নাফাখুম ঝর্ণা বর্ষায় হাদিরাতুল জান্নাত

দেখে এলাম নাফাখুম জলপ্রপাত

যে ঝিরি পথ পায়ে হেটে পার হওয়া যায় শুনেছি, সেই ঝিরি পথ নদী হয়ে ওঠায় আশ্চর্য হলাম খুব। পায়ে হেঁটে নয় আমরা ট্রলারে সেই ঝিরিপথ ধরে এগিয়ে চললাম। মজাই লাগছিল, জীবনে প্রথম আমার এমন অভিজ্ঞতা, পাহাড়েই এসেছি এই প্রথম। আমাকে গাইড করবে বলে যার আগমন আহারে বেচারা, আমারই তাকে গাইড করতে হচ্ছে। ফেরার পথে তার সেকি এক চিৎপটাং অবস্থা। তবে ভয় যে পাইনি বলা যাবে না। ট্রলারে যাত্রা শেষ হতেই শুরু হলো ট্রেকিং। ঝিরির পানিতে পা দেয়া মাত্রই পা দুটো শিরশির করে উঠলে। একটু ফসকালে পানিতে  ধপাস জেনে হাতে বাঁশের কঞ্চি তুলে নিলাম। ওহহাে, আমি কিন্তু সাঁতারজানি না। মনে মনে বলি বাপু সাবধান পা ফসকালে নির্ঘাত ডুবে মরবে। এভাবেই নানান ভাবনা চিন্তায় হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম যেখানে তাকে আমার পুলসিরাত বলেই মনে হল, ঝিরির এপার ওপার দড়ি বাঁধা।

দড়ির সামনে পেছনে তাকালেই দেখা মেলে তুষার স্রোতের ঘূর্ণি ভেদ করে । সেই দড়ি ধরে সৃষ্টিকর্তার নাম নিয়ে এগিয়ে চললাম। রশিতে হাত লাগানাে আর এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করি অত আর ভয় করছে না! প্রশ্ন করতেই পারেন কই যাচ্ছি। যাচ্ছি নাফাখুম, এসেছি গতরাতে। সারাপথ খুব ভালােয় ভালােয় এগিয়ে বৃষ্টিতে পড়লাম থানচি এসে। তবু পাহাড় আর জলপ্রপাতের টান বলে কথা। আমার সারাটাদিন মেঘলা আকাশ বৃষ্টি তোমাকে দিলাম বলে ট্রলারে চাপলাম। মনে মনে বললাম ভয়ের কিছু নাই, মরতে তাে হবেই, সে রাতে আমরা রেমাক্রি ছিলাম। পরদিনও বৃষ্টি কমার নাম নিলাে না। শেষমেষ বৃষ্টিকে সখা করেই নাফাখুমের পথ ধরলাম।

দড়ি বেঁধে খাল পার হওয়া।

জোঁককে আমি ভয় পাই খুব, সে জন্যই মনে হয় জোক আমার ধারে কাছেই ছিলাে না। তবে আমাদের দলের দুজনকে জোক কামড়ে ধরেছিল। আমি কখনােই অতিসতর্ক ছিলাম না। ট্রলার থেকে নেমেই নির্ভাবনায় এগিয়ে চলছিলাম। কর্দমাক্ত গভীর জঙ্গল এর মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছিলাম বাঁশের কঞ্চি গেঁথে গেঁথে। কখনও কখনও গাছের ডালপালা জড়িয়ে ধরে চড়াই পার হচ্ছিলাম। এভাবেই ঘন্টা দেড়েক ক্লান্তিকর পথ চলার পর সেই পুলসিরাত মনে করা দড়ি বা রশির সামনে এসে কিছু সময়ের জন্য ভীষন চিন্তায় পড়ে যাই। অবশেষে সাহস করে সেই দড়িও পার হয়ে যাই।

এভাবেই আরো ঘন্টাখানেক চলার পর তীব্র গর্জন কানে আসে। বৃষ্টি হচ্ছে তখনাে সুতরাং দৌড়ে ছুটে যাবার উপায় ছিলাে না। কেননা ক্রমাগত একটানা ক্লান্তিকর চড়াই ভেঙ্গে, কখনো পাথরের উপর আবার কখনাে কর্দমাক্ত পিচ্ছিল পথ ধরে দৌড়ে ছুটে চলা আমাদের জন্য দূরহ ছিলাে বটে। তবু আমরা দ্রম্নত পা চালাই। এভাবেই এক সময় নজরে আসে নাফাখুম জলপ্রপাতের জলধারা। আরাে কিছু পথ যেতে চোখ আর সরতে চাচ্ছিলো না। সবাই জলপ্রপাতের গর্জনে দিশেহারা হই, আবার সতর্কতাও ছিলাে। কেননা অঝাের না হলেও বৃষ্টি তখনাে ছিলাে। আর পিঞ্ছিল পাথরের ওপর দিয়ে দৌড়ে ছুটাও সম্ভব ছিলাে না। তবু আমরা দ্রুত এগিয়ে যাই, তারপর তাে ফেরার কথাই ভুলে যাই ভুলে যাই বৃষ্টির পানিতে মােবাইল বা ক্যামেরা ভিজে ওঠার কথা। এসব কিছু ভুলে ছবি তুলে চলি একটানা সঙ্গে নাফাখুমের জলধারা দেখি মুগ্ধ নয়নে। এদিকে বৃষ্টির বেগ বাড়ছিল সঙ্গে রেমাক্রি ঝিরির পানিও ফুলে ফেঁপে উঠছিল। গাইডের তাড়া খেয়ে নাফাখুম কে বিদায় বলে ফিরতি পথ ধরি

বর্ষার নাফাখুম ঝর্ণা।

কিভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে বান্দরবান। ঢাকা বান্দরবান বাস ভাড়া ননএসি ৬৬০ টাকা। বান্দরবান থেকে বাসে বা দল ভারী হলে চাঁন্দের গাড়িতে থানচি। দল ছোট হলে বাসে যেতে পারবেন। বাসে অবশ্য সময় অনেক বেশি লাগে। বাস ভাড়া জনপ্রতি ২০০ টাকা। চান্দের গাড়ি বা জীপ ভাড়া রিজার্ভ ৪০০০  থেকে ৫০০০ টাকার মতো। থানচি রাত্রিযাপন করে অথবা সেদিনই ট্রলারে চেপে তিন্দু হয়ে চলে আসেন রেমাক্রি। রেমাক্রি পৌছে পরদিন সকাল সকাল বের হয়ে চলে যান নাফাখুম। পুরাে বেলা সেখানে কাটিয়ে দুপুরের পর ফিরতি পথ ধরুন। নাফাখুমের পথে পর্যাপ্ত পানি আর শুকনা খাবার অবশ্যই সঙ্গে রাখবেন। লাইফ জ্যাকেট সঙ্গে রাখবেন। পরিবেশ নষ্ট হওয়ার মত তেমন কিছু করবেন না এবং অপচনশীল কিছু বনে কিংবা জলপ্রপাতের আশেপাশে এবং রেমাক্রি খালে ফেলবেন না! নাফাখুম ভ্রমণের পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন এখানে দেখুন।

আরো পড়ুন

error: Content is protected !!
Exit mobile version