দিগন্ত জোড়া সবুজ পাহাড় আর বিস্তীর্ণ প্যানারোমা, এর মাঝে ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘেদের দল। স্বপ্নের মতো এই দৃশ্য আপনি বাস্তবে দেখতে পাবেন বাংলার দার্জিলিং খ্যাত নীলগিরি তে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে নীলগিরির উচ্চতা ২২০০ ফিট। বান্দরবানের দূর্গম পাহেড়ের কোলে নীলগিরি সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। প্রকৃতি এখানে বৈচিত্র্যময়। ক্ষণে ক্ষণে তার রূপ বদলায়।
সকালে একরকম তো সন্ধ্যায় তার অন্য-রূপ।
বান্দরবান জেলা শহর থেকে প্রায় ৫০ কিঃমিঃ দূরে নীলগিরির অবস্থান। এর খুব কাছেই রয়েছে পাহাড়ি গ্রাম কাপ্রু পাড়া। এটি ম্রো আদিবাসী অধ্যুষিত একটি জনপদ। তাই পাহাড়ীদের জীবন যাপন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারবেন খুব কাছ থেকে। নীলগিরির চূড়ায় দাঁড়িয়ে আকাশ পরিষ্কার থাকলে দূরের সাগর পর্যন্ত দেখা যায়! এছাড়া দেখতে পাবেন দেশের সর্বোচ্চ পর্বত সাকাহাফং, বগালেক, কেওক্রাডং ও সাঙ্গু নদী! এটি সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি পর্যটন কেন্দ্র। এর কাছেই রয়েছে আর্মি ক্যাম্প। তাই নিরাপত্তা নিয়ে কোনো প্রকার সমস্যা নেই। আপনার কোনো প্রয়োজনে সেনাবাহিনী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিবে। আপ পরিবার পরিজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরে আসার জন্য নীলগিরি একটি আদর্শ স্থান।
কিভাবে নীলগিরি যাবেন
নীলগিরি যেতে হলে প্রথমে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে আপনাকে বান্দরবান আসতে হবে। রাতের বাসে আসাই ভালো। ঢাকা থেকে এসি – নন এসি সব ধরণের বাসই বান্দরবান যায়। নন এসির মধ্যে শ্যামলী, সৌদিয়া, ইউনিক, ডলফিন, সেন্টমার্টিন, এস আলম ইত্যাদি পরিবহনের বাস পাবেন। বাস ছাড়ে কলাবাগান, ফকিরাপুল ও সায়েদাবাদ থেকে। রাত এগারোটার মধ্যে লাস্ট বাস ছেড়ে যায়। ভাড়া ৫৮০ থেকে ৬২০ টাকা। এসি বাসের ভাড়া ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে।
ট্রেনে যেতে চাইলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী যেকোনো ট্রেনে উঠতে হবে। সোনার বাংলা এক্সপ্রেস, সূবর্ণ এক্সপ্রেস, তূর্ণা নিশীথা, চট্টলা, মহানগর ও গোধুলী সহ অনেকগুলো ট্রেইন ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ট্রেন ও আসন ভেদে ভাড়া ২০০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে।
চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবানের বাস পাবেন নতুন ব্রিজ, দামপাড়া ও বহদ্দারহাট বাস টার্মিনালে। বহদ্দারহাট থেকে ৩০ মিনিট পরপর ‘পূর্বাণী’ ও ‘পূরবী’ নামে দুটি পরিবহনের বাস ছাড়ে। ভাড়া ২২০ টাকা।
বান্দরবান থেকে নীলগিরি
বান্দরবান থেকে বাসে, জিপে, চন্দের গাড়ি অথবা সিএনজিতে আপনি নীলগিরি যেতে পারেন। সিএনজিতে গেলে ভাড়া পড়বে সিজন ভেদে ১৮০০ থেকে ২৫০০ টাকা। যদি সদস্য সংখ্যা ৬/৭ জন হয় তাহলে ল্যন্ড ক্রুজার জিপ নিতে পারেন। এতে ভাড়া পড়বে ৩০০০ থেকে ৪০০০ টাকা। আর চান্দের গাড়ির ভাড়া ৪৫০০ থেকে ৫০০০ টাকা। চান্দের গাড়িতে বসতে পারে ১২/১৩ জন।
বর্ষা মৌসুমে কম বেশি সারাদিন মেঘের দেখা পাওয়া যায় এখানে। তবে শুকনো মৌসুমে নীলগিরিতে মেঘ থাকে মূলত ভোর থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত। তাই মেঘ দেখতে চাইলে খুব ভোরে আপনাকে রওনা করতে হবে। যেন সকাল সাতটা আটটার মধ্যে নীলগিরি থাকতে পারেন। বান্দরবান থেকে জিপে নীলগিরি যেতে দেড় থেকে দুই ঘন্টার মতো সময় লাগে।
ভ্রমণ পরিকল্পনা
নীলগিরি যাওয়ার পথে পড়বে মিলনছড়ি ভিউ পয়েন্ট, শৈলপ্রপাত ও চিম্বুক পাহাড়। আপনি গাড়ি থামিয়ে এই স্থানগুলো দেখতে দেখতে নীলগিরি যেতে পারবেন। তাহলে দুপুরের পরের সময়টা নীলগিরিতে কাটালেন। আবার চাইলে প্রথমে সকালে একটানে নীলগিরি চলে যাবেন। ফেরার পথে চিম্বুক শৈলপ্রপাত ও মিলনছড়ি ভিউ পয়েন্ট দেখতে দেখতে আসবেন। এসব স্পটে যে থামবেন, এটা গাড়ি ঠিক করার সময়ই ড্রাইভারের সাথে কনফার্ম হয়ে নিবেন। শৈলপ্রপাতের ঝর্ণার জলে গা এলিয়ে বিভিন্ন পাহাড়ি ফলের স্বাদ আস্বাদন করতে পারবেন। শৈলপ্রপাতের পাশেই বম আদিবাসী অধ্যুষিত পাড়া। বম তরুণ তরুণীরা এখানে আম, লিচু, পেপে, পেয়ারা, কলা সহ বিভিন্ন পাহাড়ি ফল বিক্রি করে বছরজুড়ে। সুস্বাদু এসব ফলের স্বাদ নিতে ভুলবেন না।
যারা দুইদিন বান্দরবান থেকে নীলগিরি বাদেও স্বর্ণমন্দির, নীলাচল, মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স সহ মেইন স্পটগুলো দেখতে চান, তাদের জন্য আমাদের ১ রাত দুইদিনের বিস্তারিত ভ্রমণ তথ্য পোস্টের শেষে দেওয়া আছে।
নীলগিরি ভ্রমণের সময়
বলা হয়ে থাকে কোনো ভ্রমণ স্থান যতই সুন্দর হোক, ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় না গেলে, ভালো নাও লাগতে পারে। নীলগিরি বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ও নিরাপদ পর্যটন স্পষ্ট হিসেবে স্বীকৃত। তাই বছরজুড়ে ভ্রমণপ্রেমীরা এখানে পরিবার পরিজন নিয়ে ছুটে আসেন প্রকৃতির অমোঘ টানে। তারপরও বলা যায় চৈত্রের প্রচন্ড গরমে ও বর্ষার শুরুতে নীলগিরি ভ্রমণ না করাই ভালো। নীলগিরি ভ্রমণের উপযুক্ত সময় বর্ষার শেষ থেকে শরৎ হেমন্ত ও শীতকাল। অর্থাৎ জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত। বর্ষায় প্রকৃতি সবচেয়ে সতেজ ও সবুজ থাকে। তখন মেঘেদের আনাগোনা লুকোচুরি চলে দিনভর। মেঘের জন্য খুব বেশি দূরে দেখা না গেলেও মেঘের সমুদ্রে একদিন ডুব দেওয়াই যায়। আর শীতে যতদূর চোখ যায় ততদূর দেখা যায় বলে চমৎকার ভিউয়ের সৃষ্টি হয়!
কম খরচে নীলগিরি ভ্রমণ
ট্যুরের সদস্য সংখ্যা কম হলে, কিংবা কম খরচে নীলগিরি যেতে চাইলে আপনি বাসে করে যেতে পারবেন। বান্দরবান থেকে থানচিগামী যেকোনো বাসে উঠলে নীলগিরিতে নামিয়ে দিবে। ভাড়া জনপ্রতি ১২০ টাকা। এছাড়া অন্যান্য টিমের সাথে জিপ শেয়ার করতে পারেন। এতেও কম খরচ হবে। সবচেয়ে ভালো হয় নিজেরা গ্রুপ করে যেতে পারলে। গ্রুপে গেলে সব খরচ ভাগ হয় বলে কম খরচে ঘুরে আসা যায়।
কোথায় থাকবেন
নীলগিরিতে থাকার জন্য সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত কটেজ আছে ৬টি। এসব কটেজে থাকার জন্য রুম ভাড়া পড়বে ৪০০০ থেকে ১০০০০ টাকা। থাকতে চাইলে ক্ষেত্রবিশেষে দেড় থেকে দুই মাস আগে বুকিং দিতে হবে। বুকিংয়ের জন্য আর্মির অফিসার পর্যায়ের কারো রেফারেন্স লাগে। সুযোগ থাকলে নীলগিরিতে একটা রাত কাটানো যেতেই পারে।
তবে বেশিরভাগ পর্যটকই এত ঝামেলায় না গিয়ে নীলগিরি ঘুরে সন্ধ্যার মধ্যে আবার বান্দরবান শহরে ফিরে আসেন। বান্দরবানে থাকার জন্য রয়েছে বিভিন্ন মানের অনেকগুলো হোটেল। রয়েছে কটেজ ও রিসোর্ট। এর মধ্যে কয়েকটি হোটেল হলো-
হোটেল হিল ভিউ: এর অবস্থান বাস স্ট্যান্ড এর পাশেই। এটি বেশ ভালো মানের একটি হোটেল। রুম ভাড়া ১২০০ থেকে ২৮০০ টাকা।
পর্যটন মোটেল: এটি শহর ৪ কিঃমিঃ দূরে মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স এর কাছে অবস্থিত। রুম ভাড়া ক্যাটাগরি ভেদে ১২০০ থেকে ২৫০০ টাকা।
হোটেল নাইট হ্যাভেন: এটিও শহর থেকে ৪ কিঃমিঃ দূরে নীলাচলের কাছে। এর রুম ভাড়া ১৫০০ থেকে ৪০০০ টাকা।
হোটেল প্লাজা: এটি শহরের মধ্যেই। এই হেটেলের নিজস্ব রেস্টুরেন্ট আছে। ছিমছাম গুছানো সুন্দর হোটেল। রুম ভাড়া পড়বে ১৫০০ থেকে ৬০০০ টাকা।
রিভার ভিউ: শহরের ভিতর সাঙ্গু নদীর পাড়ে এই হোটেলটির অবস্থান। রুম ভাড়া ৬০০ থেকে ১৮০০ টাকা।
কোথায় খাবেন
নীলগিরিতে খাওয়ার জন্য একটি ক্যান্টিন রয়েছে। ওখানে দুপুরে খাওয়া যেতে পারে। খাবার জন্য আগে থেকে অর্ডার করতে হয়। এছাড়া নীলগিরির আগে চিম্বুক পাহাড়ের সাথে আর্মির আরেকটি ক্যান্টিন আছে। ওখানে সাধারণত খিছুড়ি মুরগির মাংস পাওয়া যায়। আর বান্দরবান শহরে খাওয়ার জন্য রয়েছে বেশকিছু রেস্তোরা। এর মধ্যে রূপসী বাংলা রেস্টুরেন্ট, কলাপাতা রেস্টুরেন্ট, ফুড প্যালেস, রি সং সং, তাজিং ডং ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
নীলগিরি ভ্রমণ খরচ
ভ্রমণের খরচ সবসময় নিজের উপর নির্ভর করে। কেউ কম খরচে ঘুরে আসতে পারেন। অনেকে একটু বেশি আরাম আয়েশ পছন্দ করেন। সেক্ষেত্রে খরচ অনেকটা বাড়ে। বেশিরভাগ ভ্রমণকারী এই দুইটা বিষয়ে সামঞ্জস্য রেখে ঘুরতে পছন্দ করেন। নীলগিরি ভ্রমণের খরচ সম্পর্কে একটু ধারণা দেওয়া যাক।
বাস ভাড়া আসা যাওয়ায় ৬২০ x ২ = ১২৪০ টাকা।
এসি বাসের ভাড়া আসা যাওয়া ২০০০ থেকে ৩০০০ টাকা।
হোটেল ভাড়া জনপ্রতি ৫০০ থেকে ২৫০০ টাকা।
যানবাহন ভাড়া দুইদিনে সিএনজি নিলে ৩০০০ টাকা, জিপ ৫৫০০ ও চান্দের গাড়ি ভাড়া ৮৫০০ টাকা। সিএনজিতে ৪ জন, জিপে ৭ জন এবং চান্দের গাড়িতে ১৩ জন বসতে পারবেন সর্বোচ্চ।
খাবার খরচ প্রতিবেলা ১২০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে হয়ে যাবে।
নীলগিরি এন্ট্রি ফি জনপ্রতি ৫০ টাকা ও গাড়ি পার্কিং চার্জ ৩০০ টাকা।
নীলগিরি ভ্রমণ টিপস ও সতর্কতা
*গ্রুপ ট্যুর হলে ভ্রমণ খরচ কমবে।
*হোটেল ও জিপ নেওয়ার সময় দরদাম করে নিবেন।
*চান্দের গাড়ির ছাদে উঠবেন না। আঁকাবাঁকা রাস্তায় ছাদে উঠা বিপদজনক। আর্মির পক্ষ থেকেও নিষেধ আছে।
*শৈলপ্রপাতে ঝর্ণার জলে ভিজতে চাইলে সাবধানে নামবে। জায়গাটা পিচ্ছিল।
*অনুমতি না নিয়ে আদিবাসীদের ছবি তুলবেন না। এটি সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান।
*আদিবাসীদের কালচারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করুন। এমন কিছু বলবেন না, যেটি অন্যকোনো জাতির মানুষ আপনাকে বললে আপনারও খারাপ লাগতো।
*কোনো প্রকার অপচনশীল বস্তু পাহাড়ে ফেলবেন না। শুধু পাহাড় নয়, এমনকি আপনার শহরেও ফেলবেন না। এটি আপনার ব্যক্তিত্বকে রিপ্রেজেন্ট করে।
আরো পড়ুন
⦿ দুই দিনের বান্দরবান ট্যুর প্ল্যান (নীলগিরি, নীলাচল, মেঘলা, স্বর্ণমন্দির ও শৈলপ্রপাত)
⦿ নাফাখুম, বগালেক কেওক্রাডং সহ বান্দরবানের অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলোর ভ্রমণ তথ্য এখানে পড়ুন।