজিত সৈনিকদের মত। পেছনে ধেয়ে আসছে সাক্ষাৎ আজরাইল। কেউ একজন খোলা আকাশের নীচে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছিল, পরনের কাপড় ফেলে দৌড়াতে শুরু করল সে। লিউ টলষ্টয়ের কালজয়ী উপন্যাস ’ওয়্যার এন্ড পিস’ অবলম্বনে তৈরি ছায়াছবির পুনরাবৃত্তি হচ্ছে যেন এখানে। পরনের ভারী জ্যাকেট নিয়ে দৌড়াতে বেশ অসুবিধা দেখা দিল। ভাবলাম ছুড়ে ফেলি। কিন্তু তখনই দেখলাম ভয়াবহ দৃশ্যটা! পাহাড়ের উঁচু হতে ধেয়ে আসছে অসংখ্য পাথর। সাথে ধনুক হতে ছোড়া শত শত তীর। জ্যাকেট ফেলে দেয়ার চিন্তাটা বাদ দিলাম নিরাপত্তার কথা ভেবে। পাগলের মত বেশ কিছুটা পথ দৌড়ানোর পর বুঝতে পারলাম তীর ধনুকের বলয় হতে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। ওগুলো টার্গেট মিস করে লুটিয়ে পরছে পাথরের উপর। সাথে সৃষ্টি করছে এক ধরনের বন্য আওয়াজ। দৌড় থামানো গেলনা কারণ সামনে পেছনে সবাই এ কাজটা করছে জীবন বাজি রেখে। হঠাৎ মনে হল দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। থামতে বাধ্য হলাম। নাক হতে রক্তের ফোয়ারা বইতে শুরু করেছে ততক্ষণে। সমুদ্র পৃষ্ট হতে অনেক উঁচুতে আমরা, এমন একটা উচ্চতায় কেনীয়ান দৌড়বিদরাও দু’বার চিন্তা করবে ম্যারাথন দৌড়ে শামিল হতে। প্রায় জ্ঞান হারানোর মত অবস্থা। এক পা এগুনোর শক্তি অবিশিষ্ট নেই শরীরে। শুয়ে পরলাম বাধ্য হয়ে। জ্যাকেটটা টেনেটুনে মরার মত পরে রইলাম কিছুক্ষণ। দূরের চিলগুলোকে মনে হল আমার দিকেই তাকাচ্ছে যেন। চিল নয়, বড় বড় শকুন কোত্থেকে এসে হাজির। অনবরত চক্কর দিচ্ছে মাথার উপর। অনেক গল্প উপন্যাসে পড়েছি ক্ষুধার্ত শকুনের দল রক্তের গন্ধ পেলেই ছুটে আসে। খুবলে খায় খুঁজে পাওয়া শিকার। পাখীর শিকার হয়ে আন্দিজের এ অঞ্চলে কংকাল হওয়ার ইচ্ছা হলোনা, তাই জোর করে দাড়াতে হল। আমার মত বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত এবং প্রায় অর্ধমৃত অনেককেই দেখলাম টেনেটুনে হাঁটছে। সবাই কম বেশী আহত। অনেকের নাক দিয়েই রক্ত ঝরছে। বেশ কিছুটা হেটে প্রথম বাঁকটা পার হতেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। যতদূর চোখ যায় শুধু মাঠ আর মাঠ। কোন এক দৈব মন্ত্রবলে হাওয়া হয়ে গেছে  অপেক্ষমাণ বাসগুলো।

শুরু হল আসল চিন্তা। সাথে মানিব্যাগ ছাড়া অন্যকিছু নেই। পাসপোর্টটাও রেখে এসেছি বাসে। চিন্তার সব দুয়ার একসাথে বন্ধ হয়ে গেল যেন। কোথা হতে শুরু করব বুঝতে পারছিলামনা। মানিব্যাগ থাকলেও নগদ বলতে শ’খানেক ডলার, সাথে দু’টা ক্রেডিট কার্ড আর বলিভিয়ার কিছু বলিভিয়ানো। কিন্তু এসব কাজে লাগিয়ে কি করে লোকালয় পর্যন্ত পৌঁছবো তার কোন কাঠামো দাড় করাতে পারলাম না। এক কথায় আমি হারিয়ে গেছি আন্দিজ পর্বতমালার বাকে। মরে কংকাল হয়ে গেলেও কেউ আমার খোজ পাবেনা। মাথায় কোন কিছুই ঢুকতে চাইছে না। বসে পরলাম ধপাস করে। নাকের রক্তটা থামানো যাচ্ছেনা কিছুতেই। ভিক্টোরিয়ার কথা মনে হল হঠাৎ করে। সে সাথে থাকলে একটা কিছু বেরিয়ে আসত। কিন্তু মাইল-খানেকের ভেতর মেয়ে মানুষের কোন ছায়া দেখা গেলনা। কেন জানি মনে হল সে নিশ্চয় মিশে গেছে আদিবাসীদের সাথে। হয়ত তার মিশনটাই ছিল এখানে আসার এবং এই আউলা চক্কর কাছ হতে দেখার। মিনিট দশেক বিশ্রাম নিয়ে আবারও হাটতে শুরু করলাম। সামনে আরও একটা বাঁক। দেখতে হবে কি আছে ঐ বাঁকটার পর। গায়ের জোড় আর শরীরের জোর একসাথে করে কচ্ছপ গতিতে এগিয়ে চললাম।

বাঁকটা পার হতেই চোখে পরল দৃশ্যটা। মাইল দু’এক দূরে সাদা সাদা বিন্দুর মত দেখাচ্ছে অপেক্ষমাণ বাসগুলোকে। হঠাৎ মনে হল স্বপ্ন দেখছি! যেন অমল ধবল মেঘরাজ্যে উড়ছি আমি। সাথে বসন্তের পাগলা হাওয়া। জ্যাকেটটা খুলে মাথার উপর ঘুরাতে শুরু করলাম। দূর হতে কেউনা কেউ দেখে থাকবে নিশ্চয়ই। দু’মাইলের পথ, ইচ্ছে হল দু’মিনিটে পাড়ি দেই। আমার বিশ্রাম দরকার, সারা জীবনের বিশ্রাম। কিন্তু বাতাসের শো শো আওয়াজ আর হাড্ডি কাঁপানো কনকনে শীত বাধা হয়ে দাঁড়াল বাস ও বিশ্রামের মাঝে। মাথার উপর সূর্যটাকেও কেমন ক্লান্ত দেখাল। কিন্তু এ মুহূর্তে আমার ক্লান্ত হওয়া চলবে না… আজ শনিবার এবং সোমবার মধ্যরাতে লিমা হতে নিউ ইয়র্কের ফিরতি ফ্লাইট ধরতে হবে।

দূর হতে দু’মাইলের পথ মনে হলেও দূরত্ব বোধহয় এক মাইলের বেশী ছিলনা। ক্লান্ত, শ্রান্ত এবং বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে বাসটার কাছাকাছি আসতেই স্বাগত জানাল পটকা মাছের মত ফুলে উঠা কতগুলো মুখ। ডায়নামাইটের মত বিস্ফোরিত হল ট্যুর গাইড, সাথে গলা মেলাল ড্রাইভার এবং তার হেল্পর। দু’একজন যাত্রীও ইনিয়ে বিনিয়ে কি যেন বলতে চাইল। এতকিছু শোনার মত শরীর ছিলনা।  বসে পরলাম ধপাস করে এবং ভুলে যেতে চাইলাম গত কয়েক ঘণ্টায় ঘটে যাওয়া অলৌকিক ঘটনাগুলো। পাসপোর্টের কথা মনে হতেই হুস ফেরলো। লাগেজ খুলে জায়গা-মত হাত দিতেই অনুভব করলাম মূল্যবান ডকুমেন্টটার উপস্থিতি। সব আগের মতই আছে শুধু জীবন হতে খসে  ৩টা ঘণ্টার মত সময়। হেল্পার পানি এগিয়ে দিল নাক-মুখের রক্ত পরিষ্কার করার জন্যে। অনিচ্ছা স্বত্বেও নামতে হল বাস হতে।

পরিষ্কার হয়ে বাসে ফিরতেই হাজারো প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল সহযাত্রীরা। মূল প্রশ্ন, মেয়েটা কোথায়? ট্যুর গাইড সবার হয়ে অফিসিয়ালি করল প্রশ্নটা। আমি সাফ জানিয়ে দিলাম ভিক্টোরিয়া ছিল আমার সহযাত্রী মাত্র। বাসে পরিচয় এবং তার সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। আমার বক্তব্যের পক্ষে সমর্থন পাওয়া গেল দু’এক জন যাত্রীর। বাস ড্রাইভার জানাল আর মিনিট দশেক অপেক্ষা করবে, মেয়েটা না ফিরলে সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া তাদের গত্যন্তর নেই। ব্যাপারটা ভাবতেই আমি শিউরে উঠলাম, কি হত বাসটা যদি এই জনশূন্য এলাকায় আমাকে ফেলে চলে যেত! এবার আমার প্রশ্ন করার পালা, ভেতরের সব রাগ দলা করে ছুড়ে দিলাম ট্যুর গাইডের মুখে, কঠিন গলায় জানতে চাইলাম, আমাদের ফেলে বাসটা কেন পালিয়েছিল? এই প্রথম জানলাম একটা বাসের মূল্য আমার জীবনের চেয়ে অনেক বেশী। এমন একটা তথ্য দিতে ট্যুর গাইডের গলাটা সামান্য একটু কাঁপলোনা। হজম করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলনা। এ ধরনের কথাবার্তা তৃতীয় বিশ্বের অনৈতিক এবং মানসিকভাবে পঙ্গু মানুষগুলোর পক্ষেই বলা সম্ভব, এমনটা ভেবে নিজকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলাম।

আরও আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করল বাসটা। কিন্তু ভিক্টোরিয়ার  হদিস পাওয়া গেলনা। আমাদের যমজ বাসটা ইতিমধ্যে রওয়ানা হয়ে গেছে। ট্যুর গাইড জানাল মূল রাস্তা হতে বের হয়ে মাইল খানেক গেলে নতুন একটা ট্রেইল পাওয়া যাবে। এবং সে পথটা ধরতে পারলে আরও স্বল্প সময়ে আমরা লা-পাস পৌঁছতে পারব । আমার কাছে এসব কথা রূপকথার মত মনে হল। এখান হতে জাহান্নামের দিকে রওয়ানা দিলেও আমার কিছু আসে যায়না, লা-পাস পৌঁছার আগে বাস হতে আমি নামছি না। অপেক্ষা শেষে বাসটা রওয়ানা দিল উলটো পথে। যতক্ষণ সম্ভব জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলাম ফেলে আসা পথটার দিকে। রহস্যময়ী ভিক্টোরিয়ার হাজারো রহস্যের জন্ম দিয়ে হারিয়ে গেল আন্দিজের বাঁকে।

সামনের নড়বড়ে সেতুটা দেখে অন্তরাত্মা কেপে উঠল আমার। দৈত্যের তাণ্ডবে বয়ে যাওয়া খরস্রোতা নদীটা পার হতে গেলে সেতুটা অতিক্রম ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই। ড্রাইভারের তাগাদায় নামতে হল প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে। দূর হতে যতটা দুর্বল মনে হয়েছিল, বাস্তবে ততটা দুর্বল মনে হলোনা। কোন দৈব ঘটনা ছাড়াই পারাপার পর্ব শেষ হল। টেনেটুনে শরীরটাকে কোন রকমে বাসে ঠেলে বসে পরলাম আগের সীটটায়। শুরু হল আমাদের যাত্রা।

চোখ বুজে মৃতের মত পরে রইলাম অনেকক্ষণ। রাজ্যের ঘুম এসে ভর করল শরীরের উপর। পেটের ক্ষুধাও জানান দিচ্ছে নিজের অস্তিত্ব। ভয়, বিস্ময় আর অনিশ্চয়তা গ্রাস করে নিলো ষষ্ঠইন্দ্রীয়। চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে অনেক আগেই। এবার শরীরের পালা। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি টের পাইনি। চোখ খুলে জানালার বাইরে তাকাতে যে দৃশ্য চোখে পরল তা দেখে দূর হয়ে গেল সব ক্লান্তি। শুধু মাঠ আর মাঠ। সবুজের বুক-চিড়ে চলে গেছে সূক্ষ্ম একটা ট্রেইল। একদিকে বরফ আচ্ছাদিত আন্দিজের চূড়া।  নৈসর্গিক প্যানোরমার অন্যপাশেই অঘটনে ভরা পাকা হাইওয়ে। খোলা মাঠে এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছে ভেড়া এবং আলপাকার দল। মাঝে মধ্যে দু’একজন রাখাল অবাক হয়ে লক্ষ্য করছে আন্দিজের দুর্গম অঞ্চলে আমাদের অনিশ্চিত যাত্রা। নদীটাকে দেখা গেলনা কাছাকাছি কোথাও। খণ্ড খণ্ড জমিতে ভুট্টার চাষাবাদ দেখে আন্দাজ করা যায় খুব কাছ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে হয়ত। বন্য পশুর লাশ নিয়ে টানাটানি করছে শকুন, চিল আর কয়োটির দল। এমন দৃশ্য চোখে পরছে কিছুক্ষণ পর পর। দিগন্ত জুড়ে রাজত্ব করা সূর্যটাকে আগ্নেয়গিরি হতে বেরিয়ে আসা লাভার মত দেখালো। বাইরে কি আসলেই এত গরম? জানালাটা সামান্য খুলতেই আন্দিজের শো শো হাওয়া আর তীব্র শীত এসে ভরিয়ে দিল বাসের ভেতরটা। সামনের সীটে বসা অস্ট্রেলিয়ান স্বামী-স্ত্রী বিনীত অনুরোধ করল জানালাটা বন্ধ করতে। ভিক্টোরিয়ার কথা মনে হতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে থাকলে বিরামহীন ধারাবর্ণনায় মাতিয়ে রাখত বাসের নীরবতা। বিন্দু হতে বৃত্তের মত দিগন্তরেখায় ফুটে উঠলো সাদা ধবধবে বাসটার চেহারা। আমাদের যমজ বাস। ট্রেইলটাকে আড়াআড়িভাবে আটকে রেখে ঠায় দাড়িয়ে আছে মাঝ পথে। অভিজ্ঞ মন বলছে সামনে বিপদ!

আসলেই বিপদ… সামনের চাকা ফুটো হয়ে বাসটা প্রায় ছিটকে পরেছে ট্রেইল হতে। কাছাকাছি এসে নিথর হয়ে গেল আমাদেরটাও। যাত্রীরা নেমে গেল বিনা বাক্য ব্যয়ে। আমি বসে রইলাম অনাগত আশংকা নিয়ে। কিছুক্ষণ পর ট্যুর গাইড এসে জানালো চাইলে নীচে নামতে পারি। দুঃসংবাদ যে আসবে তা আমার আগেই জানা ছিল। চাকা বদলানো ঝগটা ভেঙ্গে গেছে ইতিমধ্যে! নেমে পরলাম ঘোর নেশাগ্রস্থের মত। নিজকেই দায়ী করলাম এমন গোলক ধাঁধায় আটকে যাওয়ার জন্যে। তবে ভাল সংবাদ বলতে যা বুঝায় তার একটা হল, রাস্তার ঠিক পাশেই ছোট একটা লোকালয় দেখা যাচ্ছে এবং হাত পাওয়ালা দু’একজন আদমকে দেখা যাচ্ছে ঘুরা ফেরা করতে। ইতিমধ্যে স্থানীয় একজন বাইসাইকেল নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেছে কোন এক রহস্যপুরী হতে নতুন একটা ঝগ আনবে বলে।

সময় বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সেই রাজপুত্রের আর দেখা নেই। ততক্ষণে ক্ষুধা বাবাজি পেটে ঢোল বাজাতে শুরু করে দিয়েছে। শক্ত কোন খাবার পেটে যায়নি অনেকক্ষণ। আমার হাতে মাত্র দু’টা আপেল। পানির শেষ খালি বোতলটা এখনো ডাস্টবিনে ফেলা হয়নি। চমৎকার একটা দৃশ্য দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল। দু’টা বাসের সব যাত্রীদের ষ্টকের খাবার এক জায়গায় করা হচ্ছে। দু’টা আপেল দিয়ে আমিও যোগ দিলাম অসময়ে গড়ে উঠা আন্তর্জাতিক সংহতিতে। আমি ছাড়া বাকি সবাইকে মনে হল আপদ-কালীন সময়ের প্রস্তুতি হয়েই যেন ভ্রমণে বের হয়েছে। সবাই পেট পূরে খেয়ে বেরিয়ে পরল পাশের লোকালয় দেখবে বলে। পরনের জ্যাকেটটা বিছিয়ে মাটিতে শুয়ে পরলাম একটু ঘুমবো বলে। ১৩ই অক্টোবর, ১৯৭২ সালে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটা মনে করার চেষ্টা করলাম। ৪৫ জন যাত্রী নিয়ে চিলি-গামী উরুগুয়ের একটা বিমান বিধ্বস্ত হয়েছিল আন্দিজের চূড়ায়। ১২ জন সাথে সাথে মারা যায়। বাকিরা মাইনাস ৩০ ডিগ্রী সেঃ তাপমাত্রার সাথে পাল্লা দিয়ে শুরু করে বাচার লড়াই। খাবার হিসাবে মৃত সহযাত্রীদের মাংস ভক্ষণ করতে বাধ্য হয় অনেকেই। এভাবে একটানা ৭২ দিন লড়াই করে শেষ পর্যন্ত ১৬ জন জীবন্ত ফিরে আসে মূল ভূখণ্ডে। পৃথিবী চমকে উঠে এমন একটা লোমহর্ষক জার্নির খবর পেয়ে। আমাদের ভাগ্য কি শেষ পর্যন্ত এমনটাই হতে যাচ্ছে? আবোল তাবোল ভাবনায় মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। প্রথমত আমরা আন্দিজের চূড়ায় নই, দ্বিতীয়ত পাশেই আছে লোকালয়, মূল রাস্তাটাও বেশী দূর নয়, তাছাড়া এটা ২০০৪ সাল, – এমন কতগুলি যুক্তি দাড় করিয়ে নিজেই নিজের কাছে প্রমাণ করলাম আমাদের ভাগ্য অতটা অনিশ্চিত নয়। বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে যোগ দিলাম বাকি যাত্রীদের কাফেলায়। এই প্রথম ক্যামেরাটা বের করলাম ছবি তুলব বলে।

শীতের দাপট মানুষগুলোর শরীর ঝলসে দিয়েছে বাদামী কাবাবের মত। প্রায় সবারই অনেকগুলো দাঁত নেই। নাক দিয়ে বেরুচ্ছে হরেক রকম তরল পদার্থ। দারিদ্র্যতার সাথে রুক্ষ্ন প্রকৃতি যোগ হলে মানুষের জীবন কতটা দুর্বিষহ হতে পারে আন্দিজের এ অঞ্চলটায় না এলে বোধহয় বুঝা যাবেনা। শত বছর বয়সী এক বৃদ্ধার বেশ কটা ছবি তুললাম। সেশন শেষ না হতেই হাত বাড়িয়ে দিল কিছু পয়সার জন্যে। সাথে কিছু স্থানীয় মুদ্রা ছিল, দশ বলিভিয়ানো দিয়ে বেরিয়ে আসলাম বৃদ্ধার আঙ্গিনা হতে। পানির কুয়া পাওয়া গেল একটা জায়গায়। সবার মত আমিও ভরে নিলাম আমার খালি বোতলটা। মনে হল উত্তর মেরুর বরফ গলিয়ে কেউ জমা করেছে কুয়াটায়, নিথর হিম শীতল পানি! সময়টা মন্দ কাটলোনা এমন অনিশ্চয়তার মাঝেও। এ ফাকে সহযাত্রী অনেকের সাথে নতুন করে পরিচয় হল। এক অপরের সাথে ছবি তুলল বিরল মুহূর্তগুলো ধরে রাখবে বলে।

বাতাসের শো শো আওয়াজ আর ধোয়াটে আবহাওয়ার ফাঁক গলে হলিউডের নায়কের মত বেরিয়ে এলো স্বপ্নের সেই রাজপুত্র। হাতে বিশাল একটা ঝগ। এ যেন শত বর্ষ অপেক্ষার পর এক পশলা বৃষ্টির আগমন। খুশীর ফোয়ারা বয়ে গেল যাত্রীদের মাঝে।

বেলা পরে আসছে। রওয়ানা হওয়ার উৎকণ্ঠা সবার চোখে মুখে। সূর্যাস্তের পর আন্দিজের এ এলাকাটা মোটেও নাকি নিরাপদ নয়। বন্য হায়েনা আর অপহরণকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয় অরক্ষিত মাঠ ঘাট । বলিভিয়া পৃথিবীর অন্যতম গরীব দেশ। দুর্নীতির হিংস্র থাবায় ক্ষতবিক্ষত এর রাজনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামো। সামরিক শাসনে দেশটির রয়েছে বিশ্ব রেকর্ড। এতগুলো বিদেশী পর্যটক এমন একটা অরক্ষিত এলাকায় আটকে থাকা মানে অপহরণকারীদের মুখে খাবার তুলে দেয়ার মত। ব্যাপারটা ভাল করেই জানা ছিল ট্যুর গাইডদের। চাকা বদল এবং ঠেলেঠুলে বাসটা রাস্তায় তুলতে প্রায় ঘণ্টা খানেক পেরিয়ে গেল। ড্রাইভার জানাল বেলা অনেক গড়িয়েছে, যে পথ ধরে যাচ্ছি সে পথটা সামনে মোটেও নিরাপদ নয়। ফিরে যেতে হবে আসল পথে। রাস্তার অবরোধের তীব্রতাও নাকি কমে এসেছে ইতিমধ্যে। সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত রওয়ানা হলাম আমরা। তবে এ যাত্রায় পিছনমূখী। আমার কেন জানি মনে হল এ কাহিনীর কোন শেষ নেই… সামনে পেছনে করে অনন্তকাল ধরে চলবে আমাদের যাত্রা! নিয়তির কাছে নিজকে সপে দিয়ে বোবার মত গিলতে শুরু করলাম আন্দিজের নৈসর্গিক স্তব্ধতা।

আবারও সেই বিভীষিকা! সেই লোমহর্ষক জায়গা!!! তবে গাড়ির সংখ্যা দেখে পরিস্থিতি সকালের মত ততটা জটিল মনে হলোনা। গাইড এসে জানাল ভয়ের কিছু নেই, কিছু লেনদেন করতে হবে শুধু। তৃতীয় বিশ্বের বিপ্লবী আন্দোলন! সবকিছুর শেষ মনে হয় একটা জায়গায়, পকেট! চোখের সামনে নতুন এক বাংলাদেশকে আবিষ্কার করলাম। বিছানো পাথরগুলো রাস্তা হতে সরিয়ে নেয়া হয়েছে ইতিমধ্যে। যদিও বাঁশ জাতীয় কিছু একটা দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে গোটা হাইওয়ে। হাতে লাঠি আর মাথায় লাল পটকার ’বিপ্লবী’রা সিংহের মত গর্জন করে বেড়াচ্ছে। ইশারা পেলে ঝাঁপিয়ে পরতে মিনিট খানেক সময় নেবে বলে মনে হলোনা। ডান হাতের ব্যাপারটা খুব দ্রুতই সম্পন্ন হয়ে গেল। গাইড জানাল দেসাগুয়াদে্‌রতে যাত্রী প্রতি ১০ ডলার উঠানো হয়েছিল এমন একটা আশংকার কারণে। এ মুহূর্তে কাউকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলোনা আমার। সবাইকে মনে হল একই চক্রের সদস্য, পর্যটকদের পকেট খসানোর সংঘবদ্ধ নীল নক্সা।

দৈত্য-দানব আর রাক্ষস-খোক্কসদের তাণ্ডব হতে মুক্তি পেলাম শেষ পর্যন্ত। সামনে নতুন কোন ঝামেলা নেই, এমনটা বলে ট্যুর গাইড আস্বস্ত করল আমাদের। সারাদিনের মধ্যে এই প্রথম বুক ভরে নিশ্বাস নিলাম! চোখ বুজে কল্পনা করলাম নিউ ইয়র্কের ছোট রুমটার কথা। আরও প্রায় ২ ঘণ্টার পথ। পেছনের ঝামেলা মাথা হতে নামিয়ে যাত্রীদের অনেকেই ব্যস্ত হয়ে পরল জানালার বাইরে রূপকথার আন্দিজের নিয়ে। আমি ভেজা মুরগীর মত ঝিমুতে শুরু করলাম। রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভিড় করল শরীরে। পাশের সীটটা খালি, দু’পা উঠিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পরলাম।

পাক্কা এক ঘণ্টা পর ঘুম ভাঙল। সূর্যটা নেতিয়ে পরেছে ততক্ষণে। চারদিকে শুনশান নীরবতা। আন্দিজের চূড়াগুলো ডুবে গেছে হাল্কা কুয়াশার কোলে। সূর্যের রক্তিম আভায় কুয়াশাগুলোকে আগ্নেয়গিরির রাক্ষুসে লাভার মত দেখাল। মাঝে মধ্যে দু’একটা বাড়ি ঘরের চিহ্ন দেখা গেল পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। যতই এগুচ্ছি বাড়তে থাকল জনবসতির ঘনত্ব। সামনের সহযাত্রী জানাল ’বিপ্লবীরা’ মাঝ পথে আরও একবার বাসটা থামিয়েছি। কি একটা কাগজ দেখাতে ছেড়ে দিয়েছে বিনা বাধায়। সহযাত্রীদের জানার কথা নয়, কিন্তু এই বাংলাদেশীর ভাল করেই জানা ছিল ঐ কাগজটার অর্থ এবং মূল্য। রাশিয়ায় পড়াশুনা শেষে ব্যবহারের জিনিষপত্র এবং একগাদা বই পাঠিয়ে ছিলাম জাহাজে করে। চট্টগ্রাম বন্দরের ঐতিহাসিক কালো অধ্যায় সমাপ্তি শেষে ট্রাকে করে ফিরছি ঢাকায়। বন্দর হতে বেরুতে না বেরুতে পুলিশ বাহিনী আটকে দিল আমাদের যাত্রা। ড্রাইভার জানাল টাকা দিতে হবে। গাই গুই করে কাজ হলোনা, পরিশোধ করতে হল পুলিশের ’পাওনা’। সব শেষ হতে একটা ক্লিয়ারেনস্‌ সার্টিফিকেট ধরিয়ে দিল ড্রাইভারের হাতে। এটাই নাকি সেই যাদু-মন্ত্র যার বলে পার হওয়া যাবে সামনের সাত সমুদ্র তের নদী। ঘটনাটা মনে হতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। উত্তর আর দক্ষিণ আমেরিকা, কাছের প্রতিবেশী দুই মহাদেশ, অথচ একেবারে উলটো তাদের জীবন যাত্রার মান!

ট্রাফিকের সংখ্যা দেখেই ধারণা করা যায়, আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি। পাহাড়ের বিপদজনক শেষ বাকটা পার হতেই চোখে পরল শহরটা, লা পাস। পাহাড়ি উপত্যকার খাদ ঘেঁষে থরে থরে সাজানো বাড়ি ঘর আর উঁচু দালান নিয়ে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে শহরটা। প্রায় ৮ লাখ লোকের বাস সমুদ্র পৃষ্ট হতে ৩৬৬০ মিটার উচ্চতার এই শহরে। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতম শহরের ভিত্তি স্থাপন করেছিল স্প্যানিশ দখলদাররা। সময়টা ছিল ১৫৪৮ সাল। এর আগে ইনকাদের কাছে এলাকার পরিচিতি ছিল চকেয়াপো হিসাবে। গ্রামটার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া চকেয়াপো নদীতেই প্রথম সোনা খুঁজে পায় উপনিবেশবাদীরা। ১৮৯৮ সালে লা পাস’কে বলিভিয়ার এডমিনিষ্ট্রেটিভ রাজধানী হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৪ সাল হতে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত মার্কিনীদের সহায়তায় একটা পর একটা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটতে থাকে দেশটায়। সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের উচ্চাভিলাষ ব্যাহত করে বলিভিয়ার গণতান্ত্রিক যাত্রা। সোনা, তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পদের মালিক হয়েও দেশটার সাধারণ মানুষ কখনোই দারিদ্র সীমা হতে বেরিয়ে আসতে পারেনি।

সূর্যটা ডুবু ডুবু করছে প্রায়। সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দেয়ার মত কণ্টকাকীর্ণ বিশাল এক পথ পাড়ি দিয়ে শহরের প্রবেশ মুখে ঢুকতেই পরিচিত দৃশ্যটা দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। খোলা আকাশের নীচে আবর্জনা ফেলার বিশাল আয়োজন। সব বয়সের শিশু, নারী এবং পুরুষের দল পিঠে ঝোলা চাপিয়ে হুমড়ি খেয়ে হাতড়াচ্ছে আবর্জনার স্তূপ। উচ্ছিষ্ট নিয়ে শকুন, কুকুর আর মানুষের কামড়া কামড়িতে বিষাক্ত হয়ে উঠছে চারদিকের পরিবেশ। দারিদ্রের এমন কুৎসিত চেহারা দেখা হয়নি অনেকদিন। এক সময় ঢাকার প্রবেশ মুখ যাত্রাবাড়ীতে দেখা যেত দারিদ্রের একই রূঢ় ছবি। পশ্চিম দুনিয়ার পর্যটকের দল হুমড়ি খেয়ে পরল ছবি তোলার জন্যে। আমি দু’চোখ বন্ধ করে ফিরে গেলাম জন্মভূমিতে। বোমা বিস্ফোরণের মত ভয়াবহ শব্দে কেপে উঠল আমাদের বাসটা। অনেকের হাত হতে ছিটকে পরল ক্যামেরা। কিছু বুঝার আগেই ড্রাইভার জানাল পেছনের চাকা পাংচার। চাকা বদলানোর কোন আয়োজন নেই বাসটায়, অথচ মূল শহর এখনো মাইল খানেকের পথ। ’এবার তোমাদের নামতে হবে এবং নিজ খরচে স্থানীয় যানবাহন ধরে পৌছতে হবে শহরের কেন্দ্রবিন্দু সানফ্রানসিসকো প্লাজায়’, ট্যুর গাইড মৃত্যু ঘোষণার মত সংবাদটা প্রকাশ করে হারিয়ে গেল জনারণ্যে।

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৫

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৫

আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ১
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ২
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৩
আন্দিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে – ৪

আবারও অনিশ্চয়তা! কুফা যেন পিছু ছাড়ছে না কিছুতেই। একদিনে এত ঝামেলা সহ্য করার জন্যে চাই বায়োনিক শরীর! মাছে ভাতে বাঙ্গালীর শরীর এমন বিরামহীন হাঙ্গামার জন্যে মোটেও তৈরি নয়, এ সহজ সত্যটা আগেই বোধহয় বুঝা উচিৎ ছিল। অস্থিরতা ধীরে ধীরে হতাশায় পরিণত হল। হাতের লাগেজটা মাটিতে বিছিয়ে জিন্দা-লাশ হয়ে বসে পরলাম খোলা আকাশের নীচে। সূর্যটা বিদায় নিয়েছে অনেকক্ষণ হল। একদিকে হায়েনার মত আন্দিজের বিশাল চূড়া, বিপরীত দিকে লাখ লাখ নিয়ন বাতির রহস্যময় লা পাস নগরী। এ যেন কল্পরাজ্যের স্বপ্ন-পূরীর মত, চোখে দেখা যায় কিন্তু কাছে যাওয়ার উপায় নেই! যমজ বাসটাকে দেখা গেল বেশ কিছুক্ষণ পর। ক’জন যাত্রী উঠিয়ে ওটাও চলে গেল একই কথা বলে। মহিলাদের প্রাধান্যের কারণে আমার জায়গা হলোনা এ যাত্রায়। তীর্থের কাকের মত বসে রইলাম পরবর্তী বাসের আশায়। প্রায় ৪০ মিনিট পর থামল দ্বিতীয় বাসটা। এবার মিস হলে হয়ত সাড়াটা রাত এখানেই কাটাতে হতে পারে, তাই পরি মরি করে উঠে পরলাম। বসার জায়গা নেই, গাদাগাদি করে কোন রকমে দাড়িয়ে রইলাম লাগেজটা হাতে নিয়ে। যে সমস্যার কথা ভেবে এতক্ষণ উৎকণ্ঠিত ছিলাম এসে গেল সেই মহেন্দ্রক্ষণ! বাস কন্ডাক্টর জানতে চাইল, কোথায় যাচ্ছি আমরা? একজন আরেকজনের দিকে তাকাই, কিন্তু কারও মুখে কোন উত্তর পাওয়া গেলনা। সাহস করে আমিই বললাম, সানফ্রানসিসকো প্লাজা! ট্যুর গাইডের মুখে উচ্চারিত নামটা মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। সময় মত মনে করতে পারায় সহযাত্রীরা প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে। ভাড়া পরিশোধ করতে হল ডলারে। এক ডলার সমান কত বলিভিয়ানো আর কতই বা গন্তব্য-স্থলের ভাড়া তার কোন ধারণা না থাকায় ৫ ডলার নোটের সবটাই রেখে দিল ভাংতির অজুহাতে। এ সব নিয়ে চিন্তিত হওয়ার মত মানসিক অবস্থা ছিলনা কারও। শুধু তজ্‌বী গোনার মত বেহুশ হয়ে গুনছিলাম অন্তিম মুহূর্তের। এবং শেষ পর্যন্ত এলো সেই মুহূর্ত। বাস কন্ডাকটরদের কেউ একজন প্রায় গলাধাক্কা দিয়ে ছুড়ে ফেলল বাস হতে। লাগেজটাও ছিটকে পরল হাত হতে।

ব্যাগটা কুড়িয়ে সোজা হয়ে চারদিক চোখ ফেরাতে সহযাত্রীদের কাউকে খুঁজে পেলামনা কাছাকাছি। ওরা কেউ নামেনি। মনটা দমে গেল নতুন আশংকায়। সানফ্রানসিসকো প্লাজা! প্লাজার বিশাল ঘড়িটায় ঢং ঢং করে রাত ৯টা বাজার সময় সংকেত বেজে উঠল। ৪ ঘণ্টার পথ ১৫ ঘণ্টায় পাড়ি দিয়ে শেষ পর্যন্ত দাড়িয়ে আছি লা পাস শহরের কেন্দ্রস্থলে; ক্লান্ত, শ্রান্ত, অবসন্ন, বিষণ্ণ এবং বিধ্বস্ত! ধাতস্থ হতে ৫টা মিনিট কেটে গেল। এ ধরনের অমানুষিক অভিজ্ঞতা জীবনে এই প্রথম নয়। জার্মানির বার্লিন শহর তখনও এক হয়নি। ঐতিহাসিক বার্লিন দেয়াল পার হয়ে পশ্চিম বার্লিনের জুওলঝিশিয়া গার্টেন ষ্টেশনে হাজির হয়েছি নেদারল্যান্ডের হোক-ভ্যান-হল্যান্ড গামী ট্রেন ধরব বলে। শেষ গন্তব্য হারউইচ হয়ে লন্ডনের লিভারপুল ষ্টেশন। পূর্ব বার্লিনে অযথা ঘুরাঘুরির কারণে শেষ ট্রেনটা মিস হয়ে যায়। হোটেল ভাড়ার যথেষ্ট টাকা নেই হাতে, তাই ষ্টেশনে রাত কাটাবার সিদ্ধান্ত নেই বাধ্য হয়ে। সেপ্টেম্বরের শুরু, কনকনে শীত আর পুলিশের অত্যাচারে সাড়াটা রাত দৌড়ের উপর কাটাতে হয়। সকালের প্রথম ট্রেনটা ধরতে বেলা বেজে যায় ১১টা।

ভেঙ্গে পরলে চলবে না। এখনও অনেক পথ পাড়ি দেয়া বাকি। নিজকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলাম! প্লাজায় ঠায় দাড়িয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। কোনদিকে গেলে হোটেল মিলবে তার কোন হদিস করতে পারলাম না। হরেক রকম মানুষের ভীরে গিজগিজ করছে চারদিক। সাহস করে একজনকে জিজ্ঞাস করতে বাধ্য হলাম, ‘দন্ডে এস্তা এলো হোতেল?‘। অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী সন্দেহ নেই, কিন্তু এই অল্পতাই অনেক সময় বিশাল কাজে আসে, বিশেষ করে অজানা অচেনা ভাষার দেশে। কাজ হল এ যাত্রায়! আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখানোর চেষ্টা বুঝতে অসুবিধা হলোনা আমার। হাটতে শুরু করলাম হোটেলের সন্ধানে। কয়েক গজ যেতেই রাস্তাটা ৪৫ ডিগ্রী কোণ হয়ে উপরে উঠতে শুরু করল। জ্বিহ্‌বাকে জায়গা মত ধরে রাখায় অসুবিধা দেখা দিল। ম্যারাথন দৌড়ের গতিকে পাল্লা দিয়ে হার্ট-বীটও বাড়তে থাকল। মুখের থুথুতে এই প্রথম লবণের অস্তিত্ব অনুভব করলাম। প্রথম হোটেলটা চোখে পরল কাইয়ে পতোসির উপর, ’হোটেল প্রেসিদেন্তে’। ভাগ্য এ যাত্রায় বিমুখ করল আমায়, সীট নেই একটাও। দূরে অন্য একটা হোটেলের সাইন দেখে আশান্বিত হয়ে রওয়ানা দিলাম সে দিকে। আরও অনেক উপরে উঠতে হবে। শরীরের শেষ শক্তি ব্যয় করে হোটেল দরজায় হাজির হতেই দেখি দরজা বন্ধ! প্রচণ্ড শব্দে নক করে ইয়া নফ্‌সি ইয়া নফ্‌সি ঝপতে থাকলাম। কেউ এগিয়ে এলো মা। ঘুসি মারতে বাধ্য হলাম। রাজ্যের ক্ষুধা মগজের চিন্তা শক্তিকে গ্রাস করে নিয়েছে ইতিমধ্যে। খুট করে ছোট বুথের মত জানালা খুলে উঁকি দিল কেউ একজন। ’সিনিওরা, উস্তেদ হাবলা ইংলেজ?’। অন্য একজন মাথা বের করে জানাল ’পকি্‌ত‘, অর্থাৎ অল্প স্বল্প। সীট পাওয়া গেল ৬ তলায়, আলাদা বাথরুম। এটা আসলে একটা হোস্টেল, ভাড়া মাত্র ৭ ডলার। হঠাৎ মনে হল পৃথিবীটা আসলে অতটা খারাপ নয় যতটা আমি ভাবছি!

’হোস্তাল নাইরা’, আসলেই নাইড়্যা (ন্যাড়া), ভেতরের সবকিছুতে অযত্ন, অবহেলা আর দারিদ্রের ছাপ। এলিভেটর নেই, তাই সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে হল ৬ তলায়। চাবি ঘুরিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করতে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরল, খুলছে না দরজা! নীচে নামা এ মুহূর্তে অসম্ভব আমার পক্ষে! বসে পরলাম দরোজার সামনে। আধা ঘণ্টা পর রুম সার্ভিসের একজনকে দেখা গেল নতুন গ্রাহকের সাথে উপরে উঠতে। হাউমাউ করে বুঝাতে চাইলাম আমার অবস্থা। সুন্দর একটা হাসি দিয়ে অপেক্ষা করতে বলল। আরও প্রায় ১৫ মিনিট পর প্রায় ৮০ বছরের এক বৃদ্ধাকে দেখা গেল সিঁড়ি ভাঙ্গছে। পাগলের মত হাঁপাচ্ছে সে। শেষ পর্যন্ত অন্য একটা রুমে ঠাঁই নিতে হল। ধবধবে সাদা বিছানা, রঙ্গিন টিভি আর বড় মত আয়নাটা দেখে চোখে পানি আসার মত অবস্থা। হঠাৎ মনে হল আমার বিশ্বজয়ের এখানেই বোধহয় সমাপ্তি! এবার বিশ্রামের পালা!!

শরীরে শুটকির গন্ধ, পরনের কাপড়ে দশ ইঞ্চি ধূলা, জুতা জোড়া বলছে এইমাত্র হালচাষ শেষে ঘরে ফিরেছি, এমন একটা অবস্থায় বিছানায় গেলে সহসাই ঘুম ভাঙ্গবেনা। তাই সাদা শুভ্র বিছানাটায় ঝাঁপিয়ে পরার লোভ সামলাতে হল জোড় করে। প্রথমত গোসল করতে হবে যে কোন মূল্যে। পেট শান্ত করাও জরুরী হয়ে পরেছে। প্রায়োরিটি সেট করে প্রথমে গোসলখানায় ঢুকে পরলাম। আধা ঘণ্টা মরার মত দাড়িয়ে রইলাম ঝরনাটার নীচে। গরম পানির উষ্ণ ছোঁয়ায় দিনের ক্লান্তি অনেকটাই কেটে গেছে মনে হল। পোশাক বদলে রাতের খাবারের সন্ধানে বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সিঁড়ি ভাঙ্গা এখন আর ততটা কঠিন মনে হলোনা। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল হোটেল ফটকে! বন্ধ হয়ে গেছে রাতের জন্যে। অল্প ইংরেজি জানা মহিলার দেখা পাওয়া গেল লবিতে। সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি জানতে পেরে তার চোখে মুখে মমতা ঝড়ে পরল। আমাকে সাথে নিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া ক্যান্টিনটায় ঢুকে পরল। দশ মিনিটের ভেতর গরম সুপ, সিদ্ধ আলু এবং সাথে মুরগীর ফ্রাই নিয়ে হাজির হতেই হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পরলাম প্লেটে। খাওয়া শেষ হতে মনে হল হাত-পা কাঁপছে আমার। চক্কর দিয়ে মাথাটাও ঘুরছে। এক কাপ কফি নিয়ে মহিলা কখন পাশে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। ’খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে, উপরে যাও এবং ভাল করে ঘুমিয়ে নাও, সব ঠিক হয়ে যাবে’, মা’র মমতা নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল মহিলা। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো আমার। এবার ঘুমের পালা।

সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে গেল ওয়েক-আপ কল ছাড়াই। হাত ঘড়িটা বলছে স্থানীয় সময় সকাল ৬টা। খুব একটা বেশী সময় ঘুমিয়েছি বলে মনে হলোনা। গতকালের ঘটনাগুলো এ মুহূর্তে দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই ভাবতে ইচ্ছে করলোনা। এতদিন জেনেছি এক জায়গায় দু’বার বজ্রপাত হয়না, আজ বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল আমারও পরপর দুটো দিন খারাপ যেতে পারেনা। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম ঘটনাবহুল আরও একটা দিনের প্রস্তুতি নিতে। মনে মনে দিনটার একটা ছক একে নিলাম; প্রথমে নিশ্চিত করতে হবে সময় মত পেরুর রাজধানী লিমা ফিরে যাওয়া; দ্বিতীয়ত, শহরটা দেখতে হবে যে কোন মূল্যে।

এধরনের সস্তা হোটেলে থাকার এ একটা ভাল দিক, বিনামূল্যে ব্রেকফাস্ট! যদিও তা আহামরি কিছু নয়, কিন্তু সময় মত হাতের কাছে পাওয়াটাই অনেককিছু, বিশেষকরে ডলার পাউন্ডের দেশে। ফ্রেশ হয়ে নীচে নামতে নামতে ৭টা বেজে গেল। টোষ্টেড রুটির উপর মাখন, সাথে ডিমের অমলেট… সবশেষে এক কাপ ধূমায়িত কফি। মন্দ না ফ্রি নাস্তার জন্যে। পকেটে পাসপোর্টটা আরও একবার পরীক্ষা করে বেরিয়ে পরলাম রাস্তায়। রোববার সকাল। উত্তর আমেরিকার হিসাব মত সময়টা হওয়া চাই একেবারেই জনশূন্য। কিন্তু এখানে দেখলাম ঠিক তার উল্টো। চারদিক লোকে লোকারণ্য। হাটতে হাটতে হাজির হলাম রাতে যেখানটায় আমাকে বাস হতে ছুড়ে ফেলা হয়েছিল। ঢালু রাস্তা, হাটতে গেলে মনে হবে কেউ যেন পিছন হতে ধাক্কা মারছে। গড় গড় করে নেমে গেলাম উচ্চতা হতে। সান ফ্রান্‌সিসকো প্লাজায় দৃশ্যটা দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল। হরেক রকম পোশাক পরে একদল বৃদ্ব-বৃদ্ধা নাচছে। বলিভিয়ানরা দৈর্ঘ্যে প্রায় সবাই ছোট, কিন্তু প্রস্থে বেশ নাদুস নুদুস। বাদ্যযন্ত্র প্রায় সবার হাতে। ৩-৪ জন মিহি-সুরে গান গাইছে। এ রকম প্রায় ৩/৪ গ্রুপে আলাদা হয়ে গোটা ৫০ মানুষ উপভোগ করছে রোববারের অলস সকাল। একজনকে জিজ্ঞাস করে জানা গেল একটু পর এরা সবাই চার্চে যাবে। ঈশ্বরকে আগাম ধন্যবাদ জানাতে এই আয়োজন। বিভিন্ন এঙ্গেল হতে বেশ ক’টা ছবি তুললাম। আমার মত বেশ ক’জন টুরিস্টকেও দেখলাম প্রাণভরে উপভোগ করছে সকালের এই আয়োজন। ৮টা বাজতেই হুস হল। ফিরে যাওয়ার টিকেট কেনা হয়নি এখনো।

মাথা ঠাণ্ডা রেখে প্ল্যান শুরু করলাম কোথা হতে শুরু করা যায়। কিছুদূর না যেতেই দেখা মিলল স্থানীয় পুলিশ ষ্টেশনটার। দৈব জিনিষে বিশ্বাস ছিলনা কোন কালেই, কিন্তু এ যাত্রায় মনে হলে দিনটা ভাল যাওয়ার এ যেন ঐশ্বরিক ইংগিত। সাত পাঁচ না ভেবে ঢুকে পরলাম। ‘উস্তেদ হাবলা ইংলেজ?‘ দাঁড়াও বলে ভেতরে গিয়ে নিয়ে আসল ইংরেজি জানা এক মহিলা পুলিশকে। খুলে বললাম আমার কাহিনী। উত্তরে ভদ্রমহিলা যা বলল তাতে আশান্বিত হওয়ার কোন কারণ খুঁজে পেলামনা। আজ রোববার, খাবার দোকান ছাড়া লা পাস শহরের সবকিছু বন্ধ! গতকালের মত সবকিছুতেই আতংকিত না হয়ে জানতে চাইলাম কোথা গেলে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সাহায্য মিলতে পারে। ফাইভ স্টার হোটেল হতে পারে পারফেক্ট স্পট, এমনটাই ধারণা পাওয়া গেল পুলিশ ষ্টেশনে। তথাস্তু! সব দ্বিধা দন্ধ আছড়ে ফেলে লম্বা একটা ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে পরলাম ফাইভ স্টার হোটেলের খোঁজে। আন্দিজের মৃদু মন্দ বাতাসে হাটতে মন্দ লাগছিলোনা। এক ধরনের কাব্যিক আনন্দ পেলাম সুমুদ্রপৃষ্ট হতে এতটা উচ্চতায় ঘুরে বেড়াতে। না, কোন কিছুতেই আজ মন খারাপ হচ্ছেনা। দূর হতে পড়তে অসুবিধা হলোনা দালানটার মাথায় সাইনবোর্ডটা, র‌্যাডিশন। ভেতরে ঢুকতেই ফাইভ স্টার আরামের গন্ধ পাওয়া গেল চারদিকে। হোটেলটার নিজস্ব ট্রাভেল এজেন্সিটাতে বড় একটা তালা ঝুলতে দেখে মনটা বেশ দমে গেল। ফ্রন্ট ডেস্কে আলাপ করে জানা গেল সোমবার সকাল ছাড়া কাজ হবেনা। নিজের কাহিনী সবটা খুলে বলতে ডেস্কে বসা ল্যাটিন সুন্দরীর মন গলাতে পেরেছি মনে হল। মুহূর্তের মধ্যে গোটা দশেক ফোন করে গাই গুই করে স্প্যানিশ ভাষায় কি বললো কিছুই বুঝা গেলনা। কিন্তু কাজের কাজ হল শেষ পর্যন্ত। ’লান চিলি’ নামের এয়ার লাইনের টিকেট পাওয়া গেল। দাম নিয়মিত দামের প্রায় ৩ গুন। আলহামদুল্লিলাহ্‌ বলে জবাই হওয়ার স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য হলাম। সকাল ৭ টার ফ্লাইট, এয়ারপোর্ট থাকতে হবে ৬টার ভেতর। সুন্দরী জানাল সোমবার সকালে নতুন করে শুরু হতে যাচ্ছে অনির্দিষ্ট কালের ধর্মঘট। মন মনে বললাম, লা ক্যুম দ্বিনুকুম ওলয়্যাদিন …। আমাকে আর পাচ্ছোনা তোমরা! টিকেটের ঝামেলা শেষ হতেই মনে হল গোটা আন্দিজ পাহাড় নেমে গেছে মাথা হতে। এবার যে উদ্দেশ্যে এখানে আসা তা পূর্ণ করার পালা। এ ব্যাপারে সাহায্য চাইলাম ফ্রন্ট ডেস্কের কাছেই। তোতা পাখীর মত একগাদা ট্যুরের আমলনামা ধরিয়ে দিল হাতে। ধারণাটা হঠাৎ করেই মাথায় খেলল, প্রথমবার সিংগাপুর গিয়েও এর সাহায্য নিয়েছিলাম। সারাদিনের জন্যে বিশ্বাসযোগ্য একজন ক্যাব ড্রাইভার দরকার আমার! জানাতেই বত্রিশ পাটি দাঁত উদাম করে হেসে উঠল উদ্ধার দেবী। হোটেলের নিজস্ব ড্রাইভার কার্লোস বসে আছে ৭ দিন ধরে। হাঙ্গামার কারণে টুরিস্টদের দেখা নেই, আমই চাইলেই নিতে পারি। ৬০ ডলারে ফয়সালা হয়ে গেল। সেকেন্ডের ভেতর মাটি ফুড়ে হাজির হলেন আমার সারাদিনের কেনা গোলাম কার্লোস হেরনান্‌ডেস।

বিয়েন বেনিদছ্‌ আ লা পাস’, হাত বাড়িয়ে লা পাস’এ আমাকে স্বাগত জানাল কার্লোস। ’গ্রাসিয়াস সিনওর’, ধন্যবাদ জানিয়ে আমিও হাত বাড়িয়ে দিলাম। স্প্যানিশ ভাষায় জানতে চাইলাম তার নাম, এবং তাতেই সে ধরে নিলো এ আমার ন্যাচারাল ভাষা। দক্ষিণ আমেরিকা আসব বলে প্রয়োজনীয় ক’টা বাক্য রপ্ত করেছিলাম সেই নিউ ইয়র্ক বসেই। কিন্তু কার্লোসের বকবকানির উত্তর দিতে গিয়ে সহসাই আবিষ্কার করলাম আমার স্প্যানিশের ভাণ্ডার একেবারেই ঠুনকো। কিছুদূর এগুতেই জানিয়ে দিলাম, নো স্প্যানিশ por favor(প্লীজ)। বেচারা তাতে মোটেও দমে গেল বলে মনে হলোনা, বরং বকর বকর আরও বাড়িয়ে কান ঝালাপালা করে ফেলল। উপায় না দেখে আমিও কথা বলার ষ্ট্রাটেজি বদলে ফেললাম, মিঃ হেরনান্‌ডেজের সাথে এখন হতে বাংলায় কথা বলব আমি! আমার সূদীর্ঘ ভ্রমন জীবনে অনেকবারই ব্যবহার করেছি এ কৌশল। মৌখিক যোগাযোগে ভাষার গ্যাপ থাকলে নির্জলা বাংলা ব্যবহার এক ধরনের ঐশ্বরিক তৃপ্তি দেয়!

হাতের কাছেই সান ফ্রানসিস্কো প্লাজা। আমার ড্রাইভার-কাম-ট্যুর গাইড এখান হতেই শুরু করতে চাইল শহর ভ্রমন। খাঁটি বাংলায় বললাম, ’মিয়াভাই, ঘন্টাখানেক আগে ঘুরে গেছি এই স্কয়ার, যাওয়ার আর দরকার নাই‘। আগা মাথা কিছু না বুঝে গাড়ির দরজা খুলে আহ্বান জানাল সান ফ্রানসিস্কো কলোনিয়াল চার্চটা ঘুরে আসার জন্যে। না গেলে হয়ত ভুলই করতাম। দেখার মত জিনিষ। পরবর্তী ঠিকানা প্লাজা মুরিয়েয়ো। এই প্লাজার চারদিক ঘিরে আছে অনেকগুলো সরকারী ভবন, তারমধ্যে জাতীয় কংগ্রেস ভবন এবং প্রেসিডেন্ট ভবন অন্যতম। লন্ডনের ট্রাফলগয়ার স্কয়ারের মত শত শত কবুতর উড়ে বেড়াচ্ছে যত্র তত্র। খাবার দিলে ওরা হাতে, শরীরে বসে পর্যটকদের আনন্দ যোগায়। টুরিস্টদের ভীরে গিজ গিজ করছে স্কয়ারটা। বেশ ক’টা ছবি তুলে বিদায় নিলাম জায়েন ষ্ট্রীটের উদ্দেশ্যে। পথেই দেখলাম এভিনিউর নামটা, বুশ এভিনিউ। এবার আর বাংলা নয়, ভাঙ্গা স্প্যানিশেই কার্লোসকে জিজ্ঞেস করলাম, ’তে গুস্তা বুশ মুচঅ?’ অর্থাৎ, বুশকে কি তোমাদের খুব পছন্দ? পাহাড়ি খাদ বেয়ে উপরের দিকে উঠছিলাম আমরা, কায়দা করে গাড়িটাকে এক জায়গায় থামিয়ে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল সে আমার দিকে, বিশ্রী একটা গালি দিল প্রেসিডেন্ট বুশকে, আমাকে সাবধান করে দিল লা পাসে এ ধরনের মন্তব্য করা হতে বিরত থাকতে। ভুলেই গিয়েছিলাম বলিভিয়া ভেনিজুয়েলান প্রেসিডেন্ট হুগো সাভেজের সমাজতান্ত্রিক জ্বরে আক্রান্ত এবং এই নতুন কাস্ত্রোর লোকাল এজেন্ট এবো মরালেসের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। মাথা ঠাণ্ডা হতেই কার্লোস জানাল বুশ এভিনিউর নাম করণ করা হয়েছে আসলে তাদেরই এক জেনারেলের নামে, যার পুরো নাম খেরমান বুশ। দক্ষিণ আমেরিকার রাজনীতি নিয়ে কথা বলার সময় এবং জায়গা এটা নয়, তাই চুপ করে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। তিওয়ানাকো কালচারের ওপেন-এয়ার মিউজিয়াম আমাদের পরবর্তী ঠিকানা। তারপর মেনুতে ছিল ওব্রাখেস, কালাকোতা এবং লা ফ্লোরিডা আবাসিক এলাকা ভ্রমন। মুন ভ্যালির মাটির ধ্বস দেখার মধ্য দিয়ে আমাদের ট্যুর শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু কার্লোস এখানেই থামল না, আঁকাবাঁকা পথ ধরে পাহাড়ে ভাঙ্গতে শুরু করল প্রচণ্ড গতিতে। প্রথমেই থামল এমন একটা উচ্চতায় যেখান হতে পুরো লা লাজ শহরের প্যানোরমা দেখা যায় ফ্রেমে বাধানো ছবির মত। গাড়ি থামিয়ে সেও এগিয়ে এলো আমার সাথে। নির্দিষ্ট একটা জায়গায় আঙ্গুল দেখিয়ে তাকাতে বলল আমায়। বিন্দুর মত দেখাল দূরের স্টেডিয়ামটাকে। এক ধরনের গর্ব খেলে গেল কার্লোসের চোখে মুখে। এই সেই বিখ্যাত স্টেডিয়াম যেখানে অনুষ্ঠিত হয় বলিভিয়ার ন্যাশনাল ফুটবল স্পেক্টাকেল। প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম আমি ফুটবল পাগল দক্ষিণ আমেরিকার কোন একটা দেশে এখন। সমুদ্র পৃষ্ট হতে পৃথিবীর যে কোন স্টেডিয়ামের চাইতে সবচেয়ে বেশী উচ্চতায় অবস্থিত এই স্টেডিয়াম। নাম শুনেছি অনেক, রাশিয়ায় থাকতে টিভিতে সরাসরি খেলাও দেখেছি অনেকবার। কার্লোসকে ধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে গেলাম গাড়ির দিকে। তাকে খুব একটা খুশী মনে হলোনা ফুটবল নিয়ে আমার এই ভাবলেশহীন অভিব্যক্তিতে।

আমরা এগিয়ে গেলাম ট্যুরের শেষ গন্তব্যস্থল পরিদর্শনে। সান পেড্রো পাহাড়ের উপর কোচাবাম্বা এলাকায় ’ক্রেষ্টো দ্যা লা কনকরডিয়া’ স্ট্যাচু শহর হতে বেশ কিছুটা দূরে। যিশু খ্রিষ্টের এই মূর্তি ব্রাজিলের রিও দ্যা জেনেরোর ’ক্রাইস্ট দ্যা রিডিমারের’ চাইতেও কয়েক ফুট লম্বা। প্রায় ৪১ মিটার লম্বা এটাই বিশ্বের সর্ব বৃহৎ যীশুর স্ট্যাচু। উচ্চতায় পৌঁছে গাড়ি থামতেই চোখ জুড়িয়ে গেল দৃশ্যটা দেখে। খণ্ড খণ্ড মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে চারদিক। ইচ্ছে করলেই হাত দিয়ে ছোঁয়া যায় এক খণ্ড মেঘ। বিশাল উচ্চতা হতে নীচে লোকালয়ের দিকে তাকালে রক্ত হিম হয়ে আসে। এত উঁচুতেও আলপাকা এবং জামাদের দেখা গেল এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করতে। ছবি তুললাম মন ভরে। হঠাৎ করেই বিশাল এক খণ্ড মেঘ ঢেকে দিল মাথার উপরটা, চারদিকে নেমে এলো এক ধরনের বোবা অন্ধকার। ভয়টা ভূতের মত চেপে বসল মাথায়! আমার হাতে দু’টা ভিডিও ক্যমেরা, একটা ডিজিটাল ষ্টীল ক্যমেরা এবং পকেটে অনেকগুলো টাকা। কি হবে যদি এই অজানা অচেনা ড্রাইভারের মাথায় লোভ চেপে বসে? হাল্কা একটা ধাক্কা দিলেই যথেষ্ট, ইতিহাস হয়ে যাব আমি আন্দিজের বিপদজনক বাঁকে। বলিভিয়া পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র এবং চরিত্রহীন দেশ, এখানে কাউকে বিশ্বাস করাটা হবে বোকামির শামিল। উঠে দাঁড়ালাম মূর্তিটার বিশাল পাদদেশ হতে। ড্রাইভার বললাম, ‘বামুস‘ (চল)। কোন অঘটন ছাড়াই পৌঁছে গেলাম হোটেলে। বিদায়ের আগে কার্লোসই জানতে চাইল সকালে এয়ারপোর্ট যাওয়ার যানবাহন ঠিক করা আছে কিনা। ভাল কথা মনে করিয়ে দিল সে, ধন্যবাদ জানিয়ে তাকেই আসতে বললাম সকাল ৪টার ভেতর।

সন্ধ্যাটা এলোমেলো ঘুরে বেড়ালাম ডাউন টাউনে। মূল রাস্তায় এক মহিলা মুচির ছবি তুলতে গেলে তেড়ে এলো মারতে, দৌড়ে আশ্রয় নিলাম পার্শ্ববর্তী হোটেলে। তবে এখানেই সমাপ্তি টানলাম না ভাল একটা দিনের। সন্ধ্যা নামার সাথে আবারও আন্দিজ হতে নেমে এলো ঘন কালো কুয়াশা, ভোজবাজির মত কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেল চারদিকের সবকিছু। অনেক সন্ধান অনুসন্ধানের পর একটা চীনা রেস্তোরা খুঁজে পাওয়া গেল বেশ কিছুটা দূরে। অস্ট্রেলিয়ান এক দম্পতিকে সাথে নিয়ে অনেকদিন পর রাতের আহারে ভূরি ভোজ করলাম মনের আনন্দে। ৯টা বাজতেই চারদিকে বেজে উঠল হরতাল দামামা, তৈরি হচ্ছে লা পাস কালকের জন্যে। আর কোন রিস্ক না নিয়ে ঘরে ফিরে গেলাম বিনা এডভেঞ্চারে। ১০টার ভেতর শুয়ে পরলাম খুব সকালে উঠতে হবে বলে।

ভোরে ঘুম ভাঙ্গল ওয়েক-আপ কলে, নীচে ক্যাব নিয়ে অপেক্ষা করছে কার্লোস। হোটেল ভাড়া পরিশোধ করে যথেষ্ট সময় হাতে নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্য। লা পাস এয়ারপোর্টের চারদিকের বিস্ময়কর সৌন্দর্য বেশীক্ষণ উপভোগ করার সময় পাওয়া গেলনা, চারদিকে হরতাল শুরুর চাপা উত্তেজনা। ইমিগ্রেশন পার হয়ে ভেতরে ঢুকে পরলাম নিরাপত্তার কথা ভেবে। যাত্রী সহ ’লান চিলির’ ফ্লাইট আকাশে উঠতেই হাফ-ছেড়ে বাঁচলাম, কিন্তু মনটাও কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেল সাথে। বিমানের জানালা ধরে তাকিয়ে থাকতে সেলুলয়েডের ফিতার মত রি-ক্যাপ হতে শুরু করল ফেলা আসা ২/৩ দিনের স্মৃতি। দেসাগুয়াদেরর অজানা আশংকা, আন্দিজের অচেনা বাঁকে জীবন বাঁচানোর ম্যারাথন দৌড়, বিকট শব্দে বাসের চাকা পাংচার, খাদ্য এবং পানি ছাড়া আন্দিজের বাকে বিপদজনক বিকেল সহ টুকরো টুকরো অনেক ঘটনা। সবচেয়ে বেশী মনে পরল হারিয়ে যাওয়া রহস্যময়ী ভিক্টোরিয়ার কথা। স্মৃতির অলিগলি হাতড়াতে কোনদিন কি ফিরে আসা হবে পৃথিবীর এ প্রান্তে?

লা পাস ‘এলো আলতো’ এয়ারপোর্ট হতে লিমা ’হোরহে চাভেজ‘ এয়ারপোর্ট ২ ঘণ্টার পথ। দেশ দু’টোর মধ্যে রয়েছে ১ ঘণ্টা সময় ব্যবধান। সাধারণ মানের এক প্যাকেট পটেটো চিপস, সাথে মিনি গ্লাসে এক গ্লাস ইনকা কোলা, আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে এ ধরনের দায়সারা গোছের আপ্যায়নে বেশ হতাশ হলাম। এতগুলো ডলার খসে গেল মাত্র দুই ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে হবে, ভেতরের এই অসন্তুষ্টিটা কাটা গায়ে নুন ছেটানোর মত যন্ত্রণা দিচ্ছিল বার বার। দৃশ্যটা প্রথমবারও লক্ষ্য করেছি, লিমা এয়ারপোর্টকে ঘিরে থাকা আন্দিজের চূড়াগুলো ঘন মেঘের স্তর ভেদ করে আকাশে উঠে গেছে। হঠাৎ করে দেখলে দৈত্য দানবের মত মনে হবে। প্রাক ধারণা না থাকলে চূড়াগুলি ভয় ধরিয়ে দেয় ফ্লাইট সেফটির আশংকায়। সীট নিয়ে ভাল করে বসার আগেই মন হল হল ল্যান্ড করছি আমরা।

৯টার ভেতর ঝামেলা চুকিয়ে বেরিয়ে এলাম এয়ারপোর্ট হতে। নিউ ইয়র্কের ফ্লাইট রাত ১২টায়; মাঝখানের ১৫ ঘণ্টা কোথা যাব, কি করব ভেবে চিন্তিত হয়ে পরলাম। ইচ্ছা ছিল এয়ারপোর্ট লাউঞ্জেই কাটিয়ে দেব সময়টা, কিন্তু এত লম্বা সময়ের কথা মনে হতেই দ্বিধায় পরে গেলাম। রাতে ভাল ঘুম হয়নি, তা ছাড়া সামনে পরে আছে আরও ৭ ঘণ্টার ফ্লাইট। এত ধকল শরীরে সইবার নয়, তাই হিসাব শেষে হোটেলে উঠার সিদ্ধান্ত নিলাম। টুরিস্ট ব্যুরোর ডেস্কে গিয়ে সন্ধান চাইলাম কাছাকাছি সস্তা হোটেলের। আগের বার বোকার মত ৭৫ ডলার দিয়ে লিমার সবচেয়ে অভিজাত এলাকা মিরাফ্লোরেসে হোটেল বুক করেছিলাম। ডেস্কের লাস্যময়ী তরুণী এক সপ্তাহের ভেতর দ্বিতীয় বার স্বাগত জানিয়ে আগের হোটেলে যেতে চাই কিনা জিজ্ঞেস করল। ৩৫ ডলারে এয়ারপোর্টের সবচেয়ে কাছের হোটেলটায় বুকিং দিয়ে ক্যাব নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেলাম।

রাজধানী লিমা ইতিমধ্যে জেগে উঠেছে। অগুনিত যানবাহন, গিজ গিজ করা মানুষের ভিড়। এয়ারপোর্টের কাছাকাছি রাস্তাগুলো হঠাৎ করে দেখলে ঢাকার কোন রাস্তা বলে ভুল হতে পারে। এলোমেলো ট্রাফিক, শ্রীহীন ইমারত, যত্রতত্র নির্বাচনী চিকা, লক্কড় ঝক্কড় মিনিবাস এবং রাস্তায় পরিকল্পনাহীন দোকান পাট, নির্ঘাত ঢাকার ছবি! শুধু পার্থক্য এর চতুর্দিকের প্যনোরমা। আন্দিজের বিশাল বিশাল চূড়ায় নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে সকালের সূর্য। এক ধরনের ঘন কুয়াশা রাজত্ব করছে শহর জুড়ে। একটু এগিয়ে হাইওয়ে ধরতেই পার্থক্যটা প্রকট হয়ে উঠল, ঢাকায় এ ধরনের নিয়ন্ত্রিত ট্রাফিক চলাচল অকল্পনীয়। পনের মিনিটের ভেতর হাজির হলাম হোটেলটার সামনে। হোটেল ’ম্যানহাটন’, নির্জন পরিবেশে বেশ খোলামেলা জায়গায় হোটেলটাকে দেখে পছন্দ হয়ে গেল।

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই ৩২ দাঁত বের করে স্বাগত জানাল অবিকল বাঙ্গালী চেহারার এক তরুণী।

আমার ভ্রমণ কাহিনীর এখানেই বোধহয় সমাপ্তি টানা যায়, কারণ এর পরের ১৫ঘন্টায় যা ঘটবে তার সাথে ভ্রমণের কোন সম্পর্ক নেই। লম্বা একটা ঘুম সেরে নীচে নামতেই আলাপ হবে সকালের সেই মেয়েটার সাথে। সে আলাপ চলবে টানা ৩ ঘণ্টা। এবং এই ৩ ঘণ্টায় বীজ বপিত হবে নতুন এক কাহিনীর। এ কাহিনীর ট্রেইল ধরে আমাকে আবারও ফিরে আসতে হবে লিমায়। স্মৃতির অলিগলি হাতড়াতে আবারও যেতে হবে কুসকো, মাচা পিচু, পদানত হবে আন্দিজের নতুন নতুন চূড়া। পাড়ি দিতে হবে কলার দেশ ইকুয়েডর, ড্রাগের স্বর্গভূমি কলম্বিয়া সহ আন্দিজের আরও অনেক বাঁক। এ নিয়ে হয়ত লেখা যেতে পারে বিশাল ক্যানভাসের আরও একটা কাহিনী, যা ভ্রমণের পাশাপাশি ছুঁয়ে যাবে প্রেম, ভালবাসার মত নাটকীয় বিষয়গুলি।

– সমাপ্তি

লেখাটা শেষ করে গিন্নীকে আনতে যেতে হবে। সে এখন কাজে। এবং আমার গিন্নীই সেই জন যার সাথে দেখা হয়েছিল লিমার সেই হোটেলটায়।

error: Content is protected !!
Exit mobile version