বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার গহীন পাহাড়ে দমাতুয়া ঝর্ণার অবস্থান। বাংলাদেশের যে কয়টি ঝর্ণা আছে, আকৃতি প্রকৃতি ও সৌন্দর্যের দিক থেকে দামতুয়া ঝর্ণা প্রথম সারিতেই থাকবে। প্রকৃতির কাছ থেকে পাওয়া আমাদের প্রথম শিক্ষা হচ্ছে সৌন্দর্য দেখতে হলে কষ্ট করা লাগবে। বিনা পরিশ্রমে প্রকৃতির সবচেয়ে সুন্দর রূপটি উপভোগ করা যায়না। দামতুয়া ঝর্ণার রাস্তাটি বেশ দূর্গম ও এডভেঞ্চারাস। ঝর্ণার জলে গা ভেজাতে চাইলে এই পথ পাড়ি দিতেই হবে। ঝর্ণায় আসতে যেতে পাহাড়ি রাস্তায় ট্রেকিং হবে প্রায় ১২ কিঃমিঃ পথ।
ঝর্ণার নামকরণ
দামতুয়া ঝর্ণাটির অবস্থান মুরং আদিবাসী অধ্যুষিত ব্যাঙ ঝিরিতে। ঝর্ণাটি ডামতুয়া, তুক অ ঝর্ণা, লামোনোই ইত্যাদি নামেও পরিচিত। সাধারণত ঝিরির নামে ঝর্ণার নামেই ঝর্ণার নামকরণ করা হয়। মুরং ভাষায় তুক মানে ব্যাঙ, আর অ মানে ঝিরি। আর দামতুয়া মানে খাড়া দেয়াল, যেখানে ব্যাঙ বা মাছ লাফিয়ে উপরে উঠতে পারেনা।
যাওয়ার উপযুক্ত সময়
যেকোনো ঝর্ণা তার পূর্ণ যৌবন পায় বর্ষাকালে। তাই বর্ষা বা তার পরবর্তী সময়ে দামতুয়া অভিযানে যাওয়াই ভালো। অর্থাৎ জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দামতুয়া অভিযানের ভালো সময়। তবে বর্ষায় টানা কয়েকদিন ভারী বৃষ্টি হলে পাহাড়ি ঢলের কারণে আর্মি ঝর্ণায় যাওয়ার পারমিশন নাও দিতে পারে। বিষয়টি মাথায় রেখেই অভিযানের পরিকল্পনা করা উচিত।
কিভাবে যাবেন
একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, ঝর্ণাটি বান্দরবানের আলীকদমে হলেও সেখানে যেতে আপনাকে বান্দরবান শহরে যেতে হবেনা। এটির সুবিধাজনক যাতায়াত ব্যবস্থা মূলত কক্সবাজারের চকরিয়া দিয়ে। তাই দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে কক্সবাজারগামী বাসে উঠে প্রথমে চকরিয়া নামতে হবে। ওখান থেকে বাস জিপ বা সিএনজিতে আসতে হবে আলীকদম। লোকাল গাড়িতে গেলে ভাড়া আসবে ৭০ টাকা, আর জিপ রিজার্ভ করলে খরচ পড়বে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা। এক জিপে ১২/১৩ জন বসতে পারবেন।
আলীকদম থেকে দামতুয়া
আলীকদম থেকে দামতুয়া ঝর্ণায় যেতে হলে প্রথমে আসতে হবে ১৭ কিলোমিটার। “১৭ কিলোমিটার” একটি জায়গার নাম। আলীকদম থেকে ১৭ কিলোমিটার আপনি বাইকে যেতে পারবেন। এক বাইকে দুইজন বসা যায়। বাইক বাড়া নিতে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। আবার টিমে সদস্য সংখ্যা বেশি হলে জিপেও যেতে পারেন।
১৭ কিলোমিটার এর উদ্দেশ্যে রওনা করে ১০ কিঃমিঃ যাওয়ার পর আর্মি চেকপোস্ট পড়বে। ওখানে সবার নাম এন্ট্রি করতে হবে। জমা দিতে হবে জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি। আর্মি এই শর্তে আপনাকে যাওয়ার অনুমতি দিবে যে বিকেল পাঁচটার মধ্যে আবার ক্যাম্পে এসে রিপোর্ট করবেন। অকারণে সময় নষ্ট না করলে অনায়াসে বিকেল পাঁচটার আগে ক্যাম্পে এসে পৌঁছাতে পারবেন।
১৭ কিলোমিটার নামলেই ওখানে আদুপাড়া নামে একটা গ্রাম আছে। এই পাড়াটি ম্রো আদিবাসী অধ্যুষিত। এটাই মূলত আপনার বেজক্যাম্প। এখানে গাইড সমিতি আছে। সমিতি থেকে একজন গাইড নিতে পারবেন দামতুয়া যাওয়ার জন্য। গাইড ফি ১০০০ টাকা। আদুপাড়া থেকে দামতুয়া ঘুরে আসতে ৫/৬ ঘন্টা সময় লাগবে। তাই সময়ের বিষয়টি সবসময় খেয়াল রাখতে হবে।
কোথায় থাকবেন
দামতুয়া অভিযানে গেলে ওখানকার কোনো আদিবাসী পাড়ায় থাকার পারমিশন পাবেন না আর্মির কাছ থেকে। তাই আলীকদমে ফিরে আসতে হবে। আলীকদম ও চকরিয়ায় থাকার জন্য সাধারণ মানের কিছু হোটেল আছে। তবে সেখানে থাকার চেয়ে রাতের বাসে গন্তব্যে ব্যাক করাই ভালো। এছাড়া চাইলে কক্সবাজার চলে যেতে পারেন। চকরিয়া থেকে কক্সবাজার যেতে দুই ঘন্টা সময় লাগে। আর যদি আলীকদমে থাকতেই হয় থাকতে পারেন হোটেল ‘দ্যা দামতুয়া ইন’ এ। যোগাযোগ ০১৭৪৮-৯১২১২৭
কোথায় খাবেন
দামতুয়াতে খাওয়ার জন্য কোনো রেস্টুরেন্ট বা দোকান পাবেন না। শেষ দোকান হিসেবে আদুপাড়ায় টং দোকান আছে। ওখানে চা বিস্কুট পাবেন। ভারী খাবার আপনাকে আলীকদমে খেতে হবে। আলীকদমের পানবাজারে সাধারণ মানের কয়েকটি রেস্টুরেন্ট আছে। কম খরচে ওখানে খাওয়া যাবে। এছাড়া ঝর্ণায় যাওয়ার সময় এখান থেকে দুপুরের খাবার কিনে নিন। দুপুরের খাবার হিসেবে চিপস, বিস্কুট, কলা, চকলেট ইত্যাদি খাবার বহন করা সুবিধাজনক হবে।
দামতুয়া ভ্রমণ খরচ
কোনো স্থানে ভ্রমণে গেলে খরচটা নির্ভর করে মূলত নিজের উপর। আপনি চাইলে কম খরচে ঘুরে আসতে পারেন। আবার কিছুটা কমফোর্টের জন্য কিছুটা বেশি খরচ করতেও রাজি থাকতে পারেন। দামতুয়া অভিযানের উল্লেখযোগ্য কিছু খরচ হলো-
*চকরিয়া আসা যাওয়ার বাস ভাড়া ৮৫০ x ২ = ১৭০০ টাকা
*চকরিয়া থেকে আলীকদম জিপ ১৪০০ টাকা। সর্বোচ্চ ১৩ জন।
*আলীকদম থেকে ১৭ কিলোমিটার বাইকে জনপ্রতি আসা যাওয়া ১৫০ x ২ = ৩০০ টাকা
*গাইড ফি ১০০০ টাকা
*খাবার ও শুকনো খাবার মিলিয়ে ৩ বেলার জন্য ৫০০ টাকার মতো আসবে।
দামতুয়া ভ্রমণ টিপস ও সতর্কতা
*এখানে অনেকক্ষণ পাহাড়ি পথে হাঁটতে হয়। তাই শিশু ও বয়স্কদের না যাওয়াই উচিত।
*আর্মি ক্যাম্পে পারমিশনের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র বা অন্যকোনো ফটো আইডির ফটোকপি লাগবে। ওখানে ফটোকপির দোকান নেই। ঢাকা থেকেই করে নিতে হবে।
*আলীকদমের পর আপনাকে নেটওয়ার্কের বাইরে থাকতে হবে।
*ট্রেকিংয়ের জন্য ট্রেকিং বুট ব্যবহার করুন। চাইলে প্লাস্টিক বা রাবারের স্যান্ডেল ব্যবহার করতে পারেন।
*ট্রেকিং রুটে জোঁক থাকতে পারে। সতর্ক থাকুন। তবে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু নয়।
*চান্দের গাড়ির ছাদে উঠবেন না। আঁকাবাঁকা রাস্তায় ছাদে উঠা বিপদজনক।
*অনুমতি না নিয়ে আদিবাসীদের ছবি তুলবেন না। এটি সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান।
*আদিবাসীদের কালচারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করুন। এমন কিছু বলবেন না, যেটি অন্যকোনো জাতির মানুষ আপনাকে বললে আপনারও খারাপ লাগতো।
*কোনো প্রকার অপচনশীল বস্তু পাহাড়ে ফেলবেন না। শুধু পাহাড় নয়, এমনকি শহরেও ফেলবেন না। এটি আপনার ব্যক্তিত্বকে রিপ্রেজেন্ট করে।
আরো পড়ুন
বান্দরবানের অন্যান্য স্থানগুলোর ভ্রমণ তথ্য এখানে পড়ুন। ভ্রমণ বিষয়ক আপনার যেকোনো সাহায্যের জন্য গ্রিন বেল্ট এর ইনবক্সে নক করুন।