টাঙ্গুয়ার হাওর এর দিনলিপি

আসলে হঠাৎ প্ল্যান গুলো সব সময় ভালো হয়। ভার্সিটিতে ক্লাস নিতে নিতে একদিন হুট করেই দেখলাম সামনে একটা তিনদিনের বন্ধ আছে। ভাবলাম এই তিনদিন কোথাও ঘুরে আসি। কই যাব ভাবতেই হুট হাট আমাদের প্ল্যান সুনামগঞ্জ টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরতে যাব। ফেনী থেকে প্রথমে গেলাম ঢাকা, সেখানে ছোট খালামনির বাসায় সুন্দর একটা দিন কাটিয়ে পরদিন রাতে চড়ে বসলাম সুনামগঞ্জ এর বাসে। বাস আমাদের একদম ভোরেই সুনামগঞ্জ নামিয়ে দিলো। তখন সময়টা ২০১৮ সালের অক্টোবর মাস। একটু একটু শীতের আমেজ, ভোরবেলা চারদিকে হালকা কুয়াশা।

সুনামগঞ্জ নেমে প্রথমেই চলে গেলাম হোটেল টাঙ্গুয়া ইন এ। সেখানে গিয়ে নাস্তা করলাম। নাস্তা করে চোখে মুখে একটু পানি দিয়ে ফ্রেশ হলাম। এবার লেগুনা দিয়ে যাত্রা শুরু তাহিরপুরের দিকে। যেতে যেতে পথের দুইপাশে একবার স্বাগত জানালো লাল শাপলার বিল, একবার স্বাগত জানালো সাদা শাপলার বিল। পথের দু’পাশে সৌন্দর্য সেভাবে উপভোগ করতে পারিনি কারণ রাস্তা ছিল খুব বেশি পরিমাণে খারাপ। প্রায় দুই ঘন্টার জার্নি শেষে এসে পৌছালাম টাঙ্গুয়ার হাওর পাড়ে। সেখানে আগে থেকেই বোট রিজার্ভ করা ছিল।

নৌকাতে উঠতে যাবো এমন সময় দেখি একজন মানুষকে পরিচিত পরিচিত লাগে। তিনি এবং আমি আমরা দুজনে মানুষটার দিকে দিকে এগিয়ে গেলাম এবং গিয়ে এতটাই অবাক হলাম যে বলার মত না। তিনি হচ্ছেন আমাদের কলেজ শিক্ষক, অত্যন্ত প্রিয় একজন শিক্ষক ছিলেন। উনার কাছে আমরা পড়েছিলাম। আমাদের দুজনকে খুব আদর করতেন তিনি। তিনি এবং আমাদের অন্যান্য শিক্ষকরা মিলে ঘুরতে এসেছেন টাঙ্গুয়ার হাওরে। বাসা থেকে এত দূরে এখানে এসে এভাবে শিক্ষকদের সাথে দেখা হয়ে যাবে ভাবতেই পারিনি। খুব খুশি হলেন আমাদেরকে দেখে, বেশ কিছু ছবি তোলা হলো। এরপর উনারা উনাদের বোটে চলে গেলেন আমরা আমাদের নৌকায় গেলাম। এবার নৌকায় যাত্রা শুরু।

লাকমাছড়া
ছবি : লাকমাছড়া

ধীরে ধীরে নৌকা যতই হাওড়ের ভিতর দিকে যাচ্ছে ততই পানি নীল সবুজ হচ্ছে। দুইপাশে মেঘালয়ের সবুজ পাহাড় গুলো। নিচে নীল জল।নির্জন দুপুরে খাবার খেলাম রান্না করা হাঁসের মাংস ভাত দিয়ে। খাবারটা মনে হল যেন অমৃত। মাঝি ভাইর হাতে জাদু আছে। দুপুরের পরেই গেলাম টেকের ঘাট। তখন কি যেন একটা পূজা চলছিল। সেই পূজা, দেবী বিসর্জন দেখলাম। উপর থেকে তাকালেই পাশে মেঘালয়ের নীল সবুজ পাহাড় গুলো। এত সুন্দর, এত সুন্দর আমাদের দেশ !!! দুচোখ ভরে মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। টেকের ঘাট ঘুরে ছবি তুলে সন্ধ্যার মধ্যেই নৌকায় ফেরত আসলাম। সিদ্ধান্ত হলো রাতে নৌকাতে থাকবো।

রাতে খেলাম খুব তাড়াতাড়ি। রাত ৯ টার মধ্যেই হোটেল টাঙ্গুয়া ইনে খাওয়া-দাওয়া শেষ, এবার বোটে এসে বসলাম। ট্যুরমেট দের সাথে কিছুক্ষণ লুডু খেললাম। রাত যত বাড়ছিল শীত ও ততই বাড়ছিলো। একসময় ছাদে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আকাশ ভরা তারার আলো আর ভরা পূর্ণিমা। চারদিকে কোন শব্দ নেই, ঠিক হাওরের মাঝখানে নৌকায় আমরা কিছু মানুষ। আকাশে থালার মত বড় চাঁদ, আমার হাত ধরে আছে প্রিয় মানুষটা, মুহূর্তটা যেন থমকে আছে। এইরকম মুহূর্তের জন্যই কি হাজার বেঁচে থাকতে পারে মানুষ???!!!!

রাত এগারোটার দিকে খুব ঘুম পাচ্ছিল। বারোটা সাড়ে বারোটা করে বোটে ঘুমোতে গেলাম। ঘুম ভাঙলো খুব ভোরে। ভোরে ঘুম ভাঙ্গার পরে এবার হোটেলে গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে আবার বোটে করে যাত্রা শুরু। এবার প্রথমেই গেলাম শিমুল বাগান। অক্টোবর মাস হওয়াতে তখন শিমুল ফুল পাইনি কিন্তু চারপাশে যেন সবুজের সমারোহ। চোখের প্রশান্তি বলে একেই। চোখ জুড়িয়ে দিচ্ছিল সবুজ। একটা ভেড়ার বাচ্চাকে পেয়ে আদর করে দিলাম খুব। এবার এখানে কিছুক্ষণ ঘুরে গেলাম যাদুকাটা নদীতে। টিলার উপর থেকে জাদুকাটা নদী এত সুন্দর লাগছিল, নীল এবং সবুজ জল। একটা জায়গা ছিল টিলার উপরে যেটাতে একটা পাথর ছিল, পাথরটার একপাশে লেখা বাংলাদেশ আরেক পাশে লেখা ইন্ডিয়া। মানে সেটা ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ জিরো পয়েন্ট।

যাদুকাটা নদী উম্মে আইমুন
ছবি: যাদুকাটা নদী

সুনামগঞ্জ এর জাদুকাটা নদীটির পাশেই প্রায় ১৫০ ফুট উচ্চতার এই টিলাটি রয়েছে। স্থানীয়রা এই টিলাটিকে বারিক টিলা বলে থাকে। এই টিলায় অবস্থিত পিলারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। এই পাথর টার এক পাশে ইন্ডিয়া এক পাশে বাংলাদেশ। ইন্ডিয়ার পাশে গিয়ে যখন ছবি তুলছিলাম ট্রাভেল মেট রা মজা করে বলছিলো, ” আপু আর যাইয়েন না, বিজিবির গুলি খাবেন।” আমি বলছিলাম “একদিন ফলো মি টু ইন্ডিয়া এলবাম দিব”!

সেই সংকল্প পুরন করলাম ঠিক এক বছর পর ২০১৯ সালের নভেম্বরে। সেখানে ঘুরে আবার কিছু ছবি তুলে অবশেষে তাহিরপুরে ফিরে আসলাম। এরপর আবার লেগুনা দিয়ে সুনামগঞ্জ শহরে ফিরে এসে বাসে করে ফিরে আসলাম নগর সভ্যতায়। নৌকায় ভাসা এই ক’টা দিনের স্মৃতি মনে থাকবে সারা জীবনভর। জীবনটা নেহাতই মন্দ নয় আলহামদুলিল্লাহ।

তবে যেটা খারাপ লেগেছে এত সুন্দর টাঙ্গুয়ার হাওর। কিন্তু হাওরের জলে ভাসে বিরিয়ানির প্যাকেট, বাচ্চাদের পেমপার্স, প্লাস্টিকের বোতল ইত্যাদি ইত্যাদি। আচ্ছা আমরা ঘুরতে যাই মনের শান্তির জন্য কিন্তু পরিবেশকে শান্তি কেন দেইনা বলতে পারেন??? বিদ্র. আমরা যাই পরিবেশটা দেখতে, যেটা দেখে আমরা মনে শান্তি পাচ্ছি সেটাকে পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব আমাদেরই। আমরা কেন পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখিনা।

উম্মে আইমুন এর অন্যান্য লেখা

 

ভ্রমণ গাইডলাইন পড়ুন

Exit mobile version